স্মৃতির আকাশ থেকে
(Bharati Devi)
(Bharati Devi) নিউ থিয়েটার্স থেকে সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদারের ছবিতে সাবলিল অভিনয় করেছেন। তবুও বাঙালি কি তাঁকে মনে রেখেছে! ২০১০ সালের মকর সংক্রান্তির সকালে ভারতী দেবীর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম খুব মন দিয়ে দেবকী বসু পরিচালিত এবং নিজ অভিনীত ছবি ‘সাগর সঙ্গমে’ দেখছেন। আমায় দেখে বললেন, ‘আজকে তো সংক্রান্তি তাই ইচ্ছে হল ছবিটা দেখতে।’ তপনদা মানে তপন সিংহর বিষয়ে একটা লেখার সূত্রে ভারতীদির সঙ্গে পরিচয়। জানতাম বয়েস হলেও তিনি রয়েছেন এবং সুস্থই আছেন কিন্তু কোথায় থাকেন জানতাম না। (Bharati Devi)
একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি : অরিজিৎ মৈত্র
এরপর জানতে পারি যে শহরতলির ঢাকুরিয়া কালীবাড়ির উল্টোদিকের বাড়িতে থাকেন তিনি। ফোন নম্বর সংগ্রহ করে গেলাম তাঁর বাড়ি। সাদামাটা আটপৌরে জীবনযাত্রা, হাসিমুখে অভ্যর্থনা। দীর্ঘ জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক স্মৃতি ভাগ করতেন বিভিন্ন সময়। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। শুনতাম না বলে দেখতে পেতাম বলাই ভাল। ওঁর মধ্যে যেটা সব সময় দেখতে পেতাম, সেটা হল অসম্ভব স্নেহ। আমার কথায় সহমত পোষণ করে তরুণ মজুমদারও বলতেন ভারতীদির মধ্যে যে স্নেহ দেখা যায়, তা খুব বেশি মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। ছবির জগতে পা রাখার প্রাক্কালে তাঁর প্রথম ছবিটি তুলেছিলেন বিমল রায়। বি.এন.সরকারের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর ব্যানারে প্রচুর ছবি করেছেন যার মধ্যে ছিল, ‘কাশীনাথ’, ‘নার্স সিসি’, ‘ডাক্তার’, ‘ওয়াপাস’, ‘উচনিচ’, ‘মঞ্জুর’ ইত্যাদি। (Bharati Devi)
আমার কথায় সহমত পোষণ করে তরুণ মজুমদারও বলতেন ভারতীদির মধ্যে যে স্নেহ দেখা যায়, তা খুব বেশি মানুষের মধ্যে দেখা যায় না।
যখন ভারতীদির বাড়িতে গিয়েছি তখন সেইসব দিনের নানান গল্প করতেন। অনেক কথা বলতেন কানন দেবীর সম্পর্কে। তাঁদের মধ্যে খুব সুন্দর একটা শ্রদ্ধা আর স্নেহের সম্পর্ক ছিল। ভারতীদি ছিলেন উত্তমকুমারের প্রথম নায়িকা। ‘মনের ময়ূর’ এবং ‘সহযাত্রী’ উত্তমকুমার ভারতীদেবীর জুটির উল্লেখযোগ্য ছবি। ভারতীদির বাড়িতে বছরের বা মাসের অন্যান্য সময় গেলেও বছরের দুটি দিন যেতেই হত, একটা ওঁর জন্মদিন অক্টোবর মাসের শেষের দিকে আর একটা দিন, যেদিন ফলহারিনি কালীপুজো পড়ত সেইদিন। (Bharati Devi)

ভারতীদির শোবার ঘরের পাশেই ছিল তাঁর ঠাকুরঘর যেখানে তাঁর নিজের হাতে তৈরি করা কালিমূর্তি পূজিতা হতেন, সম্ভবত এখনও হন।
প্রতি বছর ফলহারিনি কালীপুজোর দিনে খুব ধুমধাম করেই পুজো হত। উনি নিজে সেখানে বসে থেকে সব তদারকি করতেন। জন্মদিনে ওঁর কাছে গেলে বলতেন, ‘তুমি আমাকে খুবই ভালোবাসো তাই এই দিনটা মনে রাখ।’ তপনদাকে খুব ভালোবাসতেন। তপন সিংহ ছিলেন ওঁর পছন্দের পরিচালকদের অন্যতম। ভারতীদি তপনদার একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন। (Bharati Devi)
তপনদাকে খুব ভালোবাসতেন। তপন সিংহ ছিলেন ওঁর পছন্দের পরিচালকদের অন্যতম।
একদিন নির্জণ সৈকতে ছবির বিষয়ে আমার সঙ্গে গল্প করছিলেন, বলেছিলেন, ‘চারজন বিধবার গল্প, মহরতের দিন আমার তো বেশ ভয় করছিল, ভাবছিলাম কী জানি দর্শকদের ছবিটা কেমন লাগবে আর খবরের কাগজের থেকে যাঁরা ছবিটা দেখতে এসেছেন, তাঁদেরই বা কেমন লাগবে! তারপরে ছবিটা শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর থেকে মাঝে মধ্যে হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

ছবি শেষ হওয়ার পরে দেখলাম সবার মুখে হাসি। নিশ্চিন্ত হলাম। পরে আমরা পাঁচজন জাতীয় পুরস্কার পেলাম।’ এক একদিন নতুন সব গল্প করতেন। একদিন কানন দেবী আর সুশীল মজুমদারকে নিয়ে অনেক মজার গল্প বললেন। টালিগঞ্জের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে কাজের ফাঁকে গাছ থেকে আম পাড়ার ঘটনা শোনালেন। (Bharati Devi)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: পরবাসী, চলে এসো ঘরে
অনেকদিন খোঁজ খবর না পেলে ফোন করতেন, সেই সময় মোবাইল ফোন সবে বাজারে এসেছে কিন্ত উনি ল্যান্ডলাইন থেকেই ফোন করতেন। ওঁর ভাইপো আমায় ফোন করে বলতেন, ‘পিসিমা কথা বলবেন।’ ফোন ধরে বিশদে সবার খোঁজ খবর নিতেন। রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত ‘নটির পূজা’ চলচ্চিত্রর বেশ কয়েকটি স্থির চিত্র ওঁর সংগ্রহে ছিল, আমার রবীন্দ্রপ্রীতির কথা শুনে ভারতীদি সেগুলো আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন, সঙ্গে অনেকগুলো বাংলা ছায়াছবির বুকলেটও দিয়েছিলেন। সেইদিনই উত্তর কলকাতার হারিসান রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখার অভিজ্ঞতা ভাগ করেছিলেন। (Bharati Devi)

ভগিনী নিবেদিতা ছবিটার কথা আমরা প্রায় সকলেই জানি কিন্ত ভারতীদির প্রযোজনা করা স্বামীজী ছবির কথা আমার আগে জানা ছিল না। ভারতীদির কাছে শুনেছিলাম যে ছবিটির প্রযোজনা করেছিলেন ভারতী দেবী এবং অমর মল্লিক যৌথভাবে। ওই ছবিতে নিবেদিতার ভূমিকায় অভিনয় করেন ভারতীদি। সেই ছবির কিছু লবিকার্ড উনি আমার জন্য রেখে দিয়েছিলেন এবং পরে দিয়েও ছিলেন। (Bharati Devi)
আগেই বলেছি ভারতীদির বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত করার সুবাদে তৈরি হয়েছিল সুসম্পর্ক। আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল ওঁর কাছ থেকে বাংলা ছবির জগতের অতীত দিনের সব গল্প শোনার। ওঁর প্রথম দিকের ছবির আর এক নায়ক জ্যোতিপ্রকাশের কথা খুব বলতেন। তাঁর সঙ্গে সম্ভবত ভারতীদি ‘ডাক্তার’ ছবিতে কাজ করেছিলেন। (Bharati Devi)
ভারতীদির বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত করার সুবাদে তৈরি হয়েছিল সুসম্পর্ক। আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল ওঁর কাছ থেকে বাংলা ছবির জগতের অতীত দিনের সব গল্প শোনার।
জন্মদিনে ভারতীদির বাড়িতে গেলে খুব আনন্দ করে দেখাতেন তাঁকে কে কী উপহার দিয়েছে। সরল মানুষ, আরও সরল ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। অসম্ভব বড় অভিনেত্রী, জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে তরুণ মজুমদারের ‘আলো’ ছবিতে তাঁর অসাধারণ অভিনয় ভোলার নয়। ভাবতে লজ্জা করে যে বর্ষিয়াণ এই অভিনেত্রীর ভাগ্যে কোনও পদ্ম সম্মান জোটেনি, দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার তো দূর অস্ত। শীতের এক রাতে চলে গিয়েছিলেন, খবর পেয়ে ভোর হওয়ার পরেই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম ওঁর ঢাকুরিয়ার বাড়িতে। বাংলা চলচ্চিত্রর কোনও ব্যক্তিকে দেখতে পাইনি কোয়েল মল্লিক ছাড়া। আর ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। (Bharati Devi)

পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র নন্দনে নিয়ে গেলে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টাখানেক সরকারি স্তর থেকে একটা মালা আসার জন্য! এমন প্রবাদপ্রতিম মানুষের প্রস্থান হয়েছিল নীরবেই। আজও ঢাকুরিয়া অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করার সময় ভারতীদির হাসিমুখ চোখে ভাসে। (Bharati Devi)
ছবি- লেখক
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।