বেশ অনেকগুলো পর্ব ধরে আত্মজীবনী লিখছি বা আত্মবিশ্লেষণ করছি। সবাই পড়ছেন; আনন্দ পাচ্ছেন; আমাকে আরও আরও লেখার জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন। খুব ভালো লাগে। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সত্যি বলছি। আমি তো সাহিত্য রচনা করি না বা ভাবিও না কখনও। আবার সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনাও করিনি। সারা জীবনটাই বিজ্ঞান-নির্ভর। এবং খুবই আশ্চর্যভাবে স্কুল লিভিং সার্টিফিকেটে আমার বোর্ডের নম্বরে ফিজিক্সে হায়েস্ট মার্কস মানে সমস্ত বোর্ডের পরীক্ষার্থীর মধ্যে ফিজিক্সে লেটার এবং সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলাম। অথচ যেটাতে আমার সবচেয়ে বেশি ভালবাসা ছিল বা পড়াশোনা ছিল, সেই ইংরেজি কিন্তু ব্রাত্যই থেকে গেল। যখন কলেজে যাব, বোর্ড পাশ করলাম। খুব ক্ষীণ স্বরে ইংরেজি নিয়ে পড়ার ইচ্ছের কথা মা’কে জানিয়েছিলাম। কোনও পাত্তাই পেলাম না। মা ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে বলল, সেকি! তুমি তো ডাক্তারি পড়বে। যাও প্রিপারেশন নাও। মায়ের মুখের ওপর কথা বলা—উরিব্বাপ! স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। তবুও মাথা নিচু করে বললাম, “ওই সব ব্যাঙ, আরশোলা কাটাছেঁড়া আমার ভালো লাগে না।” মা চোখ কপালে তুলে বলল, “সেকী! তুমি তো বায়োলজিতে প্রচুর নম্বর পেয়েছ। তাহলে!!!”
আর কিছু বলার সাহস নেই। বাবা সব শুনলো। দাদু, ঠাকুমা, সব্বাই জানলো। গৌরী ডাক্তারি পড়বে না। বাড়ির বড় মেয়ে। কত আশা সবারই। ডাক্তার হবে না! এ কেমন কথা??? তখনকার মধ্যবিত্ত সংসারে, প্রধানতঃ বাঙালি সমাজে ছেলেমেয়েরা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে এই স্বপ্নটাই অভিভাবকদের মধ্যে চলত বা জারি থাকত। আবার মা-বাবার দিকে চোখ তুলে কেউ একজন বলবে যে, সে নিজে কী চায়। বা কী তার স্বপ্ন, এ আবার হয় নাকী???
কিন্তু আমার বেলায় হল। বাবা বলল, “গৌরীর স্বাস্থ্য ভাল না। ডাক্তারি পড়া খুব চাপের ব্যাপার। তারপর মড়া কাটা এইসব তো আছে। ওর যদি ভাল না লাগে, মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়ে, পড়া ছাড়তে হয়, তাহলে তো বছর নষ্ট হবে। তার চেয়ে ও যা চাইছে তাই হোক। প্রেসিডেন্সিতে ইকোনমিক্স। ব্রেবোর্নেও ইংলিশ পেয়েছ, তাই পড়ুক।”
মা বেঁকে বসল—“না ওকে সায়েন্স পড়তে হবে।”
অনেক টানাপোড়েনের পর আমি রাজি হলাম। তবে পিওর সায়েন্স না বায়ো-সায়েন্স পড়ব।
তাই হল। বোটানিতে অনার্স। পাসে জুলজি, ফিজিওলজি নিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। এবং কোথায়? মেদিনীপুর কলেজে। আমাকে মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
অবশ্য তখন প্রচুর কান্নাকাটি, রাগারাগি করলেও এখন এই বয়সে মায়ের সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিল বুঝতে পারি। আমার যিনি গৃহশিক্ষক ছিলেন, আমাকে অঙ্ক করাতেন, একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি হঠাৎ আমাকে বিবাহ প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। আমাকে অর্থাৎ প্রস্তাব করলেন আমার মা-বাবার কাছে। মা তো আকাশ থেকে পড়ল। বাবা, দাদু সবাই ভয়ঙ্কর ব্যতিব্যস্ত হয়ে এই প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবেই নাকচ করে দিল। এইবার অভাবনীয় ঘটনা যা ঘটল আমাকে রাতারাতি ভীষণ বড় করে দিল। তিনি সারা পাড়ায় বলে বেড়াতে শুরু করলেন, গৌরীর সঙ্গে আমার বিবাহ হয়ে গেছে কালীঘাটে। মা তো রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে আমাকে দু-চার ঘা দিয়ে বলল, “সত্যি করে বল, কী করেছিস।”
আমি এমনিই খুব সন্ত্রস্ত আছি বেশ কিছুকাল যাবৎ। এইরকম একটা ঘটনা আমি বুঝেই উঠতে পারছিলাম না কী করে সামাল দেব। তার ওপর মা কাঁদছে???!!! এত কী সম্ভব!!!
—“মা আমি কিছু জানি না। আমি কিছু করিনি। উনি সব মিথ্যে বলছেন।”
—“তোকে বিয়ে করেছে? কবে, কোথায়, কখন, … বল??
—“আমি তো একলা কোথাও যাই না। বিয়ে কেন করব। সব মিথ্যে, মা সব মিথ্যে। উনি সব বাজে কথা বলছেন।”
এই ঘটনা লিখতে গিয়ে এখনও আমার বুক ধড়ফড় করছে। এতদিন, এত বছর পরেও আমি থরথর করে কাঁপছি। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, মা হাপুস নয়নে কাঁদছে আর মাথা চাপড়াচ্ছে—
—“গৌরী যদি সত্যি হয় আমি গলায় দড়ি দেব। বল বল বল।”
আমার নরম, ক্ষীণ শরীর মায়ের ঝাঁকানিতে একেবারে যেন ভেঙে পড়ছে মনে হচ্ছিল। আমি চিৎকার করে বললাম, “মা, সত্যি বলছি মা, উনি সব মিথ্যে বলছেন।”
—“আমাকে ছুঁয়ে বল।”
—“এই তোমাকে ছুঁয়ে, জড়িয়ে ধরে বলছি মা। বিশ্বাস করো। আমি কিচ্ছু করিনি। কিচ্ছু করিনি। কিচ্ছু জানি না। কেন উনি ওরকম বলছেন। জানি না।” নিস্তেজ হয়ে মায়ের কোলের ওপরেই পড়ে গেলাম। জলের ঝাপটায় যখন চোখ মেললাম, দেখলাম সব্বাই আমার চারপাশে। সব্বাই আমার নাম ধরে ডাকছে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ভিজে আঁচল দিয়ে মাথা, মুখ, মুছিয়ে দিচ্ছে।

আস্তে আস্তে দিন পেরিয়ে রাত হল। রাত পেরিয়ে দিন। আবার রাত। আবার দিন। আর একটা করে রাত যায়। একটা করে দিন যায়। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমার মধ্যে আস্তে আস্তে জেগে ওঠে রাগ, অবিশ্বাস, সন্দেহ, ঘৃণা। এগুলো কোথায় ছিল এতদিন। গৌরী এসব অনুভূতি তো তোমার ছিল না। এত জেদ্। এত বিতৃষ্ণা, সবকিছু কেমন তেঁতো, ভোঁতা, নীরস, বিস্বাদ। কেন? কেন? কোথায় গেল তোমার সাধের গান, নাচ, কবিতা,. সাহিত্য??? কোথায় তারা???
ভেতরে ভেতরে আমি আমূল পাল্টে গেলাম। এত মিথ্যে কেউ বলতে পারে? কেন? কেন? কেন?
প্রতিজ্ঞা করলাম কোনওদিন বিয়ে করব না। কোনও পুরুষ মানুষের সঙ্গে কোনওরকম বাক্যালাপ এখন থেকে বন্ধ। গান গাইব। গায়িকা হব। পড়াশোনা করব। অনেক, অ-নে-ক পড়াশোনা। রিসার্চ করব, অধ্যাপক হব। কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে পড়াব। ঈশ্বর অলক্ষ্যে হাসলেন। একদিন সকালে উঠে মা’কে বললাম। আমি মামাবাড়িতে থাকব। মেদিনীপুর যাব। ওখানেই পড়াশোনা করব।
তাই হল। মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি হলাম। কলকাতার মেয়ে পড়তে এসেছে। খুব হইচই।
কিন্তু সেখানেও কী শান্তিতে ছিলাম???
*ছবি সৌজন্য: লেখক,
*আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে ১৭ এপ্রিল ২০২৪-এ
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব