(Mohammed Rafi) উত্তম-সুচিত্রার ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির গান রেকর্ডিং হচ্ছে বম্বেতে। গান গাইছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও গীতা দত্ত। এমন সময় সুরকার নচিকেতা ঘোষ বলে বসলেন ‘‘’ইন্দ্রাণী’ ছবিতে আমি একটা হিন্দি গান রাখব। আর সেটা গাওয়াব মহম্মদ রফিকে দিয়ে।’’ কিন্তু এ কী যে সে আবদার! বাংলা ছবিতে মহম্মদ রফি গাইবেন? কত পারিশ্রমিক চাইবেন? পরিচালক প্রযোজকদের মাথায় হাত। শেষ অবধি হাল ধরলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত বাবু নচিকেতা ঘোষকে নিয়ে গেলেন মহম্মদ রফির কাছে। (Mohammed Rafi)
‘সবি কুছ লুটাকার হুয়ে হাম তুমহারে’— গান শুনে মহম্মদ রফি তো প্রায় পাগল হয়ে গেলেন, বললেন ‘‘কেয়া ধুন বানায়া আপনে! ইতনা মিঠা…!’’
এবার আসল কথা পাড়লেন নচিকেতা ঘোষ। রফিকে বললেন “এটা বাংলা ছবির গান। প্রযোজক আপনাকে পাঁচশো টাকা অবধি দিতে পারবে গান গাইবার জন্য।”
‘‘পাঁচশো টাকায় রেকর্ডিং!’’ চমকে উঠলেন রফি। রফির আঁতকে ওঠা দেখে নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হতাশ হয়ে পড়লেন। এমন সময় রফি সাব বললেন, ‘‘ছাড়ুন, ছাড়ুন। ও সব টাকার কথা ছাড়ুন। আপনার জন্য এ গানটা আমি বিনা পয়সায় গেয়ে দেব।’’
রচিত হল সেই ক্লাসিক লাভ সং, ‘সবহি কুছ লুটাকার হুয়ে হাম তুমহারে’। গানের কথা লিখেছিলেন হিন্দি গীতিকার শৈলেন্দ্র। এক পথচলতি আগন্তুকের লিপে এ গান সুচিত্রা-উত্তমের প্রেমদৃশ্যকে কালজয়ী করে তোলে। এই হলেন রফি। ভারতীয় চলচ্চিত্রের তানসেন বলা হত মহঃ রফিকে। (Mohammed Rafi)
ভিডিও: ভারতীয় সংগীতের দুঃখ রাতের রাজা : মুকেশ
অধুনা পাকিস্তানের পঞ্জাবের কোটলা সুলতানসিং গ্রামে ২৪ ডিসেম্বর ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন মহঃ রফি। রফির ডাক নাম ছিল ফিকো। পিতা হাজী আলী মোহাম্মদের ৬ষ্ঠ সন্তান ছিলেন তিনি। রফির পিতা জীবিকার সন্ধানে ১৯১৮ সালে লাহোর পাড়ি দেন এবং লাহোরে একটি স্যালুন খোলেন। রফির বড়দার বন্ধু আবদুল হামিদ রফির সঙ্গীত প্রতিভা দেখে তাঁকে গানের তালিম নিতে উৎসাহ দেন। আব্দুল রফিকে সঙ্গে করে বম্বে নিয়ে যান। উস্তাদ ছোটে গোলাম আলি খান, উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খানের মতো প্রথিতযশা গুরুর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন রফি। (Mohammed Rafi)
১৩ বছর বয়সে লাহোরে কে এল সায়গলের সাথে প্রথম লাইভ ফাংশান করেন রফি। নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তাঁর প্রথম সুযোগ আসে পাঞ্জাবি ছবিতে। শ্যাম সুন্দরের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘গুল বালুচ’ চলচ্চিত্রে জিনাত বেগমের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন রফি। শ্যাম সুন্দরের সুরেই ‘গাঁও কি গোরী’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেই মহঃ রফির বলিউডে একক শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। (Mohammed Rafi)
১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধী নিহত হবার পর ‘শুনো শুনো অ্যায় দুনিয়াওয়ালোঁ/বাপু কি ইয়ে অমর কহানি…’ গান গেয়ে রফি আসমুদ্রহিমাচলে সাড়া ফেলে দেন। ১৯৪৮ সালেই ভারতের স্বাধীনতা দিবসে জওহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণে গানটি তিনি আবার পরিবেশন করেন এবং নেহরুর কাছ থেকে রৌপ্যপদক গ্রহণ করেন। এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একক সঙ্গীতে রফি হয়ে ওঠেন বলিউড সংগীত পরিচালকদের নয়নের মণি। (Mohammed Rafi)
শচীন দেব বমর্ণের সুরে গুরু দত্ত আর দেব আনন্দের ছবিতে রফির গান যখন পর্দায় পড়ত তা দর্শকদের পাগল করে দিত। রফি শচীন কত্তার সঙ্গীত পরিচালনায় পিয়াসা (১৯৫৭), কাগজ কে ফুল (১৯৫৯), তেরে ঘর কে সামনে (১৯৬২), গাইড (১৯৬৫), আরাধনা (১৯৬৯), অভিমান (১৯৭৩) প্রভৃতি ছবিতে কাজ করেন। বিশেষত ‘গাইড’ ছবিতে রফির কন্ঠে ‘দিন ঢল যায়ে হায় রাত না যায়’ গানটি শুনতে বহু দর্শক ছবিটি ২০ ২৫ বার সিনেমাহলে দেখতে গেছিলেন। (Mohammed Rafi)
আবার একদম ওয়েস্টার্ন ঘরানায় রফি আর শাম্মি কাপুরের জুটি ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রফির কন্ঠ না পেলে হয়তো শাম্মি কাপুর সুপারস্টার হতেননা। ‘ইয়াহু! চাহে কোই মুঝে জংলি কহে’ এর মতো দ্রুতলয়ের অর্কেষ্ট্রা ঘরানার গান গেয়ে রফি সারা পৃথিবীকে দুলিয়ে দিয়েছিলেন।
উত্তমকুমারের প্রথম হিন্দি ছবি ‘ছোটি সি মুলাকাত’ সুপারফ্লপ করলেও উত্তমের লিপে রফির হিন্দি গান ‘ছোটি সি মুলাকাত প্যায়ার বান গয়ি’ বিশাল হিট করল। রফি-আশার ডুয়েট গানে বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে উত্তমকুমারের নাচ দেখে পাগল হল বাংলার দর্শক।
বিদেশে ৩০ বার দল নিয়ে কনসার্ট করতে গেছেন রফি। রফির সঙ্গে ডুয়েট গাইতে বহুবার গেছেন তৎকালীন সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণা মুখার্জি, যিনি হলেন বলি অভিনেত্রী রানি মুখার্জির মা। বাংলা আধুনিক থেকে নজরুলগীতিও রফির মাখন মাখা কন্ঠে ভাঙা ভাঙা বাংলা উচ্চারণে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ৩১ শে জুলাই ১৯৮০ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন মহঃ রফি। মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন ওঁর ছোট ছেলে, স্ত্রী ও তিন মেয়ে। বড় তিন ছেলে তখন ইংল্যান্ডে। ৩০ শে জুলাই রফি জীবনের শেষ গান রেকর্ড করেন ‘আস পাস ছবির ‘শাম ফির কিউ উদাস হ্যায় দোস্ত’।
কদিন আগে পুজোর সময় গাইবেন বলে শ্যামল মিত্রর কাছে একটা বাংলা গান শিখে নিচ্ছিলেন রফি। সে আর হলনা। মহঃ রফির সবথেকে বড় গুণ গানের জগতে তাঁর মতো ভদ্রলোক আর কেউ আসেননি। তাঁর নম্র ব্যবহারের গুণে তিনি সিনেমাজগতে অবং শ্রোতাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আদায় করে নিয়েছেন।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।