পণ্ডিত রবিশঙ্কর (Pt. Ravishankar)— বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কীভাবে ব্যাখ্যা করব জানি না। ওঁকে নানান সময়ে, নানান দেশে, নানান অবস্থানে বারবার দেখেছি। কিন্তু কখনওই মনে হয়নি উনি একজন ভিন্ন জগতের মানুষ। অন্যান্য অনেক নামজাদা, ভুবনবিখ্যাত শিল্পী বা মানুষের সঙ্গে মিশেছি, কিন্তু রবুদার মতো এমন বন্ধুত্ব কারও সঙ্গেই হয়নি। যেমন, একদিন, খুব সম্ভব ১৯৮৭ সাল, তখনও মোবাইল আসেনি। সকালে ল্যান্ড ফোনে রিং হল। আমি অভ্যাসমতো ধরলাম, হ্যালো…
— কে ইন্দ্রাণী?
— হ্যাঁ
— কেমন আছ?
— কে বলছেন?
— আমাকে সবাই পণ্ডিত রবিশঙ্কর বলে।

আমি আকাশ থেকে পড়ে প্রায় চিৎকার করে বললাম,
রবুদা ! কী হয়েছে? আপনি এখন কোথায়? আমেরিকায়?
— না গো এই ভারতবর্ষে। কলকাতায়
— ও মা কবে এলেন?
— এই তো সবে এলাম
— ও তাই? কবে প্রোগ্রাম?
অমি জানতাম একমাত্র প্রোগ্রাম থাকলেই প্রধানত কলকাতায় আসতেন রবুদা।
— হ্যাঁ, প্রোগ্রাম একটা আছে। কী, তা বলছি। আগে বল তো, কাঁথাস্টিচের শাড়ি কোথায় পাওয়া যায়?
— ওমা! আপনি কাঁথাস্টিচের শাড়ি কী করবেন?
— একটু দরকার আছে। বল না।
আমি হিন্দুস্তান পার্কের একটা দোকানের হদিশ ওঁকে দিলাম।
— শঙ্করকে একবার দেবে?

শঙ্করের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলছেন, কী ব্যাপার কিছুই বুঝছি না। উদগ্রীব হয়ে আছি। ফোন রেখে শঙ্কর বলল, রবুদা (Pt. Ravishankar) সুকন্যাকে বিয়ে করছেন।
আমি এত অবাক হয়েছিলাম ‘কী!’— এই একটা শব্দ ছাড়া প্রায় দশমিনিট কোনও কথাই বলতে পারিনি। স্থানুর মত দাঁড়িয়েছিলাম। শঙ্করের কোনও তাপ উত্তাপ নেই। ও আসলে এই খবরের কিছুটা আভাস আগেই পেয়েছিল। হায়দ্রাবাদ যেতে হবে। রবুদার বিয়ে attend করতে হবে— কারও সঙ্গে ফোনে সেই ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। আমি ছবিগুলো রিলের মতো চোখের সামনে ভেসে চলে যেতে দেখছি। অন্নপূর্ণা শংকর— রবুদার বিবাহিত স্ত্রী। কমলাদি— রবুদার সর্বক্ষণের সঙ্গী। শুভ— শুভেন্দ্রশংকর, রবুদা-অন্নপূর্ণাদির সন্তান। নোরা জোনস্, গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পাওয়া আমেরিকান গায়িকা, স্যু জোনস্ এবং রবুদার সন্তান। স্যু জোনস্ নিউ ইয়র্কে থাকতেন। রবুদার সঙ্গে স্যু জোনস্-এর সম্পর্ক ছিল, স্যু রবুদাকে বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু রবুদার সন্তানের মা হতে চেয়েছিল। সেই সন্তানের আজ পৃথিবীব্যাপী নাম, নোরা জোনস্— মায়ের পদবীই সে ব্যবহার করে।

আসলে রবুদার অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। অন্নপূর্ণা শংকর, রবুদার প্রথম স্ত্রী ডিভোর্স দিতে চাননি। না চাওয়ার অনেক কারণ ছিল। তার মধ্যে প্রধান হল শুভেন্দ্রশংকর, রবুদা-অন্নপূর্ণাদির একমাত্র সন্তান। অসম্ভব প্রতিভাবান। কিন্তু অকালে তার মৃত্যু হয়। আমেরিকাতে থাকত। সেতারে দুর্দান্ত দখল ছিল। আমেরিকান স্ত্রী। ইঙ্গবঙ্গ fusion-এ খুব দক্ষতা ছিল। অন্নপূর্ণাদিও দুর্দান্ত সেতার এবং বীণা বাজাতেন। মুম্বাইতে ওঁর বাড়িতে সাক্ষাৎ হয়েছিল। খুব সাধাসিধে মাটির মানুষ। দেখলেই মা বলে প্রণাম করতে ইচ্ছে হত। ভারী মিষ্টি ব্যবহার। মিষ্টি মানুষ। প্রচুর ছাত্রছাত্রী। রবুদার প্রতি প্রচণ্ড ভালবাসা। এরকমও শোনা যায়, অন্নপূর্ণাদি রবুদার চেয়েও বেশি প্রতিভাবান ছিলেন। এবং রবুদার পথে যাতে ওঁর প্রতিভা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেইজন্য প্রফেশনাল পারফরম্যান্স থেকে দূরে থাকতেন। সন্তান, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানই ছিল তাঁর একমাত্র ভালবাসা। একমাত্র সহায়।

কমলা চক্রবর্তী, বিখ্যাত Film director অমিয় চক্রবর্তীর স্ত্রী, দীর্ঘদিন রবুদার সঙ্গী ছিলেন। বিয়ে হয়নি। কারণ, অন্নপূর্ণাদি ডিভোর্স দেননি, তাঁর ছোটবেলার ভালবাসাকে তিনি হারাতে চাননি।
ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের বোন, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের যোগ্য কন্যা অন্নপূর্ণা এবং রবিশঙ্করের বিয়ে হয় খুব ছোট বয়সে। তখন রবিশঙ্কর সদ্য যুবক একুশ-বাইশ বছরের এবং অন্নপূর্ণার ষোলো-সতেরো। মাইহারে রবুদার মা ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের বাড়িতে রবিশঙ্করকে সংগীত শিক্ষার জন্য যখন রেখে আসেন, তখন রবুদার বয়স পনেরো-ষোলো। ওস্তাদজী তাঁর অন্যান্য সন্তানের থেকে আলাদা করে দেখতেন না রবুদাকে। সন্তানস্নেহে তাঁকেও সংগীত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। তার প্রমাণ আমরা পরবর্তীকালে পেয়েছি, সে ইতিহাস সবারই জানা।

বিয়ের পর দুজনে মুম্বাইতে আসেন। অর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো না। একটি বাড়ির সিঁড়ির নীচে একটা ছোট্ট ঘরে সংসার পাতলেন দুজনে। ধীরে ধীরে স্বাচ্ছল্যের মুখ দেখলেন। সন্তান এল। রবুদা ক্রমশ বিখ্যাত হচ্ছেন তখন। পাশে সর্বংসহা স্ত্রী। শ্যালক ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব। তিনিও দুর্দান্তভাবে এগিয়ে চলেছেন। তবে রবুদার মিষ্টি ব্যবহার এবং সৌম্যদর্শন চেহারা মানুষকে টানত। আস্তে আস্তে অন্নপূর্ণাদি, শুভেন্দ্রশংকরকে ছাপিয়ে রবুদা ক্রমশ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লেন। অন্নপূর্ণাদি তাঁর সন্তান এবং ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। রবুদা তাঁর অন্তরে চিরকাল সুখের ঘরে বিরাজ করতেন। কোনোদিন কোনও বিরূপ কথা তাঁর স্বামী সম্বন্ধে জনসমক্ষে উচ্চারণ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁদের দুজনের স্মৃতির অনেক স্বাক্ষর উদ্ধার হয়। তিনি সযত্নে সেগুলো আগলে রেখেছিলেন।
তাঁর জীবৎকালে সন্তান এবং স্বামী-মৃত্যুর শোক তাঁকে সামলাতে হয়েছে। তবে শেষবেলায় তিনি ডিভোর্স দিয়েছিলেন। তাই রবুদা সুকন্যাকে বিয়ে করছেন। বিয়ে করলেন কোলে সাত বছরের অনুষ্কাকে নিয়ে। একেবারে বসানো বাবার মুখ। সুকন্যা রবুদার এক ছাত্রের স্ত্রী। লন্ডনে থাকতেই পরিচয়। সন্ধানসম্ভবা হবার পর সুকন্যা ও তার স্বামী রাজনের বিচ্ছেদ হয়ে যায়, এবং মেয়ের সাতবছর বয়সে রবুদা ডিভোর্স পাবার পর কমলাদিকে ছেড়ে অনুষ্কাকে কোলে নিয়ে রবুদা বিয়ে করলেন।
শংকর হায়দ্রাবাদে উড়ে গেল। আমার ইচ্ছে হয়নি।
(চলবে)
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia
*আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব