নির্বাচিত অংশের অনুবাদ (Novel)
ভূমিকা –
ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ খুন করলে, তাদের কি নির্দোষ বলা যায় নাকি দোষী? ‘অ্যানা ও’ লন্ডন-ভিত্তিক লেখক ও চিত্রনাট্যকার ম্যাথিউ ব্লেকের একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য ক্রাইম থ্রিলারের উপন্যাস, যেখানে ‘অ্যানা ও’ একজন পঁচিশ বছর বয়সী লেখিকা, ঘুমের মধ্যে হাঁটার সময় তার দুই কাছের বন্ধুকে হত্যা করে এবং তারপরে “রেজিনেশন সিন্ড্রোম” নামে পরিচিত এক রহস্যজনক অসুস্থতায় পড়ে চার বছরের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়। ডাঃ বেনেডিক্ট প্রিন্স, একজন ঘুমের মনোবিজ্ঞানী, তিনি ঠিক করেন অ্যানাকে অবশ্যই জাগিয়ে তুলতে হবে, যাতে সে রাতে সত্যিই কী ঘটেছিল এবং আনা নির্দোষ বা দোষী কী না তা খুঁজে বের করার সময় হত্যার বিচারের মুখোমুখি হতে পারে। বইটি ২০২৪ সালে লন্ডনের হারপার কলিন্স প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। মোট পাঁচটি খণ্ডে উপন্যাসটি বিভক্ত, যেখানে সব মিলিয়ে মোট বিরাশিটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। এখানে প্রথম দুটি পরিচ্ছেদের অনুবাদ রইল। (Novel)
রেনাতা মোরেসি-র কবিতা : অনুবাদ— অনিমিখ পাত্র
প্রথম পরিচ্ছেদ – বেন
‘অধিকাংশ মানুষ তার জীবনের তেত্রিশ বছর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়’
সে আমার কাছাকাছি এমন ভাবে ঝুঁকে আসে যে দামী পারফিউমের তীক্ষ্ণ গন্ধটা আমার ভেতর অবধি আসার জন্য যথেষ্ট। এটাই সাধারণত সেই মুহূর্ত যখন আমি অনুমান করতে পারি ‘আপনি কি করেন?’
‘হ্যাঁ’
‘একজন ঘুমের ডাক্তার?’
‘আমি এমন লোকদের অধ্যয়ন করি যাঁরা ঘুমের সময় অপরাধ করে।’ বিজনেস কার্ডে আমার নামের আগে ‘ডক্টর’ আছে। ডাঃ বেনেডিক্ট প্রিন্স, দ্য অ্যাবে, হার্লে স্ট্রিট। আমি ঘুমের বিশেষজ্ঞ। কোথাও আমি নিজেকে ডাক্তার বলে দাবি করি না।
সে দেখে যে আমি সিরিয়াস।
‘এটা কী করে সম্ভব?’
‘আপনি কি কখনও ভেবে দেখছেন না যে আপনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখন আপনি কী কী করতে পারেন?’
বেশিরভাগ মানুষ এখানেই অস্বস্তিতে পড়েন। অধিকাংশ অপরাধের পেছনে কোনও না কোনও দূরদূরান্তের কারণ রয়েছে। আমরা আমাদের মতো মানুষের গল্পে আনন্দ করি; কিন্তু যারা আমাদের মতো নয়। কিন্তু ঘুম সেই যোগ্যতাকে অনুমোদন করে না।
ঘুম সার্বজনীন, রাত দিনের মতই স্থির।
‘কী ধরনের অপরাধ?’
তিনি তখনও বিষয়টি পরিবর্তন করেননি। আমি তখনও তাঁর মনোযোগ পাচ্ছিলাম
‘সবচেয়ে খারাপ…’
‘নিশ্চয়ই মানুষ জেগে উঠবে?’
‘না যদি তারা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। আমি এমন রোগীদের চিনি যারা তাদের দরজা লক করে এবং ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় গাড়ি চালায়। কেউ কেউ খুনও করে।
‘সত্যিই মনে আছে?’ ‘ঠিক এখন যেমন আপনার চোখের চারপাশের রেখা থেকে, আমি অনুমান করছি আপনি গত রাতে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন।’
সে ভ্রুকুটি করে ‘এটা কী করে হতে পারে?’
‘সেই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে কী ঘটেছিল তার কোনও স্মৃতি আছে কি?’
সে থেমে যায়, তার ডান হাতে তার চিবুক কাঁপছে। ‘আমি কিছু স্বপ্ন দেখেছি।’
‘কী রকম?’
‘মনে করতে পারছি না।’
‘এবার আমার অনুমান সত্যি হল’
তার চোখ হঠাৎ বদলে গেল। সে আমাকে এখন অন্যভাবে নিরীক্ষণ করছে। তার কণ্ঠস্বর বেড়ে গেছে, শরীরের ভাষা প্রাণবন্ত।
‘দাঁড়াও, সেই ঘটনাটা বলি। এটাকে বলা হতো—’
এটাই সেই চূড়ান্ত মুহুর্ত। কিছু ঘটনা কখনও এই পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাত। আমি তখন আমার কাজের বিবরণ দিয়ে তাদের উত্তেজিত করতাম। আমি ঘুমের সময় সংঘটিত অপরাধের গল্প দিয়ে তাদের ভয় দেখাতাম। যদি এটিতেও কাজ না করে, তবে এই শেষ উপায়টিতে সর্বদা আমি সফল হয়েছি। বুঝতে পারলে কেউ থাকে না। কেউ না।
‘অ্যানা ও’, আমি তাকে ডাকলাম। দুঃখের বিষয় আমি তখন আমার ওয়াইনের শেষ চুমুকটা পান করলাম- একটি দামি মেরলট এবং তারপরে আমার জ্যাকেটটা আনতে গেলাম।
‘তুমিই সেই লোক। ফটোতে দেখেছিলাম। একজন মনোবিজ্ঞানী তুমি।’
আমি মৃদু হাসলাম। আমার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম ‘হ্যাঁ’, বললাম ‘আমি ছিলাম।’
সেই নৃশংস, রক্তে ভেজা সমাপ্তির পরে প্রতিটি প্রধান দৈনিক পত্রিকার সামনের পাতায় আমার ছবি থাকত। ওটা ছিল এক দুর্ভাগ্যজনক মুহূর্ত যার পরে কিছুই একরকম থাকতে পারে না। ওই নির্বাসন ও সর্বনাশের আগে আমি একরকম ছিলাম। এখন আমি অন্যরকম। মসৃণ চুল এবং সামান্য পরিচ্ছন্ন পোষাক সেন্স সঙ্গে চশমা পরা চেহারা। তারপর থেকে আমি নিজেকে নতুন করে তৈরি করেছি। দাড়িতে পাক ধরেছে; চুলের ডগা ধূসর হয়েছে। আমার চশমাগুলি হ্যারি পটারের বাতিল করা চশমার মতো। কিন্তু আমি আমার চোখ বা মুখ পরিবর্তন করতে পারিনি।
ওপর ওপর আমি হয়তো এখন একজন ভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু অন্তরে একই মানুষ বিরাজ করে।
আমি এবার সেই প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করি যা আমাকে সবসময় জিজ্ঞাসা করা হয়। এটি একটি রহস্য যা, সবকিছু সত্ত্বেও, এখনও দীর্ঘস্থায়ী। এটি পরিবার, স্ত্রী, এমনকি বন্ধুদেরও আমার থেকে দূরে করে দিয়েছে।
‘সে কি দোষী ছিল?’
‘যখন সে ওই দুইজনকে ছুরিকাঘাত করেছিল, সে কি সত্যিই খুন করে পালিয়ে গেছে?’
আমার মক্কেল জিজ্ঞেস করে, কিংবা সেই মহিলা যিনি আগে আমার মক্কেল ছিলেন। আমি এখন তার কাছে ক্রিসমাসটাইম বা নববর্ষের উপাখ্যানের পিশাচ ছাড়া কিছুই নই।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বেন
লন্ডন –
মোবাইল বেজে ওঠে।
যেটা আমি সবসময় মনে রাখি সেটা হল যেকোনও ঘটনার শুরুটা কীভাবে হয়েছিল।
তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, অন্ধকার ইতিমধ্যেই ঘন, কালো হয়ে গেছে। আমি একটি আর্মচেয়ারে অর্ধ-ঘুমিয়ে আছি। থালায় একটু হালকা গরম তরকারি আর আধা-খালি গ্লাসে সস্তা ওয়াইন। একটা সাদা-কালো সিনেমা চলতে থাকে, ঘরের কোণে ঝিকিমিকি করে। ‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন’ আমার প্রিয় সিনেমা। সময় কাটানোর জন্য কেউ হিচককের ‘সাইকো’ বা ‘ভার্তিগো’ সিনেমা খুলে বসেছে। তবে আমার মনে হয় ওরা ভুল ছিল। ‘স্ট্রেঞ্জার্স অন আ ট্রেন’ এই টেনিসের ওই দৃশ্যটি ছিল।
মোবাইলের ভাইব্রেশন শুনে আমি রুমে ফেরত আসি। আমার চোখের পাতা পিটপিট করছে। আমি আমার হাত থেকে গ্রীজ মুছে কলার আইডির দিকে তাকিয়ে দেখলাম: ‘ব্লুম, মঠের প্রফেসর’।
আমি বোতামটি স্লাইড করে ফোনটা ধরি, নিজেকে কিছুটা দৃঢ় করি, একটি অগোছালোভাবে দম বন্ধ করে হাই তুলে বলি ‘হ্যালো?’
‘বেন, এই অপবিত্র সময়ের জন্য দুঃখিত। আমি এটাই ভয় পাচ্ছিলাম যে কেউ অপেক্ষা করতে পারবে না।’
তাকে বেশ সিরিয়াস শোনাচ্ছে এবং রাতের অন্ধকারেও এটা আমাকে চমকে দিচ্ছে।
প্রফেসর ভার্জিনিয়া ব্লুম সাধারণত একজন কৌতুক মানুষ যাকে প্রায়ই অক্সফোর্ড স্ট্রিটে কাফতান এবং হিল জুতো পরে অথবা ল্যাংহামের রাস্তায় কোণার কোনও টেবিলে হুইস্কির ডেক্যান্টার এবং পকেটভর্তি উত্তেজক সামগ্রী নিয়ে নেমে যেতে দেখা যায়।
আমি লাইনে দাঁড়িয়ে পায়ের শব্দ এবং কণ্ঠস্বর দূর থেকে শুনতে পাই। মনে হল ব্লুম এখনও মঠে আছে। আমি ঘড়িতে দেখলাম, তখন প্রায় মধ্যরাত।
‘কিছু কী হয়েছে?’
‘আপনি সেটা বলতে পারতেন’ ব্লুম গলা ঝেড়ে বিকট স্বরে বলল।
‘ভয়ে ভয়ে বলছি, আপনার কাছে একটি নতুন অনুরোধ আছে, যদিও ব্যাপারটা বেশ সংবেদনশীল।’
আমি একজন ফরেনসিক সাইকোলজিস্ট। আমি বেশিরভাগ অপরাধ প্রধান সংস্থার সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছি। এনসিএ, এফবিআই এবং ইন্টারপোল সবার কাছেই এই নম্বর আছে। তবে এটি স্বাভাবিকের চেয়ে আরও গোপনীয় শোনাচ্ছে। ‘এই অনুরোধের কি কোনও নাম আছে?’
ফোনের ওপারে তখন হইহট্টোগোলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ব্লুমকেও বেশ অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে।
‘মঠে ঘুরে আসতে পারেন, যাবেন? আমাকে বলা হয়েছে খোলা প্রাঙ্গণে কোনও বিষয়ে আলোচনা না করতে।’
অফিসিয়ালি আমি এক সপ্তাহের ছুটিতে আছি। আমার সর্বশেষ জার্নাল নিবন্ধটি শেষ করার সময়সীমা কাছে এসে গেছে। লেখার জন্য তিনটি রোগীর ফাইল পড়ে আছে। তাই আগামীকাল বাড়ি থেকেই কাজের পাহাড় মোকাবিলা করার পরিকল্পনা করছিলাম।
কেবলমাত্র কয়েকটি ঘুম-সম্পর্কিত কেস রয়েছে যা খুবই সংবেদনশীল। আমার মনে হচ্ছিল এই রহস্যগুলো আমায় ব্ল্যাকমেইল করছে, ঠিক যেমন ব্লুম আমায় চাপ দিতে থাকে ‘তোমাকে এই বিষয়ে কিছু একটা উদ্ঘাটন করে আমাকে দিতেই হবে।’
আমি লাইনের অন্য প্রান্তে বাতাসের ওঠানামার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। ব্লুম চুপ করে ছিল তারপর জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘আপনি এর জন্য আমাকে ধন্যবাদ নাও দিতে পারেন।’
তখন খুব ঠান্ডা বাইরে, সেপ্টেম্বরের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে পূর্ণ একটি মেঘলা আকাশ। আমি ইতিমধ্যে পিমলিকো থেকে হার্লে স্ট্রিট পর্যন্ত যাত্রাকে ভয় পাচ্ছি। আমি আবার আমার ওই হিচকক পরিচালিত সিনেমা এবং আরেকটি গ্লাস ওয়াইন নিয়ে মানসিক উত্তেজনা নিয়ে সামনের ঘরের দালানে বসে পড়লাম। কিন্তু যেভাবে আমাকে জানানো হয়েছিল, এটা সেরকম নয়।
এজন্য আমি উত্তর দিচ্ছি। সবসময়ই উত্তর দি।
ব্লুম শেষ পর্যন্ত বললেন ‘এটি অ্যানা ও কেস,’ ‘এমন কিছু আছে যা তারা আমাদের দেখাতে চায়।’
- বাকিটা রইল উপন্যাসের গভীরে পাঠকের অপেক্ষায় –
মূলকাহিনী- ম্যাথিউ ব্লেক
ছবি সৌজন্যে – Google
মোহনা মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। অঙ্কে স্নাতকোত্তর। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ শব্দলেখা থেকে ''যতোটা অপ্রকাশিত'(ই-সংস্করণ)। ২০২২ এ বইতরণী থেকে প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'বিহান আলোর লিপি' ও ২০২৩ আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় অক্ষর সংলাপ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'উৎসারিত ও সলিলোকুই'।