জানুয়ারি মাসের একেবারে গোড়ার দিক। এক অ্যালার্মেই তড়াক করে বিছানা ছেড়েছি, একে অপরকে ঠ্যালাঠেলি করতে হয়নি। ঘড়ির কাঁটায় ভোর পৌনে চারটে। শীতকালে এ সময়টাকে নিশুতি রাতই বলা যেতে পারে। গলি থেকে বেরিয়ে নিস্তব্ধ পাড়ার মোড়টা পর্যন্ত এসে পৌঁছতেই তিনটে কুকুর ঘ্যাঁক ঘ্যাঁক করে তাড়া করল। এরা সব আমার বন্ধু লিপিকার পাড়াতুতো পোষ্য, তাই রক্ষে। ওর গায়ের কাছে এসে চেনা গন্ধ শুঁকে এ যাত্রা রেহাই দিল।
জনমানবশূন্য রাস্তায় মিনিট দশেকের অপেক্ষা। ক্যাব লেট করেনি। বিজন সেতু পেরিয়ে গড়িয়াহাট মোড় ছাড়িয়ে গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটছে। গোটা শহরটা লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। দু’একটা সরকারি বাস চলছে। বন্ধ জানালার ঘষা কাচের ওপারে করগোণা লোক আছে বলেও তো মনে হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: লাজবাব লিনজ়ারের লোভে
জানুয়ারি মাসে যে দু-তিনটে দিনকে কলকাতার শীতলতম দিন বলে ঘোষণা করা হয়, আজকের দিনটা বোধহয় তার মধ্যে অন্যতম। রাসবিহারীর মোড়ে ঊর্মি অপেক্ষা করছিল। ঠান্ডায় হাতের তালুদুটো ঘষতে ঘষতে গাড়িতে উঠেই বলল, “পাঁচটার মধ্যে পৌঁছতে হবে, নইলে জায়গা পাব না।” শীত-ভোরে নির্জন রাস্তা। আমরা চলেছি নিহারী (Nihari) অভিযানে, নবাবি প্রাতরাশের টানে।

কলকাতার বড়বাজার সংলগ্ন এলাকায় জাকারিয়া স্ট্রিট। গাড়ি এসে থামল নাখোদা মসজিদের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে ঘুমন্ত ফুটপাথবাসী, হেলানো ঠেলাগাড়ি, বন্ধ দোকানপাটগুলোকে পাশ কাটিয়ে কয়েক পা হেঁটে এগোতেই ‘সুফিয়া’ রেস্তোরাঁ। রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে পার্ক করা আছে অন্তত খান পঞ্চাশেক (তার বেশি বৈ কম হবে না) বাইক। হাতঘড়ি বলছে, ভোর প্রায় পাঁচটা। উলটোদিকের মসজিদে সবেমাত্র নামাজ পড়া শেষ হয়েছে। সুফিয়ার ভিতরে জনকোলাহল, উপচে পড়া ভিড়।
যার টানে শীতের এই কাকভোরে রেস্তোরাঁয় এত জনসমাগম, তার নাম নিহারী। নিহারী কী? প্রাতরাশের সময়টাই বা এমন অদ্ভুত কেন? এককথায় বলতে গেলে, নিহারী হল ঢিমে আঁচে রান্না করা গরু, ভেড়া বা খাসির মাংসের অস্থি-মজ্জা সহযোগে মশলাদার সুরুয়া (স্ট্যু)। আরবি শব্দ ‘নাহার’ (যার অর্থ ভোর), উর্দুতে ‘নিহার’ থেকে ‘নিহারী’ (উচ্চারণভেদে- নেহারি) শব্দের উৎপত্তি। দিনের আলো ফোটার আগে ফজরের নামাজের পরই এটা খাওয়ার চল।
নিহারীর জন্মলগ্ন অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে। অসুস্থ, রুগ্ন, বৃদ্ধ মোঘল বাদশার শারীরিক উন্নতির জন্য এ খাবার ছিল রুগীর পথ্য। তবে নিহারীর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, এটি সম্পূর্ণভাবেই একটি আওয়াধি খানা। লক্ষ্ণৌয়ের রাজকীয় রসুইঘরই এর আঁতুর। আবার কারও মতে হায়দ্রাবাদে নিজামদের নবাবি হেঁশেলেই এর সৃষ্টি। দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, হায়দ্রাবাদ— উৎপত্তিস্থল যাই হোক না কেন, সারা দেশ জুড়ে বিশেষ করে শীতের মরশুমে ‘নিহারী’ এখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। বর্তমানে এটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের ‘জাতীয় আহার’। তবে এ প্রসঙ্গে জানাই, নিহারী সম্পর্কে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন মতও আছে। উচ্চক্যালরিযুক্ত এই খাবারটি মূলত ছিল শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষের আহার। ভোরের নামাজ সেরে নিহারী খেয়ে তারা কাজে যেত। কায়িক পরিশ্রমের জন্যে এনার্জির যোগান দিত নিহারী। ফলে একেবারে দুপুরের আগে খিদে পেত না। পরে নিহারীর জার্নিটা আমআদমি থেকে শুরু হয়ে খাসআদমির কাছে পৌঁছেছিল।

নিহারীবৃত্তান্তের পর এবার আসি নিহারী ভক্ষণের কথায়। সুফিয়ার সামনে রাস্তার উপরেই বড় কালো কড়াইয়ে গরম ডুবো তেলে ডালপুরি ভাজা চলছে। একজন লেচি কাটছে, একজন বেলছে, একজন ভাজছে। এই ডালপুরি সহযোগেই নিহারী পরিবেশন করা হচ্ছে। একপাশে ডাঁই করা আছে কৌটো। একটা বড় থালায় মাংসের টুকরোগুলো রাখা আছে। রান্নাঘর থেকে বালতি ভরে ভরে সুরুয়া আসছে। একটা বাঁশের মধ্যে তিনটে বালতি গলিয়ে দিয়ে বাঁশটার দুপ্রান্ত কাঁধে করে বয়ে আনছে দুজন। কারিগররা যান্ত্রিক তৎপরতায় কাজ করে চলেছে। প্লেটের মধ্যে মাংসের টুকরো রেখে সুরুয়া ঢেলে দিচ্ছে। সোজা তা চলে যাচ্ছে ভিতরের টেবিলে, নয়তো চালান হচ্ছে জমা পড়া টিফিন কৌটোয়। সত্যি বলছি, সুরুয়ার টুকটুকে রং দেখেই মন মজে যাবে।
জিজ্ঞেস করলাম, “দোকান কখন খুলেছে? রান্না কখন শুরু হয়েছে?” কর্মব্যস্ততা, হাঁকডাক চলছে, কারও উত্তর দেওয়ার সময় নেই। আরও দুবার বলার পর, বড় ছান্তা দিয়ে ডালপুরিগুলো এপাশ-ওপাশ করতে করতে তিনবারের বার জবাব এলো, “ রাত দশ বাজে সে পাকানা শুরু হুয়া, সুবহ্ সাড়ে চার বাজে দুকান খুল গ্যায়া…” নভেম্বর মাসের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ— সুফিয়াতে নিহারীর সিজন।

এখনও পর্যন্ত সমস্ত পর্যবেক্ষণই রাস্তায় দাঁড়িয়ে হচ্ছিল। রেস্তোরাঁর ভিতরে ঢোকার মতো পরিস্থিতি নেই। ভিড়, ধাক্কাধাক্কি চলছে। প্রথম ব্যাচের খাওয়া প্রায় শেষ। লাইনে দাঁড়িয়ে গেছি। প্রথম ব্যাচের খাওয়া শেষ হতেই আবার ধাক্কাধাক্কি শুরু হল। বুঝলাম, এখানে কিউ বলে কিছু নেই। যেভাবে হোক টেবিল দখল করতে হবে। দ্বিতীয় ব্যাচেও জায়গা মিলল না। লোকজন বাইকে চেপে আসছে, কেউ বা গাড়িতে— পার্সেল নিয়ে চলে যাচ্ছে। ভাবলাম, এর পরের ব্যাচের জন্যে কিছু বাঁচবে তো! নাহলে তো সব পরিশ্রম মাটি। তাই আর বাইরে নয়, টেবিলের সামনে থেকে নড়ছি না। ওখানে দাঁড়িয়ে লোকের গুঁতো খেয়েই অপেক্ষা করতে লাগলাম। লোক চেয়ার ছেড়ে উঠলেই, যে যেখানে পারব, বসে পড়ব।
ঘড়ির কাঁটা ছটা থেকে খানিক ডানদিকে হেলেছে। অবশেষে তৃতীয় ব্যাচে জায়গা মিলল। প্লেটপ্রতি চারটে করে ডালপুরি। অত ভোরে ডালপুরি-নিহারী তো কোন ছার, চা খাওয়ার অভ্যেসটুকুও নেই। তিন প্লেট নিহারী অর্ডার করেছি। তার সঙ্গে দু প্লেট ডালপুরি তিনজনে মিলে শেয়ার হবে। পেটে খিদের লেশমাত্র নেই। কিন্তু লোভী, বুভুক্ষুর মতো বসে আছি। অবশেষে সমস্ত প্রতীক্ষার অবসান। নিহারীর প্লেট থেকে ভেসে আসছে নবাবি সুগন্ধ। ধনেপাতা কুচি দিয়ে গার্নিশ করা সুরুয়ায় একটু লেবু চিপে নিলাম। লেবু, ধনেপাতা ছাড়া নিহারী অসম্পূর্ণ। ডালপুরির টুকরো ছিঁড়ে ঝোলে চুবিয়ে মুখে দিতেই রাজকীয় সুখানুভূতি, যা এক কথায় লা-জবাব। তুলতুলে নরম গরুর মাংস, যা সহজেই চামচ দিয়ে কাটা যায়। নবাব একে বৃদ্ধ, তাও আবার রুগ্ন—মাংস তো তুলতুলে হতেই হবে।

মৌরি মুখে দিয়ে বাড়ির জন্য কেনা পার্সেলটা নিয়ে সুফিয়া থেকে যখন বেরোলাম, ভোরের আলো ফুটেছে। বড়বাজার চত্বর একটু একটু করে সচল হচ্ছে। নিহারীর নৈশ অভিযান সেরে আমরাও এবারে ঘরমুখো।
সুফিয়ায় খুব বেশি হলে সকাল সাতটা পর্যন্ত নিহারী পাওয়া যায়। তারপরে ডেকচিগুলো সব সাফ হয়ে যাবে। যাদের পক্ষে কনকনে ঠান্ডায় ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে সুফিয়ায় নিহারী খেতে যাওয়া সম্ভব নয়, অথচ মনের মধ্যে ইচ্ছে ভরপুর, তাদের জন্যে কলকাতায় বেশ কিছু রেস্তোরাঁ আছে। সেখানে দিনের যেকোনও সময়ে নিহারী মিলবে। এছাড়া প্যাশনেট রাঁধুনিরা বাড়ির কিচেনে ঘরোয়াভাবে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। নিহারী কিন্তু রেড মিট দিয়েই হয়, মুরগির মাংসে নয়। গরু, ভেড়া, খাসি— যে মাংসে আপনি স্বচ্ছন্দ, তাতেই রাঁধুন। বাড়িতে ৬-৭ ঘণ্টা ঢিমে আঁচে রান্না করাটা বেশ বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রেশারকুকার সহায়।

নিহারী তৈরির উপকরণ:
খাসির মাংস – ১ কেজি
পেঁয়াজ – ৩ টে
সরষের তেল – ১ কাপ
আদা-রসুন বাটা – ২ চামচ
লংকা গুঁড়ো – ১ চামচ
কাশ্মীরি লাল লংকাগুঁড়ো – ১ চামচ
নিহারী মশলা – ৫০ গ্রাম
ময়দা – ৫ চামচ
ব্যাসন – ৫ চামচ
নুন স্বাদ অনুযায়ী…
নিহারী মশলা তৈরির উপকরণ ও প্রণালী:
গোলমরিচ, একটা বড় এলাচ, ৪/৫টা ছোট এলাচ, দারচিনি, ৭/৮ টা লবঙ্গ, জয়িত্রী ২ টো, জায়ফল ৪ ভাগের ১ ভাগ, স্টার অ্যানিক্স ১ টা, ১ চামচ মৌরি, ১ চামচ ধনে, ১ চামচ শা-জিরা, ১ চামচ গোটাজিরে। সব একসঙ্গে মিক্সিতে পিষে নিতে হবে। তারপর এর সঙ্গে শুঁট আদা, লংকা গুঁড়ো, কাশ্মীরি লাল লংকা গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, ধনেগুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি করে নিতে হবে নিহারী মশলা। বাজারেও নিহারী মশলার প্যাকেট কিনতে পাওয়া যায়।

নিহারীর প্রণালী:
প্রথমে কুচি করে কাটা পেঁয়াজ ছাঁকা তেলে লাল করে ভেজে বেরেস্তা বানিয়ে নিতে হবে। প্রেশারকুকারে সরষের তেল গরম হলে মাংস দিন। আদা-রসুন বাটা, নুন, লংকাগুঁড়ো, কাশ্মীরি লাল লংকাগুঁড়ো, নিহারী মশলা দিয়ে কষতে হবে। পেঁয়াজ বেরেস্তার ৩ ভাগের ২ ভাগ মিক্সিতে দিয়ে একটা পেস্ট বানিয়ে নিন। এই পেস্টটা মাংসে দিয়ে আরও কষতে হবে। মশলা কষানো হয়ে গেলে ১ লিটার জল দিতে হবে। প্রেশার কুকার ঢাকনা দিয়ে এঁটে ঢিমে আঁচে আধঘণ্টা রান্না করুন। পাঁচটা সিটি দিলে আঁচ বন্ধ করে দিন।
এবার ময়দা আর ব্যসন ভালো করে মিশিয়ে জলে গুলে একটা পাতলা ব্যাটার বানিয়ে নিতে হবে। কুকার থেকে প্রেশার বেরিয়ে গেলে, ঢাকনা খুলে ওপর থেকে গলে যাওয়া চর্বিটা আলাদা করে তুলে রাখুন। এবার বেশি আঁচে কুকার বসিয়ে ময়দা-ব্যসনের ব্যাটারটা মাংসের ঝোলে মিশিয়ে ভালো করে নাড়ুন। ঢিমে আঁচে ঢাকা দিয়ে আরও ১০ মিনিট রান্না করুন। ঝোল ঘন হয়ে এলে নিহারী তৈরি।
পরিবেশন:
বাটিতে মাংস আর গ্রেভি দিন। আলাদা করে তুলে রাখা ফ্যাট ওপর থেকে ছড়িয়ে দিন। বাকি পেঁয়াজ বেরেস্তা, কাঁচালংকা কুচি, ধনেপাতা কুচি, জুলিয়েন করে কাটা আদা, লেবুর রস ছড়িয়ে পরিবেশন করুন।
দীর্ঘদিন ধরে ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। ভ্রমণ, আনন্দবাজার ই-পেপার, ভ্রমী পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এছাড়া যারা-যাযাবর, তথ্যকেন্দ্র, লেটস্-গো, আজকাল, প্রতিদিন, গণশক্তি প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় ভ্রমণকাহিনি প্রকাশিত। ট্র্যাভেল রাইটার্স ফোরাম ইন্ডিয়ার সদস্য। প্রধান শখ ও নেশা বেড়ানো আর ট্র্যাভেল ফটোগ্রাফি।
4 Responses
ভালো লাগলো
ভালো লাগলো। স্বাদও পেলাম কিছুটা। পুরো স্বাদ পাবো আমাদের কোনো সমাবেশে শ্রেয়সী যদি কৌটো করে নিয়ে আসে।
দর্শনে জিবে জল
না জানি স্বাদে কিবা তল !
মাংস হতে হবে চারপেয়ের এবং লেদার।লা-জওয়াব পরিবেশন।লেখার গুনে শুধু স্বাদু নয়, রীতিমতো সুস্বাদু