২০১৮-র ১৩ই ডিসেম্বর। পূর্ব জয়ন্তিয়া জেলার কসান গ্রামের এক খনিতে তলিয়ে গেল পনের (মতান্তরে ষোলজন) শ্রমিক। অভিযোগ, সুড়ঙ্গ কাটতে কাটতে এগিয়ে যাওয়ার সময় শ্রমিকদের গাঁইতি ফাটিয়ে দেয় পাশের নদীর তলদেশ। হু হু করে নদীর জল সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে। বেআইনি এই খনিতে অন্যান্য খনির মতোই না ছিল কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা উদ্ধার করার সাজ সরঞ্জাম। ফলে হারিয়ে গেল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোজগারের সন্ধানে কাজ করতে থাকে এতগুলি বালক-কিশোর।
মেঘালয়ের রাজধানী শিলং থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব মাত্র দেড়শ কিলোমিটার হলেও দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের উদ্ধার করার মতো প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো সেখানে নেই। ঘটনার পরের দিন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (NRDF) একশ জনকে ঘটনাস্থলে মোতায়েন করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অন্য জায়গা থেকে সাহায্য চেয়ে পাঠাতে রাজ্য প্রশাসনের সময় লাগল প্রায় দু’ সপ্তাহ। আস্তে ধীরে নৌসেনা, কোল ইন্ডিয়া এবং বিমানবাহিনীর বিশেষজ্ঞ ও যন্ত্রকুশলীরা সমবেত হলেন।
তারপর সত্যিকারের উদ্ধারকাজ শুরু করতে কেটে গেল আরও এক সপ্তাহ। যতক্ষণ না জল সরানো হচ্ছে ততক্ষণ কিছুই করা যাবে না বলে জানিয়ে দিল উদ্ধারকারী দল। দিবারাত্র কাজ চালিয়ে কয়েক কোটি লিটার জল পাম্প করে বের করার পরে হতাশ হয়ে উদ্ধারকারীরা যখন হাল ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে ঠিক সেই সময় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিল উদ্ধারকাজ বন্ধ করা চলবে না। সুপ্রিম কোর্টের মতে মিরাকল ঘটলেও ঘটতে পারে। কাজেই সরকারি ভাষ্যে উদ্ধারকাজ বন্ধ হয়নি।
মেঘালয়ের কসান খনিতে আটকে পড়া শ্রমিকদের সম্পর্কে প্রচারমাধ্যম যখন প্রায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে, সেই সময় দুর্ঘটনার ৪২ দিন পর, একজনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়।

খনি গহ্বর ও সুড়ঙ্গের মধ্যে জল ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক ও গ্যাস। এর মধ্যে এক মাসের বেশি সময় কোনও মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা মেনে নিতে এত আপত্তি কেন বলা মুশকিল। এই দুর্ঘটনার পরে রাজ্যের কোনও জনপ্রতিনিধি ঘটনাস্থলে ক্ষণিকের জন্যও উপস্থিত হলেন না। অবিশ্যি আসবেন কোন মুখে? তাঁদের অনেকেই তো এইসব বেআইনি খনির মালিক।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরেও কি আশপাশের আরও নব্বইটি বেআইনি খনির কাজ বন্ধ হয়েছে? না, হয়নি। খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলে কয়েকদিন বিষয়টি প্রচারিত হলেও সমস্ত বেআইনি খনি অবিলম্বে বন্ধ করার কথা কোথাও উচ্চারিত হয়নি। বেআইনি খনিটির মালিক জেমস্ সুখলেইন দুর্ঘটনার পরে পালিয়ে যায়। কয়েকদিন পর তাকে গ্রেফতার করার পর প্রশাসন কৃতিত্ব দাবি করে। অথচ সামগ্রিক ভাবে এন জি টি-র নির্দেশ প্রয়োগ করে সমস্ত বেআইনি খনির কাজ বন্ধ করার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
এখানেই শেষ নয়। কসানের উদ্ধারকাজ নিয়ে চলতে থাকা ডামাডোলের মধ্যেই ২০২০-এর ১৭ই জানুয়ারি ইস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলার জালিয়া গ্রামের এক র্যাটহোল কয়লা খনিতে ধ্বস নামায় দুই কর্মীর মৃত্যু হয়। ১৩ই ডিসেম্বরের পর ১৭ই জানুয়ারি। মধ্যে মাত্র ৩৫ দিন। সেই একই পরিস্থিতি। কয়লা বের করার জন্য খনির দেওয়ালে আঘাত করতেই নাকি হুড়মুড় করে নেমে আসে বড় বড় চাঙড়। ঘটনাস্থলেই দুই শ্রমিকের মৃত্যু। খনিমুখ সংকীর্ণ। কাজেই উদ্ধারকাজ কঠিন। এবং সংবাদমাধ্যম প্রায় নীরব।
তারপর এসে গেল করোনা সংক্রমণ সংক্রান্ত সংবাদ। হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল জাতীয় পর্যায়ের লক ডাউন। সংবাদমাধ্যম থেকে উধাও হয়ে গেল কসান খনি দুর্ঘটনা এবং উদ্ধারের খবর। হারিয়ে গেল কতগুলি শিশু-কিশোর। তাদের অধিকাংশরই নাম-ঠিকানা, পরিচয় অজানা রয়ে গেল।
কসানের উদ্ধারকাজ নিয়ে চলতে থাকা ডামাডোলের মধ্যেই ২০২০-এর ১৭ই জানুয়ারি ইস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলার জালিয়া গ্রামের এক র্যাটহোল কয়লা খনিতে ধ্বস নামায় দুই কর্মীর মৃত্যু হয়। ১৩ই ডিসেম্বরের পর ১৭ই জানুয়ারি। মধ্যে মাত্র ৩৫ দিন।
অবরোধের অন্তরালে অন্যান্য খনিগুলি কিন্তু সক্রিয় থেকেছে। কোথাও কাজ বন্ধ হয়নি। বরং আরও বেশি পরিমাণেই কয়লা তোলা হয়েছে। কে তার হিসাব রাখে? প্রশাসন প্রচারমাধ্যম সকলেই তো তখন সংক্রমণ নিয়ে ব্যস্ত।
কথায় বলে পাপ চাপা থাকে না। করোনা সংক্রমণ সংক্রান্ত ডামাডোলের মধ্যেই ২০২১-এর জানুয়ারি মাসে ইস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ জেলার সদর ক্লেহরিয়াট শহরের থেকে একটু দূরের রিমবাই এলাকার এক খনি দুর্ঘটনায় ছয় জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। কসান খনিতে হারিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের মতো দুর্দশা রিমবাই এলাকার নিহতদের হয়নি। দুর্ঘটনার পরেই মৃতদেহগুলি ক্লেহরিয়াট স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। আবারও প্রমাণিত হল যে জাতীয় পরিবেশ আদালত বা এনজিটি এবং সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞার পরোয়া না করে রমরমিয়ে চলছে মেঘালয়ের র্যাটহোল মাইনিং।
ইস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ এবং ওয়েস্ট জয়ন্তিয়া হিলস্ মিলিয়ে দুই জেলার অন্তত শ’ পাঁচেক গ্রামে র্যাটহোল মাইনিং-এর কাজ চলে। বিভিন্ন অসরকারি সংগঠনের অনুমান প্রতি গ্রামে কমবেশি দশটি কয়লা খনি আছে। অর্থাৎ হাজার পাঁচেক খনি থেকে কয়লা তোলার বন্দোবস্ত রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন নথি যেমন কয়লা রপ্তানির হিসেব কিংবা সরকারের খাজানায় জমা দেওয়া রয়্যালটি অথবা কতগুলি ট্রাক কয়লা নিয়ে চলাচল করে, এইসব মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে অনুমানটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
প্রতি খনিতে অন্তত পক্ষে দশ থেকে বারো জন শ্রমিকের কাজ না করলেই নয়। খনির ভিতরে ঢুকে কয়লা খুঁড়ে বের করে খনিমুখে পাঠানো থেকে শুরু করে ট্রাকে ভর্তি করা পর্যন্ত দশ-বারো জন শ্রমিকের উদয়াস্ত ঘাম ঝরানো শ্রমের উপর পুরো ব্যবস্থাটা টিকে আছে। অর্থাৎ পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার শ্রমিক। জাতীয় পরিবেশ আদালতে অসরকারি সংগঠনগুলি যে ওকালতনামা জমা দিয়েছিল তাতেও র্যাটহোল মাইনিং-এ ষাট হাজার শ্রমিক নিযুক্ত আছে বলে জানানো হয়। এসব কিন্তু ২০১৪-র আগেকার হিসেব। কারণ, জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশে ২০১৪-র ১৭ই এপ্রিল থেকে মেঘালয়ে র্যাটহোল মাইনিং নিষিদ্ধ। এবং সরকারি বয়ানে মেঘালয়ে র্যাটহোল মাইনিং সম্পূর্ণভাবেই বন্ধ হয়ে গেছে।
এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে রূপায়িত হলে গত কয়েক বছর ধরে মাঝেমধ্যেই মেঘালয়ের র্যাটহোল কয়লা খনির বিপর্যয়ের খবর প্রচারিত হত না। লোকে বলে, শুধুমাত্র বড়সড় দুর্ঘটনার খবরই ফলাও করে প্রচারিত হয়। ছোটখাটো দুর্ঘটনা প্রায়শই ঘটে। জাতীয় তো দূরের কথা স্থানীয় প্রচারমাধ্যমও সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। সত্যি সত্যিই তো র্যাটহোল কয়লা খনিতে সাদামাটা ধ্বসের খবরের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রতিদিন কতই না ঘটে চলেছে।
জোয়াই, ক্লেহরিয়াট অথবা ডাউকির রাস্তায় প্রতিদিন সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা কয়লার ট্রাকও বুঝিয়ে দেয় জাতীয় পরিবেশ আদালতের নিষেধাজ্ঞা কেমনভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রশ্ন করলে জানা যাবে যে সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী খনিমুখে জমে থাকা কয়লা সরিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। চূড়ান্ত বিচারে প্রশ্ন করা যেতেই পারে সত্যিই র্যাটহোল মাইনিং বন্ধ হয়েছে কি?
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।
One Response
চমৎকার তথ্য সম্ব্রিদ্ধ লেখা l অমিতাভবাবুর গদ্য খুব ঝরঝরে – পড়তে খুব ভালো লাগে l