Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গল্প: সন্তানসন্ততি

অমর মিত্র

নভেম্বর ২৪, ২০২২

Molat story Amar mitra
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

ঠিক দুপুরে ভাদুরি যেন রণরঙ্গিণী হয়ে বাপের ভিটেয় পা দিল, ভােলা, এই ভােলা… মাঠে রােয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। ভাের থেকে এই পর্যন্ত আট বিঘের অর্ধেক রােয়া শেষ করে ভােলা ঘাটে ডুব দিয়ে সবে ভাতের থালার সামনে বসেছিল, বােনের ডাক শুনে লাফ দিয়ে উঠতে যাবে তাে তাকে চেপে বসিয়ে দিল ময়না, ‘খেয়ে লাও, ও দাঁড়ায়ে থাকপে।’

শ্রাবণের মেঘে আকাশ ভারী। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে জোর একপশলা, উঠোনে কাদা, যতটা চেনা পথ হেঁটে এল ভাদুরি তার সবটার কোথাও কাদা আঠালো, পা আটকে ধরে, কোথাও পা রাখলেই হড়কে যায়। ভাদুরি তার বাপের ভিটের উঠোনের কাদায় পায়ের বুড়ো আঙুল চেপে ঘষতে ঘষতে আবার ডাক দিল, ভােলা আছিস! ময়না! 

এবার ময়না বেরয়। পাঁচ মাসের পােয়াতি, ভারী হয়ে গেছে সর্বাঙ্গ এর ভিতরে, ভাদুরির দিকে তাকিয়ে উদাস আলস্যে জিজ্ঞেস করল, ‘ডাকতেছ কেন? ও বেরুতে পারছে না। খাচ্ছে, খেটে এল খেতি দিলাম, তুমাদ্দের ঘরে তাে এ খাটাখাটনির পালা নেই, আছ কেমন?’

কথা নয় যেন বিষ। ভাদুরির গা জ্বলে যায়। তাও যদি নিজের সম্পত্তি রােয়া করত তো বোঝা যেত, আট বিঘেতে যে তারও ভাগ আছে, সে যে ভানুরাম সর্দারের পাঁচ মেয়ের চতুর্থ জন। ভাদুরি বেশ গলা উঁচিয়েই বলে, খাটাখাটনি করো তো পরের জমিতে, পঞ্চাত ডাকা করেচি, কাল দুপুরে পঞ্চাত আপিসে যেতে বলো, আমারে খপর দিতে বলল, তাই আলাম।

এবার ময়না বেরয়। পাঁচ মাসের পােয়াতি, ভারী হয়ে গেছে সর্বাঙ্গ এর ভিতরে, ভাদুরির দিকে তাকিয়ে উদাস আলস্যে জিজ্ঞেস করল, ‘ডাকতেছ কেন? ও বেরুতে পারছে না।

কথাটা কানে যেতেই ময়না যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠল, ডানা ঝাপটে নিল একবার। গলা বাড়িয়ে সে বলল, কেন সোয়ামির ভাত তােরও গেল? ভাদুরি টাল খেয়ে পড়ে যেতে যেতে সামলায় নিজেকে। মা গিরিবালার পাঁচ মেয়ের পর এক ছেলে ওই ভােলা। পাঁচটি মেয়ের কপাল একরকম। বড়জন কোকিলা বিধবা, মেজো সুন্দরীর বর মান্য সর্দার ডাকাতির কেসে জেল খাটছে, সেজো জন আদুরি আর ন মেয়ে ভাদুরি স্বামীর ঘরে আছে বটে, কিন্তু বড়ো অভাব। আদুরির স্বামী চিটেরাম খেতমজুরি করে বেড়ায়, পাট্টায় জমি পেয়েছিল, কিন্তু তা বেচে খেয়েছে। আর ভাদুরির স্বামী নিশ্চিন্ত মণ্ডল ভ্যানরিকশা চালায়, দিনে আয় করে যদি বিশ-পঁচিশ টাকা তো তার অর্ধেক টাকা ব্যয় করে আসে নেশায়। আর ছোট মেয়ে, ভােলার উপরে যে হাসি, তাকে ছেড়ে দিয়েছে তার বর ক্যানিং-এর ভজন সাঁপুই; ছেড়ে দিয়ে ফের বিয়ে করেছে ওপারে ভাঙনখালিতে। ময়না বলে, শাশুড়ির সব মেয়েগুলো অলক্ষ্মী, তাদের গায়ের বাতাস লাগাও খারাপ, সংসার চুলােয় যাবে। 

Paddy field Bengal Farmer
মাঠে রােয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে

ভাদুরি আচমকা নরম হয়ে গেল। বলল, বউ, মা তার চার ভাগটা লিখে দিল, তবু মারে মেরে তাড়ালি, তোদ্দের কি ভালো হবে ভাবতিছিস, ভয় করে না? বছর বছর পেটে ধরছিস, তাের ভয় করে না! বুড়ির অংশ লিখে নে তারে তার সোয়ামির ভিটের থে তাড়ালি, কানি বুড়ি। চোখে দ্যাখে না, বুকি ব্যথাও লাগল না।

ময়না বসে পড়ল দাওয়ায়। বেশিক্ষণ দাঁড়ালে ইদানীং তার হাঁপ লাগে। ছ-বছর বিয়ে হয়েছে, ছ-বছরের মধ্যে তিন সন্তানের মা, আবার পেটে এসেছে আর-একজন, মনে হচ্ছে তিন মেয়ের পর এবার ছেলে। হবেই। প্রথম দুবার যত সামর্থ্য নিয়ে ঘুরেছিল পোয়াতি অবস্থায়, পরের বারে তা কমেছিল, এইবারে আরও কম। তখন তো শাশুড়ি গিরিবালা ছিল, ননদরা কেউ না কেউ আসত, হাসি তো খালাসের সময় ছিলই। এবারে অবস্থা ভিন্ন। খাটতে খাটতে জান যাচ্ছে। বেশি জোরে কথা বললেও বুক ধড়ফড় করে। ভাদুরির কথা শুনেও তেমন হচ্ছে।

ভােলা এঁটো হাত চাটতে চাটতে বেরিয়ে এল, নেমে এল উঠোনের কাদায় ফেলা ইটের উপর, ইটের পর ইট টপকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, খাওয়া হয়েচে দুপুরে? ভাদুরি মাথা নাড়তে যাবে তো শক্ত হয়ে গেল ভাজের কথায়, ‘বুনির জন্যি দরদ উথলে উঠল, ও যে পঞ্চাত ডেকে সব্বোনাশ করতে এয়েছে’।

পঞ্চাত, পঞ্চাত কেন? 

ভাদুরি বলল, মারে তাড়ালি, বাপের সম্পত্তি সব একা ভোগ করতিছিস, এ লিয়ে তোর বিচার হবে। খুব রেগেছে পধান সব শুনে, দেখ তোরে কী কয়।

ছ-বছর বিয়ে হয়েছে, ছ-বছরের মধ্যে তিন সন্তানের মা, আবার পেটে এসেছে আর-একজন, মনে হচ্ছে তিন মেয়ের পর এবার ছেলে। হবেই। প্রথম দুবার যত সামর্থ্য নিয়ে ঘুরেছিল পোয়াতি অবস্থায়, পরের বারে তা কমেছিল, এইবারে আরও কম।

যা যা। ভােলা খেপে উঠল, দেখা যাবে, ভাগ এখেন থেকে। কথাটা বলেই ভােলা ঘুরে ময়নার দিকে তাকায়। বউ অন্তপ্রাণ তার, বউ ছাড়া কিছু বোঝে না জগতের। শুধু মা বোনের জন্য খচখচানি আছে বটে, কিন্তু তারা তো তার অন্ন কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে।

ভাদুরি মুখ গোমড়া করে হঠাৎ চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘুরে গেল। ভেবেছিল ভােলার ঘরে, তার নিজের মরা বাবা ভানুরাম সর্দারের ঘরে, দুপুরটা খেয়ে নেবে, খেয়ে পরে কথাটা বলবে, কিন্তু কী যে হয়ে গেল! ভাদুরি হাঁটল কাদা থপথপে পথে। মেঘ আরও নীচে নেমে বাতাস যেন ভিজিয়ে আরও ঠান্ডা করে দিল প্রায়। ভােলা হাঁ করে তাকিয়ে থাকল পথের দিকে।

Rural Woman
ভাদুরি মুখ গোমড়া করে হঠাৎ চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘুরে গেল

ময়না ডাকল, হাঁ করে দাঁড়ালে কেন, খাওয়াবা তো ডাকো বুইনরে, বলি ঘরে নিজেদের জোগাড় আছে?
না, এমনি বলতিলাম, বলতি হয় তাই, না বললি খারাপ দেখায়।

ওই হয়েছে মুশকিল, তা হলি বলো আমি বাপের ঘরে চলে যাই, তুমি বেধবা, সোয়ামি খেদানো, ডাকাতির আসামির বউ, তুমার বুনদের লিয়ে থাকো। আর ও দুটাও চলে আসুক চিটেরাম আর নিশ্চিন্ত মোড়লের বউ। মারে ডাকো, শ্মশানের চিতে থেকে বাপরে তুলে আনো, নিজিরা থাক, বউ ছেলেমেয়ের দরকার কী, তারা ভাসুক।

কথা বলে আর হাঁপায় ময়না। বিষকণ্ঠ তার। শরীরের জন্য গলা তুলতে না পারলেও বলতে ছাড়ে না, বলবে সারা দুপুর ধরে ইনিয়েবিনিয়ে, যতক্ষণ না ভােলা আবার যাবে মাঠের দিকে। এখন তো কাজ দুই বেলার।

দুই

কোকিলা, সুন্দরী, আদুরি, ভাদুরি, হাসি— পাঁচ মেয়ের পর ভানুরাম সর্দারের এক ছেলে ভােলানাথ। ভােলানাথের পরও একটা হয়েছিল, মেয়ে, কিন্তু বাঁচেনি, অপঘাতে জলে ডুবে মরেছিল। কোকিলা তো আজকের বিধবা নয়, বিয়ের দু-বছরের মাথায় তার কপাল পোড়ে। ক্ষীণজীবী এক চাষার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল ভানুরাম। সে কোকিলাকে কিছুই দেয়নি, না সন্তান, না সোয়ামির আহ্লাদ। পরের মেয়ে সুন্দরী, আদুরির বিয়েও ভানুরামের দেওয়া। ভাদুরিকে নিশ্চিন্ত মণ্ডলের হাতে সমর্পণ করেছিল মা গিরিবালা আর ভাই ভােলানাথ। পরেরজন হাসিকেও ওই দুজন।

কোকিলা তো আজকের বিধবা নয়, বিয়ের দু-বছরের মাথায় তার কপাল পোড়ে। ক্ষীণজীবী এক চাষার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল ভানুরাম। সে কোকিলাকে কিছুই দেয়নি, না সন্তান, না সোয়ামির আহ্লাদ। 

ময়না বলে, এমন কপাল দেখিনি সত্যি, কারও ভাত জোটে না! কথাটা গিরিবালার সামনেই ইদানীং বলত ময়না। তখন গিরিবালার পাশে হাসি কেন, সুন্দরীও থাকত। তারা ছাড়ত না, মুখ তাদেরও কম নয়। ভানুরামের মৃত্যুর পর তার আট বিঘে সম্পত্তির অধিকারী ছয় সন্তান আর বউ। গিরিবালার কাছ থেকে তার প্রাপ্য দু আনা পাঁচ গন্ডা দু-কড়া দু-ক্রান্তি বারো তিল অংশ লিখিয়ে নিয়েছে ভােলানাথ তার নিজের নামে, সে-ও আজকের কথা নয়। বোনেরা লিখে দেয়নি বটে, কিন্তু সম্পত্তির দখলও পাচ্ছে না, ভােলা ছাড়বে না। ময়না তাকে ছাড়তে দেবে না।

শ্রাবণের আকাশ আজ মৃত ভানুরামের পুত্র ভােলানাথের মাথায় প্রায়। মাথার উপরে খোড়ো চাল, তার উপরে মেঘ। সন্ধে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। তিন মেয়েকে ভাত খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ভােলানাথ ময়না মুখোমুখি ভাতের থালা নিয়ে। মাঝে কেরাসিন কুপি যত না আলো দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি ধোঁয়াচ্ছে।

Rainy Season
শ্রাবণের আকাশ আজ মৃত ভানুরামের পুত্র ভােলানাথের মাথায় প্রায়

ভােলা জিজ্ঞেস করে, এবারে বেটা তো হচ্ছেই।

হবে, কিন্তু ওদের ঢুকাবা না, ওই অলক্ষ্মীদের দেখলি আমার গা গুলােয়, পেটে ব্যথা ওঠে, মাথা ঘোরে।

তার মানে?

মানে আবার কী, ওদের বাতাসে ছেলেডা মেয়ে হয়ে যেতি পারে, এ বাড়ির মেয়ের কপাল মানে তো…। 

চুপ কর! ভােলানাথ হাতের তােলা গরাস মুখে না তুলে পাতে প্রায় ছুড়ে ফেলে যেন, নিজির পেটের সন্তানদের লিয়ে এসব ভাবতি ভয় করে না?

ভয়ের কী আছে! কেমন যেন উদাসীন হয়ে বলে ময়না, আমার তো চারডেই ছেলে হওয়ার কথা ছেল, তিনডেই হয়েছে মেয়ে। এডা যাতে ও ফাঁদে না পড়ে সেইজন্যি তো ওকথা বলতিছি।

ছেলে হবার আবার কথা থাকে? হঠাৎ রাগ জল হয়ে যায় ভােলানাথের, জানে সে রাগ করে ভাত ফেলে উঠে গেলেও ময়না ডাকবে না। তাকে গোটা রাত পেটে কিল মেরে পড়ে থেকে শেষে ওই ময়নার কাছেই মাথা মুড়োতে হবে।

ময়না বলল, হ্যাঁ থাকে, বে-র আগে আমার হাত দেকে ঘুঁটিয়ারির বিষ্টু জ্যোতিষ বলিল সব ছেলে হবে, কাজের পরে ডান কাত হয়ে শুয়ো।

হাঁ হয়ে গেল ভােলা, বলিল!

হ্যাঁ, মিথ্যে বলব কেন তার নামে! সে হল পেরায় সন্নিসী মানুষ। কপালে বাঁ হাত তোলে ময়না, ডান হাতে গরাস মুখে নেয়।

তা ডান কাতে শুসনি?

শুইছি। 

তবে যে হল না?

হবে কী করে! বে হল তো ওই অলক্ষ্মীদের ভায়ের সঙ্গে, যারা কিনা ভাইকে পঞ্চাতে ডাকা করে, যখন জ্যোতিষমশায় হাত দেকিল তখন তো আমার বে-র ঠিক, তবে তুমার সঙ্গে লয়। 

মুখের গরাস আটকে গেল গলায়। গিলতে গিয়ে দম আটকে যায় যেন ভােলার, সে সামলায় কোনওক্রমে, কার সঙ্গে?

ডাইমনহাবড়ার এক ছুতাে মিস্ত্রির সঙ্গে। এটটা ক্যাটাল গাছে দুখানা আলমারি বানাতি পারত, আটকে গেল ট্যাকায়, না হলি তো আমার মেয়ের কথাই লয়।

ভােলা বোঝে কথা সব ময়নার বানানো, তৈরি করা বুলি। এ কোনওদিন হতে পারে, জ্যোতিষী হাত দেখে কুমারী মেয়েকে বলছে ডান কাতে শুয়ো কাজের পর, সে জ্যোতিষের বয়স কত, কেমন লোক সে?

হি হি করে হাসল ময়না, অত কথায় দরকার কী? বলিল ছেলে হবেই, অথচ হচ্ছে না।

village family lunch
মুখের গরাস আটকে গেল গলায়

ভােলানাথ উঠে পড়ে। ময়নার কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে তা বোঝা বড়ো দায়। ভােলার বড় ভাগ্য যে তাকে নিয়ে ঘর করছে। বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল কত জায়গা থেকে, সােনারপুর থেকে ক্যানিং লাইন, বারুইপুর থেকে ডায়মন্ডহারবার, লক্ষ্মীকান্তপুর লাইন, যত স্টেশন আছে, যে-কোনও জায়গায় বিয়ে হতে পারত তার। ওই লাইনেই তো হয়েছে। ভােলা বলতে চেষ্টা করে উঠতে উঠতে।

হ্যাঁ, হয়েছে। পাঁচটা ননদ, কানি বুড়ি শাউড়ি, এরে কি সুকির বিয়ে বলে? শুধু তুমার মুখ চেয়ে ডান কাতে শুচ্ছি, বুনগুলারে দ্যাখপে কেডা, যদি ভাই না থাকে কার কাছে যাবে বেপদে পড়লে?

অন্ধকারে এসে দাঁড়ায় ভােলানাথ। বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে আবার। ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। ভাদুরি গেল কোথায়? পিয়ালিতে সুন্দরীর ঘরে? মা বুড়িও ওখানে আছে খবর পেয়েছে সে। কী অন্ধকার হয়েছে আকাশ! সুন্দরীর ঘর তো পোড়া ভিটের মতো। মান্য সর্দার জেলে যাওয়ার পর তার পেট চালানোই দায়। চলছে কী করে! এ বাড়িতে ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে ময়না। ভাঙা পোড়া ভিটেয় হাসি, সুন্দরী, কোকিলা… সব গিয়ে উঠেছে। রাতের বৃষ্টিতে ও ঘর টিকবে তো! না টিকলেও উপায় নেই। ময়না তাদের এ ভিটেয় পা দিতে দেবে না। বলে, অতজনের খোরাকি দিতে হলে এ ভাঙা নৌকো ঠিক ডুববে।

তিন

পঞ্চায়েত অফিসে ঠিক দুপুরে হাজির হয়েছে গিরিবালার মেয়েরা। সকাল থেকে বেলা বারােটা পর্যন্ত কারও ফুরসত নেই। রােয়া বােনা চাষের কাজে সবাই ডুবু ডুবু মাঠে। পরের দুই-আড়াই ঘণ্টা যে ফাঁক যায়, তখনই বিচারের সময়। সময় তো প্রধান, মেম্বার কারও নেই। তাদের জমিনেও চাষ চলছে। নিজেরা কাদায় না নামুক, মাঠের আলে ছাতা মাথায় বসে থাকতে তো হয়। মা গিরিবালাকে ভাদুরির স্বামী নিশ্চিন্ত মণ্ডল তার ভ্যানে চাপিয়ে পিয়ালি থেকে নিয়ে এসেছে পঞ্চায়েত অফিসে। পাকা রাস্তার ধারে, তাই অসুবিধে বিশেষ নেই। কিন্তু গিরিবালার এ কী দশা হয়েছে! মাথা ন্যাড়া, কানা চোখটা যেন আরও গর্ত হয়ে অন্ধকার, ভালো চোখটা ফ্যাকাশে। শুধু জল গড়াচ্ছে দু-চোখ দিয়েই। পঞ্চায়েত প্রধান মেম্বারের এ বিচারে খুব বিরক্তি, কেননা রায় দেওয়া বড় কঠিন। সব পক্ষই তাঁদের পক্ষের লোক, যে যেখানে থাকে তাঁদের প্রতীকেই ছাপ মারে। তবে কিনা গিরিবালা, ভােলানাথ আর ময়নার ভোটটা তাঁদের দুজনের নামেই পড়ে, এই পঞ্চায়েতেই তাদের নাম।

পাঁচ মেয়ে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছে। তাদের একটি বিধবা, একটির স্বামী ডাকাতির আসামি, একটির স্বামী তাকে খেদিয়ে দিয়েছে ঘর থেকে। আদুরি ভাদুরির স্বামী চিটেরাম আর নিশ্চিন্ত হাজির। হাজির ভােলা সর্দার, তার বউ ময়না, তিনটে কচি মেয়ে সঙ্গে। মেয়েরা মা গিরিবালাকে বসিয়ে দিয়েছে পঞ্চায়েতের পাকা বারান্দায়।

কিন্তু গিরিবালার এ কী দশা হয়েছে, মাথা ন্যাড়া, কানা চোখটা যেন আরও গর্ত হয়ে অন্ধকার, ভালো চোখটা ফ্যাকাশে। শুধু জল গড়াচ্ছে দু-চোখ দিয়েই।

কথা আরম্ভ করল ভাদুরি। দ্যাখেন বাবুরা, বাপ ভানুরাম সদ্দার যে আট বিঘে জমিন রেখে গিইলো তার ভাগ মেয়েরা পাবে কি না এই হল পেথথম বিচার। দ্বিতীয় বিচার হল গিয়ে মা গিরিবালার অংশডা ওরা লিখে নিয়ে মাকে খেদায়ে দিল, এর কি বিচার হবে না? চন্দর সূয্যি কি পলায়েছে দেশ ছেড়ে? 

Bengal Village
ময়না তাদের এ ভিটেয় পা দিতে দেবে না

জবাব দিল ময়না, মারে তাড়াইনি, ওই সব্বনেশে মেয়েগুলান লিয়ে গেছে টেনে, আর মেয়েরা কিসির সম্পত্তি লেবে, তাদের বেতে খরচ হয়নি?

মেম্বার, প্রধান চুপ। প্রধান মধ্যবয়সি, ভানুরাম সর্দারের পাঁচ মেয়েকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। বয়স কারও বেশি নয়। সব শক্ত সমর্থ চেহারা, চোখেমুখে বন্যতা। মেয়েদের মতো বউটাও কম যায় না। ভারী পেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে গলা খরখর করে উঠছে, বে দিতি খরচ হয়নি ভায়ের?

হাঁ হাঁ, বে কত খরচ করে দেছে তা জানা আছে। বলে উঠল ক্যানিংয়ের ভজন সাঁপুই-এর ত্যাগ দেওয়া বউ হাসি, বুনগুলারে ধাক্কা মেরে ফেলে দেচে বাবু, আমাদের বে তো দেয়নি। 

ময়না কঠিন চোখে তাকায় হাসির দিকে, প্রায় হিস হিস করে ওঠে, কেন সতীন লিয়ে ঘর করা যায় না, সোয়ামি বাঁধতি জানিসনে, মোদের দোষ?

হাসি বলে, খোঁজ লিয়ে তো দাওনি কার ঘরে পাঠাচ্ছ।

হাসির খুব আপত্তি ছিল ক্যানিংয়ের এই বিয়েতে। কিন্তু তাকে ধরেবেঁধেই বিয়ে দিয়েছিল ময়না, গিরিবালা, ভােলানাথ। ময়নার পাঁচ ভাইয়ের একটি খুব বড় চাকুরে, সেটেলমেন্ট আপিসের চেন পিয়ন। আমিনবাবুর সঙ্গে চেন টেনে টেনে জমি মাপ করে বেড়ায়। উপরি আছে, খাতির আছে। সে আসত মাঝেমধ্যে বোনের বাড়ি। বোনকে তো শুধু দেখা নয়, বিয়ে না-হওয়া দুটো ননদও আছে, তাদের সঙ্গে একটু আমােদ-আহ্লাদ করা। কিন্তু ভাদুরি নয়, হাসির সঙ্গেই সে প্রায় জুড়ে যাওয়ার জোগাড়।

ভােলা প্রস্তাব করেছিল বউয়ের কাছে, হাসির সঙ্গে রাজকুমারকে মানায় ভালো। গরগর করে উঠেছিল ময়না, বেটাছেলের পাশে সব মেয়েছেলেকেই ভালো মানায়। ভায়ের আমার দর বাড়তেছে দিন দিন, বাসন্তীতে দশ বিঘে জমিন দেবে এমন কথাও হয়েছে, পারবা দিতি? আছে তো দুটো খিরিশ গাছ।

ময়নার পাঁচ ভাইয়ের একটি খুব বড়ো চাকুরে, সেটেলমেন্ট আপিসের চেন পিয়ন। আমিনবাবুর সঙ্গে চেন টেনে টেনে জমি মাপ করে বেড়ায়। উপরি আছে, খাতির আছে। সে আসত মাঝেমধ্যে বোনের বাড়ি। বোনকে তো শুধু দেখা নয়, বিয়ে না-হওয়া দুটো ননদও আছে, তাদের সঙ্গে একটু আমােদ-আহ্লাদ করা। 

হ্যাঁ, খিরিশ গাছ পুঁতে রেখে গিয়েছিল ভানুরাম। মেয়েসন্তান হবার সঙ্গে সঙ্গে তার নামে গাছ, খিরিশ, কাঁটাল যা পেরেছে মাটিতে বসিয়ে দিয়েছিল। মেয়েদের সঙ্গে গাছও বড় হয়েছে, এক-একটা গাছে এক এক মেয়ের বিয়ে।

ময়না বলেছিল, ওসব চিন্তে ছাড়ো, ওরে আমি আসতি বারণ করি দেব। তুমার দিদি বলো, বুন বলো, ওই ওদের জন্যি এ জীবনে আর আমাদের ওঠা হবে না, ওপরে উঠতি ইচ্ছে হয় না? জমিজমা মাছের ঘেরি পাকা দালান!

হি হি করে হেসেছিল ভােলানাথ, বড়ো আশ্চর্য কথা বলিস তুই।

হাসি চিৎকার করে উঠেছে, আশ্চয্য বটে, বে দিল তো গাছ বেচে, গাছ আমার বাপ ভানুরাম পুঁতি রেখি গিইলো বে-র জন্যি। 

ওই গাছে তো ভাইও অংশ পায়, পায় কি না, তার বিচার কেডা করবে? পালটা গর্জে উঠেছে ময়না, তারপর আরও কোমর বেঁধে বলল, বিচার যদি হয় ভালো করেই হোক কে কত বড় সত্যবাদী দুয্যোধন, কেন বে দিইলাম, কারে নষ্ট করতি গিইলো ওই মেয়েছেলে।

বারান্দা পেরিয়ে পাকা রাস্তা, দূর দক্ষিণে সমুদ্রমুখী হয়ে কালো মেঘের আকাশে মিলিয়ে গেছে যেন। এ পথে বাস চলে টাইমে টাইমে। ফলে অধিকাংশ সময়েই পথ নির্জন থমথমে। মেঘ এসে সেই নির্জনতা যেন আরও বাড়িয়েছে। আকাশের অন্ধকার ঢেলে দিচ্ছে মাটিতে। হাসি চুপ করে যায়। ভাইয়ের বউ তার চেয়ে বয়সে ছোট। ভাইও ছোট। কিন্তু ভােলা বিয়ে করেছিল আগে। বিয়ে তো করেনি, তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল মেয়েকে ওর মা বাপ। সেসব অন্য কথা, কিন্তু ঘরে বিয়ে না-হওয়া দিদি রেখে কেউ বিয়ে করে! এবার ভাদুরি ঘোষণা করে, আমার মা-ডারে ওরা বিষ খাউয়েচে বাবু, ওই ময়না, বিষ খাউয়ে পাগল করে দেছে, দে তার অংশডা লিখে লিয়ে ঘর থে তাড়ায় দেছে, এর বিচার হোক।

Man with an Umbrella
মাঠের আলে ছাতা মাথায় বসে থাকতে তো হয়

সকলে দেখল কানি বুড়ি গিরিবালা ঝিম মেরে বসে। মাথা কামিয়ে দেওয়ার পর তার রূপ যেন আরও খোলতাই হয়েছে। প্রধান এতক্ষণে বললেন, তা যদি হয় তো খুব অন্যায়।

অন্যায় তো বটে, বুড়ি মার পেটে অন্ন দিয়ার দায়িত্ব কার? বলল ভ্যানরিকশাচালক নিশ্চিন্ত মণ্ডল, তোর মায়েরে লিয়ে আলাম ভােলা, ভাড়াটা তুই দিবি।

ময়না বলে, মারে তাড়াইনি, বলেন তো লিয়ে যাব এক্ষুনি।

তাড়াসনি মানে? তবে মা পিয়ালিতে রয়েছে কেন?

তুমরা লিয়ে গেছ। মা তার অংশডা হাসিমুখে লিখে দেছে বাবু, ওই মারে তার পাঁচডা অলক্ষ্মী মেয়ে ছিড়ে খাচ্ছে। 

হেঁকে উঠল আদরি, বলল, মিথ্যে কথা! ও মা, বলো দেকি তোমার কাচ থেকে জোর করে লিখে নে তাড়ায়ে দেছে কিনা? 

বুড়ি গিরিবালা প্রাণহীন পতঙ্গের মতো, রক্তমাংস বের করা খড় ভরা মানুষীর মতো কিছু শোনে না, কিছুই বলে না। চোখ আর চোখের গহ্বর দিয়ে শুধু জল গড়ায় তার। আদুরি আঁচল দিয়ে মোছায়, বলে, বলো দেকি মা।

হাঁ হাঁ বলেন মা, চিটেরাম মণ্ডল ঝুঁকে পড়ে তার উপর, আপনারে আমি ফিরি নে আলাম বিচারশালায় ওই কথা শুনতি।

ঝুঁকে এল বিধবা বড় মেয়ে কোকিলা, বলো, বলতেছ না কেন, ও তুমারে আলোকলতার রস খাউয়ে মাথা খারাপ করায়ে লিখে নেছে কি না অংশ! 

হ্যাঁ হ্যাঁ বলো, অন্য চার কন্যা ঝুঁকে পড়ে গিরিবালার উপর, কারও আঁচল সরে যায়, কারও চুলের খোঁপা খুলে যায়। গিরিবালার পরিবর্তে তার মেয়েদের দ্যাখে মধ্যবয়সি পঞ্চায়েত বাবুরা। এ দেখায় কোনও দোষ নেই। কানি বুড়ির দিকে তাকাতে যেন ভয় হয়। গিরিবালার ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু আওয়াজ বেরোয় না গলা থেকে।

এডা কীরম হল, কালকে যে মা বলল বলবে সব, আজকে চুপ, বুড়ি মুখ পোড়াচ্ছে। নিশ্চিন্ত মণ্ডল বিড়বিড় করে ওঠে।

কী হল, বলো? হাসি বুড়িকে ঝাঁকিয়ে দেয়।
আহা করো কী, প্রধান বললেন, ওসব বাদ দেও, দলিল যহন হয়ে গেছে তার বিচার এহেনে হবে না, নেছে নেছে, মা নেশ্চয় দেছে তাই নেছে।

না দেয়নি, তালি মারে তাড়াল কেন? ভাদুরি চিৎকার করে ওঠে, ওটা অন্যায্য, মারে ফিরত নিয়ে যাক ভােলা।।

হাসি বলল, শুধু মায়েরে ফেরত নিলে হবে না, আমাদের অংশ দিয়ে দিক, বাপের ঘরে আমরা যাব না তাই বা কী করে হয়?
ময়না মাথা নাড়ে, বে-র খরচ, সেডার হিসেব?

বে-র খরচ! বিধবা কোকিলদাসী এবার হা হা করে যেন তেড়ে যায় ভায়ের দিকে, যত্তোসব চোর ছ্যাঁচোড় ধরে বে দিয়ে পয়সা ইনকাম করেচে, বে-র খরচ দেখাচ্ছিস! 

জামাই চিটেরাম বলল, বাবু, শালিদ্দের খুব কষ্ট, আমাদ্দের দেখতি হয়, এডা কেন হবে, দেখে বে দেয়নি কেন, মেয়ে পার করলিই হল!

কথাটা সত্য তা প্রত্যয় হয় সবকটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে। মেয়েগুলােকে যেমনতেমন বিয়ে দিয়েছে ভােলা। মান্য সর্দার যে ডাকাত, তা কে না জানে! ক্যানিংয়ের ভজন সাঁপুই যে দুশ্চরিত্র তাও কে না জানে; বছর বছর বিয়ে করে। এ তো ওর রােগ। আর একটা রোগীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল কোকিলার, দু-বছর যেতে না যেতে বিধবা। চিটেরাম, নিশ্চিন্ত মণ্ডলই বা কোন গুণের আধার, সংসার চালাতে পারে না বলেই না শ্বশুরের সম্পত্তি নিতে এসেছে। এখন মেয়েরা কীভাবে খেয়ে পরে বাঁচবে? প্রধান কেন, দশ গাঁয়ের মানুষই তো এ কথা জানে।

ময়না জবাব দেয় চিটেরামের কথার, যেমন বাবা রেখে গেছে তেমন বে দিয়া হয়েছে, বাপে তো দিইলো তিনডেরে বে, ভাই দেছে দুডারে, তফাত কী হয়েছে বলেন বাবুরা।

Old rural Woman
সকলে দেখল কানি বুড়ি গিরিবালা ঝিম মেরে বসে

হাসি রাগে জ্বলতে থাকে। ময়নার ভাইয়ের সঙ্গে সেই বিয়েটা তো হতে পারত তার। বারুইপুর টাউনে ঘর ভাড়া নিয়ে সংসার পাততে পারত। এটা তো ময়নার দোষ। কিন্তু বলে না, বলতে পারে না। প্রধান নয়, এবার মেম্বার কথা বলেন, তাহলি হল কী, মিটতেছে না তো কিছুই।

সম্পত্তি ভাগ হোক, চিটেরাম বলল, তাহলিই মিটে যায়। 

হাঁ হাঁ, ঝা আছে ভাগ হয়ে যাক, বলল ভাদুরি।

প্রধান বলেন, হতে পারে ভাগ, বণ্টননামা করে ভাগ হতে পারে। 

বণ্টননামা মানে! ময়না চিৎকার করে ওঠে।

ময়নার কণ্ঠস্বরে প্রধানও যেন কুঁকড়ে যান, সাবধানে কথা বলার দরকার, না হলে ভোট অন্যদিকে চলে যেতে পারে। বিড়বিড় করেন, বণ্টননামা হোক, কিন্তু জমিগুলো থাক ভােলার কাছে, মা থাক ছেলের কাছে। আর বোনরা যদি চায় তো তাদের অংশ বেচে দিতে পারে ভায়ের কাছে।

ট্যাকা দিতি হবে? জিজ্ঞেস করে ময়না। 

বিনি ট্যাকায় কিনাবেচা হয়? চিটেরাম দাঁত বের করে হাসে। 

তার মানে! ময়না তাকায় স্বামীর দিকে, ভােলা কিছু বলুক।

ভােলা বলল না, ছুটে গেল প্রধানের দিকে, এডা করবেন না, ট্যাকা দেব কী করে, না খেয়ে মরে যাব বাবু।

তাহলে মায়েরে মেরে তাড়ালি কেন? প্রধান মেম্বার দুজনে এবার চোখ রাঙান।

মায়েরে তো তাড়াইনি, মায়ের কাছে পাঁচডা বুন, এমনকী ওই জামাই নিশ্চিন্ত মণ্ডল, চিটেরামবাবুও এসে উঠত। অত খোরাকি দেব কী করে, সেকথা বলতি গেছে আমার বউ তো ওরা আমার মায়েরে লিয়ে গেল, পঞ্চাত ডাকা করল, এডা হল সত্যি কথা! ভােলানাথ প্রায় কেঁদে ফ্যালে।

বাহ, মার কাছে বাপের ঘরে যাব না? একসঙ্গে ভাদুরি, আদুরি, সুন্দরী বলে ওঠে।

মায়েরে দেখতি ইচ্ছে করে না? বলে ওঠে বিধবা কোকিলা। আমার বাপ ভানুরাম সর্দার কত বড় মানুষ ছেল, কত বড় হেদয় ছেল তার। তার বেটা এরম হল, বিচার করেন বাবু, সব ওই ময়নার জন্যি। হাসি এতক্ষণে গুছিয়েগাছিয়ে কথাটা বলল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, সব ওই ময়নার জন্যি। বলল আদুরি, ভাদুরি।

বাপের মতন হেদয় আমার ভায়ের, ওর পরে এডটা বুন ছিল, নাম ছেল ক্ষ্যান্ত, সে জলে ডুবে মলো। বাঁচাতি তো ওই ভাই ঝাঁপ দেছিল, ডুবি মরছিল পেরায়, শেষে ভাইরে আমি বাঁচাই, ভাই আমার ভালো, খারাপ হল ওর বউ। হাসি এবার যেন বাণে বাণে বিদ্ধ করছে ময়নাকে।

তাই? মেম্বার জিজ্ঞেস করেন।

হাঁ। ভােলানাথ গুম হয়ে যায়।

তাহলি বুন আলি এমন করো কেন, বুন তোমার কাছে আসপেই। মেম্বার কথাটা বলে সিগারেট ধরান, হঠাৎ যেন মনে পড়ল নেশার কথা।

আলি তো যায় না ওই হাসি সুন্দুরি কোকিলা দিদিরা। বিড়বিড় করে ভােলানাথ। পরিবেশটা থমথমে হয়ে যায়। প্রধান চুপ। তাঁর যেন ভালো লাগছে না বিচার করতে। এর কোনও বিচার হয় না। কোনও তত্ত্ব নেই এদের বোঝানোর। সব ছোটলােকের কারবার। এ কারবারে না থাকাই যেন শ্রেয়। কেউ না কেউ অসন্তুষ্ট হবেই। এখানে আইনও খাটে না। আইন করলে ভােলা যায় কোথায়? তিনটে আর বউ-এর পেটে একটা, তার তো এক ফসলি আট বিঘেয় চলে না সংসার।

বাপের মতন হেদয় আমার ভায়ের, ওর পরে এডটা বুন ছিল, নাম ছেল ক্ষ্যান্ত, সে জলে ডুবে মলো। বাঁচাতি তো ওই ভাই ঝাঁপ দেছিল, ডুবি মরছিল পেরায়, শেষে ভাইরে আমি বাঁচাই, ভাই আমার ভালো, খারাপ হল ওর বউ।

ময়না বোধহয় এতক্ষণে সত্যিই বাণবিদ্ধা, বসে পড়েছে মাটিতে। দাঁড়াতে পারে না বেশিক্ষণ। শরীরে ক্রমশ আলস্য আসছে, বিড়বিড়িয়ে বলল, সব আমার দোষ, বুনদের থাকতি দিইনে, হাঁ বাবু দিইনে, ওরা যে আলি আর যায় না, তিনটে বাচ্চা, মােরা দুজন, পেটে একডা আর শাউড়ি, এতজনায় খেতি কুলােয় না, পয়সা রেখে যে এক-দু বিঘে কেনব, সে উপায় নেই, আমার মেয়েগুলান বড় হলে কি তারা পিসিদের মতো কপাল করবে, বলেন পধান সায়েব!

মানে! হাসি ঘুরে দাঁড়ায়, আমাদের কপাল মানে?

ময়না তার দিকে তাকায় না, বিড়বিড় করে যায় ক্রমাগত। এডা তো আনন্দের কথা লয়, আমি চাই আমার মেয়েগুলান যেন চোর ডাকাতের হাতে না পড়ে, এহন যদি সব খােলে পুরে দিই, তবে পরে কী হবে, এটটু ওঠপো না ওপরে, জমি হবে না আর এটটু?

ভােলা এতক্ষণে যেন সাহস পায়। বউ ঠান্ডা গলায় কথা বলছে দেখে তার সাহস বাড়ে। সে হাত জোড় করে মা গিরিবালার সামনে দাঁড়ায়, মা, ময়নার কথা শুনতেছ, আমি এটটু উঠতি চাই, এটা বোঝ, বুনিরা কপালে খাক, আমার সন্তানগুলান বাঁচুক, অতজনকে তো আমার পক্ষে সুবিধে হবে না মা।

কোকিলা দাসি থেকে আদুরি, সুন্দরীরা মাথা নামিয়ে একসঙ্গে যেন নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে। তাদের চোখ দিয়ে টপট্‌প, নিঃশব্দে শানের মেঝেয় জল পড়ে। বাইরে বৃষ্টি আরম্ভ হল ফিসফিসিয়ে। দূরে ধান রােয়ার জমিনে কে যেন হেঁকে কাকে ডাকে। ডেকে যায় ক্রমাগত।

ভােলা এবার হাত জোড় করে ভানুরামের পাঁচ মেয়ের দিকে ঘোরে। বলতে থাকে, তুমরাই বিচার করো, নিজিরা ভিখিরি হয়েচ, কেন হয়েচ? বাপের ক্ষ্যামতা ছেল না তাই হয়েচ। বাপ ঝেমন বে দেছে, আমিও তেমন দিছি, তোমরা পধান বাবুরে বলো পাঁচডা  ভিখিরির সঙ্গে আর এটডা যেন না বাড়ায়। ময়না কাঁদে এবার, জমি ভাগ নিলি আমার মেয়েগুলানও বেধবা হবে, ডাকাতের হাতে পড়বে, এটটু সুযােগ দ্যাও উঠি ওপরে, ভানুরামের নাম রাখি। 

হাসি মাথা নামিয়ে বসে পড়েছে। দু-হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে দিয়েছে। ভােলা বলে, যা হাসি যা, উ ভজনের বিচার করা ছাড়িস নে।

হাসির কান্নার শব্দ শোনা যায়। চিটেরাম আর নিশ্চিন্ত মন্ডল সরে যায়। নেমে যায় বারান্দা থেকে। কী ভেবে এসেছিল আর কী হল! হাজার হলে ভাইবুনের বেপার, ও বড় কঠিন ঠেক। এর চেয়ে কামাই-এর চেষ্টা করলে ঠিক হত। চিটেরাম গিয়ে নিশ্চিন্ত মণ্ডলের ভ্যানরিকশার হর্ন টেপে, প্যাঁক প্যাঁক। 

প্রধান, মেম্বার চুপ। তাঁদের মাথায় ঢুকছে না কিছুই। কে কী বলতে চায়, কে বাদী, কে বিবাদী, সব ভুল হয়ে যাচ্ছে যেন। কেউ কথা বলে না আর, কিন্তু বোধহয় চিটেরামের হর্নের শব্দে ঘুম ভাঙে গিরিবালার। হঠাৎ মাথাটা নড়ে, ঘাড় ওঠে তেরচা হয়ে আকাশের দিকে, ফিসফিসিয়ে ঘা খাওয়া পাখির গলায় যেন চিঁ চিঁ করতে থাকে মা গিরিবালা, বলতে থাকে, উঠপি ভালো, কিন্তু একা কি উঠা যায়? সবকে লিয়ে উঠতি হয় বাপ, টেনে তোল, দিদিগুলান তো এই মায়ের পেটেই হইছিল, তুর আগে আগে হইছিল, বুনডা জলে ডুবি মরল, পারলি নে তুলতি, কিন্তু ইবার তােল.।।

ভােলা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে আছড়ে পড়ে মায়ের পায়ে, কী বলতেছ, ওম্মা কী বলতেছ? গিরিবালা চিঁ চিঁ করে ডাকে। পাঁচ মেয়ে পাঁচ জায়গা থেকে উঠে চোখের জল ফেলতে ফেলতে এসে ঘিরে ধরে তাদের মাকে, কী বলতেছ, ওম্মা কী বলতেছ…?

ছবি সৌজন্য: Max pixel, Wikimedia Commons, Needpix,com, Rawpixel, PEAKPX,

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Picture of অমর মিত্র

অমর মিত্র

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।
Picture of অমর মিত্র

অমর মিত্র

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com