বাঙালির কাছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে(Soumitra Chattopadhyay) নতুন করে পরিচয় করাবার কিছু নেই। তাঁর অভিনীত ছবি, নাটক, কবিতা গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে। তাঁর বয়স যখন ৮০ পেরিয়ে গেছে, তখনও তাঁর ডায়রির পাতায় কোনও তারিখ খালি থাকত না। ছবির শুটিং, নাটকের মহড়া, কবিতা পাঠ, গ্রন্থের প্রকাশ অনুষ্ঠান, প্রদর্শনীর উদ্বোধন ইত্যাদির জন্য তাঁর সময় পাওয়া ছিল এক কঠিন ব্যাপার। এর পাশাপাশি ছবি আঁকা তো ছিলই। সৌমিত্র কাকুর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের পরিচয় বহু বছরের।

আমার দাদু আর ওঁর বাবার বন্ধুত্ব কৃষ্ণনগর থেকে শুরু। এরপরে ওঁর শ্বশুরমশাই চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী এবং ওঁর পরিবারের সঙ্গে আমার বাবা ও মায়ের সক্ষ দীর্ঘদিনের। প্রথম সৌমিত্রকাকুকে দেখি ওঁর লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে, তখন আমার বয়স অল্প। সেই সময় উনি ধূমপানের জন্য পাইপ ব্যবহার করতেন। মনে আছে বাবা-মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। সোনার কেল্লা তার কিছুদিন আগেই দেখেছি, ছবিটা দেখার রেশ তখনও রয়ে গেছে, তাই মুগ্ধ হয়ে ফেলুদাকে দেখছিলাম। এর অনেক অনেক বছর পরে বিভিন্ন রকমের কাজের সূত্রে আমার সঙ্গে সৌমিত্র কাকুর একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।(Soumitra Chattopadhyay)

একবার উত্তর কলকাতার জগৎ মুখার্জি পার্কে একটা অনুষ্ঠান হয়, সেই অনুষ্ঠানের জন্য স্ক্রিপ্ট করেছিলাম আমি। বিষয়টা ছিল ‘ছায়াচিত্রে রবীন্দ্ররচনা’। গান করেছিলেন মনোজ ও মনীষা মুরলি নায়ার, বাংলা ছবিতে ব্যবহৃত রবীন্দ্রকবিতাগুলো পাঠ করেছিলেন সৌমিত্রকাকু, আর অনুষ্ঠানের শুত্রধরের ভূমিকায় ছিলেন মধুবনী চ্যাটার্জী।
আরও পড়ুন: শতবর্ষের আলোকে সুচিত্রা মিত্র
এই বিশেষ অনুষ্ঠানটির মহড়া হয়েছিল একাধিকবার। প্রতিটি মহড়ার শেষে সৌমিত্রকাকু আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন তাঁর পাঠটা ঠিক হচ্ছে কী না। যেহেতু আমার স্ক্রিপ্ট, তাই প্রতিবারই তিনি এই প্রশ্ন করতেন। আমি প্রতিবারই লজ্জায় পড়তাম, কারণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তির পাঠ করার বিষয় বিশ্লেষণ করাটা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা মাত্র। তবু তাঁর ভদ্রতা দেখে অবাক হয়ে যেতাম।(Soumitra Chattopadhyay)

তপন সিংহ ফাউন্ডেশন যখন তৈরি করেছিলাম, তখন ভারতী দেবী ছিলেন সংস্থার সভাপতি। তাঁর জীবনবসানের পরে ভাবলাম পরবর্তী সভাপতি কাকে করা যায়! মাথায় এল সৌমিত্রকাকুর নাম। সেই সময় কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব চলছে, উনি ছিলেন চেয়ারপার্সন। উৎসব চলাকালীন নন্দনে ওঁর সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাব পেশ করি (Soumitra Chattopadhyay)

আমরা তখন প্রায়ই ওঁর সাদার্ন এভিনিউয়ের বাড়িতে যেতাম। সেখানে মাঝে মধ্যেই সৌমিত্রকাকু এবং দীপা মাসি আসত। ওদের বাড়ির অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে যখন যেতাম, তখনও ওদের সঙ্গে দেখা হত। স্বল্প আলোচনার পর উনি রাজি হন সভাপতি হতে। আবার একটু পিছিয়ে যাই অতীতে। সৌমিত্রকাকুর শ্বশুরমশাই চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভীষণ সুপুরুষ। ইন্ডিয়ান অক্সিজেন কোম্পানির উচ্চপদে ছিলেন, উদার মনের মানুষ। (Soumitra Chattopadhyay)

পরবর্তীকালের আমি দুটো তথ্যচিত্র বানিয়েছিলাম, একটা তপন সিনহাকে নিয়ে আর একটা বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উপলক্ষে। দুটো তথ্যচিত্রেই ধারাভাষ্য করেছিলেন সৌমিত্রকাকু। একদিন ধারাভাষ্যর রেকর্ডিং করতে যাওয়ার সময় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বাংলা চলচ্চিত্র বিষয়ক তথ্যচিত্রের স্ক্রিপ্টে তুলসী লাহিড়ীর নামটা যুক্ত করবেন কী না। আমি উত্তরে বলেছিলাম, ‘তুমি যেটা ভাল বুঝবে, সেটাই করবে।'(Soumitra Chattopadhyay)
পরবর্তীকালের আমি দুটো তথ্যচিত্র বানিয়েছিলাম, একটা তপন সিনহাকে নিয়ে আর একটা বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষ উপলক্ষে। দুটো তথ্যচিত্রেই ধারাভাষ্য করেছিলেন সৌমিত্রকাকু।
রেকর্ডিং এর মাঝে আমি আবদার করে বলি তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে আলাদা করে একটা সাক্ষাৎকার দিতে। উনি এক কথায় রাজি হয়ে যান কারণ তুলসী চক্রবর্তীকে উনি ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন। ‘অগ্রপথিকরা’ বইতে সৌমিত্রকাকু তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছিলেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষকে ঘিরে সব স্মৃতি তো আর একটা লেখায় বলা সম্ভব নয় তাই আরও অনেক জমা কথা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নেব পরবর্তী অধ্যায়ে।
সেখানে সৌমিত্রকাকুকে নিয়ে অনেক মজার কথাও থাকবে, যেখানে বলব তাঁর ভূতের ভয়ের কথা।
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।