আগের পর্বের লিংক- জীবন তো একটাই, জমায়েত, খাই খাই ক্লাব, পুজোর বাজনা এবং খাজনা
অগাস্ট ২০১৮ তে জমায়েত জমতে না জমতেই এল সেই তাক লাগিয়ে দেওয়া ‘নেমতন্ন’। ইরার মেয়ের বিয়ে। আজকাল যেখানে ঘনিষ্টজনকেও নেমন্তন্ন করেই, ছলে বলে বা সরাসরি জানতে চাওয়া হয় যে, যাব কিনা বা ক’জন যাবে; মানে প্লেটের তো ভয়ানক দাম! সেখানে, ইরা কিন্তু আমাদের সব্বাইকে, মানে প্রায় পঁচিশ জনের সকলকেই নেমন্তন্ন করে দিল। ইরার বর নভেন্দু সেন ছিলেন আমাদের অনেকেরই আঁকার মাষ্টারমশাই; আর সেই নভেন্দুদা-ইরার ভালোবাসার বিয়েতেই তাদের তিন মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে নভেন্দুদা থাকতেই হয়েছে। কিন্তু অকালপ্রয়াত নভেন্দুদার ছোট মেয়ের বিয়েতে, ইরার পাশে সবলে দাঁড়িয়েছে তার বাকি দুই মেয়ে। বন্ধুদলের এই জমায়েত না হলে জানতেই পারতাম না যে, কী হাসিমুখে তিন মেয়ে নিয়ে, ইরা তার জীবনের হাল ধরেছে। আনন্দ আর শান্তির সহাবস্থানে সে ভরিয়ে রেখেছে আমাদেরও। সে বিয়েবাড়ির মজা ছিল এরকম যে, ইরার দাদা অঞ্জনদা আমাদের আহ্লাদেপনা দেখে এবং শুনে বলেছিল, ‘Social Vaccine’; এর কারণ– দল জুটিয়ে সোরগোল করে আমাদের সেই সাজ, আড্ডা আর ফাটাফাটি খাওয়া।

অগাস্ট মাসেই ইরার নেমতন্ন পেয়ে-তক জল্পনা। একদিকে কে কে যাবে, সবার সাজ কেমন হবে আর অন্য দিকে কী হবে উপহার! একসঙ্গে দেওয়া হবে ঠিক হতেই, টাকা সংগ্রহের উপায়? কেননা গ্রুপে দিলেই তো ইরা জেনে যাবে। টাকা ধরে না দেওয়ার ব্যাপারে সকলেই সহমত– টাকা নয়, উপহার দেওয়া চাই। ‘লাও তো বটে কিন্তু আনে কে’! ইতিমধ্যে জনসংখ্যা কুড়ি পার হয়ে গেছে। গড়িয়া থেকে সোদপুর তো বটেই, দিল্লি-আমেরিকা-নাগপুর-গৌহাটি-আসানসোলও। “জিরাফে” থাকতে (বিয়েতে আসতে) পারুক না পারুক, ধর্মে (উপহারে) সবাই হাত তুলেছে। এবার উপায়! দেখা গেল সবচেয়ে সহজ গয়না কেনা এবং সকলেই এতে সম্মত। এদিকে আবার নভেম্বরেই যেন যত বিয়ে, তত ছুটি। ফলে হয় আটকা, নয় উইক-এন্ড বেড়ানো। তাই ঠিক হচ্ছিল যে ওই দিনই বিয়েতে যাবার আগে উপহার কেনা হবে। সেটাতে ব্যাপক চেঁচিয়ে বাগড়া দিয়েছি। আবার আমাকে বাদ দিয়েও কিনবে না ওরা। চারজন পাকা পার্টি নাগের বাজার থেকেই কিনে নিতে পারতো। কত বড় বড় দোকান এখন ওখানে। অগত্যা হুট করেই ঠিক করে ২৭শে নভেম্বর জড়ো হলাম সব। নয় নয় করেও জনা বারো। সেই শ্যামবাজার আমাদের ‘চরাবরা – মুগ্ধকরা’ তীর্থ স্থান। ড্রিমল্যান্ড নার্সিং হোম-এর সামনে দাঁড়াতে হল না। পাশেই রীতা আর তার জায়ের বুটিক ‘রং মিলন্তি’। সেখানেই তেঁতুল পাতায় এঁটে গেল স্বজনদল। চা-চপ খেতে খেতে ভুলতেই বসেছিলাম যে গয়নাটাই কেনা হয়নি। টাকা সংগ্রহে ঝামেলাই হলো না। ইস্কুলে যে যার বন্ধু ছিল, মোটামুটি সেভাবেই “তার-তার” হাতে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাকি due সুস্মিতা দিয়ে দিল। সদ্য অবসর নিয়ে এখন তো সে মেলা টাকার মালিক। এবার দোকান বেছে, যেখানে ঢোকা হল, সেটা বেশ কায়দার। বললাম যে, আমরা কেপমার নই। যত তাড়াতাড়ি; ভোর না হতেই, দধিমঙ্গলের সময় গ্রুপেই বিসমিল্লা আপলোড করে সানাই বাজালাম আমরা। ইরাও ফোটো পাঠতে লাগল সময় পেলেই। ক’দিন আগে থেকেই একদলের গাঁইগুঁই- পেটব্যথা, জ্বর, বদহজম। ঠিক যেন ক্লাস টেস্ট। সঙ্ঘমিত্রা শান্তিনিকেতনে, তার সোনাঝুরি হোম-স্টে “মহুল” সামলাতে ব্যস্ত। ক’জন যাচ্ছে না, তা জানিয়ে দেওয়া হলো ইরাকে। তাও ইরা নজর রাখছে পোস্টে। আপডেট বলে কথা! আগের দিন থেকে চলল হুলুহুলু-কুলুকুলু। যেন আমাদেরই কারোর বিয়ে। এ যে আমাদের তিন নম্বর মেয়ে, সে কথা আর কে মনে রাখছে!
আর এক পর্ব চলল যে, কে কাকে তুলবে। ওরে বাবা! সবাই প্রায় সবাইকে তুলতে চায়। মাথা গোলানো “ষাট্টু”গুলোকে আবার খাপে ভরা হলো। এবার তাল কখন যাওয়া! সাতটা না সাড়ে সাতটায়। কারণ বাড়ি ফিরে অনেককেই আবার খাবার গরম করে বরকে বেড়ে দিতে হবে। এরা তো সব অর্ডার দেওয়া বর, তুই তোকারি বন্ধু মোটেই নয়। দ্বিতীয় তাল– দেখা কোথায় হবে! ভাবখানা এমন যেন, তাসা নিয়ে ঢোকার আয়োজন। ‘অইতি’র (অদিতি) বাড়ির সামনে, না কি ইসকুলের পিছন গেট? শেষ হ্যাপা সামলালো তপতী। ভয় দেখাল এই বলে যে- ও সব জায়গা এখন নো পার্কিং; বলল, বিয়ে বাড়ি খাবি, না কেস খাবি? এই দিনই জানা গেল, যে উপহারের সঙ্গে দেওয়ার কার্ডটা যোগাড় হবেনা, কারণ তপতী দোকানে যেতে পারেনি। ফোনে দুঃসংবাদ পেয়েই অন্য একটা বিয়ের কার্ড কেটে, ছোটবেলার মতোই চলনসই কিছু বানালাম। তিনটে থেকে শুরু হল শ্রাবন্তীর তাড়া। বাকিরা স্তব্ধ। সাজতে বসেছে বা ঘুমিয়ে চোখ ‘ফোলাচ্ছে’। এটা আমাদের সেই ষোলোতে খুব চালু ছিল।

তো নানা কসরতে সময়ের একটু আগে পরে, বদলে যাওয়া চেনা পাড়ায়, ওয়ান ওয়ের চক্করে ফেঁসে সবাই তো এসে পৌঁছলাম। জনা পনেরোর দল গোল হয়ে বসে, সাজ-গয়না-মেকআপ-স্টার্টারে পেট একেবারে দমসম। আমার চিল-চোখ আটকাল শ্রাবন্তীর হাতের সোনার চূড়ে। ওর বিয়ের আশীর্বাদী; তখনকার লিকলিকে হাতে, মাপে বড় ছিল। মাধুরী এখন শোভাবাজারের দেব বাড়ির বউ। তার হাতে বনেদি সাবেক বালাখানি। সকলেই বেশ গুছিয়ে সেজেছে। আমরা তো ১৯৭৫ এর সেই শেষ শাড়ি প্রজন্ম। আর ইরা তো রাণীমা। হলুদ চান্দেরিতে আর সোনার গয়নায় যেন সরস্বতী। ঝলমল করছে, দু-জোড়া মেয়ে-জামাই, নাতি, নাতনি, দাদা, বোন, জা-ভাসুর আর আত্মীয়দের আদরে। অনবদ্য তার হাসিমুখের জৌলুস।
ইরার ভাসুর তপেন্দুদাই ফিক করে হেসে বললেন- ‘বন্ধুরা? সব ওইদিকে’। কনেকে বললাম, চিনিস! চোখ ভাসিয়ে বলল, জিজামাসি! অঞ্জনদা ফিসফিস করে বলল ‘ইরা কেন যে কাউকে বাড়িতে ডাকতনা’! আমাদের স্বরূপটি দেখা দিল নড়েচড়ে সব উঠে দাঁড়াতেই। তারপর দলবেঁধে উপহার পর্ব। টকাস টকাস করে স্টেজে উঠে কনে এবং ইরার সঙ্গে ছবি তোলা। বিরাট দল দেখে ক্যামেরওয়ালারা তো এলই, বাকিরাও হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। বলেইছি তো একষট্টি উল্টে ষোলো। তৃপ্তির হাসি নিয়ে দো’তলায় নামতেই দেখি বর এসে গেছে। বাড়ি তো তখন বরযাত্রীতে গিজ গিজ। পা ফেলার জায়গা নেই। ঠেলেঠুলে ঢুকে সবাইকে ডেকে আলাপ করালাম। গৌরীর ভাষায়, এই দেখো তোমাদের মতোই আমরাও ‘শাশুড়ি যাত্রী’ মাসির দল। ছুটে এল বর পক্ষের ছবি তুলিয়ে। আমাদের মোবাইলেও টকাটক। এতক্ষণে বুড়িগুলো লজ্জা কাটিয়ে হেসে গড়াতে লাগলো। ইরার মেজো জামাই শুধু বলে গেল, ‘কী মজা তোমাদের’! বললাম, ‘আমরাই মজার– non-digital Indiaর মেয়ে তো! সে সময় বন্ধুত্ব আর প্রেম ছাড়া no option – no way বাছা’।

বাড়ি ফিরে সাজ ছাড়তে ছাড়তে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, কতদিন পর গাঢ় তুঁতে শাড়ি আর লকার থেকে আনা হাফ কান এবং গলায় চোকর পরলাম। ভাবছিলাম, ভাগ্যিস নভেন্দুদা আর ইরার তিনটে ছানা হয়েছিল; না হলে আবার এই নতুন করে বিয়েবাড়ির সাজ হত সবাই মিলে!
আমরা যারা নিজেদের বা ছানাপোনাদের বিয়েতে যোগাযোগের অভাবে সব ইসকুল বন্ধুদের ডাকতে পারিনি, আজ আমাদের সকলের হয়ে ইরা সেটা করল। ষাট বছরের ক্লান্তিতে এঁকে দিল, ষোলোর সেই লাবণ্য আর মুগ্ধতা। স্বর্গীয় মাধুর্যের রেশ নিয়ে ভরে উঠল ইসকুলবেলা; মভ-রং শাড়ির স্নিগ্ধতায়।
২
২০১৯-এ দ্বিতীয় বিয়েবাড়ি গমন। অদিতি ঘোষণা করল, ভাইপো কি ছেলে নয়! না হয় সে বিয়ে করে সংসার করেনি; তা বলে ভাইপোর বিয়েতে আমরা যাব না এটা হতেই পারে না। এবার আমরা মাসি নয়, পিসি বাহিনী (for a change)। আবার তোড়জোড় এবং তা চলতেই লাগল ঢাক ঢোল বাজিয়ে। আবার চাঁদা, উপহারে আবার গয়না কেনা, আবার সাজ এবং দল বেঁধে যাওয়া। অদিতিরা এখনও বাগবাজারেই সেই বাড়িটাতেই থাকে; ফলে তাদের সঙ্গে নতুন করে দেখা হওয়ায়, যেন সেই ইসকুলবেলার বাতাস গায়ে মাথায় আবার বয়ে গেল; ইদানীং কে আর জিজ্ঞেস করে, কী কাজ করি! ক’টি ছেলেমেয়ে, বাড়ি কোথায়! বুঝলাম যে, সময়ও এক বড়সড় অভিভাবক! অদিতির কাছে নতুন করেই শিখলাম সন্তান স্নেহকে বন্ধুদের সঙ্গে, কেমন করে ভাগ করে নিতে হয়! ভাইপো আর পেটের ছেলেতে কোনও ভেদ নেই। তাই তার পরিবারও সানন্দে আমাদের নিমন্ত্রণ করেছেন ওই বিয়েতে। কাঁকুড়গাছির এক ব্যাঙ্কোয়েটে জমে গেল খাস বাগবাজারিদের ভিড়; এবং তা হৈ হৈ করে।
৩
এবার ডিসেম্বর ২০২২। তিন নম্বর নেমতন্ন এল সুপ্তির কাছ থেকে, তার ছোটছেলের বিয়েতে। এই মাসি-বাহিনীকে দেখতে চায় তার গোটা পরিবার। আবার সেই সাজো সাজো এবং পুজোর পর থেকেই শুরু হল ডাক খোঁজ। বউভাতের তারিখ জানার পর থেকেই এসে পড়ল বিবিধ হিসেবের খতিয়ানও। প্রথম গেরো, কে থাকতে পারবে, আর কার কার ফসকে গেল! নয়ডাবাসী জয়শ্রী আর কানপুরে থাকা অমরাবতী তো শুনেই কাঁদতে বসল পা ছড়িয়ে। এদিকে সুক্রিয়াও মুম্বাই গেছে মায়ের কাছে। মাধুরী কলকাতা থাকলেও আসতে পারবে না। তার বাবা ভীষণ অসুস্থ। আর তাপসী সেদিন কোনটা ফেলে কোথায় যায়, কারণ একসঙ্গে আরও নেমন্তন্ন পড়ে গেছে। অগত্যা ‘absent’।
অন্যদিকে ভাল খবর এই যে, আমেরিকায় বেড়াতে গেলেও, সুস্মিতা তার ক’দিন আগেই কলকাতায় ফিরছে। আর আমেরিকাবাসী লছমী তো অনেক আগে থেকে কলকাতায় এসে মাস দু’য়েক থাকবে। সবচেয়ে আনন্দের হল, শুক্লা আর তৃষ্ণাকে খুঁজে পাওয়া এবং তারাও আসবে।

এবার বিষয়, আবার সেই চাঁদা তুলে সবাই মিলে একটা কিছু দেওয়া। কয়েক বছর আগে, ইরার ছোট মেয়ের বিয়েতে, আমরা দল বেঁধে শ্যামবাজার গিয়ে গয়না কিনে, ফুচকা খেয়ে, হুলুহুলু-কুলুকুলু শেষে, রাজ্য জয় করে বাড়ি ফিরেছিলাম। এবার আর সেরকমের সুযোগ নেই। কারণ অবশ্য অজানা! মনে হয়, লকডাউন কাটলেও ঝিমুনিটা রয়েই গেছে। ফলে, সুপ্তিকে গ্রুপ থেকে, left করিয়ে শুরু হল আমাদের জল্পনা। তপতীর ব্যাঙ্ক-নম্বরে সবাই টাকা পাঠালাম। সহায় গুগল পে (Goggle Pay)। সে কি বীরভাবের তৃপ্তিতে সকলের সদম্ভ মেসেজ – Done! আমি অনলাইন সার্ভে করে, বাজেট বুঝে দু-একটা ব্র্যান্ডেড গয়নার দোকানের নাম পাঠালাম। এবার তপতী ও শ্রাবন্তী পরম উৎসাহে, দু’জনে মিলে, দোকানে গিয়ে গয়না কিনে ছবি আপলোড করল। যথারীতি বাজেট বেড়ে যাওয়ায় আবার হিসেব, আবার টাকা পাঠানো। সঙ্গে আবার নতুন করে টাসলের বায়না। এবার হিসেব নিকেশ বুঝে নেবে তপতী ও শ্রাবন্তী, কারণ বাড়তি টাকা, তারা যে কে কতটা দিয়েছে, তা তো ওরাই জানে। একজন উকিল এবং অন্যজন অধ্যাপক। এবার হাড়ে হাড়ে মনে হয় বুঝেছে যে বাজেট ছাপিয়ে গেলে, বাড়তি টাকা পেতে অসুবিধে না হলেও, নতুন হিসেবের গুঁতো কেমন হয়! অপূর্ব একটা টাসল লাগিয়ে উপহারের মোড়কে শ্রাবন্তী লিখে দিল, “বাগবাজার বহুমুখী বালিকা বিদ্যালয় ১৯৭৫”! সে ছবি পেয়ে কী আনন্দ সকলের – আবার সেই মুক্তঝরা হাতের লেখা, যা পরীক্ষার খাতায় বারবার দেখেছে সবাই; আবার তা উপহার হয়ে এল আমাদের কাছে।
এসে গেল নেমন্তন্নে যাবার দিন। ভাগে ভাগে দল বেঁধে বা যে যার সুবিধে মতো পৌঁছনোর সময় সন্ধে সাতটা। শ্রাবণী সাড়ে ছটায় টান মেরেছিল, কিন্তু তাতে বাড়ি ফিরে আবার খেতে বসার আশঙ্কা প্রবল, তাই ঠিক হলো সাতটাই। শুরু হল কলকাতার উত্তর ও দক্ষিণ – নানা প্রান্ত থেকে হুসহাস…. সব গাড়িরই গন্তব্য সেদিন নিউটাউন ক্লাব (Newtown Business Club) গেট নং ৪।
শ্রাবন্তীকে তুলতে গিয়ে, এক কাপ চা না খেলে হয়! উপরি পাওনা মেয়ে জামাই আমন ও অনির্বাণ। শুরু হল, লছমীর ফোন– আর চা খেতে হবে না, আমাকে আগে তোল। আমন তার মায়ের ফোনে, ডেসটিনেশন স্টার্ট করে দিল। আমার ‘হা পিন্টু যো পিন্টু’ ডাক শুনতে না পাওয়া ড্রাইভারকেও মুহূর্তে খুঁজে আনল অনির্বাণ। অতএব শুভ যাত্রায় আর বাধা কী!

এদিকে স্নিগ্ধা ফোন করছে, দমদমের দিক দিয়ে কোন রাস্তায় আসবে! শ্রাবণীর জানার বিষয় আমরা আপাতত কোথায়! বীণা আর সঙ্ঘমিত্রা সাতটায় পৌঁছে দেখে, বউ মা তো দূরস্থান, শাশুড়ি মাতা সেই সুপ্তিও এসে পৌঁছয়নি। মরিয়া লছমীর ফোন আসাতে বোঝা গেল যে,আমনের দেওয়া গুগল ম্যাপ কিছুক্ষণ চালিয়েই, চারপাশ বড্ড চেনা লাগায়, শ্রাবন্তী সেটা খানিক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। যাই হোক, বিচিত্র সৌভাগ্যের অধিকারী বলেই বোধহয়, লছমী-সহ পথ না গুলিয়ে, আমরা ঠিকঠাক পৌঁছতে পেরেছি। দেখলাম, বাকি বন্ধুদের প্রায় জনা দশেকের দলও ওই গেটের মুখে। তখনই সুস্মিতার ফোন, ‘আমি পৌঁছে গেছি, তোরা কোথায়’? ‘আমারও পৌঁছলাম’, এই বলে ফোন রাখতেই লছমী বলল, এটা তো ৪ নং গেট। ওরা ভুল ঢুকছে, দুই নম্বর গেটে যেতে হবে। ভাগ্যিস আমি দেখতে পেয়েছিলাম, “Sayantan Weds Veronica”! জোর করে নেমে পড়ে, হাসি হাসি মুখে ঢুকতেই দেখি, উচ্ছ্বাস-আক্রান্ত সুপ্তি আমাদের দিকে ব্যাঘ্র ঝম্পনে এগিয়ে আসতে গিয়েই, টাল সামলাতে না পেরে, বেশ জোরেই পড়েছে, আর তাকে টেনে তুলতে এগিয়ে এসেছে, হাঁটু-কোমর ব্যথায় কাতর, কোমরে পিঠে বেল্ট আঁটা, এক দঙ্গল সিনিয়র সিটিজেন; মানে তার ৬৫ ছুঁই ছুঁই বন্ধুরা। তবে, ধাক্কা সামলেই ফোটো সেশন এবং পরিচয় করানো– ‘এরা সব্বাই আমার ইসকুলের বন্ধু’। সে কথা শুনে এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে কটমট চোখে বললেন, ‘কিইইইই, বাগবাজার মাল্টিপারপাস! তাহলে আমি কেন কাউকে চিনতে পারছিনা! আমি তো ওকে মাঝে মাঝেই ইসকুলে ছাড়তে যেতাম’! হায় রে! প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার আমাদের খোঁজ করছেন, যখন উনি তিরিশ আর আমরা পনেরো বা ষোল! ‘দু একজনের নাম বল তো’, একথা বলতেই বেশ ধমকের সুরে আমাকেই বললেন, ‘মন্দার কোথায়, বড়দির মেয়ে’? চোখে জল এসে গেল। কিছুই হারায় না তবে! জড়িয়ে ধরে মাসিক নিয়ে ছবি তোলা হল।
বিশাল এলাকা জুড়ে বউভাতের ব্যবস্থা। একেবারে সিনেমার সেট। বড়ছেলে বউমা তো অবাক আমাদের দল পাকানো দেখে। তাদের নিয়ে, সাগ্রহে আর এক দফা ছবি উঠল। হাসিমুখে আদর জানিয়ে দেখা করে গেল, বিদেশবাসী সুপ্তির বড় বউমাটিও। আমরা খোলা জায়গায় মস্ত এক ঘেরি বানিয়ে গোল করে বসলাম আড্ডা দিতে। সঙ্ঘমিত্রা, ইরা, বীণা চারিদিক থেকে চেয়ার টেনে আনল। দূর থেকে হাত নাড়লেন, বউ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, প্রতিমার বর তাপসদা। আজ আমরা সাড়ে কুড়িজন কারণ, ভিডিও কলে জয়শ্রীও হাজির হয়েছিল আড্ডায়। অপূর্ব একটা শুভেচ্ছা কার্ড এঁকে সকালেই সে আপলোড করেছে আমাদের গ্রুপে। জমিয়ে বসে, নানা রকম টুকি টাকি খাওয়াও শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। স্টার্টার খাওয়ার খালি প্লেটগুলো হাতে হাতে না নিয়ে গিয়ে, সেগুলো ফেলার জন্য, মাঝখানে একটা কেটারিংয়ের নৌকো বসিয়ে দিয়ে গেল, সারভিংয়ের ছেলেরা। প্রথমে আমরা খুবই পুলকিত সে ব্যবস্থায়। কিন্তু যেই দেখলাম যে, আমাদের তাক করে মাথার ওপর উড়ে উড়ে ড্রোন ছবি তুলছে, ওমনি শুরু হল, ‘হটাও হটাও এসব নোংরা’।
বুঝলাম যে, সময়ও এক বড়সড় অভিভাবক! অদিতির কাছে নতুন করেই শিখলাম সন্তান স্নেহকে বন্ধুদের সঙ্গে, কেমন করে ভাগ করে নিতে হয়! ভাইপো আর পেটের ছেলেতে কোনও ভেদ নেই। তাই তার পরিবারও সানন্দে আমাদের নিমন্ত্রণ করেছেন ওই বিয়েতে। কাঁকুড়গাছির এক ব্যাঙ্কোয়েটে জমে গেল খাস বাগবাজারিদের ভিড়; এবং তা হৈ হৈ করে।
এর মধ্যে সুস্মিতা হাজির হয়ে তো পেল্লায় বকাবকি শুরু করল; কেন ওর ফোন ধরিনি এবং ওকে দেখতে না পেয়ে খোঁজ করিনি বলে। দফায় দফায় কথা বলে যা বুঝলাম, তা হল আমরা হারিয়ে গেছি ভেবে উদ্বেগ করলেও, আসলে বিয়ে বাড়ির ঠিকানাটিও সঙ্গে না নেয়ায়, এই বিভ্রাট এবং ওরই হারিয়ে যাওয়া; মানে পঁচিশ মিনিটের অপেক্ষা। যাই হোক নারদ নারদ বলে ইরা মিটিয়ে দিল।
ফেরার পথে গাড়িতে উঠে বসে দেখি বীণা ছুটে আসছে ‘মালাটা দে’ বলতে বলতে। তার নাতনী জানে যে আমাদের জমায়েত মানেই, খোঁপায় মালা লাগিয়ে ঠাম্মা বাড়ি ফিরবে। এই নিয়ে বিলাপ করছে দেখে, বলেছিলাম, ‘গাড়িতে আমার গণেশের গলায় একটা মালা আছে, নিয়ে নিস’। ভবি নাতনীকে ভোলাতে, ঠাম্মার তাই আমার পিছনে ওই প্রবল ধাওয়া।
এত ছড়ানো জায়গায়, এতজনে মিলে হৈ হৈ করে, এত এত খেয়ে, কী যে মজা করলাম বলবার নয়। আর কী যে সুন্দর রং মিলিয়ে আলো আর ফুলে সাজানো নানা আয়োজন। তেমন ভাল খাওয়া। আর সব ছাপিয়ে সুপ্তির আন্তরিক আপ্যায়ন। প্রতিমার মেয়ে অনুজা আমাদের আরও কিছু গ্রুপ ফোটো তুলে দিল। সত্যি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল আমদের ক্লাস টেনে, সরস্বতী পুজোর আগের দিন বিকেল থেকে সন্ধে গড়িয়ে বাড়ির বাইরে, আমাদের সেই প্রথম আড্ডা আর দেদার খুনসুটি।
আগে ছিল বাবা-মায়ের ভয়; আর এখন ভর করেছে নিজেদের এক ‘নেই আঁকড়া’ দায়িত্ব বোধ। সাধে রেগে গিয়ে বলি, ‘নিকুচি করেচে…..যত্তো…… সব ‘। বাড়ি ফিরেও কত রাত অবধি চলল সন্ধের ছবি পোস্ট করার খেলা আর মন্তব্য। ভাগ্যিস লকডাউনে সড়গড় হয় গেছে গুগল পে, গুগল ম্যাপ, অনলাইন শপিং, ভিডিও কল, ড্রোন ক্যামেরার কারসাজি!

৪
এবার ২০২২। সে এক অভিনব এবং হাইটেক অভিজ্ঞতায় বিয়ের হুল্লোড়। ইসকুল-বন্ধু জয়শ্রীর মেয়ের বিয়ে লাগলে বোঝা গেল যে, লকডাউনের কড়াকড়ি এখনও কেমন জবরদস্ত চলছে। বিদেশবাসী কনে আর তার সাহেব বর দেদার অপেক্ষার পর বুঝতে পারল যে নয়ডা থেকে তার বাবা বা মা কেউই আপাতত ক্যালিফোর্নিয়া যাবার অনুমতি পাবে না। অগত্যা বর–কনের ব্যস্ত সময় মেনেই, তাদের এনগেজমেন্ট হয়ে গেল। আর বিয়েটা হল, ২৯ অগাস্ট। আমাদের হোয়াটস্যাপ দলে হুলুহুলু-কুলুকুলুর শেষ নেই। এমনিতেই একটা কিছু পেলে হল, তায় আবার মেয়ের বিয়ে বলে ‘কতা’। বেজায় মন খারাপ জয়শ্রী আর সুব্রতদার। তবু তার শ্বশুরবাড়ির প্রথা অনুযায়ী দিল্লির কালীবাড়ি গিয়ে তারা সকালের পুজো দিয়েছে। কিন্তু না হল তার বিয়ের কার্ড আঁকা, ঘর জুড়ে আলপনা দেওয়া, যমুনায় জল সইতে যাওয়া, বা ভোর রাতে উলু দিয়ে দধিমঙ্গল। তোলা রইল, লালপেড়ে সাদা কড়িয়াল পরে জামাই-বরণ, মেয়ের আইবুড়োভাত, গায়ে হলুদ সেরে বউ ভাতের তত্ত্ব গোছানো, আত্মীয়, স্বজন ও বন্ধুদের জম্পেশ জমায়েত, আলো আর ফুল দিয়ে বাড়ি সাজানো আর সবশেষে আনন্দাশ্রুতে ভেসে চোখের জলে কন্যা বিদায়। আসলে জয়শ্রী মানেই সাজো সাজো রবেও একগাল হাসি আর তুলির ছ্টায় রং ছড়ানো। আমাদের প্রত্যেকের জন্মদিনে হাতে আঁকা কার্ডে শুভেচ্ছা পাঠায় সে। এবার সে পাঠাল মেয়ে-জামাইয়ের জন্য আঁকা শুভেচ্ছাপত্র আর হাতে লেখা বড় বিধুর এক অনুরোধ– আমরাও যেন ওদের আশীর্বাদ পাঠাই। চোখে জল এসে গেছিল, এমন এক বিরহ বার্তায়।
মনটা এমন কাতর হয়ে উঠল যে মনে হল একটা কিছু করি। ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকা আমার বন্ধু সৌম্যর কাছে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, তার আস্তানা থেকে নতুন বর-বউয়ের বাড়ি বেশি দূরে নয়। কিন্তু সকাল গড়িয়ে আমার রবিবারের দুপুর মানে, ওদের শনিবারের সন্ধে শেষ হতে চলেছে। শ্রীময়ী আর কেভিনের ঠিকানা ও ফোন নং তড়িঘড়ি যোগাড় করে, পছন্দ মতো শুভেচ্ছা-বয়ান লিখে পাঠিয়ে দিলাম। বন্ধু জানাল যে, সব যথাযথভাবে সমাপ্ত এবং আগামীকাল উপহারে পৌঁছে যাবে দু’ডজন লাল গোলাপ। ঠিক তাই। আমার দিনখানি ক্রমে রাতের দিকে গড়াতেই, শুরু হল ওদের সকাল হওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের দিয়ারাণী (শ্রী) এবং তার মায়ের আলাদা আলাদা উচ্ছ্বাস বার্তা এল। এল ছবি সমেত ‘flowers delivered’ এর নথি। আর দিয়ার কাছ থেকে এল আরও এক ছবি; উপহারে পাওয়া সেই ফুল, কাচপাত্রে সাজিয়ে । ফেসবুকের পাতা খুলতেই দেখি আমাদের হবু জামাই কেভিন আবার, দিয়ার সাজানো সেই ফুলপাত্রের পাশে নিজের আহ্লাদে বেড়াল সমেত আরও একখণ্ড ছবি তুলে, নিজের প্রোফাইল আপডেট করেছে। মনে মনে শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে ভাবলাম, এই তো! একেবারে দধিমঙ্গল দিয়ে বিয়ে শুরু হয়ে গেল। অন্তর্জাল আসলে, ‘এখান থেকে ফেললাম দড়া, দড়া গেল সেই বামুন পাড়া’।

আর এদিকে বন্ধুদের মাতামাতিরও শেষ নেই। সুব্রতদা ও জয়শ্রীর প্রোমোশন হল বলে, বন্ধু শ্রাবন্তী তাদের অর্কিড পাঠালো নয়ডায়। গ্রুপে সেই ফোটো দেখে আর একজন বন্ধু ভাবল, বাবা মায়ের বিয়ের দিনেই বুঝি, মেয়েও বিয়ে করছে। সেই ভুল বোঝার জন্য সে আবার মৃদু বকুনিও খেল। জয়শ্রীর মন ভাল রাখতে, ক্রমাগত পাঠানো মাছ, মিষ্টি আর ফুলের ছবিতে জমজমাট…‘আজ কন্যের অধিবাস, কাল কন্যের বিয়ে’। সানাইয়ের সুর, বিদেশী বাজনা, সেও এল। পুরনো এ্যলবাম থেকে পাঠানো ছবিতে আমরা দেখতে থাকলাম, জয়ীর বিয়ে, শ্রীর জন্ম, অন্নপ্রাশন। ব্যস তারপরই আজকের নবদম্পতির বিয়ের ছবি এবং তাঁর সঙ্গে জয়শ্রীর running note। চোখে পড়ল, শ্রীর সেল্ফি তোলা দু’হাতের উল্কিতে বাংলায় লেখা তার বাবা-মায়ের নাম। আবার সকলের চোখ সজল।
কী অভাবনীয় কাণ্ডটাই না ঘটল এই বন্ধু যোগাযোগে। এক বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে, এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশে, ফুল পৌঁছে দেবার ব্যবস্থায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়ে, তা করে দিল আর এক বন্ধু! এবং এরা সবাই হয় বুড়ো নয় বুড়ি (থুড়ি থুড়ি)! এর পরও ভাববো যে ‘সব’ রসাতলে গেল! চুলোর দোরে যাক অসভ্য নিষ্ঠুর লোকগুলো, যারা শুধু রসাতলে টানে। শুধু বেঁচে থাক মনের এই অমলিন নির্ভরতা আর বুড়ি বয়সেও মহার্ঘ এই ‘ বেঁধে বেঁধে থাকা’।।
আমরা এখন যে শুধু মাসি বা পিসি-গোত্রের ‘শাশুড়ি যাত্রী’ এমন কিন্তু নয়; দুরন্ত টেক স্যাভি, মানে প্রযুক্তি-জ্ঞানী সেই দল, যারা এক লহমায় জোট বেঁধে, যে কোনও অবস্থায়, মেতে উঠতে পারে নির্ভার আনন্দে। বিয়েবাড়ির জমায়েতটা নতুন সিলেবাস।
ছবি সৌজন্য: মন্দার মুখোপাধ্যায়, Pexels
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
One Response
অনেক আদর শাশ্বতী