banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

শুধু সেই সে দিনের মালি নেই! (পর্ব ১)

পল্লবী মজুমদার

মে ১, ২০২০

Bengali songs of Manna Dey
Bengali songs of Manna Dey
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

চোখ বুজে নামটা মনে করলে প্রথমেই মনে পড়ে একটা মাথা-ঢাকা ফারের টুপি। তারপর মোটা খয়েরি ফ্রেমের চশমাটা। ডান হাতের আঙুলগুলো ঝরনার মতো হারমোনিয়ামের রিডের ওপর খেলা করছে। বাঁ হাতে বেলো। আর মুখের সামনে মাইক্রোফোন। আর সেই মুখ দিয়ে যে অমৃতসুধা বেরিয়ে আসছে, তার বর্ণনা দেওয়া কি কারও পক্ষে সম্ভব? কেমন করে গাইতেন ‘হয়তো তোমারই জন্য’ কিংবা ‘আমার ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে’…এ প্রশ্নের জবাব কি কারও কাছে থাকা সম্ভব! তবু ফিরে ফিরে জানতে ইচ্ছে করে। আর পিছুডাক দেয় ওই সোনাঝরা বাংলাগানের দিনগুলো, যখন সন্ধে নামলে জলসায় এসে বসতেন শ্রী প্রবোধচন্দ্র দে। না, এ নামে তাঁকে কেউ চেনে না। দুনিয়াজুড়ে তাঁর একটাই নাম সবার মুখে মুখে – মান্না দে। কখনও প্লে-ব্যাক, কখনও আধুনিক, কখনও ভক্তিগীত, কখনও রাগপ্রধান, নিজের গলাটাকে নিয়ে কী যে করে গিয়েছেন জীবনের এতগুলো বছর ধরে, শুনে শুনেও বিশ্বাস হতে চায় না।

Suparnokanti Ghosh
কিংবদন্তী সুরকার নচিকেতা ঘোষের সুযোগ্য পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ, যাঁর সুরে আমৃত্যু গান গেয়েছেন মান্না। ছবি – সুপর্ণকান্তির ব্যাক্তিগত সংগ্রহ থেকে

আজ, ১ মে ২০২০, তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্তি। একশোটা বছর পূর্ণ হল এই ক্ষণজন্মা প্রতিভার জন্মের পর। নতুন প্রজন্মের একজন হয়ে এই বিশেষ লগ্নে তাঁকে ফিরে দেখার সাধ নিয়ে দুরুদুরু বুকে দ্বারস্থ হয়েছিলাম আর এক স্বনামধন্য শিল্পীর। তাঁর নাম সুপর্ণকান্তি ঘোষ। মান্না দে-র আদরের ‘খোকা’। খোকা কেন? কারণ তিনি যে এককালের বাংলা সঙ্গীতজগতের সন্তানবৎ! তাঁর বাবার নাম যে শ্রী নচিকেতা ঘোষ। মান্না-র প্রিয় নচিবাবু, যাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধে সুপারহিটের ঝড় তুলেছেন এক সময়। তাঁর পুত্রকে ‘খোকা’ই তো বলবেন মান্না! আর ‘খোকা’-র কাছে আমৃত্যু তিনি ছিলেন মানাকাকু। আদরে আবদারে বকুনিতে ভালোবাসায় রাগে অভিমানে চোখের জলে, মানাকাকু আর তাঁর খোকা জড়িয়ে ছিলেন এক নিবিড় বিনিসুতোর বাঁধনে, যা মান্নার মৃত্যুর সাত বছর পরেও এতটুকু ছিন্ন হয়নি। বরাবর মানাকাকুকে ফোন করার জন্য আলাদা একটা মোবাইল রাখতেন সুপর্ণকান্তি। সে মোবাইল আজও রাখা যেমন কে তেমন। শুধু চেনা রিংটোনটা অনেকদিন শোনেননি বলে খোকা অভিমান করেন আপনমনে।

চৈত্রের এক সকালে সে সব গল্প শুনব বলেই ফোন করে ফেলেছিলাম সুপর্ণদাকে। প্রথমেই সাফ বলে দিলেন, “দ্যাখো, মান্না দে-র মৃত্যুর পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা কি কেউ ভরাট করতে পারবে, এসব আমাকে জিজ্ঞেস কোরও না। কিংবদন্তীর জায়গা কেউ ভরাট করতে পারে না, কোনওদিন পারেনি। আর একটা বেঠোভেন দেখাতে পারবে? কিংবা আর একটা তানসেন? আর একটা সত্যজিৎ? হবে না। ঠিক তেমন আর একটা মান্নাও কোনও দিন হবে না। শূন্যতা শূন্যই থাকবে। ও পূরণ হওয়ার নয়। আগেকার দিনে পাশবইতে দুম করে ছাপ মারত দেখেছ? এ সব মানুষ হচ্ছে ওই দুম করে মারা রাবার স্ট্যাম্প। এটা রিপ্লেস হয় না। আগামী একশো বছরেও হবে না, লিখে নাও।”

শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম। সুপর্ণদা তখন একটা অদ্ভুত কথা বললেন। বললেন, “ঈশ্বর কিন্তু ওঁকে হাত ভরে দেননি। যাকে বলে ঈশ্বরদত্ত গলা, ওঁর কিন্তু তা ছিল না। সে গলা পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সে গলা পেয়েছিলেন মুকেশ। মান্না কিন্তু পাননি।” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “এ আপনি কী বলছেন সুপর্ণদা?” বুঝিয়ে বললেন, “গোড়ার দিকে ওঁর গলার টোনাল কোয়ালিটি নিয়ে, টেক্সচার নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হত ওঁকে। গলায় মসৃণতার অভাব থাকত। তবু তিনি কী করে নিজের গলা এই জায়গায় তুলে নিয়ে গেলেন জানো? বাংলায় তাকে বলে অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, অনুশীলন, পরিশ্রম। এইগুলো দিয়েই নিজেকে করে তুললেন কিংবদন্তী। তুমি ভাবো তো, সেই সময় মুম্বইতে কী সব সুপারহিট দিচ্ছেন হেমন্ত কুমার! অথচ তাঁর হিন্দি উচ্চারণ লক্ষ করেছ কখনও? হিন্দিতে জ-কে যে Z-এর মতো উচ্চারণ করে, হেমন্ত পারতেন না। বাঙালিদের হিন্দি বলা নিয়ে হাসাহাসি হত। কিন্তু মান্না যখন গাইলেন? কে বলবে বাঙালি? কেউ বিশ্বাসই করত না এ বাঙালির মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে। সাচ ওয়জ হিজ মেটিক্যুলাসনেস।”

“আর ছিল নিজেকে নিজে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা। নইলে প্লে ব্যাক ওই জায়গায় যায়? উত্তমকুমারের লিপে যখন গাইছেন, মনে হচ্ছে উনিই যেন গাইছেন। আবার ভাবো পড়োসন! মেহমুদের লিপে গাইছেন! সম্পূর্ণ অন্য রকম গলা, তাও আবার দক্ষিণী উচ্চারণে। আবার শাম্মি কপুরের লিপে যখন গাইছেন, ‘ছম ছম বাজে রে পায়েলিয়া’ – সে গলার সঙ্গে আগের একটারও মিল আছে?” একটানা বলে দম নেবার জন্য থামলেন সুপর্ণদা। কিন্তু আমার মনে প্রশ্ন তখন বিজবিজ করছে। জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, “এ অসাধ্য সাধন কী করে সম্ভব? শুধুই অভ্যাস আর অনুশীলন?”

এ বার অন্য এক প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন সুপর্ণদা। বললেন, “এ জিনিস তখন হাতে ধরে শেখাতেন সঙ্গীত পরিচালকেরা। মান্না দে-র টেলিভিশন সাক্ষাৎকার শুনলে দেখবে উনিই বলছেন, তখনকার যে সব স্টলওয়র্ট সঙ্গীত পরিচালকেরা ছিলেন, তাঁদের কাছেই আমি শিখেছি। তোমাকে একটা উদাহরণ দিই শোনও। ‘বিলম্বিত লয়’ বলে উত্তমকুমারের একটা ছবি ছিল জানো তো? বাবার সুরারোপ। তাতে দু’টো গান ছিল আরতি মুখোপাধ্যায়ের – একটা হল, ‘এক বৈশাখে দেখা হল দু’জনায়।’ আর একটা, ‘আঁকাবাঁকা পথে যদি, মন হয়ে যায় নদী।’ কিন্তু দু’টো গাইবার ভঙ্গি দেখো! দুই মেরুর গান। এ ভাবেই গাওয়াতেন, ভয়েস মড্যুলেশন করাতেন তখনকার সঙ্গীত পরিচালকেরা। আর মানাকাকু সেটাকে হুবহু ফোটাতেন গলায়। এখন ভাবলে মনে হয় যে মানুষটা মদন মোহন, শঙ্কর জয়কিষণ, সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, রাহুল দেব বর্মণ, শচিনদেব বর্মণের পাশে বসে গান শুনেছেন, শিখেছেন, গেয়েছেন, তাঁকে আমি গিয়েছিলাম রাগাশ্রয়ী গান শেখাতে ওই কাঁচা বয়সে! তাঁর সামনে বসে গেয়েছি! ভাবলে তো হাত-পা কাঁপতে থাকে এখন। তবে আজ মনে হয় কোথাও গিয়ে আমার নিষ্ঠাটাও উনি বুঝতে পেরেছিলেন। আমি যে মান্না দে-র সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে আসিনি, সেটা ভিতর থেকে বিশ্বাস না-করলে উনি আমার সঙ্গে ৫৬ খানা গান করতেন না। নচিকেতা ঘোষের ছেলে বলে গোটা দুই গান গেয়ে ভাগিয়ে দিতেন।”

manna dey
তাঁর আদরের ‘খোকা’-র সুরে প্রথম গান রেকর্ড করছেন ‘মানাকাকু’! সুপারহিট পুজোর গান ‘সে আমার ছোট বোন!’ছবি – সুপর্ণকান্তি ঘোষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।

এ বার আমার হাঁ হওয়ার পালা। ৫৬টা গান? “সুপর্ণদা, আপনার সুরে ৫৬খানা গান করেছিলেন মান্না দে?” প্রত্যয় ফুটে উঠল সুপর্ণদার গলায়। “হ্যাঁ। ওঁর নিজের সুরের পরেই সবচেয়ে বেশি গান আমার সুরেই করেছেন।” এ বার আবদার করে ফেললাম, অনেকবার শোনা গল্পটা আবার শোনার জন্য। কী ভাবে এসেছিল সেই প্রথম ব্রেক? সুপর্ণদা আপত্তি করলেন না। বলতে লাগলেন, “বাবা মারা গেলেন আমার ষোলো-সতেরো বছরে। বাবার টাকাপয়সা তো তেমন কিছু ছিল না। হারমনিয়মটা পেলাম উত্তরাধিকার সূত্রে। তখন থেকে ওই হাজরার বাড়ির একতলার ঘরে বসে নিজেই বাজাই। বাবার পুরনো লেখা, গৌরীকাকার (গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার) পুরনো লেখা ঝেড়েঝুড়ে বের করে সুর করি একা একাই। কখনও ভাবতেই পারতাম না কারও কাছে কাজ চাইতে যাব। চিত্র পরিচালক ও ইম্প্রেসারিও অজয় বিশ্বাস (রাখি গুলজারের প্রথম স্বামী), আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন। একদিন উনি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমার প্যাঁ পোঁ শুনে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, “কী রে, কী করছিস?” বললাম। উনি বললেন ‘দরজা খোল তো।’ বলে ঘরে এসে বসে আমার গান শুনলেন। তারপর চলে গেলেন। সে দিনই ওঁর মুম্বই যাওয়ার কথা। সেখানে ‘সমঝোতা’ ফিল্মের শ্যুটিং হচ্ছে। ফ্লাইটে মানাকাকুর সঙ্গে ওঁর দেখা। উনিই কাকুকে বলেন, “জানেন মান্নাদা, নচিদার ছেলে এখন সুর করছে!” মানাকাকু অবাক হয়ে বললেন, “ও মা! ও তো নচিবাবুর রিদম অ্যারেঞ্জমেন্ট করত, কত বাজিয়েছে আমার সঙ্গে।”

“তারপর মুম্বই থেকে ফিরে এসে আমাকে ডাকলেন ওঁর মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে। এ বাড়িতেই থাকতেন ওঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে। গেলাম। বললেন, “কী খোকা, সুর করছ শুনলাম! কী করেছ, শোনাও তো!” আমি অনেক না-না করলাম। শুনলেন না। গাইতেই হল। কী গেয়েছিলাম আজ আর মনে নেই। শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “একদম অন্যরকম, হটকে সুর করেছ খোকা! বাবার ছায়ায় চলার চেষ্টা করনি। ভালো লেগেছে আমার।” তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। যখন নামলেন, হাতে একটা খাম। বললেন, “পুলকের এই গানটা তোমাকে দিলাম। আরও দু’জনকে দিয়েছি। তারাও সুর করেছে। আমি নিজেও করেছি। তুমিও করো। যারটা ভালো লাগবে, তারটাই গাইব।” আমার তো তখন কিছু হারাবার নেই। এমনিতেই বেঁচে থাকার লড়াই। ভয় কিসের? তিন-চার দিনের মধ্যে সুর করে ফেললাম। উনি মুম্বই থেকে কলকাতায় ফিরে আবার একদিন ডাকলেন। গেলাম। আমার প্রিয় সিঙ্গাড়া আনিয়ে পেট ভরে খাওয়ালেন। তারপর বললেন, ‘শোনাও।’ গাইলাম, ‘সে আমার ছোট বোন।’ বড় গান। চোখ বুজে গাইছিলাম। যখন শেষ হল, তাকিয়ে দেখলাম ওঁর চোখে জল। শুধু বললেন, “খোকা, তুমি অনেক দূর যাবে। মাথা ঠান্ডা রেখে সৎ ভাবে কাজ করে যাও। আর আমি এই সুরটাই গাইব।”

“কিন্তু অনেকে বাধা দিল, জানো! পুলককাকাই তার মধ্যে প্রথম। মানাকাকুকে বললেন, “পুজোর গান ওইটুকু বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে কেউ করায়?” এইচএমভি-র কর্ণধার বিমান ঘোষ, প্রবীণ মানুষ। আমার বাবাকে হাফপ্যান্ট পরে গান করিয়েছেন। তিনি তো নস্যাৎ করে দিলেন। “কী যে কও, পোলাপানের কাম নয়! নচির ছেলে সুর করবে? কথা বলতেই শিখল না এখনও ভালো করে।” সবার কথা উড়িয়ে দিলেন মানাকাকু। নিজের জেদই বজায় রাখলেন। বাকিটা তো ইতিহাস। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকর্মা পুজোয় যখন পুজোর গান বেরল, মাইকে মাইকে শুধু ওই গান – সে আমার ছোট বোন।”

এরপর নিশ্চয়ই আপনাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি? সুপর্ণদার আবছা দীর্ঘশ্বাসটা যেন ফোনের এ পার থেকেও শুনতে পাচ্ছিলাম। বললেন, “অতবড় হিটের পরেও দেড় বছর বসেছিলাম। গোটা ৭৯ সাল কেউ আমাকে ডাকেনি। ১৯৮০-তে ফের ডাক পেলাম। সেই মানাকাকু। ডেকে বললেন, “শোনও এ বার তোমাকে একটা কঠিন কাজ দিচ্ছি। ‘সারা জীবনের গান’ বলে একটা অ্যালবাম হবে। মানুষের জীবনের সাতটা পর্যায় নিয়ে সাতটা গান লিখেছেন পুলকবাবু। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত- মা মাগো মা, হাঁটি হাঁটি পা পা, আমি রাজি রাখো বাজি, এসো যৌবন এসো হে, তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, আর সবশেষে, আমায় চিনতে কেন পারছ না মা।”

Manna Dey
২০১২ সালে শেষবার জন্মদিনে, মান্নার ব্যাঙ্গালোরের বাড়িতে তাঁকে গীতবিতান উপহার দিয়েছিলেন সুপর্ণ। ‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহো ভাই’ পড়তে পড়তে আবেগে ভেসে গিয়েছিলেন শিল্পী। ছবি – সুপর্ণকান্তি ঘোষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।

“সুর করলাম। উনি ফের মুম্বই থেকে ফিরে এসে বাড়িতে ডাকলেন। গান শোনালাম। একটা নোট-ও পাল্টাতে বললেন না। মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। ‘মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়’ শুনে চোখ মুছে বললেন, “এমন একটা গান কী ভাবে করলে বলো তো?” এখন ভাবলে মনে হয়, ওই একুশ বছর বয়স বলেই অমন সাহস করতে পেরেছিলাম বোধহয়। রাগসঙ্গীতের রাজার সামনে বসে ‘এসো যৌবন এসো হে’ গেয়ে শুনিয়েছিলাম কী করে কে জানে! বলতে পার আমার ওপর অগাধ ভরসাটা তখন থেকেই। ওঁর বড় মেয়ে আমেরিকায় থাকতেন, রমা দে। ওঁর কাছে যেতেন আর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে গান গাইতেন। তখন আমেরিকা থেকে চিঠি লিখতেন আমায় গানের অনুরোধ করে। আজ পিছনে তাকিয়ে ভাবি, সত্যি কী গান গাওয়াইনি ওঁকে দিয়ে। আমার অনুরোধ ফেলতে পারতেন না বলে যেমন ইচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গিয়েছি সুর নিয়ে। উনিও প্রশ্রয় দিয়েছেন।”

এবার সুপর্ণদাকে একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না। এই যে স্বর্ণযুগের গান, পুরনো দিনের সব অবিস্মরণীয় মেলোডি লোকে বলে, ওরকম গান তৈরি হত কী করে? খুব বিরক্ত শোনাল এবার সুপর্ণদার গলা। একরাশ ক্ষোভ। বললেন, “কী করে আর হত, একসঙ্গে বসে সুর শেখানো, আলোচনা, কথা নিয়ে নাড়াচাড়া, হারমনিয়ামে সুর দেখানো… এ ভাবেই হত! এখন তো যে যার সে তার মতো গান করে। সঙ্গীত পরিচালক হারমনিয়াম ধরেই না। গিটারে লা লা করে সুর দিয়ে ল্যাপটপে রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিলেন গীতিকারকে। গীতিকার সিচ্যুয়েশন শুনে সেই সুরে কথা বসিয়ে ফেরত পাঠাল। তারপর কথা দিয়ে সেই গান গেয়ে সঙ্গীত পরিচালক সোজা পাঠিয়ে দিলেন অ্যারেঞ্জারের কাছে। তিনি নিজের মনে বসে অ্যারেঞ্জ করলেন, ট্র্যাক বানালেন। পাঠিয়ে দিলেন সঙ্গীত পরিচালককে। সেই ট্র্যাকে গান গেয়ে তিনি গায়ক বা গায়িকাকে পাঠিয়ে দিলেন। গায়ক গায়িকা নিজেদের ডেট মতো স্টুডিওতে এসে নিজের গানটুকু রেকর্ডিং করে গেল। মিক্সার পরে তার সময় মতো বসে মিক্সিং সেরে ফেলল। গান তৈরি। সবার ব্যাঙ্ক একাউন্টে টাকা পৌঁছে গেল। এতে কি আর নচিকেতা ঘোষের ‘ক’ফোঁটা চোখের জল’ তৈরি হবে নাকি ‘হৃদয়ে লেখো নাম’ হবে? হতে পারে কখনও?”

একটু চুপ করে থেকে কী মনে করে নিজের মনেই আবার বলতে শুরু করলেন। “ওঁকে দিয়ে কী সব যে করিয়েছি, ভাবলে অবাক লাগে। ২০১০ সালে ওঁর শেষ গান আমার সঙ্গেই ছিল। আমি তখন ‘ছড়ার দেশের খোঁজে’ বলে একটা অ্যালবাম তৈরি করছিলাম। প্রচলিত কুড়িটা বাংলা ছড়ায় সুরারোপ করে দুটো করে ছড়া এক একজন শিল্পীকে দিয়ে গাওয়াচ্ছিলাম। আসলে বাবার থেকেই আইডিয়াটা পেয়েছিলাম! তোমরা ছোটবেলায় ‘ঠাকুমার ঝুলি’ ক্যাসেট শুনেছ তো? ওখানে লালকমল-নীলকমলে আমি ছিলাম লালকমল আর বুদ্ধু-ভূতুম-এ আমি ছিলাম ভূতুম। সেই যে গান করেছিলাম, সেখান থেকেই প্রেরণাটা পেলাম। নির্মলা মিশ্র থেকে গৌরী ঘোষ, শম্পা কুণ্ডু থেকে লোপামুদ্রা, সৈকত মিত্র সকলে করেছিলেন। মানাকাকুকে ফোন করলাম, ‘আপনাকেও গাইতে হবে।’ উনি বললেন, ‘চলে এসো আগের দিন আমার বাড়িতে। আমাকে গানটা শিখিয়ে দেবে।’ উনি কিন্তু সবসময়ে বলতেন, গান “শিখিয়ে” দেবে। কোনওদিন “তুলিয়ে দেবে” বলেননি। উনি জানতেন এবং মানতেন যে গানটা “শেখা”র জিনিস। লোহা-লক্কড়ের মতো মাথায় “তুলে” ফিরি করবার জিনিস নয়।”

“যাইহোক, গেলাম ওঁর বাড়ি। কিন্তু যখন বলেছিলেন, তখন পৌঁছতে পারলাম না। দেরি হয়ে গিয়েছিল কাজের চাপে। আমাকে দেখে ওপর থেকে নেমে এলেন। হারমোনিয়াম পেতে বসলেন। নিজে হাতে নোটেশন লিখলেন। গাইলেন আমার সঙ্গে। বললেন ‘কাল কটায় যাব?’ আমি বললাম, ‘এগারোটায়।’ পরের দিন সকাল থেকে খেয়ালি আর অরিন্দমকে নিয়ে কাজ করছিলাম। ঘড়ির দিকে খেয়াল পড়েনি। এগারোটা বাজতে দুই। দরজার হাতল ঘুরল। আর সেই বিখ্যাত গলায়, “খোকা, ঘড়িটা মিলিয়ে নাও।” স্টুডিওতে তখন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। উনি এসে একটু বসেই বললেন, “দেখি কী বানিয়েছ। ট্র্যাক দাও।” বসে শুনলেন। পটাপট হয়ে গেল। তারপর বললেন, “এ বার আমি যাই?” আমি বললাম, “বসুন। কাজ আছে।” উনি অবাক। আবার কী কাজ? আমি বললাম, “আপনাকে দুটো সংলাপ বলতে হবে কাকু। আপনার নিজের গলায় নয়। একজনকে মিমিক্রি করে।”

Manna Dey
২০১০ সালে জীবনের শেষ রেকর্ডিংয়ে। তাঁর ‘খোকা’র সুরে ছড়ার গান। ছবি – সুপর্ণকান্তি ঘোষের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে

“উনি চোখ পাকিয়ে আমাকে বললেন, “কী বলছ খেয়াল আছে? মান্না দে-কে বলছ মিমিক্রি করে সংলাপ বলতে আর সেটা তুমি বাজারে রিলিজ করবে?” আমি বললাম, হ্যাঁ। আসলে এ কথা তো বিশেষ কেউ জানেই না যে উনি নবদ্বীপ হালদারকে সাঙ্ঘাতিক ভালো নকল করতেন। চোখ বুজে শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না ওটা নবদ্বীপ নন, মান্না দে। আমি জানতাম আর ওই সব উদ্ভট আবদার করতেও পারতাম। ওঁর চোখ গরম করা দেখে স্টুডিওতে সবাই চুপ। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। করতেই হবে। শেষে রাজি হলেন। করলেন। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না যে মান্না দে এটা করছেন। কিন্তু সম্পর্কটা আমাদের এমনই ছিল জানো! আমার পকেটে একটা পাঁচ হাজার টাকার বান্ডিল ছিল। রেকর্ডিংয়ের শেষে সেটা আস্তে করে ওঁর পকেটে দিতে গিয়েছি। উনি বলে উঠলেন, “তুমি কি পাগল হলে খোকা? এত ভালো একটা কাজ করছ, আর আমি তোমার কাছ থেকে পয়সা নেব?” বলতে বলতে ফোনের ওপারে সুপর্ণদার গলা ধরে আসছিল। বললেন, “সেদিন স্টুডিওতে ওঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। এই ঘরানার মানুষ, এই ঘরানার শিল্পী আজ আর নেই।”

Suparna Kanti Ghosh
মানাকাকুর কাছ থেকে শেখা নিষ্ঠা, অধ্যবসায় আর পরিশ্রম আজও তাঁর সঙ্গী। ছবি – সুপর্ণকান্তির ফেসবুক পেজ থেকে।

তবে গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সুপর্ণদা বললেন, “সেদিন মান্নার সঙ্গে ছিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত সাংবাদিক রূপায়ণ। তাঁকেও খুব স্নেহ করতেন মানাকাকু। তাঁকে নিয়ে স্টুডিও থেকে বেরিয়েই বললেন, “একটু বাজার করব, বুঝলে! সুলোচনার জন্য মুম্বইতে নিয়ে যাব কিছু জিনিস।” বলে ঢুকলেন এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। তারা তো শশব্যস্ত। জিনিস কিনতে কিনতে চোখে পড়ল এক প্যাকেট বাদাম! হাতে নিয়ে দাম জানতে চাইলেন। তারা বললে, দশ টাকা। হাঁ হাঁ করে উঠলেন মান্না! “বলো কী হে, এইটুকু বাদামের দাম দঅঅশ টাকা? এ কী করে হয়?” মাথায় উঠল বাদাম খাওয়া। কে বলবে এই মানুষটাই একটু আগে পাঁচ হাজার টাকা প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন স্টুডিওতে! “এই সারল্য, এই হিউমিলিটি আর কখনও কারও মধ্যে দেখিনি…” সুপর্ণদার গলা স্মৃতিমেদুর।

“কী যে না গেয়েছেন আমার জন্য! এখন ভাবলে অবাক লাগে। পুলককাকা মারা গেলেন। তরুণ সিংহ বলে একজন গীতিকার লিখলেন চারটে লাইন,
‘পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে
চলে গেছে বন্ধু আমার
দরজায় কড়া নেড়ে কোনওদিন
এসে গেছি বলবে না আর
চলে গেছে বন্ধু আমার।’

মানাকাকু আমাকে ডেকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু গান বানিয়েছ নাকি?” বললাম, “পুলককাকাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে একটা গান তৈরি করেছি।” খুব উৎসাহ নিয়ে শুনতে চাইলেন। শোনানোর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “আমি গাইব।” আবার গৌরীকাকাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে তাঁরই লেখা গান দিয়ে অ্যালবাম করিয়েছি,
“যদি প্রশ্ন করি সবচেয়ে মিষ্টি কী
হয়তো বলবে মধু
না গো না, আমি বলব তুমি
আমার বাসরঘরের বঁধূ।”

এ বার একটা কিঞ্চিৎ বিতর্কিত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না! “আচ্ছা, শুনেছিলাম পেশাগত ক্ষেত্রে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের খুব কড়া প্রতিযোগিতা ছিল। একজন প্রায় আর একজনের বিষয়ে কথাই বলতে চাইতেন না!” আমার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন সুপর্ণদা। বললেন, “খুব একটা ভুল শোনওনি। সত্যিই এমন একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু তা বলে শ্রদ্ধার অভাব বা নোংরামি দেখিনি কোনওদিন। গৌরীকাকাকে যখন বললাম, বাবা যে হেমন্তকাকার জন্য ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’ তৈরি করেছিলেন, সে তো তোমারই লেখা! ওরকম একটা লিখে দাও না…! তখন এই গানটা লিখেছিলেন।”

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

4 Responses

  1. সাক্ষাৎকার গ্রহীতার সংক্ষিপ্ত অথচ অমোঘ উপস্থিতি,গভীর সাগর মন্থন করে মণিমুক্তা সংগ্রহকারী ডুবুরি সদৃশ সাক্ষাৎকার দাতা এবং সবার উপরে সমুদ্র সমান বিষয়পুরুষ, এই তিনে মিলে এক দুষ্প্রাপ্য ত্রিবেণী। অপেক্ষায় থাকলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com