(Buddhadeb Guha)
চৈত্রশেষে অরণ্যে গিয়ে পূর্ণিমার মধ্যরাতে তিনি নির্জনে দাঁড়িয়ে থাকা জাকারান্ডা গাছের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন, শীতের ভোরে নাম না জানা জংলী ফুলের রং তাঁর মন রাঙিয়ে দেয়। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের নির্জনতায় ছুটির সঙ্গে ভাললাগা ভাগ করে নেন, এমন মানুষ তো একজনই, তিনি বনবিহারী বুদ্ধদেব গুহ। (Buddhadeb Guha)
‘কোয়েলের কাছে’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘বাংরিপোসির দু’রাত্তির’, ‘লবঙ্গির জঙ্গলে’ ইত্যাদি বইগুলো পড়া বারণ ছিল কারণ এগুলো নাকি বড়দের বই।
আর পাঁচজন বাঙালির মতো ঋজুদার সঙ্গে পরিচয়, ‘মউলির রাত’, ‘বনবিবির বনে’ ইত্যাদি বই পড়ে। ‘কোয়েলের কাছে’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘বাংরিপোসির দু’রাত্তির’, ‘লবঙ্গির জঙ্গলে’ ইত্যাদি বইগুলো পড়া বারণ ছিল কারণ এগুলো নাকি বড়দের বই। আসলে এইসব বইতে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে মানব-মানবীর সম্পর্কের নানাদিক। আমার এক পিসি ছিলেন বুদ্ধকাকুর লেখার একজন নিবিষ্ট পাঠক। আমরা সবাই জানতাম যে বুদ্ধকাকু, চুনী কাকু অর্থাৎ চুনী গোস্বামী এবং আমার বাবা, এই তিনজনের বন্ধুত্ব শৈশব থেকে কারণ তিনজনই পড়তেন দেশপ্রিয় পার্কের তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। এরপর বাবা আর বুদ্ধকাকু দক্ষিণীতে একসঙ্গে বহুদিন গান শিখেছেন। (Buddhadeb Guha)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: নিমাইসাধন বসু
এই সম্পর্ক আজীবন ছিল। যাইহোক, আমার পিসির অনুরোধে বাবা একদিন আমাদের নিয়ে গেল ওয়াটারলু স্ট্রিটে বুদ্ধকাকুর চার্টার্ড ফার্মের অফিসে। ওখানে গিয়ে দু’জনের অনেকদিনের জমে থাকা গল্পের পরে বুদ্ধকাকু আলমারি খুলে ওঁর লেখা অনেকগুলো বই বের করে আমাদের তিনজনকে উপহার দিলেন, অবশ্যই নাম লিখে আর সই করে। আমরা আপ্লুত। আমাকে দেওয়া বইগুলোর মধ্যে ছিল ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, বুদ্ধকাকু নিজের হাতে বইটা দিয়েছেন তাই পড়তে আর কোনও বাধা নেই। (Buddhadeb Guha)

হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে গেলাম! পড়ে ফেললাম একটু উষ্ণতার জন্য। প্রথম যৌবনে গল্পের নায়িকা ছুটি আমার মনেও দোলা দিয়ে গেল। মা কলকাতা দূরদর্শনে থাকাকালীন একটা অনুষ্ঠানে বুদ্ধকাকুকে অংশ নিতে অনুরোধ করেছিল কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। মা বাবাকে সে কথা বলাতে, বাবা ফোন করে মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বন্ধুপত্নীর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত উনি অনুষ্ঠান করলেন। (Buddhadeb Guha)
মনে আছে দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ পার্ক রোডে বুদ্ধকাকুর ফ্ল্যাটে বাবা-মার সঙ্গে একাধিকবার গিয়েছি। ভীষণ খাওয়াতে ভালোবাসতেন। ভাল ব্রান্ডের চা খাওয়া ওঁর জীবনের একটা অন্যতম বিলাসিতা ছিল। বাড়িতে যখন যেতাম, তখন ওঁর মুখে দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন অরণ্যের বৈচিত্র্যের কথা শুনতে বেশ লাগত। হেন অরণ্য নেই, যেখানে যাননি একমাত্র চাঁদের পাহাড় ছাড়া! (Buddhadeb Guha)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: অলোক আলপনায়
মার্জিত, সুন্দর এক মনের মানুষ ছিলেন বুদ্ধকাকু। একবার দোলের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে কলকাতা দূরদর্শনের গল্ফগ্রীণ-এর স্টুডিওতে এলেন কিন্তু দূরদর্শনের কারিগরি বিভাগের অপদার্থতায় সময় তার নিজের নিয়মে বয়ে যাচ্ছিল কিন্তু রেকর্ডিং শুরু হচ্ছিল না!
অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পরে ক্যামেরাম্যান, ফ্লোর ম্যানেজার, সবার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে শুরু করলেন, আর মাঝে-মধ্যে অনুষ্ঠানের প্রযোজককে সাবধান করে দিয়ে বলছিলেন আর ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করব, তারপর কিন্তু চলে যাব। শেষে অবশ্য রেকর্ডিং শুরু হয়েছিল। (Buddhadeb Guha)

একটা আশ্চর্যের বিষয় হল, বুদ্ধকাকু যখনই আমাদের বাড়িতে এসেছেন, প্রতিবারই আমরা বাড়িতে ছিলাম না। সেই সময় মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। তাই আগে থেকে ফোনে যোগাযোগ করে কারুর বাড়ি যাওয়ার চল ছিল না! অনেকবার বাবাকে বলেছিলেন, ‘তোদের বাড়িতে গিয়ে একবার ভুনা খিচুড়ি খাব।’ (Buddhadeb Guha)
আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেই দিন আর আসেনি। জীবনের শেষ প্রান্তে চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার জন্য খুব বেশি কোথাও বেরোতে পারতেন না। একবার কলামন্দিরে একটা অনুষ্ঠানে দেখা, আমার দিকে অনেক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছেন দেখে আমি বললাম, ‘কাকু, আমি অঞ্জনের ছেলে।’ এক কথায় চিনতে পারলেন, হেসে বললেন, ‘বাবা কেমন আছে? এখনও চালিয়ে যাচ্ছে?’ মানে বলতে চাইছিলেন বাবা এখনও সিগারেট খাচ্ছেন কী না। আমার বাবার ভীষণ ধূমপানের নেশা ছিল আমৃত্যু। (Buddhadeb Guha)
কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘জানো, সামনের বছর আমাদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর, বড় করে পালন করব বলে টাকাও সরিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলাম না।
পরিচিত দুটি ছেলে একবার আমায় বলেছিল ওদের রেডিওর জন্য বুদ্ধদেব গুহর একটা ইন্টারভিউ নিতে চায়। ফোন করলাম, এক কথায় রাজি হলেন। নির্ধারিত দিনে ওঁর সানি টাওয়ারের বাড়িতে গেলাম। অনেক গল্প করলেন, একাধিকবার বাবা এবং মায়ের খোঁজ নিলেন। অনেক কিছু খাওয়ালেন। সেদিনের গল্পের মাঝখানে ওঁর একটা কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার কিছুদিন আগেই ঋতু গুহ চলে গেছেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘জানো, সামনের বছর আমাদের বিয়ের পঞ্চাশ বছর, বড় করে পালন করব বলে টাকাও সরিয়ে রেখেছিলাম কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলাম না। ঋতু চলে গেল, আসলে সব কিছুর জন্য কপাল থাকা চাই। (Buddhadeb Guha)

আমার পরিচিত দুটি ছেলে ওঁর অটোগ্রাফের জন্য কাগজের খোঁজ করতেই বললেন, ‘কাগজের কী প্রয়োজন? সামনের আলমারিটা খোলো, আমার লেখা বইয়ের থেকে কয়েকটা পছন্দ করে নাও, আমি বইতেই সই করে দিচ্ছি।’ আমি নীরবে লক্ষ করছিলাম তাদের বই নেওয়া আর শেষ হচ্ছে না, লজ্জাও করছিল। শেষে বুদ্ধকাকুই বললেন, ‘তোমরা তো নিয়েই যাচ্ছ, আমার আপনজন অঞ্জন-মধুশ্রীর ছেলেকে এবার কটা বই নিতে দাও।’ আমি বেশ লজ্জিত হয়ে মাত্র দুটি বই নিলাম, সেটা দেখে উনি আবার বললেন, ‘তুমি আরও কয়েকটা বই নাও, আমি বাবা-মাকে পাঠাব। আমার এখন চেয়ার ছেড়ে উঠতে বেশ অসুবিধে হয়, তাই তুমিই বের করে নাও।’ (Buddhadeb Guha)
পাঠকদের শিখিয়েছেন অরণ্যকে ভালবাসতে! অগণিত পাঠক আর ওঁর অনুরাগীরা ওঁর চোখ দিয়ে প্রকৃতিকে জেনেছে আর ভালবেসেছে।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে বুদ্ধদেব গুহর লেখা বই কোনওদিনও কিনে পড়তে হয়নি। সবই উনি দিয়েছিলেন। এহেন লেখকের কপালে কোনও পুরস্কার জোটেনি! অবশ্য উনি কোনওদিনই কোনও পুরস্কারের প্রত্যাশী ছিলেন না। পাঠকদের শিখিয়েছেন অরণ্যকে ভালবাসতে! অগণিত পাঠক আর ওঁর অনুরাগীরা ওঁর চোখ দিয়ে প্রকৃতিকে জেনেছে আর ভালবেসেছে। অরণ্যের সবুজ বনানীর ঘ্রাণে নিজের জীবনের আনন্দ আর শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। আজ তিনি কোন অরণ্যের উপত্যকায় ঘুমিয়ে রয়েছেন, জানি না তবে ‘জঙ্গলের জার্নাল’-এর লেখককে হারিয়ে প্রকৃতিও আজ রিক্ত হয়ে গেছে। কে আর দরদভরা কণ্ঠে গেয়ে উঠবে, ‘সহসা ডালপালা তোর উতলা যে, ও চাঁপা ও করবী।’ (Buddhadeb Guha)
ছবি সৌজন্য- লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।