প্রথম পর্বের শেষে লিখেছিলাম, সৌমিত্রকাকুর ভূতের ভয় নিয়ে দু-এক কথা লিখব। একবার কোনও অনুষ্ঠানে ওঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ওঁনার বাড়িতে গিয়েছি, সেই সময় বাড়িতে উনি ছাড়া আর কেউ ছিল না। উনি আমার যাওয়ার অপেক্ষায় বাড়ির সামনের বাগানে পায়চারি করছিলেন। (Soumitra Chattopadhyay)

আমাকে দেখে বাইরে এসে ওঁনার মনে পড়লো যে চশমাটা বাড়ির ভেতরে ফেলে এসেছেন। আমার হাতে চাবি দিয়ে বললেন বাড়ির ভেতর থেকে চশমাটা নিয়ে আসতে। এও বলে দিলেন যে সেটা রয়েছে ওঁর শোবার ঘরে। চাবি তো নিলাম কিন্তু আমার একটু কুন্ঠাবোধ হচ্ছিল ওঁর শোবার ঘরে যেতে, অতো বড় একজন মানুষের শোবার ঘরে যাব! বিশেষ করে উনি সঙ্গে নেই! যাই হোক, বাড়ির ভেতর গিয়ে চশমাটা নিয়ে এসে ওঁনাকে দিলাম। (Soumitra Chattopadhyay)

একবার শান্তিনিকেতনে গেলাম, আমি আর আমার এক বন্ধু ওখানকার দূরদর্শনের গেস্ট হাউসে উঠলাম আর সৌমিত্রকাকুর থাকার ব্যবস্থা হল গোয়ালপাড়ার একটা গেস্ট হাউসে। বিকেলে যোগেন চৌধুরী আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে সৌমিত্রকাকু যাবেন, আমাকে বললেন অনুষ্ঠান শুরুর আগেই উনি যেখানে উঠেছেন, সেখানে চলে আসতে। সেখানে যাওয়ার পরে বারে বারে জানতে চাইছিলেন, দূরদর্শন-এর গেস্ট হাউসে কেন উঠেছি? পরে শুনলাম যে সৌমিত্রকাকু একদম একা থাকতে পারতেন না, বাইরে কোথাও গেলে একা শুতেও অসুবিধা বোধ করতেন। খুব ভূতের ভয় পেতেন। (Soumitra Chattopadhyay)

আমাকে যখন এই কথা বলতেন, আমি মনে মনে হাসতাম কারণ আমারও একই অবস্থা, আমারও ভীষণ ভূতের ভয়। ওঁনার ছবি আঁকার কথা অনেকেই জানেন। সেই প্রতিভার কথা বলতে লজ্জা পেতেন। বলতেন, যাঁরা প্রথাগতভাবে চারুচর্চা করেছেন তাঁদের অপমান করা হয়, যদি আমার ছবি আঁকার বিষয়টাকে বড় করে প্রচার করি। (Soumitra Chattopadhyay)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: চরিত্রের সন্ধানে…
একবার কলকাতার আইসিসিআরে ওঁর ছবির একটি প্রদর্শনীতে গেলে প্রতিটি ছবি ঘুরিয়ে দেখান এবং মানে বুঝিয়ে দেন। ওঁর কাছে অনেক ধরণের আমন্ত্রণপত্র আসত, সেগুলো কেটে কেটে তার ওপরে ছবি এঁকে পেজমার্ক তৈরী করতেন। সেরকম শিল্প উপহার দিয়েছেন কয়েকবার। স্মৃতির ভার বহন করে সেগুলো আজও আমার কাছে রয়ে গেছে। (Soumitra Chattopadhyay)

সৌমিত্রকাকুর ৮০তম জন্মদিন বড় করে পালন করতে চেয়েছিলাম তপন সিংহ ফাউন্ডেশন থেকে। আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছিল ‘সিনে সেন্ট্রাল’, ‘শ্যামবাজার মুখোমুখি’ এবং ‘বিএফজে’। ঠিক করলাম তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানাবো, সঙ্গে শর্মিলা ঠাকুর আর তনুজাকে ডাকবো। আমাদের অতি আপনজন শ্রেণিক সেটের সহায়তায় প্রণবদার সঙ্গে আমি এবং সৌমিত্রকাকু দেখা করতে গেলাম কলকাতার রাজভবনে। রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন রকম প্রোটোকল। (Soumitra Chattopadhyay)
আরও পড়ুন: শতবর্ষের আলোকে সুচিত্রা মিত্র
রাজভবনে যাওযার পরে আমাদের এক ধরণের চকলেট কেক খেতে দেওয়া হয়। কাকুর শরীরের কারণে অনেক কিছুই খাওয়া তখন বারণ ছিল। কানে কানে জিজ্ঞাসা করলেন কেকটা খাবেন না প্লেটেই রেখে দেবেন? আমিও চুপি চুপি হেসে ওঁনাকে ইয়ার্কি করে বললাম রাষ্ট্রপতির কেক খেয়ে নেওয়াই উচিত কারণ এমন সুযোগ যদি আর না আসে। উনি হেসে খেতে শুরু করলেন। এরপর প্রণবদার হাতে আমি আমন্ত্রণের চিঠিটা তুলে দিলাম, উনি জানালেন যথাসময় ওঁর সচিবালয় থেকে যোগাযোগ করে নেবে। (Soumitra Chattopadhyay)

মনে আছে সেই সময় রোজ সকালে সৌমিত্রকাকু একবার করে আমাকে ফোন করে অনুষ্ঠানের অগ্রগতির বিষয়ে খোঁজ নিতেন। একবার ওঁনাকে জানালাম রাষ্ট্রপতির সচিবালয় জানতে চেয়েছে আমাদের প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানটা দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে করা যায় কি না? উনি উল্টে আমাকেই জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কী মত? ভাবা যায়! ওঁনার ভদ্রতা? একদিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি আর অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর মতো কিংবদন্তী শিল্পী! এর মাঝে আমি কী বলব? (Soumitra Chattopadhyay)
মনে আছে সেই সময় রোজ সকালে সৌমিত্রকাকু একবার করে আমাকে ফোন করে অনুষ্ঠানের অগ্রগতির বিষয়ে খোঁজ নিতেন।
শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটা কলকাতাতেই হয়েছিল। প্রণবদা আসতে পারেননি, কারণ সেই সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে উনি দিল্লির সেনা হাসপাতালে ভর্তি হন, বুকে স্টেন বসানো হয়। শর্মিলাদি আমাকে ফোন করে জানালেন ওঁর মেয়ে সোহার বিয়ের কারণে আসতে পারছেন না। তনুদি অবশ্য এসেছিলেন। (Soumitra Chattopadhyay)

একদম শেষ মুহূর্তে অন্য দুটি সংস্থা অনুষ্ঠান থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। তবুও অনুষ্ঠানটা ভালোভাবেই শেষ হয়। মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে অনেক মজার কথা হত আমাদের ভেতর। এর পরের কথাগুলো সবারই জানা। করোনা আক্রান্ত হল গোটা পৃথিবী আর তার জেরে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর সৌমিত্রকাকু চলে গেলেন ইতিহাসের পাতায়। এখনও মন মানতে চায় না যে, সেদিনের ঘটনাগুলো আজ শুধুই স্মৃ্তি। (Soumitra Chattopadhyay)
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।