সুপ্রীতিদি (Supriti Ghosh) যেমন আধুনিক বাংলা গান গেয়েছেন তেমনই রবীন্দ্রসঙ্গীতেও তিনি ছিলেন স্বচ্ছন্দ এবং সাবলীল। যে বছর কবির প্রয়াণ ঘটে সেই বছরই সুপ্রীতিদির প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। সেই গ্রামোফোন রেকর্ডের দুই পিঠের দুটি গান হল ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ এবং ‘কে বলে যাও যাও, আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া।’ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বিষয় হল প্রয়াণের কিছু মাস পূর্বে কবি নিজেই এই গান দুটি প্রকাশের জন্য স্বয়ং অনুমতি দিয়ে যান। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কারণের জন্য ‘কে বলে যাও যাও’ গানটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এই ঘটনা সুপ্রীতিদির (Supriti Ghosh) নিজের মুখেই শুনেছিলাম। ইচ্ছা হয়েছিল সুপ্রীতিদির একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে ওঁর বিষয়ে একটা বই লিখব। সেরকম একটা সাক্ষাৎকার নিয়েওছিলাম কিন্তু দুঃখের বিষয় বইয়ের জন্য প্রস্তুত করা পুরো পাণ্ডুলিপিটাই জনৈক প্রকাশক হারিয়ে ফেলেন। মনে আছে সুপ্রীতিদির (Supriti Ghosh) কাকুলিয়া রোডের বাড়িতে বসে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় উনি ওঁর গাওয়া এবং রেকর্ড করা একটা করে গানের কথা বলছিলেন এবং গোটা গানটাই গেয়ে শোনাচ্ছিলেন। বাড়িতে যখন ছাত্রীদের নিয়ে ক্লাস করতেন তখনও দেখেছি কোনও আড়ম্বর ছিল না। মাদুর বিছিয়ে মাটিতে সকলের সঙ্গে বসে গান শেখাতেন। আগের পর্বের লেখায় সুপ্রীতিদির সঙ্গে রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি। কিন্তু একটা ঘটনার কথা বলা হয়নি সেটা হল সুপ্রীতিদির বিরিয়ানি-প্রীতির কথা।

কলকাতায় বিরিয়ানি খুব একটা খেতেন কী না জানি না, তবে যখন প্রশান্তিনিলয়মে যেতেন, বেশিরভাগ সময়ই আমরা হায়দ্রাবাদ হয়ে যেতাম। হাওড়া থেকে ফলকনামা এক্সপ্রেসে করে সেকেন্দ্রাবাদ রেলস্টেশনে নেমে কাচ্চিগুডা নামক আর একটা স্টেশনে নেমে প্রশান্তিনিলয়মের ট্রেন ধরতাম। সবাই জানেন যে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি খুব সুস্বাদু এবং প্রসিদ্ধ। আমরা সকলে সেকেন্দ্রাবাদ পৌঁছে সেই স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে উঠতাম, মধ্যাহ্নভোজের সময় স্টেশনের ঠিক উল্টোদিকের ‘আলফা’ নামক দোকানে বিরিয়ানি খেতে যেতাম। সুপ্রীতিদিও যেতেন আমাদের সঙ্গে। বর্ষীয়ান মানুষটি আমাদের সকলের সঙ্গে কত সহজে মিশে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করতেন। যখন বলতাম, ‘আপনি দুপুরে তো বিরিয়ানি খেয়েছেন, রাতে হালকা কিছু খান।’ শুনতেন না। বলতেন, ‘কলকাতায় তো সেই একই ডাল, ভাত, মাছ খাই, বিরিয়ানি তো খাওয়ার সুযোগ খুব একটা পাওয়া যায় না। এখানে রাতেও এটাই খাব।’ ওঁর বয়স এবং শরীরের কথা ভেবে আমি ভয় পেতাম কিন্তু দেখতাম যে উনি ভালোই আছেন।
সুপ্রীতিদির হাতের রান্নাও ছিল খুব ভালো। প্রশান্তিনিলয়ম আশ্রমে ওঁর ঘরের হিটারে মাঝে-মধ্যে রান্না করে আমাদের খাইয়েছেন। অসম্ভব প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা মানুষ ছিলেন সুপ্রীতিদি। কখনও কোনও শিল্পীর সম্পর্কে কোনও কটু কথা বলতে শুনিনি বা দেখিনি কিন্তু গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে যখন রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকার রেকর্ডিং হয় তখন একজন প্রসিদ্ধ এবং শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুপ্রীতিদির সঙ্গে খুব একটা ভাল ব্যবহার করেননি। অবশ্য সেসব নিয়ে আমাদের সুপ্রীতিদির মনে কোনওরকম ক্ষোভ ছিল না। কখনও সেসব কথা উঠলে তিনি তাঁদের সমালোচনা করতেন না। ওঁর কাছে কতরকম কাহিনি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। একবার সত্য-সাঁইবাবার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সুপ্রীতিদির উদ্যোগে বাংলা থেকে অনেক বিখ্যাত শিল্পী গেছেন প্রশান্তিনিলয়মে গান গাইতে। সেই তালিকায় ছিলেন প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়। ওখানে হঠাৎই একদিন প্রতিমা বন্দোপাধ্যায় মানসিক ও শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুপ্রীতিদি আবারও আশ্রম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রতিমাদির কলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা করেন।
আলোর বেণু সুপ্রীতিদি : অরিজিৎ মৈত্র
সামনেই পুজো তাই পুজোকেন্দ্রিক একটি ঘটনার কথা ভাগ করে নিচ্ছি পাঠকদের সঙ্গে। সুপ্রীতিদির স্বামী অরবিন্দ ঘোষ ছিলেন একজন ভাল এবং সৎ মানুষ। আমরা তাকে দাদু বলেই ডাকতাম। খুব স্নেহ করতেন। যখনই ওঁদের বাড়িতে যেতাম, তখনই নানারকম গল্প বলতেন। একবার পুজোর সময় পুজোর গান রেকর্ড করার জন্য গ্রামোফোন কোম্পানি সুপ্রীতিদিকে অনুরোধ করল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার শ্যামল গুপ্ত গান লিখলেন। গানের কথাটি হল, ‘বরষ পরে পুজোর ঘণ্টা বাজল রে দেশ জুড়ে’। সুপ্রীতিদি রেকর্ড করলেন। রেকর্ড বাজারে প্রকাশ পেতেই হইচই পড়ে গেল। গানটি দারুণ জনপ্রিয় হল। শ্যামল গুপ্ত একদিন ঠাট্টা করে সুপ্রীতিদিকে ফোন করে বললেন, ‘গীতিকারের কিন্তু একটা ভাল উপহার পাওনা রইল।’
এরপরে একদিন সুপ্রীতিদি আর দাদু মানে ওঁর স্বামী অরবিন্দ ঘোষ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর শ্যামল গুপ্তের বাড়ি গিয়ে একটা সোনার নিপ দেওয়া পেন উপহার দিয়ে এসেছিলেন শ্যামল গুপ্তকে। আমার কন্যার জন্মের পরে একদিন সুপ্রীতিদি স্বপরিবারে আমার মেয়েকে দেখতে এলেন হাতে অনেক রকম উপহার নিয়ে। আমার মেয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘চন্দ্রানী’। ও তখন খুব ছোট, আমাদের সঙ্গে সুপ্রীতিদির বাড়িতে গেলেই পান খাওয়ার জন্য ওঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত। সেই সময়ই সুপ্রীতিদির গাওয়া ‘ক্লান্তি যদি নামে, শ্রান্ত চরণ থেমে যায়’ গানটি শুনে শুনে আমার কন্যা তুলে নেয় গলায়।

অনেক বয়স পর্যন্ত সুপ্রীতিদির মাথা একদম পরিষ্কার ছিল। অনেক আগের ঘটে যাওয়া অনেক কিছু মনে ছিল। প্রতি বছর মহালয়ার আগে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল থেকে ওঁকে ডাকা হত। উনি সেইসব অনুষ্ঠানে গিয়ে অতীতের সব স্মৃতি উজাড় করে দিতেন নির্ভুলভাবে। কোথাও এতটুকু ভুল করতেন না। অনেক সময় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলতেন, ‘পঙ্কজদা আমাকে উৎসাহিত করার জন্য বলতেন, “সুপ্রীতি তোমার গানটাই প্রথম, খুব মন দিয়ে ভাল করে গাইবে। তোমার গানটাই পুরো অনুষ্ঠানটাকে চালিয়ে নিয়ে যাবে”।
সুপ্রীতিদির কথা একটা বা দুটো পর্বে শেষ করা যাবে না। কত কথা জমা হয়ে আছে মনের মধ্যে। সব কি আর মনে আছে? অনেক কথা ক্ষণিকের জন্যে ভেসে ওঠে আবার মিলিয়ে যায়। একবার নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক বিরাট অনুষ্ঠানে স্মরণ করা হয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং উত্তম কুমার’কে। সেই অনুষ্ঠানে অনেক অভিনেতা, গায়ক, গায়িকা ছিলেন। ছিলেন মান্না দে, মিঠুন চক্রবর্তী, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়-সহ আরও অনেকে কিন্তু সুপ্রীতিদি যখন মঞ্চে উঠে ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ দু-লাইন গাইলেন তখন সারা স্টেডিয়াম হাত তালিতে ফেটে পড়ল। অনুষ্ঠানটা হয়েছিল পুজোর পরে। ঐ কটা লাইন শুনে মনে হল মা যেন আবার নতুন করে ফিরে এলেন। সেদিনের সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। বাংলা গানের ভুবনে সুপ্রীতিদি চিরকালই ধ্রুবতারা হয়ে থেকে যাবেন।
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।