স্মৃতির আকাশ থেকে
ছেলেবেলায় ল্যান্সডাউন রোড আর মনোহর পুকুরের মোড়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শিশুমঙ্গল অর্থাৎ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠানের দিকে যাচ্ছেন একটা হুডখোলা জিপে, রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন, মাথায় ঘোমটা আর সেই জিপগাড়ির চালকের আসনে বসে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়(Siddhartha Shankar Roy)। সেদিনের সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মাঝে-মধ্যে দেশপ্রিয় পার্কে টেনিস খেলতে আসতেন। ভীষণরকম হ্যান্ডসাম একজন মানুষ। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের আলোচনায় যাচ্ছি না, সে স্বতন্ত্র বিষয় কিন্তু তাঁর মতো মানুষেরা যখন রাজনীতি করতেন, তখন আমাদের রাজ্য তথা দেশের রাজনীতি এতটা কলুষিত হয়নি। দূর থেকে কয়েকবার দেখলেও আলাপের সুযোগ হয়নি। প্রথম পরিচয় হয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর শ্রাদ্ধনুষ্ঠানে, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তখন পাঞ্জাবের রাজ্যপাল। সাধারণ দু’একটা কথা হয়েছিল মাত্র। (Siddhartha Shankar Roy)
একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি : অরিজিৎ মৈত্র
এর অনেক বছর পরে বিধাননগরে নারায়ণ বসুর কন্যা সুদিপা বসুর বিয়ের অনুষ্ঠানে আবার দেখা হল। তখন আবার কথা হয়েছিল। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক হুসেনুর রহমান আবারও নতুন করে আমার সঙ্গে ওঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার লেখালিখির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চাইলেন। চলচ্চিত্রর প্রতি আমার আগ্রহের কথা শুনে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্বের কথা বলেছিলেন। কথা বলে বুঝেছিলাম সেই সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রর অনেকের সঙ্গেই ওঁর খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। যাক, সেদিনের বিয়েবাড়িতে আমরা একসঙ্গে ছবি তুললাম। যাওয়ার সময় বলে গেলেন ভবানীপুরে ওঁর বেলতলার পৈতৃকবাড়িতে যেতে।
একটা বই ছিল তপন সিংহ আর আর একটা বই ছিল বিমল রায়ের ওপরে। ওঁর স্ত্রী মায়া রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
গেলাম একদিন, গিয়ে আমার সম্পাদনা করা এবং লেখা দুটো বই দিয়ে এলাম। একটা বই ছিল তপন সিংহ আর আর একটা বই ছিল বিমল রায়ের ওপরে। ওঁর স্ত্রী মায়া রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ওঁর বাড়ির খুব কাছেই মনোহর পুকুর রোডে থাকি শুনে বললেন সময় পেলে মাঝে-মধ্যে ওঁর বাড়িতে যেতে। এর কিছুদিন পরে আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা বই সম্পাদনার কাজ শুরু করলাম, প্রকাশক এম. সি. সরকার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সিদ্ধার্থ রায়ের বন্ধুত্বের কথা আগেই শুনেছিলাম, তাই একদিন ফোন করে ওঁর কাছে গেলাম। ওঁর কথা টেপ করবার আগেই মায়া রায় হাতে ঠেলা একটা রট আয়রণের টেবিলে নানারকম খাবার সাজিয়ে আনলেন।

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন আগে খাওয়া তারপর ইন্টারভিউএর কাজ। এরপর নানা স্মৃতিচারণ। বৌবাজারে নির্মল চন্দ্রর বাড়িতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওঁর প্রথম পরিচয় হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি নির্মল চন্দ্র চন্দ্র ছিলেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্রের পিতৃদেব। সিদ্ধার্থ রায় বলেছিলেন সেই সময় ওই বাড়িতে রাজনীতির পাশাপাশি গানবাজনাও হত। আরও একটা মজার ঘটনা ওঁর কাছে শুনেছিলাম উত্তমকুমারকে নিয়ে। একবার স্টার থিয়েটারের সঙ্গে উত্তমকুমার চুক্তিবদ্ধ হন সম্ভবত নাটক করার জন্য কিন্তু কোনও একটা কারণে উত্তমকুমার কাজ করতে পারছিলেন না। বিষয়টা মামলা পর্যন্ত গড়াল।
মহানায়ক তাঁর প্রিয় মানুদার সরণাপন্ন হলেন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মাথা খাটিয়ে উত্তমকুমারকে স্বস্তি দিলেন আইনজ্ঞ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।
মহানায়ক তাঁর প্রিয় মানুদার সরণাপন্ন হলেন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মাথা খাটিয়ে উত্তমকুমারকে স্বস্তি দিলেন আইনজ্ঞ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। উনি কতৃপক্ষকে চিঠি লিখে জানালেন উত্তমকুমার যখন স্টার থিয়েটারের সঙ্গে কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হন, তখন সেখানে এয়ার কন্ডিশন মেশিন বসেনি, কিন্ত বর্তমানে মেশিন বসানো হওয়ার ফলে উত্তমকুমারের শারীরিক অসুবিধা হতে পারে। ব্যস, মামলা খারিজ হয়ে গেল। এমন সব গল্প শুনে যখন ওঁর বাড়ি থেকে বেরোতাম, সব ভুলে যেতাম। কিছুটা চলে আসার পরে পকেটে রাখা অটোগ্রাফ খাতাটা জানান দিত যে সিদ্ধার্থ রায়ের সই সংগ্রহের জন্য রাখা নির্ধারিত পাতাটা খালিই রয়ে গেছে। ফোনে কথা হলে বলতেন আমার দেওয়া বইগুলো পড়ে ওঁর ভাল লেগেছে। আর একদিন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা বাসবীদি আর আমি গেলাম বেলতলার বাড়িতে। গিয়ে শুনলাম উনি বাড়িতে নেই কিন্ত খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবেন।
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: পরবাসী, চলে এসো ঘরে
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে উনি চলেও এলেন। আমরা ওঁর অফিসেই বসেছিলাম। চারিদিকে আইনের নানান বই আর বৃফগুলো সাজানো আছে। আমরা এসেছি শুনে সোজা দোতলায় উঠে না গিয়ে অফিসে ঢুকলেন। দীর্ঘদিনের বন্ধু ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়েকে দেখে খুব খুশি। গল্পের মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছে তাকে রাখা বই আর ব্রিফগুলোর দিকে। সেইদিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এগুলো ঠিকমতো সাজানো নেই, যে অর্ডারে থাকা উচিৎ সেটা নেই।’
নকশাল আন্দোলন। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে অনেক গল্প করেছিলেন সেইদিন। উঠে এসেছিল শ্রীমতি গান্ধীর প্রসঙ্গ। বলেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধী ওঁকে একদিন ডেকে বললেন, ‘আমার নাকটা খুব লম্বা, আই ক্যান স্মেল, বেশ বুঝতে পারছি পাকিস্তান খুব শীঘ্রই ভারতকে আক্রমণ করবে।’ সেইদিন সিদ্ধার্থ রায় মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘শ্রীমতি গান্ধীর কথাই ঠিক ছিল, বাস্তবে পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করল আর আমাদের সেনাবাহিনীও যোগ্য জবাব দিয়েছিল।’
প্রস্তাব শুনে উনি আবার ওঁর আভিযাত্যপূর্ণ হাসি হেসে আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আমার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়, আমার কথা শুনে লিখতে পারলে ওই পারবে।’
এতসব গল্প শোনার পরে বাসবীদি বলেছিলেন সেইসব ইতিহাস লিখে রাখতে। এই প্রস্তাব শুনে উনি আবার ওঁর আভিজাত্যপূর্ণ হাসি হেসে আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘আমার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়, আমার কথা শুনে লিখতে পারলে ওই পারবে।’
তখন ওঁর হাঁটাচলাতেও অসুবিধা হত। সেইদিনই দেখেছিলাম খুব কষ্ট করে পা টেনে টেনে হাঁটছেন। ওঁর মুখের কথা শুনে আমার আর লেখা হয়ে ওঠেনি। সেই বছরের নভেম্বর মাসে পরিণত বয়েসে উনি চলে গেলেন। বেলতলা রোডের বাড়ির বাগানে ওঁর নিথর শরীরের ওপর ফুল রেখে এলাম নীরবে। চোখ চলে গেল দোতলার জানলায়, দেখলাম ওপর থেকে দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনের সঙ্গীকে বিদায় জানবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন মায়া রায়।
ছবি- লেখক
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।