মাশা কালেকোর জন্ম হয়েছিল ১৯০৭ সালের ৭ জুন, বর্তমান পোল্যান্ডের গ্যালিসিয়া প্রদেশে এক ইহুদী বণিক পরিবারে। পারিবারিক নাম ছিল গোল্ডা মাল্কা আউফেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে যখন রাশিয়াতে ইহুদিদের বিতাড়িত করবার জন্য জাতিদাঙ্গা শুরু হয়, তখন তাঁর পরিবার জার্মানিতে চলে এসেছিল। শৈশবেই জন্মভূমির শিকড় থেকে বিচ্যুতি তাঁর মনে এক নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছিল, যার প্রভাব পরবর্তীকালে তার বিভিন্ন কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বার্লিনে থিতু হয় তার পরিবার। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে মাশার লেখা, যা পাঠকের হৃদয় জয় করে নেয় এবং ১৯৩০ সালের মধ্যেই বার্লিনের বিদ্বৎসমাজের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ওঠেন মাশা কালেকো। ১৯৩৩ সালে রোভোল্ট পাবলিশার থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম বই ‘দাস লিরিশে স্টেনোগ্রামহেফ্ট্’। দু’বছর পরে রোভোল্ট থেকে বেরোয় তাঁর দ্বিতীয় বই ‘দাস ক্লাইনে লেসেবুখ্ ফ্যুর গ্রোস্সে’। তবে সবগুলি বইই নাৎসি শাসনকালে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এতই জনপ্রিয় ছিল তাঁর কবিতা, যে চিরকুটে হাতে লিখে লিখে অনেক কবিতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারিদিকে।
আরও পড়ুন: হিন্দোল ভট্টাচার্যের কলমে: ইউরগেন বেকের কবিতার অনুবাদ
ইহুদিদের উপরে নাৎসিবাহিনীর দমনপীড়ন বেড়ে চলায় মাশা জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমালেন ১৯৩৮ সালে। নিউইয়র্কে জীবিকার জন্য বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল লিখতেন। নির্বাসিত জীবন প্রতিফলিত হতে থাকে কবিতায়। ১৯৫৬ সালে আবার যাতায়াত শুরু হল ইউরোপে। ১৯৫৮ সালে জার্মানিতে পুনঃপ্রকাশিত হল প্রথম কবিতার বই, যা বেস্টসেলার হয়। এক বছর পরেই হয়তো তিনি পেতে পারতেন ফন্টানে পুরস্কার, যার ফলে আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট লাভ হত তাঁর।

কিন্তু মাশা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন এই পুরস্কার নিতে, কারণ জুরি বোর্ডে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অতীতে নাৎসি শাসকদলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ১৯৬০ সালে থিতু হওয়ার জন্য চলে গেলেন ইজ়রায়েল, তবে ইউরোপে যাওয়া আসা লেগেই থাকত। ১৯৭৫ সালের ২১শে জানুয়ারি বার্লিন থেকে জেরুজালেম ফেরবার পথে জুরিখে তাঁর দেহাবসান ঘটে।
দড়ির উপরে নর্তকী যার নিচে জাল নেই
আমার জীবন দড়ির উপরে নেচে যায় সাবধানে।
যদিও দুদিকে ঠিকঠাকভাবে বাঁধা ছিল গ্রন্থিতে।
কিন্তু এখন শক্ত দড়িটা হঠাৎ গিয়েছে ছিঁড়ে,
এবং আমার সাঁকোটা দুলছে নেই-মানুষের দেশে।
এবং এখনও নেচে যাই আমি, জানিনা যে কোনওকিছু,
হয়তো কিছুটা অভ্যাসে নাচি, নাকি গর্বিত ক্রোধে!
মানুষ দেখছে অবাক চোখেতে, আমি নেচে চলি বেশ।
হে ঈশ্বর, করুণা কর গো, সামনে তাকাব আমি।
মূল কবিতার নাম: জাইলত্যান্জারিন ওহ্নে নেট্জ্ (Seiltänzerin ohne Netz)
বিনীত প্রশ্ন
তোমার টেবিলে এখনো আমার ছবি কি রেখেছ তুমি?
এখনও কি তুমি অপেক্ষা কর আমার চিঠির জন্য?
ঢালু ছাদ সেই শহরতলির ছোট্ট কুটিরখানি
চিত্রকল্প এখনও কি বেশ- তুলি আঁকা মনোভূমি?
কলিংবেল কি এখনও প্রথমে কর্কশসুরে বাজে,
তারপরে যেন ভয় পেয়ে মিহিসুরেতে মিলিয়ে যায়…
ঠিক তখনই জুলিয়াস বুঝি ঘেউ ঘেউ করে ওঠে?
আগের মতই সাঁঝবেলাগুলো বিজনে বিরলে সাজে?
টেলিফোন বুঝি এখনও তুমি রাখছ না একেবারে?
এখনও কি তুমি হ্যামক ঝোলাও তোমার বারান্দাতে?
এখনও তুমি কি আদ্যিকালের গ্রামোফোন ঝেড়েমুছে
শুবার্ট চাপিয়ে ভেসে যেতে চাও সুরের ওই পারাবারে?
এখনো টেবিলে প্যাসট্রি আসে কি মাঝবিকেলের চায়ে?
জোহানা কি আজও ভুল বিশেষণে ভাষাকে উল্টে দেয়?
পা মেলে বসা, ঘাস দলে চলা- এখনও কি মানা আছে
মহার্ঘ্য ওই পান্নাসবুজ বাগানের গালিচায়?
সকালে এখনও মিষ্টি বাতাস উথালপাথাল নাচে?
রাত্রে কি চাঁদ এখনও সেখানে বিব্রত হাসি হাসে?
এখনও কি তুমি আমার জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাক?
এখনও আমার ছবিটা তোমার টেবিলে কি রাখা আছে?
আমার ছবিটা…? ছিঁড়ে কবে আমি, পুড়িয়ে এসেছি সাঁকো।
বিশ্বাস কর, তোমার কথাও এতটুকু ভাবছি না।
তবু তো তোমার একথা সেকথা জানতে ইচ্ছে হয়,
যখন নিজের সঙ্গেই তুমি একলাটি জেগে থাক…
তোমার টেবিলে এখনও আমার ছবিটা কি তুমি রাখ?
মূল কবিতার নাম: ‘বেশাইডেনে আনফ্রাগে’ (Bescheidene Anfrage)
সময় থেমে থাকে
সময় থেমে থাকে। আমরা মুছে যাই।
চলেছি দিনরাত রেলের যাত্রায়।
ক্ষেত-গাছপালা, গরু ভেড়ার দল,
খেলনা বাড়ি যেন, ঝলকে একপল।
বাতিস্তম্ভ, কে ওই নাড়ে হাত!
মিলায় স্বপ্নেরা- পেরোয় মাঠঘাট।
জীবন ছবিও তো মিলায় শেষমেষ
কোথায় চলে যায়, দূরের তারকায়
নেই যে ধরাছোঁয়া, আগামী কোনও ঠাঁই।
কী বৃথা চেষ্টায়, খুঁজেছি রঙ রেশ
মিথ্যা ছলনা যে, বুঝেছি সংসারে।
দৃশ্য পড়ে থাকে, রেলের গতি বাড়ে
ভ্রমণ হয় শেষ, পাড়ি পথের বাঁকে
আমরা ধেয়ে যাই। সময় থেমে থাকে।
মূল কবিতা: ‘ডি ৎজাইট স্টেহ্ট স্টিল’ (Die Zeit steht still)
ফেলে আসা সময়
উন্মুক্ত
রাতের নৌকায়
বেয়ে যেতে যেতে
পৌঁছে গিয়েছি কিনারায়।
বৃষ্টির বিপ্রতীপে মেঘে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছি।
বালিয়াড়িতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছি ক্রুদ্ধ বাতাসের সামনে।
অলৌকিক ঘটনা ছাড়া
আর কিচ্ছুটির উপরে বিশ্বাস রাখিনি।
প্রতীক্ষার সবুজ অপক্ক ফল খেয়েছিলাম আমি
এমন এক জল পান করেছিলাম
যা আমায় আরও তৃষ্ণার্ত করে তুলেছিল।
অনাবিষ্কৃত মাটির সামনে এক নতুন আগন্তুক, আমি
অন্ধকার, সুষুপ্ত সময়ে নিজেকে বন্দি রেখেছিলাম।
ভালবাসা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম নিজের জন্মভূমিকে।
মূল কবিতা: ‘ডি ফ্র্যুহেন যাহ্রে’ (Die frühen Jahre)
*ছবি সৌজন্য: inews, Mirror.co.uk, Pinterest
জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।
4 Responses
অনুবাদ এবং ছন্দের নিখুঁত চলনে… অবিশ্বাস্য রকমের ভালো কাজ।
প্রীতি জানাই সই❤️❤️
অপূর্ব সুন্দর।সচরাচর অনুবাদ কবিতা এতো মন ছুঁয়ে যায় না। বিনীত প্রশ্ন চোখের সামনে একটা ক্যানভাস এনে দিল ।
অনেক ধন্যবাদ পামেলা।