“আরে মশাই সেখানে যাব কীভাবে বললেন না তো!” স্কুলের সহকর্মী রমেশবাবুকে বলে ওঠে সায়ন।
রমেশবাবু বললেন, “আপনি তো স্যার গাড়ি নিয়ে যাবেন, অতএব নো চিন্তা। হাতের ফোনের জিপিএস অন রাখলে সেই-ই আপনাকে পথের দিশা দেখাবে। আগে তো পৌঁছে যান শান্তিনিকেতন। সেখানে একটা লজে এক রাত থেকে রেস্ট করে পরদিন ভোর ভোর চলে যান মলুটী। সারাদিন ঘুরে ঘুরে দেখুন। একটু আগেভাগে গেলে মায়ের মন্দিরে ভোগের কুপন কেটে নিন। দুপুরের খাওয়া নিয়ে চিন্তা থাকবে না আর। পথের পাশে ঝাড়খণ্ডি মহিলাদের তেলেভাজার দোকান সারি সারি। বিকেলে সেখানে চা, মুড়ি আর লংকার চপ খেয়ে ফিরে এসে আরও এক রাত থাকুন শান্তিনিকেতনে। তারপরে ধীরেসুস্থে কলকাতায় ফিরুন স্যার। মলুটী দেখে শেষ হবে না, এও বলে দিলাম কিন্তু। তবে একটা ছোট করে, নিজের মতো করে পুজো দেবেন স্যার। একটা কয়েন হলেও। কোনও পাণ্ডার উপদ্রব নেই। মন্দিরময় মলুটী ঝাড়খণ্ড তথা বাংলার ঐতিহ্য। টেলিভিশনে মলুটী নিয়ে ডকুমেন্টরি দেখে থাকবেন হয়ত। বলে নাকি তারাপীঠের তারা মায়ের বড় বোন মলুটীর এই দেবী মৌলীক্ষা। বামাক্ষ্যাপা না কী তারাপীঠের আগেই এখানে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন! শুধুই কি এই দেবী মন্দির? মলুটী গ্রামে জমিদারেরা একসময় একের পর এক টেরাকোটা শিব মন্দির বানিয়েছিলেন।

সায়ন অনেক বছর আগে ঝাড়খণ্ডে ট্যুরে আসত। কর্মসূত্রে। তখন নামই শোনেনি এই মন্দিরের। এখন সব জঙ্গল কেটে ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে যাচ্ছে, বুঝি তাই এত রমরমা।
রমেশবাবুর মুখে বর্ণনা শুনে আর লোভ সামলাতে পারে না সায়ন । স্কুলে বসেই গুগলে মলুটী সার্চ করে সেই লিংক সীমাকে না পাঠানো অবধি শান্তি পায় না সে।
ওরেব্বাস! এখন সেখানে দেবী মৌলীক্ষার মন্দির ছাড়াও মলুটী গ্রামেই ভাঙাচোরা, গোটা— সব মিলিয়ে চুয়াত্তরখানা টেরাকোটার মন্দির রয়েছে। পুরো গ্রামে থিকথিক করছে মন্দির। সেদিন ইউটিউব চ্যানেলে একটা ডক্যুমেন্ট্রি দেখে একেবারে থ বনে গেছিল সায়নের মতো সীমাও।
আরও পড়ুন- গল্প: ১৩বি হরি ঘোষ স্ট্রিট
সায়নের অত ধর্মকর্মে মতি নেই। সে মনেপ্রাণে বেশ নাস্তিক। তবে পুরনো মন্দিরের ছবিছাবা তুলে সংগ্রহে রাখতে ভারি ভালো লাগে। একা সায়ন নয়, তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ইতিহাস, ঐতিহ্য এসবে খুব আগ্রহী।
অতএব মনে মনে একটা প্ল্যান ফাঁদল সায়ন।
ঘুরতে যাবার নাম শুনলেই সীমা না জানি কত খুশি হবে। সায়ন বাড়ি ফিরেই জানাবে তাকে। সেই শুনে বাড়ির লোকজনেরা আবারও বলে উঠবে…
“উঃ! পারিস বটে তোরা। একটানা তিনদিন ছুটি পেলেই হল। রোজ তো নাকেমুখে গুঁজে স্কুল করিস দুজনে। একটা দিন জমিয়ে বাজার করে মাংস ভাত রেঁধে খা। সিনেমা দেখে আয়। রেস্তোরাঁয় যা। তা নয়, উঠল বাই তো বেড়াতে যাই। পায়ের তলায় এক্কেবারে চরকি লাগানো যেন!”

রমেশবাবুর কথা শুনে অফিসে টেবিল চাপড়ে কলিগরা বলে উঠেছিল সেদিন… এ তো মিরকল! তা কবে খাওয়াচ্ছেন রমেশদা?
সেদিনই রমেশদার কাছ থেকে চুপিচুপি সেই তান্ত্রিক ভদ্রলোকের নাম্বারটা নিয়েছিল সায়ন। বাড়ি ফিরে সীমাকে বলেছিল ব্যাপারটা। তবে শুধুই মলুটী বেড়ানোর কথা। তান্ত্রিকের কথা ঘুণাক্ষরেও বলেনি। সায়ন মনে মনে ভেবে রেখেছিল, এক ঢিলে দুই পাখি হবে, কলকাতা থেকে খুব দূরে তো নয়। রথ দেখা হবে, কলা বেচাও হবে। সীমার চোখ চিকচিক করে উঠেছিল নতুন বেড়ানোর প্ল্যান হতেই। জ্যোতিষী, তান্ত্রিক ওসব মাথায় রইল শুধু সায়নের। গাড়ি করে শীতের ভোরে বাড়ি ছেড়ে কয়েকটা দিন ঘোরা তো হবে। রোজকার এই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিন কয়েকের। ফিরে এসে আবার নতুন করে ছাত্র ঠ্যাঙানো, চিৎকার করে পড়ানো, খাতা দেখায় মন দেবে তারা ।
***
সাঁওতাল পরগণা অধ্যুষিত গ্রাম মলুটী। বাংলার বীরভূম এবং ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার সীমানায়। সেখানে বিহারিদের চাইতে বাঙালিদেরই ঘনবসতি। কলকাতার দুই ইশকুল টিচার সায়ন আর সীমা। এসএসসি দিয়ে চাকরি পাকাপাকি হতেই বিয়ে করেছে দুজনে। সীমা অবশ্যি সায়নের থেকে একটু বেশিই ছোটো। বিয়ে হয়েছে নয় নয় করে প্রায় বছর দশেক। আগের মতোই দুজনের ঘুরে বেড়ানোর শখ যেন আর ফুরোয় না। বিয়ের পরে টাকা জমিয়ে, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে, ই এম আই শোধ করতে করতে অনেক চাপের মধ্যেও একটা চারচাকা কিনে ফেলে আরও সুবিধে হয়েছে। ফাঁক পেলেই ওরা টুক করে বেরিয়ে পড়ে এদিকওদিক। দু-চারদিন ইশকুলের ছুটি পেলেই হল।

খবরের কাগজে বাংলার বুকে নতুন জায়গার খোঁজ পেলেই নেশার মত ছুটে যায় ওরা। ভ্রমণের নেশায় সমাজ সংসার পড়ে থাকে পেছনে। ফেসবুক হওয়াতে ইদানীং আরেক নেশায় পেয়ে বসেছে দুজনকেই। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত সব জায়গা খুঁজে খুঁজে বের ক্রা, তারপর সেখানে গিয়ে টুক করে কয়েকটা ছবি আর সেলফি তুলেই পোষ্ট করার লোভ সামলানো দায়।
এদিকে দুজনের বাড়ির লোকজন বলে বলে ক্লান্ত—
“প্রেমপর্ব, বিয়ে, চাকরি, সব তো হল— এবার টো টো করে না ঘুরে বেড়িয়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিংটা সেরে ফেল দিকিনি। কেরিয়ার গড়তে গড়তে মেঘে মেঘে তো অনেক বেলা হল…”
সায়ন আর সীমার তা নিয়ে একটু আধটু ভাবনাচিন্তা যে নেই তা নয়। তবে সবকিছু কি আর চাইলেই মেলে?
এর মধ্যে নিজেরাই একদিন চুপিচুপি একটা ইনফার্টিলিটি ক্লিনিকে গিয়ে সবরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে এসেছে। মোদ্দা কথা হল সীমার পলিসিস্টিক ওভারির কারণে চিকিৎসক তাদের নিরাশ করেছেন। আইভিএফ-এ ওরাও সম্মত নয়। এহেন আর্থিক ঝুঁকি এখুনি নিতে নারাজ তারা। তাছাড়া সীমার বয়স তো খুব একটা কিছু নয়। তবে এই বিষয়টা নিয়ে ইদানীং দুজনেরই মাথাব্যথা বেড়েছে বৈ কমেনি। আর তাকে চাপা দেবার জন্যও বুঝি এই মাঝেসাঝে বেরিয়ে পড়ে অপার আনন্দে অবগাহন। এই ছুটছাট ভ্রমণটুকু আছে বলেই বেঁচে আছে ওরা। শিক্ষক হিসেবেও ওরা ডেডিকেটেড বলতে যা বোঝায় এককথায় তাই। ইশকুলের ছেলেপুলেরাই যেন নিজেদের ছেলেপুলে হয়ে উঠেছে।
***
ভাগ্যিস সায়ন তার স্কুলেই মলুটীর খবর পেয়েছিল। আসলে ঝাড়খণ্ড শুনেই চমকে উঠেছিল সে। যাবার ইচ্ছেটাও হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেছিল। অফিসের হেডক্লার্ক রমেশবাবু সেখানকার এক তান্ত্রিককে দেখিয়ে নাকি কী সব যাগযজ্ঞ করিয়ে সুফল পেয়েছেন, বলছিলেন। তাঁর বহুদিনের ভাড়াটিয়া উঠে গিয়ে রমেশবাবুর পৈতৃক বসতবাড়ি এদ্দিনে শেষমেশ খালি হয়েছে। এখন তো মামলা করে বিস্তর টাকাপয়সা খরচ করে ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ না করলে তারা সহজে বাড়ি ছাড়েই না। পুরনো বাড়ি প্রোমোটারের হাতে দিলেই ভাড়াটিয়া সেখান থেকে হয় থোক টাকা, নয় নতুন ফ্ল্যাট নেয়। রমেশবাবুদের চল্লিশ বছরের পুরনো ভাড়াটিয়া নাকি মলুটী গ্রামের কোন তান্ত্রিকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অতঃপর নির্দ্বিধায় খুব স্বল্প টাকাকড়ির বিনিময়ে বাড়ি ছেড়েছে।
এসব শোনা ইস্তক আপাতভাবে নাস্তিক সায়নের মনের কোনায় দু’একবার যে যাগযজ্ঞ ব্যাপারটা উঁকি মারেনি তা নয়। মুখ্য আকর্ষণ বেড়ানো হলেও একবার দেখা করতে দোষ কি সেই তান্ত্রিক ভদ্রলোকের সঙ্গে? ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং-ও। সীমাকে এসব বললে সে হয়তো বেঁকে বসবে, যেতে চাইবে না। আপত্তি করবে। বিজ্ঞানের ছাত্রী ও, তুখোড় সব যুক্তি দেখাবে। সায়নও বিজ্ঞানের শিক্ষক। কিন্তু দিন দিন নিজের অধরা হয়ে থাকা পিতৃত্বের বাসনা তাকে যেন কেমন দুর্বল করে দেয় মাঝেমধ্যেই। এমন করে রমেশবাবু সেদিন বললেন! এতদিন সায়নের বিশ্বাস ছিল না মোটেও। নিজেই এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হত। এইসব জ্যোতিষ টোতিষ, তান্ত্রিক-টান্ত্রিক, বশীকরণ ফশীকরণ নাকি ফালতু। টিভি চ্যানেলে নিজেরাই নিজেদের প্রোমোট করে ভ্যাজারাম ভ্যাজারাম বকে চলে। দেশের লোকজনও হয়েছে তেমন। তারাও হিপনোটাইজড হয়ে হাজার হাজার টাকা এদের পেছনে খরচা করে ফেলে— এইসব বলত সে। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় মানসিকতাও।
ভাবে সায়ন। কে জানে বাপু! অনেকেই ফল পায় হয়ত রমেশবাবুর মতো। নয়ত কেন এত ভিড় হয় মলুটীতে? পকেট থেকে রমেশবাবুর দেওয়া তান্ত্রিক রাজা বাবার লাল টুকটুকে গ্লসি ভিজিটিং কার্ডটা একবার সে বের করে। আবার সযত্নে পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে।
আপাততঃ এসব তন্ত্র-মন্ত্রকে দূরে সরিয়ে রেখে আগে তো প্ল্যানটা ছকে নিক সে আর সীমা মিলে। তারপর নাহয় এক্সপ্লোর করে দেখাই যাবে। তান্ত্রিকের ফাঁদে না পড়লেই হল। অন্তত সেটুকু বুদ্ধি আছে সায়নের।
অলংকরণ: শুভ্রনীল ঘোষ
*পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ৮ মার্চ, ২০২৩
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
2 Responses
দারুন লাগলো দিদি, অপেক্ষায় থাকলাম পরের পর্বের
সব চাইতে ভাল লাগলো লেখার ঝরঝরে গতি এবং কাহিনীতে এখনও অবধি পাওয়া দুটি প্রধান চরিত্র যারা স্বামী স্ত্রী এবং সন্তান ধারণের বৈজ্ঞানিক সমস্যা আছে এবং আগে দেখা যাক কিভাবে সেই সমস্যার সমাধান হয় । ঈর্ষণীয় লেখনী