(Lepchajagat) (Chatakpur) মেঘ, কুয়াশা ছাড়া পাহাড় ভ্রমণ যে অসম্পূর্ণ, চটকপুর যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। মেঘবিহীন ঝকঝকে আকাশে সারাদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। মেঘ কুয়াশা কাঞ্চনজঙ্ঘার লুকোচুরি, মস্ত পাহাড় শ্রেণীর হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া, আবার ফিরে আসা। ঠিক যেন মাঝে মাঝে একটা সাদা চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলা, আবার ইচ্ছেমতো কখনও শুধু চোখ দুটো দেখানো, কখনও শুধু মুখটুকু, আবার ইচ্ছে হলে পুরো চাদর সরিয়ে ঝলমলে হাসি। (Lepchajagat) (Chatakpur)

রাতের কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে শিয়ালদহ থেকে রওনা দিলাম। বুকের মধ্যে পাহাড় দেখার ডাক। সকালে শিলিগুড়ি পৌঁছে একটা গাড়ি নিয়ে সোজা লেপচাজগত। ঘুম থেকে মিরিক যাওয়ার রাস্তায় ৭ কিলোমিটার গেলেই রাস্তার ধারে এই জনপদ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হোমস্টে, আমরা উঠলাম সলাখা হোমস্টেতে। ঘর থেকেই নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তবে তখন সে সাদা মেঘের চাদরে ঢাকা। (Lepchajagat) (Chatakpur)

সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। মিরিক দার্জিলিং -এর সংযোগকারি রাস্তা, বেশ ভালোই গাড়ি চলাচল আছে। স্নান খাওয়া সেরে বনদপ্তরের বাংলোর দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ সুন্দর লাগছে। সামনে ফুলের ঝোপ, সেখানে প্রজাপতি আর মৌমাছির দল উড়ে বেড়াচ্ছে। সূর্যাস্তের সময়েও কাঞ্চনজঙ্ঘা মুখ দেখালো না। আমাদের প্রতীক্ষা সত্ত্বেও অবগুন্ঠন সরাতে রাজি নয়। দেখা যাক কাল কি হয়। রাতে এখান থেকে আলো ঝলমলে দার্জিলিংকে মোহময় রূপ। (Lepchajagat) (Chatakpur)

ভোরের আবছা আলো ঘরে উঁকি দিলো। জানালায় পর্দার আড়াল সরাতেই দেখলাম মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। আবছা আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘার বিরাট চেহারা ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে। গরম জামা গায়ে চাপিয়ে বারান্দায় এলাম। আস্তে আস্তে আলো ফুটছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা রঙ পাল্টাচ্ছে। লাল থেকে সোনালী, সোনালী থেকে সাদা ধবধবে। কতবার যে এই দৃশ্য দেখেছি, তবু মন ভরে না। কাঙালের মত অপেক্ষা করি আবার দেখার আশায়। হোমস্টের ছেলেগুলো বলে গেল ছাদে গেলে আরো ভালো দেখা যাবে। চললাম ছাদে। সত্যি! মিরিক, নেপালের সীমানা সবটাই দারুণ দেখায় ছাদ থেকে! (Lepchajagat) (Chatakpur)

স্নান, প্রাতরাশ সেরে চললাম ভিউ পয়েন্টের দিকে। সামান্য পায়ে হাঁটা পথ। ২০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। আক্ষরিক অর্থেই ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ এখান থেকে। তবে ততক্ষণে কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে সাদা মেঘ জমতে শুরু করেছে। তবু বসে রইলাম অনেকক্ষণ।
তাদের ফাঁক দিয়ে আসা আলো পিচের রাস্তার উপর ছক কেটেছে, জাল বুনেছে। মনে পড়বে সুমনের গানের কথা, “ছক কেটেছে গাছের ছায়া এবং রোদের দ্বন্দ্ব”।
অধিকাংশ টুরিস্ট এখানে একদিন রাত্রিবাস করে চলে যান। আমাদের দুদিন থাকা। তাই ফেরার পথে আবার বনদপ্তরের রাস্তায় হেঁটে এলা।, মৌমাছি, প্রজাপতির পিছনে ছোটাছুটি করতে করতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেল। দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে ছাদে চলে গেলাম। অক্টোবরের শেষে বেশ ঠান্ডা হাওয়া। সূর্যাস্তের মনভোলানো রূপ দেখে তখন মুগ্ধ। আজও মন ভরে দেখলাম রাতের দার্জিলিংকে।
আজ লেপচাজগত ছেড়ে চটকপুর যাওয়ার দিন। ঘুম ভেঙে দেখলাম কাঞ্চনজঙ্ঘা গতকালের মত পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। তবু যেটুকু পাই সেই আশায় বারান্দায় বসে রইলাম। তারপর মিরিকের দিকের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। লেপচাজগতের ছোট্ট এলাকাটুকু ছেড়ে বেরোলেই বিশাল বিশাল পাইন গাছের বন। তাদের ফাঁক দিয়ে আসা আলো পিচের রাস্তার উপর ছক কেটেছে, জাল বুনেছে। মনে পড়বে সুমনের গানের কথা, “ছক কেটেছে গাছের ছায়া এবং রোদের দ্বন্দ্ব”।

তবে এই রাস্তায় ক্রমাগত গাড়ি চলে, তাই একটু সাবধানে হাঁটতে হয়। ফিরে এসে প্রাতরাশ সেরে স্নান করে মালপত্র গুছিয়ে উঠলাম হোমস্টের গাড়িতে। দুজনের জন্য মাহিন্দ্রার ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি, আসলে ছোট গাড়ি চটকপুর যায় না রাস্তার দুরবস্থার কারণে। ঘুম হয়ে সোনাদা পর্যন্ত হিল কার্ট রোড, তারপরেই আসল খেলা। সোনাদা থেকে চটকপুর ৬.২ কিলোমিটার, এই রাস্তাটুকু যেতে সময় লাগলো ১ ঘন্টা। যারা সান্দাকফুর পুরোনো পাথর ফেলা রাস্তায় গেছেন তারা আন্দাজ করতে পারবেন, এখানে উপরি পাওনা বড় বড় গর্ত। রাস্তায় পড়বে বনবিভাগের চেকপোস্ট, সেখানে গাড়ির জন্য ৪৮০ টাকা আর দুদিনের জন্য মাথাপিছু ১৫০ টাকা করে দিয়ে চললাম চটকপুর।

চটকপুরের বর্ণনা দেওয়া আমার ক্ষমতার বাইরে। বাঁয়ে সবুজ পাহাড়শ্রেণী চলে গেছে টাইগার হিলের দিকে, সামনে উন্মুক্ত শায়িত বুদ্ধের রেঞ্জ, ডানদিকে অহলদাড়া, সিটং, মহলদিরাম, একটু ভালো করে খেয়াল করলে জোগীহাট ব্রিজও দেখা যায়। পিছনে বাগডোগরা, রাতে আলোয় ঝলমল করে। আর সকাল সন্ধ্যে দূরে মহানন্দার ক্ষীণ ধারা সাপের আঁশের মত ঝকঝক করে।

আমরা ছিলাম সানরাইজ হোমস্টেতে, অনবদ্য লোকেশন। এই যে জায়গাটার বর্ণনা দিলাম, পুরোটাই দেখা যায় সানরাইজ হোমস্ট থেকে, আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। বিকেলে সূর্যাস্তের লাল আভায় কাঞ্চনজঙ্ঘা খানিক আভাস দেখিয়ে দায়িত্ব সারলেন। রাস্তার ধকল সামলে আমরাও তাড়াতাড়ি বিছানায়।

সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ চোখের সামনে। তবে মেঘের আনাগোনা সূর্যোদয় দেখতে দিলো না, যদিও লাল রঙে সেজেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রচুর ফুল আর প্রজাপতির মেলায় রঙিন পথে হেঁটে বেড়াতে দারুণ লাগবে। আসল মজা শুরু হলো বেলা তিনটে নাগাদ। সহসা, মেরেকেটে ৫ মিনিটের মধ্যে মেঘের হানায় পুরো পাহাড়শ্রেণী গায়েব। তারপরে আরো মজা, কোথাও একটু মেঘ সরছে, সেখানে আলোয় সাজছে সবুজ পাহাড়, আবার নেই।

বিকেল থেকে শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি। ঘরের সামনে বসে চা, কফি, মোমো খেতে খেতে দেখতে থাকলাম ভেজা পাহাড়। আলো নিভে গেলে শান্ত চটকপুর নিঝুম। রাত আটটা নাগাদ হঠাৎ মেঘ সরে গিয়ে একেবারে তারা দেখা গেল আকাশে। সাথে প্রবল ঠান্ডা।

সকালে উঠে দেখি সামনের গাছগুলোও মেঘের পর্দা টেনে ঘুমোচ্ছে, যদিও বৃষ্টি নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা তো দূরস্থান, সামনের পাহাড়টাও দেখা যাচ্ছে না। এর পরের ঘটনা, হঠাৎ কোন মন্ত্রবলে কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনের মেঘের পাহাড় সরে গেল, ভোরের আলো ঝিকিয়ে উঠলো শায়িত বুদ্ধের মাথায়, উপরে নীচে মেঘ, মাঝে তিনি স্বমহিমায় বিরাজিত হলেন। সামান্য মিনিট চারেক, আবার মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে সেই যে ঘুমোলেন, বেরোনোর আগে পর্যন্ত আর তার দেখা পাইনি। যেন মন্দিরের দরজা খুলে একঝলক দেখা দিয়ে আবার দ্বার বন্ধ হলো।

বেলা দশটায় গাড়ি আসবে, নেমে যাবো নিউজলপাইগুড়ি। তাই পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম চটকপুরের পাথুরে পথে। দুপাশে কখনও ফুলের গাছ, কখনও বাঁশ, বেত, আঁকাবাঁকা রাস্তা, কখনও মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, কখনও পরিষ্কার। কোথা দিয়ে সময় কেটে গেল টেরও পেলাম না। দশটায় গাড়ি এলো। চললাম ফিরে, মনে মনে বললাম ‘আবার আসবো ফিরে’।
ছবি সৌজন্য: লেখক
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতকোত্তর।পেশায় শিক্ষক। বেলুড় বিদ্যামন্দিরের ফোটোগ্রাফির ডিপ্লোমা। ভালোবাসেন বেড়াতে, ছবি তুলতে আর পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে।