রবুদা আমার দিন তিনেক আগে বোম্বাইয়ের(তখনও মুম্বই হয়নি) প্লেন ধরলেন। আমিও বোম্বাই গিয়েই চেঞ্জ করব। রবুদা ওই ক’টা দিন বোম্বাইতে থাকবেন। বোম্বাই থেকে কলকাতা যাবেন এয়ার-ইন্ডিয়ার সন্ধের ফ্লাইটে। অন্তত যাবার চেষ্টা করবেন। আমি লন্ডন থেকে বোম্বাই এসে ট্রানজিটে রইলাম ঘণ্টা পাঁচেক। তারপর কলকাতার ফ্লাইটের এয়ার-ইন্ডিয়াতে চেপে বসলাম। (Ravi Shankar)
বেশ ফাঁকা প্লেন, বসলাম জানলার পাশে। আর বিয়ার কিনে কটকট খুলি আর খাই। একবার টয়লেটে যাবার পথে এয়ার হোস্টেসদের মধ্যে ফিসফিসানি শুনলাম, জানিস তো ফার্স্ট ক্লাসে পন্ডিত রবিশঙ্কর আছেন। কোঁকড়া চুল, পাঞ্জাবি পরা। ওই লোকটা। আমার ভারি স্বস্তি হল। যাক, উনি যা চেয়েছিলেন, তাই হল।

এসে সিটে ফের বসেছি, হঠাৎ একজন হোস্টেস এসে বললেন, ‘আর ইউ মিস্টার ভট্টাচারিয়া?’ বললাম, ‘ইয়েস।’ হোস্টেস বললেন, ‘পন্ডিত রাভিশঙ্কর ইজ অন দিস প্লেন। হি হ্যাজ সেন্ট ইউ হিজ ব্লেসিংজ।’ বললাম, ‘প্লিজ দেন, গিভ হিম মাই রিগার্ডজ।
কলকাতা বিমানবন্দরে বিরাট একটা দল এসেছিল রবুদা’কে রিসিভ করতে। আমজাদ আলি খাঁ ও অরূপবাবুর তরফ থেকে এসেছিলেন প্রদ্যোৎ সরকার। আমরা ডাকি বুড্ডু বলে। বুড্ডুর হাতে মালা আশেপাশে ছড়িয়ে আছেন ভূদেবশঙ্কর, ঝর্ণা শঙ্কর, আনন্দশঙ্কর, রবীন পাল এবং আরও অনেকেই। এই সময়ে একটা মজার ব্যাপার ঘটল পাসপোর্ট কন্ট্রোল ডেস্কে। আমি আমার পাসপোর্ট দিতেই ভদ্রলোক(বয়স চল্লিশের কোটায় বলে মনে হল) আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আপনি শঙ্করলাল ভট্টাচার্য?’

—হ্যাঁ।
—সাংবাদিক?
—হ্যাঁ।
—মাস কয়েক আগে মহম্মদ আলির ইন্টারভিউ নিয়েছেন। ভদ্রলোক মুগ্ধ নয়নে আমাকে অনেকক্ষণ দেখলেন। একবার হাত তুলে নমস্কার করলেন, তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়েই পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মারলেন।
কাস্টমস-এ ঘটল অন্য এক ঘটনা। আমার এক বান্ধবীর বাবা জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য তখন কাস্টমস-এর বড় অফিসার। তিনি আমাকে দেখে কোত্থেকে জানি না, ছুটে এলেন। ওঁর কন্যা সেতার শেখে, স্ত্রী সরোদ বাজান। উনি নিজে অসম্ভব রাগসঙ্গীতের ভক্ত। ওঁর সবে তখন ডিউটি শেষ হয়েছে। আমাকে বললেন— ‘চলুন, চলুন আপনার মুখে রবিশঙ্করের গল্প শুনি।’
কিন্তু আমার যে তখন জিনিসপত্র লটকে আছে কাস্টমসে। ট্যাক্স করার মতো কিছুই নেই। তবে অফিসাররা একবার খুলে তো দেখবে। জ্যোতির্ময় বাবু ওরঁ স্টাফকে বললেন, ভট্টাচাৰ্য্য মশাইকে শিগগির খালাস করুন। ওরঁ একটা টেপ রেকর্ডার আর একটা ক্যামেরা আছে। ব্যস্!
দমদম থেকে ফিরলাম বুড্ডুর ফিয়েটে করে। বুড্ডু বলল, ‘আমার মাস্ক আফটার শেভ এনেছেন?’ বললাম, ‘তার চেয়েও অনেক দামি জাতের কোলোন এনেছি। ফাবের্নে গ্ৰুপের গন্ধ। যারা ‘ব্রুট’ বানায়। তবে এ অনেক দামি।’ শুনে খুশি হয়ে বুড্ডু ওর পকেট থেকে ফাইভ-ফাইভ বার করে বলল, ‘খান।’ বুঝলাম না বিলেত থেকে কে ফিরল, ও না আমি।

আমি তখন আমার পকেটের বেনসন অ্যান্ড হেজেসের প্যাকেটটা না-খোলা অবস্থাতেই জ্যোতির্ময়বাবুকে দিয়ে বললাম, ‘এটা রাখুন।’ উনি কাস্টমসের সৎ কর্মচারী, গিফট নিতেও ওঁর আপত্তি। প্রায় জোরাজুরি করে প্যাকেটটা ওঁকে দিতে পারলাম। এবং দেওয়া-থোওয়া শেষ করে রবিশ্বঙ্করের কথা শোনাতে শোনাতে চললাম। ভি আই পি রোডে এসে দেখি চারিদিকে আলো আর পুজোর প্যান্ডেল। জ্যোতির্ময়বাবু বললেন, ‘জানেন তো, আজ কালী পুজো। খুবই ভাল দিনে দেশে ফিরলেন। সে-তারিখ আজও ভুলিনি। ৯ নভেম্বর ১৯৭৭। বছর দুয়েক আগে যখন আমি ‘আমার কালিকাপুরাণ’ বইটি লেখা শেষ করি সেই দিনটিও ছিল ৯ নভেম্বর। এবং আরও আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি যে, যে-দিনটিতে আমি লন্ডন থেকে কলকাতা ফিরি ঠিক সেই দিনেই-বাংলা তারিখ ২৪ শে কার্তিক ১৩৮৪ সন-শ্রী শ্রীহীব ন্যায়তীর্থ তাঁর পরিশোধতিত ও পরিদৃষ্ট মহর্ষি মার্কন্ডেয় কথিত ‘কালকিকাপুরাণম’-এর ভূমিকা লেখা শেষ করেন! এই সমাপতন আমার এখন প্রায় অলৌলিক বলেই মনে হয়।’
বাড়ি ফিরতেই মা বলল, ‘আমি জানতাম তুই আজ আসবি। কাল থেকেই কেন জানিনা মনে হচ্ছিল তুই পুজোর দিন ফিরবি।’ আমি ব্যাগ, বাক্স নামিয়ে মাকে প্রণাম করে বললাম, ‘আমায় সাবান, তোয়ালে দাও। স্নান করব।’
—‘সে কী রে! আজ তো ভয়ানক ঠান্ডা। লোকে গরম জামা পরে ঘুরছে। তুই স্নান করবি কী রে?’

—’মা শীত এখন তোমাদের গায়ে। আমার গায়ে গরম। কী ভীষণ ঠান্ডা ছিল লন্ডনে, যেদিন এলাম। মাইনাস ডিগ্রি টেম্পারেচারে নেমেছিলাম মস্কোতে। আমার গরম করবে না!’
যখন শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শীতল হচ্ছি শীতের দিনে ঠিক তখনই ফোন এল ইন্দ্রাণীর কাছ থেকে। রাত দশটায় আমি স্নান করছি শুনে যৎপরোনাস্তি অবাক হয়েছিল আমার ভাবী স্ত্রীও।
কলকাতায় ফেরার মাত্র সপ্তাহ খানেক পরেই আমি আর অলোক রওনা হলাম বারাণসীর দিকে। ইন্দ্রাণী বলল, ‘আপনি তো কেবল বাইরে বাইরেই ঘোরেন দেখছি।’ মা বলল, ‘বেনারস যাচ্ছিস যখন বিয়ের বেনারসি ওখান থেকেই কিনে আনিস। সেই মতন টাকা নিয়ে যা।’
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।