হায়দ্রাবাদ থেকে একবার ফলকনামা এক্সপ্রেসে করে কলকাতায় ফিরছি। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে টিকিট চেকার এসে তাঁর নিজের কাছে রাখা তালিকার সঙ্গে নামগুলি মিলিয়ে নিচ্ছেন, এক জায়গায় এসে তাঁর চোখ আটকে গেল এরপর আমার দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার সঙ্গে যিনি যাচ্ছেন তিনি কি সঙ্গীতশিল্পী সুপ্রীতি ঘোষ? (Supriti Ghosh)’ আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপরে আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘মানে যাঁর গাওয়া “বাজলো তোমার আলোর বেণু?’’ আমি আবার টিকিট চেকার মশাইয়ের কথায় সায় দিলাম। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলেন ট্রেনের অন্য যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করতে। কী করে জানি না, খুব দ্রুততার সঙ্গে খবরটা রটে গেল সারা ট্রেনে। কলকাতাগামী ট্রেনের বেশিরভাগ যাত্রীই বাঙালি।

এর কিছুক্ষণ পরে একদল তরুণ-তরুণী এসে ভিড় করলেন আমাদের ঘিরে। কেউ সুপ্রীতিদির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন তো কেউ তাঁর সাক্ষর সংগ্রহ করতে চাইছেন। এসবের পরে সকলের সম্মিলিত অনুরোধ ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ গানটি যদি একটিবার গেয়ে শোনান। ঘুমজড়ানো চোখে বিছানায় শুয়ে যে গান দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে এতদিন শুনে এসেছি, সেই গান শীতের শুরুতে চলন্ত ট্রেনের কামরায় আর পাঁচ-জনের সঙ্গে আমিও শুনলাম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। সুপ্রীতিদি তাঁর পান খাওয়া শেষ করে গান তো ধরলেন কিন্তু একটু গেয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমিও গাও।’ অগত্যা তাঁর সঙ্গে আমিও যোগ দিলাম। দক্ষিণ ভারত থেকে কলকাতার দীর্ঘ এই রেলযাত্রায় কত যে মজার ঘটনা চোখে পড়ল, তার হিসাব রাখাই মুশকিল। সুপ্রীতিদি আর পান এই দুজনে যেন একে অপরের পরিপূরক। মজার ব্যাপার হল ট্রেনে সুপ্রীতিদির বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে টাকার ব্যাগটি নিজে আসনে ফেলে রেখে পানের ব্যাগটি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন! নিজেকে তিনি সেলিব্রেটি না ভাবলেও তাঁকে সবাই ভীষণ সম্মান করত। একবার ওই রেলযাত্রার সময়ই আমাদের পাশে বসা এক সহযাত্রী অনেক্ষণ ধরে সুপ্রীতিদির সঙ্গে গল্প করছেন। বেশ খানিকক্ষণ পরে তিনি সুপ্রীতিদির কাছে একটা পান খেতে চাইলেন। বোঝা গেল তিনিও পান ভালোবাসেন।
‘এদেশে পদাঘাতই শুধু পেলাম’ : অরিজিৎ মৈত্র
সুপ্রীতিদি পান দিলেন কিন্তু তারপর থেকে কথা বলতে প্রায় দেখাই গেল না তাঁকে। দৃষ্টি জানলার বাইরে। কিছু সময় পরে পাশে বসা ভদ্রমহিলাটি একটু উঠে গেলে, সুপ্রীতিদি ট্রেনের তীব্র শব্দের মধ্যে আমাকে কানে কানে বললেন ‘বুবান(আমার ডাকনাম) ওই মহিলার সঙ্গে আর বেশি কথা বলার দরকার নেই।’ কারণ জানতে চাইলে বললেন, ‘আবারও পান চাইতেই থাকলে তো আমার সঙ্গে রাখা সব পানই যে ফুরিয়ে যাবে।’ অমনই সরল সাদা-সিধে ছিলেন আমাদের সুপ্রীতিদি মানে বাংলা গানের প্রখ্যাত গায়িকা সুপ্রীতি ঘোষ। তাঁর কথা বাঙালির একমাত্র মনে পড়ে মহালয়ার ভোরে কিন্তু ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ ছাড়াও তাঁর অগণিত বাংলা আর আধুনিক গানের কথা কেউ প্রায় অলোচনাই করে না যা গীতিকার শ্যামল গুপ্তর লেখা ‘যেথায় গেলে হারায় সবই’, ‘এই ফুলের দেশে কোন ভ্রমর’, ‘এই বসন্ত জানালে বিদায়’, ‘কৃষ্ণচূড়ার স্বপ্ন তরু’, ‘আকাশ যদি না অত সুদূর’, ‘গানে গানে আমি যে খুঁজি’ ইত্যাদি গান গুলোর সঙ্গে সুধীর দাশগুপ্তের কথায় ও সুরে ‘ক্লান্তি যদি নামে’ প্রবীর মজুমদারের কথায় ও সুরে ‘ঢেউ ওঠে সাগরে’ শুনলে বোঝা যাবে সুপ্রীতিদির সঙ্গীতে জীবনের পরিধি কতটা বড় ছিল। এছাড়াও তিনি গেয়েছেন অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, ডি. এল রায়ের গান। অগণিত ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন, তার মধ্যে ‘কাঁকনতলা লাইট রেলওয়ে’ ‘সাহেব বিবি গোলাম’ দেবকী বসুর ‘রত্নদীপ’, ‘তথাপি’, ‘দাসীপুত্র’, ‘কার পাপে’, ‘বর যাত্রী’, ‘লাল দরজা’, ‘কঙ্কাল’, ‘সুনন্দার বিয়ে’ ইত্যাদি ছবিতে গান গেয়েছেন।

‘রত্নদীপ’ ছবিতে হেমন্তদাদুর (মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া ‘এক যে ছিল রাজার কুমার পথিক মেয়ে আর’ গানটির রেকর্ডিং-এর সময় একটা মজার ঘটনার কথা সুপ্রীতিদির মুখেই শুনেছি। তখনকার দিনে একটা মাইক্রোফোনেই রেকর্ডিং হত। গান রেকর্ড করার সময় একটা সমস্যা দেখা দিল। হেমন্তদাদুর শারীরিক দৈর্ঘ্যের বিষয়ে সবাই ওয়াকিবহাল, সুপ্রীতিদি ছোটোখাটো মানুষ। কিছুতেই দুজনের মুখ আর একসঙ্গে মাইকের কাছে পৌঁছোচ্ছে না। তারপর একটা ছোট টুল নিয়ে আসা হল সুপ্রীতিদি তার ওপরে উঠে দাঁড়িয়ে গান গেয়ে রেকর্ডিং শেষ করলেন। সুপ্রীতিদি ছিলেন আমাদের পরিবারের বড় আপনজন, বড় কাছের। বলা যায় আমাদের পরিবারেরই একজন। দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা অনেকদিনের। আমার মামার বাড়িতে সুপ্রীতিদি একসময় নিয়মিত আসতেন কারণ মায়ের পিসি-আকাশবাণীর সংবাদ পাঠিকা নীলিমা সান্যাল ছিলেন তাঁর বিশেষ বন্ধু। আমার মা মধুশ্রী মৈত্র ছিলেন কলকাতা দূরদর্শনের অনুষ্ঠান আধিকারিক। সেই সূত্রে মায়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই সুপ্রীতিদির যোগাযোগ হত।
যূথিকাদির আনন্দময় সান্নিধ্য : অরিজিৎ মৈত্র
যখন তিনি দূরদর্শন কেন্দ্রে রেকর্ডিং করতে যেতেন। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি যে সুপ্রীতি ঘোষও ছিলেন সত্য সাই বাবার বিশেষ ভক্ত। প্রশান্তিনিলয়ম আশ্রমের ভেতরই ছিল তাঁর ফ্ল্যাট। যখন উনি শুনেছিলেন যে আমরা প্রতি বছর শীতকালে ওখানে সেবা-কাজে যোগ দিতে যাই তখন জানতে চেয়েছিলেন ওখানে গিয়ে আমরা কোথায় থাকি। যখন শুনলেন হোটেলে থাকি তখন মাকে বলছিলেন প্রশান্তিনিলয়মের ওয়েস্ট-ওয়ানে ওঁর একটা ফ্ল্যাট রয়েছে, সেখানে আমরা অনায়াসেই থাকতে পারি যাওয়ার আগে জানালে উনি আশ্রম কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে দেবেন। আমরা বেশ কয়েক বছর ওঁর চিঠি নিয়ে আশ্রম কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেই ফ্ল্যাটে থাকি। আবার এমনও হয়েছে যে সুপ্রীতিদি এবং ওঁর স্বামী প্রয়াত অরবিন্দ ঘোষও আমাদের সঙ্গে একাধিকবার সেখানে গেছেন এবং আমাদের সঙ্গে থেকেছেন। সুপ্রীতিদির সম্পর্কে যতই পুরনো কথা মনে পড়ছে, ততই একটা মজার কথা বারেবারে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হল ওঁর ভূতের ভয়। একদম একা থাকতে পারতেন না এবং একা শুতেও পারতেন না এমনকি ট্রেনে করে কোথাও যাওয়ার সময় সন্ধের পরে একা ট্রেনের বাথরুমেও যেতে ভয় পেতেন। এর কারণ হয়ত ১ নম্বর গাসটিং প্লেসের আকাশবাণীর-পুরোনো অফিসকে ঘিরে নানান ভৌতিক গল্পের স্মৃতি ওঁর মনজুড়ে ছিল। কখনও কিছু দেখেছিলেন কী না জানি না তবে মাঝে মধ্যে আকাশবাণীর সাহেব ভূতের গল্প করতেন। বলতেন পঙ্কজ’দা মানে পঙ্কজ মল্লিক যখন মহালয়ার বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য মহড়া দেওয়াতেন, তখন রেডিও অফিসে বিরাট হলঘরের মধ্যে সবাই জড়সড় হয়ে বসে থাকতেন। ঘরের একধারে ছিল বড়বড় জানলা কিন্তু কোনও শিল্পীই জানালার কাছে বসতে চাইতেন না। জানলার পাশেই ছিল চার্চ আর কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নকের সমাধি। পঙ্কজদা জিজ্ঞাসা করতেন, “তোমরা সবাই কষ্ট করে অল্প জায়গার মধ্যে বসে আছো কেন?” এক আধজন ভূতের কথা বললে পঙ্কজদা হাসতেন।

সুপ্রীতিদির ভূতের ভয়ের একটা নমুনা দিই। ঘটনাটি শুনলে সবার বেশ মজাই লাগবে। একবার প্রশান্তিনিলয়ম আশ্রমে আমরা একসঙ্গে গেছি। রাতে সুপ্রীতিদির ঘরে আমরা শুয়ে আছি ঘরের মধ্যে দুটো খাট। একটায় সুপ্রীতিদি আর একটা খাটে আমার মামা, আর আমি মাটিতে বিছানা পেতে শুয়েছি। হঠাৎ মাঝরাতে শুনতে পেলাম সুপ্রীতিদি ডাকছেন আমার নাম ধরে। আমি উঠতেই সুপ্রীতিদি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার খাটে বসে কেউ কি তবলা বাজাচ্ছিল?’ আমার হাসি পেয়ে গেল। এরপর সুপ্রীতিদি আমাকে অনুরোধের সুরে বললেন, ‘তুমি যদি কিছু মনে না করো তবে তুমি আমার খাটে উঠে শোও আমি মাটিতে শুচ্ছি।’ আমি বললাম মনে করার কোনও প্রশ্নই উঠছে না কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব, যে আমি খাটে উঠে শোবো আর আপনি মাটিতে শোবেন এটা ভীষণই অস্বস্তিকর বিষয় আমার পক্ষে। উনি কিছুতেই শুনলেন না বললেন, ‘তাতে কোনও সমস্যা নেই, আমি মাটিতেই শোবো।’ আসলে ব্যাপারটা হল উনি যেখানে শুয়েছিলেন ঠিক তার উপরে একটা জানালা ছিল সেটা ছিল আবার খোলা অবস্থায়। সেটাতে ওঁর একটা অস্বস্তি হচ্ছিল।
নজরুলগীতির রাজপুত্র ধীরেন বসু : অরিজিৎ মৈত্র
সুপ্রীতিদির গলায় অনেক ধরণের গানই শুনেছি বিভিন্ন অবকাশে কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আবার আরও একটা ট্রেন যাত্রার কথা। অতীতে সত্য সাই বাবার প্রশান্তিনিলয়ম আশ্রমে যেতে পাক্কা দুদিন সময় লাগত। হায়দ্রাবাদ অথবা ব্যাঙ্গালোর স্টেশনে ট্রেন বদল করে যেতে হত অর্থাৎ যাত্রাটা ছিল সময় সাপেক্ষ। কিন্তু পরে সত্য সাই প্রশান্তিনিলয়ম রেল স্টেশন তৈরি হওয়ার পর থেকে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর থেকেই সরাসরি সেখানে পৌঁছানো যায়। কলকাতা থেকেও মাত্র একটাই ট্রেনে প্রশান্তিনিলয়ম যাওয়া সম্ভব। যাক, একবার সুপ্রীতিদির সঙ্গে আমরা সেখানে যাচ্ছি। দুদিনের ক্লান্তিকর যাত্রার শেষে যখন গন্তব্যের কাছাকাছি প্রায় চলে গিয়েছি এমন সময় দেখি ট্রেনের জানলার বাইরে উদাস দৃষ্টি দিয়ে সুপ্রীতিদি গান ধরেছেন, ‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ আসিতে তোমার দ্বারে’। প্রভাতের প্রথমক্ষণের এক অপূর্ব সুন্দর অভিজ্ঞতার সাক্ষী রইলাম। এই না হলে শিল্পী? প্রকৃত জাত শিল্পীর কাছে সুরের সাধনাই প্রধান। যেখানে স্থান, কাল, পাত্র গৌণ হয়ে যায়। আজ এই পর্যন্তই থাক। আরও অনেক কথা অনেক স্মৃতি রয়ে গেছে মনের এক কোণে। গত ২৮ আগষ্ট ছিল সুপ্রীতিদির জন্মদিন। বাকি জমে থাকা কথাগুলো পরবর্তী কিস্তিতে ভাগ করে নেব পাঠকদের সঙ্গে। স্মৃতি সবসময়ই সুখের। সেই সুখের আরও কিছু কথা না জানালে যে এই স্মৃতিচারণ অসমাপ্তই থেকে যাবে।
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।