স্মৃতির আকাশ থেকে
(Shankha Ghosh)
অল্প কথার মানুষ, নীরবতাই তাঁর ভাষা। ছোটবেলায় রবীন্দ্রজয়ন্তী কাছে এলেই দেখতাম মায়ের ব্যস্ততা বেড়ে যেত। কবির জন্মদিনে প্রতিবার দূরদর্শনে নতুন অনুষ্ঠান কবিকে নিয়ে। কখনও ‘জন্মদিনের ধারা’, আবার কখনও ‘রূপের অদৃশ্য অন্তপুরে’, আবার ‘মঙ্গপুতে রবীন্দ্রনাথ’। এইসব অনুষ্ঠানের নেপথ্যে যে মানুষটির অবদান থাকত, তিনি শঙ্খ ঘোষ। কোন দৃশ্যর পরে কোন গান, গানের কোন লাইন থেকে শুরু, সঙ্গে কবির কোন ছবিটি থাকবে, সব কিছু ঠিক করে দিতেন শঙ্খ ঘোষ। মায়েদের কাছে তিনি শঙ্খদা। গল্প শুনেই মানুষটিকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। পরিচয় অনেক বছর পরে তাঁর ঈশ্বরচন্দ্র আবাসনের ফ্ল্যাটে। অবশ্য সাংবাদিকতা করার সুবাদে রবীন্দ্র বিষয়ক কোনও প্রশ্ন না জানা থাকলে দূরাভাষের মাধ্যমে তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া অবশ্যই মায়ের পরিচয় দিয়ে। বলাই বাহুল্য কোনওবারই নিরাশ হতে হয়নি। সহজেই উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে দূর থেকে তাঁকে দেখে আনন্দ পেয়েছি। কাছে গিয়ে পরিচয় করবার সাহস এবং সুযোগ কোনওটাই হয়নি। ২০১১ সাল, রবীন্দ্রজন্মের সার্ধশতবর্ষ, একটি বহুজাতিক বেসরকারি সংস্থা ঠিক করল আমার কাছে থাকা রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক কিছু সংগ্রহ নিয়ে বই প্রকাশ করবে। (Shankha Ghosh)
একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি : অরিজিৎ মৈত্র
একদিন চলেও গেলাম ওঁর বাড়িতে। বাইরের ঘরে বসে অপেক্ষা করছি, ঘরের চারিদিকে শুধু বই! গৃহকর্তা ঘরে আসার আগেই আমার সামনে এল এক প্লেট মিষ্টি। একটু পরেই শঙ্খদা এলেন, এসে জিজ্ঞাসা করলেন মা কেমন আছেন। এরপর এল বইয়ের কথা। সব শুনলেন, তারপর বললেন ভূমিকা লিখে দেবেন কিন্তু একটা শর্ত রয়েছে সেটা হল প্লেটের সব মিষ্টিগুলো খেয়ে শেষ করতে হবে। ভেতরে গিয়ে ভূমিকা লিখে নিয়ে এলেন। সেই ভূমিকার একটা লাইন আজও মনে আছে, ‘অরিজিতের যত্ন করে জমিয়ে রাখা সৌখিনতা’। একটা লাইনই অনেক কথা বলে দেয়। এমন ভাষা শুধু শঙ্খদার পক্ষেই লেখা সম্ভব! আমার আগের একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে বইতে ছাপা বিশেষ সেই ডায়রিতে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক কিছু লিখে দেওয়ার জন্য যখন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে অনুরোধ করেছিলাম, তখন উনি বলেছিলেন যেখানে শঙ্খদা লিখেছেন, সেখানে আমি কী লিখব! (Shankha Ghosh)

অনেক কথার মাঝে বলতে ভুলে গিয়েছি যে ওই বইতে ছাপা ডায়রিতে শঙ্খদাও লিখেছিলেন। খুব সহজে পাওয়ার ফলে তখন সেই লেখাটির মূল্য বুঝিনি। বই ছাপার পরে ভুলেই গিয়েছিলাম শঙ্খদার হাতে লেখা সেই ভূমিকাটি কোথায় আছে। একবার মনে হয়েছিল বই ছাপার সময় ওই লেখাটিও প্রেসে দিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু কয়েক বছর আগে পুরোনো কিছু কাগজকে বাতিল করতে বসে একটি সাদা খাম চোখে পড়ে। ফেলে দেওয়ার জন্য খামটি ছিঁড়ে ফেলবার আগে কী মনে হল ভাবলাম একবার দেখাই যাক না খামের ভেতর কী আছে। খুলে দেখি শঙ্খদার হাতে লেখা সেই ভূমিকাটি। কাগজের ভাঁজটিও ওঁর করা। সেদিনের হারিয়ে যাওয়া ভূমিকাটি হাতে পেয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে থাকলাম, মনে হচ্ছিল এক মহামূল্য হীরকখণ্ড অপ্রত্যাশিত ভাবে হাতে এল! (Shankha Ghosh)
অনেক কথার মাঝে বলতে ভুলে গিয়েছি যে ওই বইতে ছাপা ডায়রিতে শঙ্খদাও লিখেছিলেন। খুব সহজে পাওয়ার ফলে তখন সেই লেখাটির মূল্য বুঝিনি।
সৌমিত্রকাকুর (চট্টোপাধ্যায়) ৮০তম জন্মদিন পালনের জন্য আমাদের তপন সিংহ ফাউন্ডেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা ঠিক করেছিল একটি বিশেষ পুস্তিকা প্রকাশ করবে। তার মধ্যে ওঁর লেখা কয়েকটা কবিতাও থাকবে। সৌমিত্রকাকুই তখন বলেছিলেন শঙ্খদা কবিতাগুলো নির্বাচন করে দিলে ভাল হয়। ফোন করে শঙ্খদাকে সেই কথা বলতে উনি আমায় আবার ওঁর বাড়িতে যেতে বললেন। তারপরে একদিন খানচারেক কবিতাও নির্বাচন করে দিলেন স্মারক পুস্তিকায় ছাপার জন্য। মনে আছে সেইদিন শঙ্খদার বাড়িতে সারা সন্ধ্যা কেটেছিল শুধু কলকাতার বিভিন্ন বিখ্যাত দোকানের মিষ্টি নিয়ে গল্প করে। নকুড়ের দোকানে যাতায়াত থাকলেও শঙ্খদার কাছেই প্রথম শ্যামপুকুরের চিত্তরঞ্জন মিষ্টির দোকানের কথা শুনি। ওইদিনই দূরদর্শনের কয়েকটি অনুষ্ঠানের কথা হচ্ছিল, ‘মঙ্গপুতে রবীন্দ্রনাথ’ অনুষ্ঠানের কথা উঠলে আমি বললাম ওই তথ্যচিত্রটির একটা রেকর্ডিং আমার কাছে রয়েছে। উনি সেই অনুষ্ঠানটা ফিরে দেখতে চেয়েছিলেন। পরে একদিন তাঁর বাড়ি গিয়ে অনুষ্ঠানের একটা ডিভিডি দিয়ে এসেছিলাম, সঙ্গে ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর একটা কবিতার সিডি, যেটা প্রকাশ পেয়েছিল গীতাঞ্জলির শতবর্ষে। (Shankha Ghosh)

সংকলন ও বিন্যাস করেছিলেন শঙ্খদা। যে কোম্পানি থেকে সেটা প্রকাশ পেয়েছিল, তারা সিডির কোনও কপিই ওঁকে দেয়নি। এসবের পাশাপাশি চলছিল আমার সাংবাদিক জীবনের ব্যস্ততা। খবর এল শঙ্খদা জ্ঞানপিঠ পুরস্কার পেয়েছেন। আপিস থেকে আমাকে বলা হল বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য শঙ্খদাকে নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখতে। পড়লাম মহাসমস্যায়। ব্যক্তি শঙ্খদার কাছে একটু আধটু যাতায়াত থাকলেও ওঁর লেখা কবিতা আমার বিশেষ পড়া ছিল না, আর সত্যি বলতে, বেশিরভাগ কবিতা আমি বুঝতেও পারি না। সেটা অবশ্যই আমার অজ্ঞতা। যাইহোক দুরু দুরু বক্ষে একটা লেখা লিখলাম। একদিন শঙ্খদাকে গিয়ে দিয়েও এলাম, এও বললাম যে আমি কিন্তু আপনার কবিতা নিয়ে খুব একটা কিছু লিখতে পারিনি কারণ আমার বেশিরভাগই পড়া নেই। কিন্তু ওঁর লেখা ‘ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ’ পড়ার মুগ্ধতার কথাটা জানাতে ভুলিনি। শুনে শুধু একটু হেসেছিলেন। (Shankha Ghosh)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: পরবাসী, চলে এসো ঘরে
আমি যে সংবাদপত্রে সেইসময় কর্মরত ছিলাম, তার সম্পাদক জানতেন শঙ্খদার সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ যোগাযোগ রয়েছে তাই তিনি আবদার করে বসলেন জ্ঞানপিঠ পাওয়ার পরে শঙ্খদার কী প্রতিক্রিয়া সেই সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। আর সেটা পাওয়া যে কত কঠিন তা আমিই জানি। শঙ্খদার মতো মানুষ নিজের সম্পর্কে প্রচারের জন্য কখনই উদগ্রীব হননি। আমার বন্ধু এবং সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম শঙ্খদার বাড়ি। জ্ঞানপিঠ প্রাপ্তির জন্য ওঁকে শুভেচ্ছা জানাতে সঙ্গে নিলাম ফুল। মা একটা ছোট্ট চিঠি লিখে দিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে নিজে যেতে পারেননি কারণ তখন পা ভেঙে বাড়িতে বন্দি, কিছুদিন আগে অপারেশন হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারেও শঙ্খদার উষ্ণ অব্যর্থনা। ফুল হাতে দিয়ে প্রণাম করে মা’র কথা বললাম, চিঠিটাও বাড়িয়ে দিলাম ওঁর দিকে। মার অসুস্থতার কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে ঘরের চারিদিকে এক টুকরো কাগজ খুঁজতে লাগলেন, উদ্দেশ্য মায়ের ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখবেন এবং ফোন করে খোঁজ করবেন মা কেমন আছেন। এমনই ছিল শঙ্খদার আন্তরিকতা। (Shankha Ghosh)
যাক, যে কারণে সেদিন ওঁর বাড়িতে আমাদের আগমন, সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পূর্বের মতো আবারও প্লেটভর্তি মিষ্টি এল এবং সেগুলো শেষ করবার হুকুম জারি হল জ্ঞানপীঠজয়ী কবির পক্ষ থেকে। আমার বন্ধু কোনও ভনিতা না করেই ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়ে আপনারা অনুভূতি কেমন?’ অল্প হেসে শঙ্খদা খুব মৃদু স্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘গত কয়েকদিনে আমি কোনও সংবাদপত্রের কাছে কোনও ভাবেই মুখ খুলিনি’। আমার বন্ধুটিও ছাড়বার পাত্রী নয়, সে আবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এই পুরস্কারটা কি কোনও একটা বিশেষ বইয়ের জন্য দেওয়া হল না আপনার জীবনের সমগ্র সাহিত্যসৃষ্টির জন্য? আমি সেদিন ওঁর বাড়িতে যাওয়ার আগে দক্ষিণ কলকাতার একটি বইয়ের দোকান থেকে শঙ্খদার লেখা, ‘শুনি শুধু নীরব চিৎকার’ শিরোনামের বইটি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। (Shankha Ghosh)
আমি সেদিন ওঁর বাড়িতে যাওয়ার আগে দক্ষিণ কলকাতার একটি বইয়ের দোকান থেকে শঙ্খদার লেখা, ‘শুনি শুধু নীরব চিৎকার’ শিরোনামের বইটি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম।
সেই সময় জনৈক পুস্তকবিক্রেতা আমাকে বলেন এই বইটার জন্যই শঙ্খ ঘোষকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এই কথাটি শঙ্খদাকে বলতেই খুব হাসলেন বললেন, ‘ব্যবসা করবার জন্য ভাল বুদ্ধি ঠাওরেছে তো!’ সেদিন আমরা শঙ্খদার কাছেই জানতে পারলাম যে অতীতে কোনও একটি বিশেষ বইয়ের জন্য এই পুরস্কারটি দেওয়া হত কিন্তু বর্তমানে খানিকটা ওই জীবনকৃতি সম্মান হিসেবেই জ্ঞানপীঠ দেওয়া হয়। সেদিন যখন চলে আসি, দরজা পর্যন্ত শঙ্খদা এলেন এবং দাঁড়িয়ে থাকলেন, আমরা যখন একদম নীচে মানে একতলায় নেমে এলাম তখন দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলাম। আমরা কথায় কথায় বলি তিনি বাংলার বিবেক কিন্ত সত্যি কি আমরা তাঁকে অনুসরণ করি, তাঁর সৌজন্যবোধ থেকে কিছু শিখেছি! আমার কন্যার খুব ইচ্ছে ছিল শঙ্খদার কাছে একবার যাওয়ার কিন্তু এই ছোট একটা কারণে শঙ্খদাকে বিরক্ত করতে মন চায়নি। ওই বছরই অমর্ত্য সেনের একটা বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ উপলক্ষে কলকাতার আইসিসিয়ারে শঙ্খদাও এসেছিলেন। সেইখানে আমি কন্যাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। (Shankha Ghosh)

অনুষ্ঠান শেষে অল্প কথার মানুষ শঙ্খদা ওকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন সেদিন উনি ওঁর স্বরচিত কবিতা আবৃত্তির একটা সিডি তে আমার কন্যাকে সই করে দিয়েছিলেন। অমর্ত্য সেন এবং শঙ্খদা দু’জনকে কাছ থেকে দেখে ও ভীষণ খুশি হয়েছিল। শেষবার শঙ্খদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল নন্দনে। কলকাতার এক নামি প্রকাশন সংস্থার অনুষ্ঠানে গুলজার এসেছিলেন। শঙ্খদাও ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে নন্দন-৪ এর এক কোণে একাই নীরবে দাঁড়িয়েছিলেন, আমি একটু কাছে এগিয়ে যাওয়ার পরে হাসলেন কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমাকে চিনতে ওঁর একটু অসুবিধে হচ্ছে তাই নিজেই কাছে গিয়ে বললাম, ‘শঙ্খদা আমি মধুশ্রীর ছেলে অরিজিৎ’। কোনও কথা নয়, স্নেহমিশ্রিত আলিঙ্গনে আমাকে বন্দি করলেন। সেদিনের সেই ছবিটাই মনের এক কোণে রেখে দিয়েছি আজ পর্যন্ত। ভয়াবহ করোনাকালের সময় ওঁর প্রস্থানের কোনও ছবি দেখতে চাইনি কোনওদিন, শেষ দেখার ওই স্নেহের পরশটাই যেন আজীবন আমার অনুভূতিতে থেকে যায়। (Shankha Ghosh)
ছবি- লেখক
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।