Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গল্প: জয়কিষণগঞ্জের গল্প (শেষ পর্ব)

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

মার্চ ২০, ২০২৩

Alolika Mukhopadhyay
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

আগের পর্ব পড়তে: [] []

জবা সময়টা অনুমান করার চেষ্টা করছিল—“এটা তুই কবেকার কথা বলছিস? মাঝে সে একটানা বছর তিনেক এল না। তোর মনে আছে?”

—“এটা প্রায় তেরো-চোদ্দ বছর আগের ঘটনা। সোহেলের কাছে যা শুনেছি। ওই সময় বাবা একজন বাংলাদেশী রেস্টারেন্ট ওনারের কাছে মেহরীন আন্টির খোঁজ পেয়েছিল এবার আর টাকা পয়সার ডিল নয়। উইডো মহিলা বিয়ে করতে চান। বাবা এখানকার সংসারেরর কথা লুকিয়ে মেহরীন আন্টিকে বিয়ে করে নিল। গ্রিনকার্ড না পাওয়া পর্যন্ত কলকাতায় আসেনি।”

—“তোর সঙ্গে বুঝি ছেলেটার খুব ভাব? ওদের সঙ্গে বেশি মেলামেশার দরকার কি? ওর মাকে তুই ভাল বলছিস? জেনেশুনে একটা ম্যারেড লোককে বিয়ে করল কেন? তার যে এখানে বউ আর দুটো ছেলেমেয়ে আছে, কিছুই জানত না?”

দেবী ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল—“না মা, মেহরীন আন্টি তখন সত্যিই সব কথা জানত না। বাবা নিজেকে ডিভোর্সড বলেছিল। তুমি এখানে আমাদের নিয়ে আলাদা থাকো। বাবা অ্যালিমনির জন্যে ডলার পাঠায়। বাবার মিথ্যে কথাগুলো মেহরীন আন্টি অনেক পরে ধরতে পেরেছিল। তখন থেকে ওদের রিলেশনটা স্ট্রেইন্ড হয়ে গেছে।”

জবার গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ল—“রিলেশন! তুই প্রেম-ভালবাসার কথা বলছিস? ওই মানুষটার মধ্যে ভালবাসা বলে কিছু নেই রে দেবী। কোনওদিন ছিল না। বুঝতো শুধু শরীর আর নিজের স্বার্থ! এই জন্যে ওখানে বিয়েটা করেছিল! এত কাণ্ডের পরেও পাপু হল। ওই মেহরীন কি করে মেনে নিল?”

—“তারপর থেকেই ‘অশান্তি’ শুরু হয়েছিল। লিগ্যালি বাবা দুটো বিয়ে করতে পারে না। বাবা আগে বুঝিয়েছিল রাজা জন্মানোর পরেই তোমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল। তাই মেহরীন আন্টির সঙ্গে সেকেন্ড ম্যারেজটা লীগ্যাল। মাঝে একবার এখানে এসে ইমিগ্রেশনের ফর্ম সই করাচ্ছে বলে তোমাকে দিয়ে একগাদা কাগজপত্রে সই করিয়ে নিল। তুমি না দেখেশুনে ডিভোর্সের কাগজে সই করে দিলে। বাবা কিভাবে তোমাকে চিট করল? পাপুর কথাও ভাবল না!”

দেবী কাঁদছিল। জবা স্তম্ভিত। অনিলের কাছে প্রত্যাশা কিছু ছিল না। নিজের দুর্ভাগ্য, বঞ্চনার দুঃখ একরকম সয়ে গিয়েছিল। জানত, মানুষটা কখনও বদলাবে না। এখানে সংসার রেখে, ওখানে যা করার করে যাবে। মাঝে মাঝে আসে। নিয়ম করে খরচ পাঠায়। দেবী আর রাজাকে নিজের কাছে নিয়ে গেল। জবা ভেবেছিল একদিন ওদেরও যাওয়া হবে। আর, আজ দেবী বলছে অনিল ওকে ডিভোর্স করেছে? এখনও বিশ্বাস হয় না। মানুষ এমনভাবে ঠকাতে পারে। বউ, বাচ্ছাকে পথে বসাতে পারে? এখন তাহলে শুধু দয়া করে টাকা পাঠায়? ক্ষোভে, দুঃখে অপমানে জবা স্তব্ধ হয়ে রইল। 

প্রতিমা বুঝতে পারছিলেন কিছু একটা ঘটেছে। দেবীর মধ্যেও পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলেন। তিন বছরে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। আমেরিকায় থাকলে বোধহয় এরকম হয়। অল্প বয়সেই স্বাবলম্বী হাবভাব। সেটা ভাল। তবে দেবীকে যেন একটু চিন্তিত মনে হয়। মার সঙ্গে অনেক রাত অবধি জেগে থাকে। পাশের ঘর থেকে ওদের কথাবার্তার আওয়াজ পান। পাপু আর রাজা প্রতিমার ঘরে শোয়। কাল মাঝরাতে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে পাপু ঘুমচোখে বিড়বিড় করে বলল—“মা আর দিদি এখনও জেগে আছে।”

শেষ পর্যন্ত প্রতিমা সবই শুনলেন। দেবী আর জবা যাই বলুক, অনিলের ডিভোর্স নিয়ে সেরকম বিচলিত হলেন না। যা করেছে, সে তো অনেকদিন আগেই করেছে। তার জন্য কলকাতায় আসা বন্ধ করেনি। টাকা পাঠানো বন্ধ করেনি। এবার ও দেবীর সঙ্গে অনেক ডলার পাঠিয়েছে। অকর্তব্য করছে না। জবা বলছিল অনিল টাকা দিতে বাধ্য। সংসারটা কি জবার একার? প্রতিমা আর পাপুর খরচ নেই? জবার জন্যেও অনিল খোরপোশ দিতে বাধ্য। অন্যায় কিছু বলেনি। ছেলের স্বরূপ প্রতিমা ভালই জানেন। কত চালাকি করে গেল সারা জীবন। কিন্তু নিজেও কি শান্তি পেল? দেবীর তো বাবার ওপর প্রচণ্ড রাগ। রাজা অবশ্য কোনও কথায় থাকে না। দেবী বলে, রাজা ছেলে বলে ওর জন্যে বাবা কলেজের খরচ দেবে। অথচ দেবীকে আর পড়াবে না। হাইস্কুল শেষ হলে দোকানের চাকরিতে ঢোকাবে। তারপর বিয়ে দিয়ে দেবে। আমেরিকার গ্রিনকার্ডের লোভে এদেশেই ওর পাত্র জুটে যাবে। জবা বলে উঠল—“কখনও রাজি হবি না। আমার অবস্থা দেখছিস না?”

প্রতিমা মুখ নিচু করে তরকারি কাটছিলেন। দেবীর গলায় জেদ ফুটে উঠল—“বাবা চাইলেই তো হবে না। মেহরীন আন্টি, সোহেল, আমাদের স্কুলের গাইডেন্স কাউন্সেলর সবাই আমাকে হেল্প করবে। দরকার হলে কলেজ লোন নেব। একটা সলিউশন হবেই।”

প্রতিমা মুখ তুললেন—“দেখিস বাবা, শেষ পর্যন্ত বাবার সঙ্গে ঝগড়া লাগাস না। ওই তো তোদের নিয়ে গেছে। পরের কথায় নেচে এখন থেকে মাথা গরম করিস না। কলেজের তো দেরি আছে।”

দেবী মুখের ওপর শুনিয়ে দিল—“যাদের পর বলছ, ওরাই কিন্তু আমার ভাল চায়। মেহরীন আন্টি রাজি না হলে, বাবা কোনওদিন আমাদের নিয়ে যেতে পারতো না। এই যে তোমাদের জন্যে এত জিনিস নিয়ে এলাম, সেও মেহরীন আন্টি কিনে দিয়েছে। আমি চাইনি। নিজে থেকেই তো দিল?”

ছুটির শেষে দেবীরা নিউইয়র্ক ফিরে গেল। জবা যন্ত্রের মতো কাজকর্ম চালিয়ে যায়। কোনওমতে বাজার করে। দায়সারাভাবে রান্না করে। নেহাৎ ছোট মেয়েটা আছে তাই। নয়তো এই সংসারে থাকাটাই ওর প্রহসন মনে হয়। একদিন টেলারিং শপ থেকে ফেরার পর প্রতিমা বললেন—“আজ আবার প্রোমোটারের লোক এসেছিল। রবিবারে আসতে বলেছি। এবার তুমি কথা বলবে।”

এবার ও দেবীর সঙ্গে অনেক ডলার পাঠিয়েছে। অকর্তব্য করছে না। জবা বলছিল অনিল টাকা দিতে বাধ্য। সংসারটা কি জবার একার? প্রতিমা আর পাপুর খরচ নেই? জবার জন্যেও অনিল খোরপোশ দিতে বাধ্য। অন্যায় কিছু বলেনি। ছেলের স্বরূপ প্রতিমা ভালই জানেন। কত চালাকি করে গেল সারা জীবন। কিন্তু নিজেও কি শান্তি পেল? দেবীর তো বাবার ওপর প্রচণ্ড রাগ। রাজা অবশ্য কোনও কথায় থাকে না। দেবী বলে, রাজা ছেলে বলে ওর জন্যে বাবা কলেজের খরচ দেবে।

জবা নিষ্পৃহ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল—“আমার অত বিষয়বুদ্ধি নেই মা। কথা বলার জন্যে ছোটমামাকে খবর দিন। তাছাড়া, আমি এর মধ্যে থাকতেও চাই না।”

প্রতিমা ক্ষুব্ধ হলেন—“কেন? নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি হলে আমার সঙ্গে থাকবে না? তোমার মাথায় কী ঢুকেছে বলো তো?”

জবার মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। একপলক চেয়ে থেকে বলল—“আপনার ছেলের সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক নেই। তবু এই ভাঙাচোরা বাড়িটার মায়া কাটাতে পারছি না। এত বছর পরে কোথায় যাব বলুন?”

—“এই ভাঙাচোরা বাড়িটা আমার। এর জন্যেই দশবার প্রোমোটার আসছে। নতুন ফ্ল্যাট আর টাকা দেবে বলছে। তুমি এবার উকিল ডেকে নিজের জন্যে সবকিছু বুঝে নাও জবা। তোমার নামে উইল করতে চাই। মানুষকে আর বিশ্বাস হয় না।”

দেড় বছর পরে দেবী নিউটাউন হাইস্কুল থেকে পাশ করে স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্কে ভর্তি হল। কলেজের ক্যাম্পাস লং আয়ল্যান্ডে। ছুটিতে বাড়ি আসতে গেলে ট্রেনে ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগে না। দেবী কলেজে ফাইন্যানশিয়াল এইড পেয়ে যেতে অনিল বাকি খরচপত্র দিতে আপত্তি করল না। রাজার হাইস্কুল চলছে। সপ্তাহে দু’দিন বিকেলে এলমহার্স্ট হসপিট্যালে ভলান্টারি সার্ভিস করে। অন্যদিন ছুটির পরে বাস্কেট বল প্র্যাকটিস, স্কুলের নিউজ লেটার কমিটির কাজকর্ম, স্প্যানিস ক্লাবের মিটিং, রাজার একস্ট্রা কারিকিউলার অ্যাকটিভিটি বেড়েই চলেছে। দেবী ওকে রাতের দিকে ফোন করে। পড়াশোনার খবর নেয়। কলেজে দেবীর বেশ ক’জন নতুন বন্ধু হয়েছে। পড়াশোনা, পরীক্ষার চাপ, সাউথ এশিয়ান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নানা অনুষ্ঠান, দেবীর প্রথম বছরটা দ্রুত শেষ হয়ে গেল। সোহেলের সঙ্গে আগের মতো দেখা হয় না। দেবী আশা করেছিল গরমের ছুটিতে বাড়িতে আসার পর মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই দেখা হবে। দেবী সামার জব খুঁজছিল। তিনমাসের জন্যে কাছাকাছি একটা ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গেল। ছুটির দিনে সোহেল যদি বা আসে, বেশিক্ষণ থাকে না। ব্রুকলিন কলেজে নাইট কোর্সে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছে। চাকরি, পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। দেবী শনি-রবিবারে সময় কাটানোর জন্য মাঝে মাঝে জ্যাকসন হাইটস্-এ ঘুরে আসে। মেহরীন দোকানে কয়েক ঘণ্টা থেকে ওকে সাহায্য করে।

SUNY Bengali story on Jackson Heights
দেবী নিউটাউন হাইস্কুল থেকে পাশ করে স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্কে ভর্তি হল।

অনিলের মাথায় নানা চিন্তা। এরপর রাজা কলেজে যাবে। তার খরচ আছে। এখানকার বাড়ির জন্যে মাসে মাসে ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করে যাচ্ছে। মর্টগেজ-এর অর্ধেক পেমেন্ট দেয় মেহরীন। বাকিটা অনিল। তবে কিছুদিনের মধ্যে লোন্ শোধ হয়ে যাবে। কিন্তু রাজা, দেবীকে এদেশে আনার পর থেকে সংসার খরচ অনেক বেড়েছে। এর ওপর কলকাতার বাড়িতে টাকা পাঠানো। কত বছর মাকে দেখতে যাওয়া হয়নি। ছোট মেয়েটা বোধহয় বাবাকে ভুলেই গেছে। মা হঠাৎ বাড়িটা প্রোমোটারকে দিয়ে দিল। অনিলের সঙ্গে একবার পরামর্শ করল না। নতুন ফ্ল্যাট না পাওয়া পর্যন্ত ওরা টালিগঞ্জের দিকে একটা ভাড়া বাড়িতে আছে। অনিলের একবার দেশে যাওয়ার দরকার। কিন্তু পারছে কোথায়? কোনকালে জবাকে ডিভোর্স করেছে। তবু অনিল কোলকাতায় যাবে শুনলে মেহরীনের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। দুটো সংসার রাখার যে কি জ্বালা অনিল ক্রমশ হাড়ে হাড়ে বুঝছে। রোজগারের জন্যে সারা জীবন খেটে যাচ্ছে। ইদানিং বড় ক্লান্ত লাগে। শরীরটা বিশ্রাম চায়। অথচ চাকরি ছাড়ার উপায় নেই। অনিলের একটাই আশা। বুড়ো বয়সে মেহরীন ছাড়াও ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই দেখবে।

দেবীর কলেজে দ্বিতীয় বছর চলছে। ইকনমিক্স ক্লাসের রাহুল শর্মা ওকে দিওয়ালি ফেসিটভ্যালে গান গাইতে ডেকেছিল। দুটো হিন্দি গান গেয়ে রাত দশটা পর্যন্ত প্রোগ্রাম দেখে দেবী কলেজ ডর্মে ফিরে এল। ওর রুমমেট ক্রিস্টিনা কম্পিউটারে বসেছিল। দেবীকে খবর দিল সোহেল ওকে দু’বার ফোন করেছে। দেবীকে ওর সেল নম্বরে কল করতে বলেছে। দেবী ঠিক করল এত রাতে আর ফোন করবে না। সোহেল আজকাল ওর সঙ্গে দেখা করার সময় পায় না। সামারে একটা ব্রডওয়ে শো দেখার কথা ছিল। তাও সোহেলের সময় হল না। হঠাৎ আজ দু’বার ফোন কেন?

দেবী জামাকাপড় বদলাচ্ছে, তখন ডোরবেল বাজল। এত রাতে কে এল? ক্রিস্টিনা উঠে গিয়ে দরজার লক ঘুরিয়ে বাইরে উঁকি দিল। সোহেল দাঁড়িয়ে আছে। দেবী ফিরেছে কিনা জিজ্ঞেস করায় ক্রিস্টিনা ওকে ভেতরে ডাকল। সোহেলের মুখ দেখে ওর মনে হল নিশ্চয়ই খুব দরকারেই এসেছে। না হলে এত রাতে কলেজ ডর্মে আসবে কেন?

অনিলের মাথায় নানা চিন্তা। এরপর রাজা কলেজে যাবে। তার খরচ আছে। এখানকার বাড়ির জন্যে মাসে মাসে ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করে যাচ্ছে। মর্টগেজ-এর অর্ধেক পেমেন্ট দেয় মেহরীন। বাকিটা অনিল। তবে কিছুদিনের মধ্যে লোন্ শোধ হয়ে যাবে। কিন্তু রাজা, দেবীকে এদেশে আনার পর থেকে সংসার খরচ অনেক বেড়েছে। এর ওপর কোলকাতার বাড়িতে টাকা পাঠানো। কত বছর মাকে দেখতে যাওয়া হয়নি। ছোট মেয়েটা বোধহয় বাবাকে ভুলেই গেছে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেবী কেমন থতমত খেয়ে গেল—“তুমি? ফোন করেছিলে? কী হয়েছে সোহেল? ইউ লুক ভেরি আপসেট! হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

সোহেল কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল—“খবর ভাল নয় দেবী। আমি তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে কনট্যাক্ট করার চেষ্টা করছিলাম। শেষ পর্যন্ত নিজেই চলে এলাম।”

দেবীর গলার স্বর কেঁপে উঠল—“কি হয়েছে বলছ না কেন? রাজা কোথায়? ওর কিছু হয়নি তো?”

—“দেবী, বাবুজী মারা গেছেন। হি হ্যাড এ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।” মুহূর্তের আশঙ্কা, তীব্র উৎকণ্ঠা দূর হয়ে যাচ্ছে। দেবী যেন স্বার্থপরের মতো এক গোপন স্বস্তি অনুভব করছিল। তবে কি রাজা ছাড়া ওর আপনজন কেউ নেই? কারওর বিপদ, দুঃসংবাদ ওর মনকে স্পর্শ করে না? বাবার মৃত্যুসংবাদও নয়?

ক্রমশ দেবীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ফিরে এল। বাবা চলে গেছে। ও জানতেও পারল না? কেন? বাবা কি অভিমান করে নিজের অসুখের কথা জানাতে দেয়নি? সোহেল একেবারে শেষ খবর দিতে এল?

দেবী বলল—“বাবার হার্ট অ্যাটাক হল। রাজা আমাকে খবর দিল না? কখন কি হল সোহেল?”

সোহেল সেই বেদনার্ত মুখের দিকে চেয়ে থেকে উত্তর দিল—“রাজা এখানে ছিল না দেবী। স্কুল থেকে ওয়াশিংটনে গিয়েছিল। খবর পেয়ে চলে এসেছে। তোমাকে ফোনে কনট্যাক্ট করতে পারছিলাম না।”

দেবী সোহেলের সঙ্গে অনেক রাতে কুইনস-এর বাড়িতে এসে পৌঁছল। তখনও মেহরীনকে ঘিরে ওদের চেনাশোনা ক’জন মহিলা বসে আছে। বাইরের ঘরে কার্পেটে বসে রাজা কাউকে ফোন করছিল। সেখানে দু’জন বাংলাদেশী ভদ্রলোক সোহেলের অপেক্ষায় ছিলেন। সোহেল বলল—“দেবী, মার সঙ্গে দেখা করে এসো। তারপর ফিউন্যারালের ডিটেইলস্ জানাচ্ছি।”

রাজা ফোন রেখে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে যাবার সময় বলল—“কাল বিকেলেও বাবার সঙ্গে ফোনে কথা হল। হি নেভার মেনশনড অ্যাবাউট হিস ডিসকমফর্ট। তখনও যদি চেস্ট পেইন-এর কথা বলত, ডিরেক্টলি অ্যাম্বুলেন্স কল করে দিতাম।”

দেবীর মুখের ম্লান হাসি—“তোদের বদার করতে চায়নি। ইউ আর দ্য ওনলি পার্সন, যাকে বাবা সবসময় খুশি রাখতে চাইত।” রাজার চোখ জলে ভরে গেছে। দেবী ওকে ঘরে পাঠিয়ে মেহরীনের কাছে গেল। 

বিছানার পাশে একটাই আলো জ্বলছে। সেদিকে দু’জন মহিলা বসে আছেন। অন্যদিকে আলো নেভানো। আধো অন্ধকারে মেহরীন শুয়ে আছে। দেবী কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মেহরীন ওর হাত ধরে কতক্ষণ কোনও কথা বলল না। দেবী খাটের ধারে দাঁড়িয়ে আছে দেখে এক মহিলা বললেন—“তুমি ভাবীর কাছে বসো। কলেজ থেকে আসছ। একটু পরোটা, সব্জি নিয়া আসি। যেটুকু পারো খাও।”

দেবী বাধা দিল—“এখন কিছু খাব না। ইচ্ছে করছে না।”

death
তোমার বাবাকে বাঁচাইতে পারলাম না।

মেহরীন চোখের জল মুছে উঠে বলল—“তোমার বাবাকে বাঁচাইতে পারলাম না। সারাদিন আমি দোকানে বইসা আছি। তিনি একবার আমারে বুকের যন্ত্রণার কথা জানাইলেন না। সকালে কাজে যান নাই। সর্দিজ্বরে হাঁপ ধরতেসে বলে বাসায় থাকলেন। আমি ফিরা আইস্যা দেখি শুইয়া পড়সেন। তখনও বুঝি নাই… ” মেহরীন কপালে হাত রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। 

অন্য মহিলা সান্ত্বনা দিল—“তুমি তো যা করার সব করেছ। মাঝরাতে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে ওঁকে হসপিট্যালে নিয়ে গেছ। ছেলেমেয়ে বাড়িতে থাকলেও এর বেশি কী করতে পারত বলো?”

দেবীর হঠাৎ মনে হল যেন অন্য কোনও বাড়িতে এসেছে। এই শোক ওকে গভীরভাবে স্পর্শ করছে না। বাবা মারা গেছে। তার জন্যে শোক করছে অন্য এক মানুষ। মা কোথায় পড়ে আছে। ঠাকুমাও কি জানে তার ছেলে বেঁচে নেই? আজ এ বাড়িতে এত লোক আসছে যাচ্ছে, তাদের কাউকে দেবী চেনে না। মেহরীন আন্টি, সোহেল অন্য সমাজের মানুষ। এই প্রথম দেবী উপলব্ধি করল এদেশে ওদের কেউ নেই। শুধু বাবা ছিল নিজের লোক। এ বাড়ির সঙ্গে কি সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে? সকলের কাছে যেন মেহরীন আন্টির দুঃখটাই বড় হয়ে উঠেছে। 

একজনও ওদের সঙ্গে বাবার কথা বলছে না। যেন বাবা দেবী, রাজার কেউ ছিল না। রাজাও বোধহয় একা একা নিজের ঘরেই বসে আছে। দেবী উঠতে যাচ্ছিল। সোহেল ভেতরে এল। মেহরীনের গায়ে হাত রেখে বলল—“এবার শুয়ে পড়ো। কাল ভোরে উঠতে হবে।”

মহিলাদের বাইরে ডেকে সোহেল মার ঘরের দরজা টেনে দিল। দেবীকে বলল—“রাজার ঘরে চলো। বাবুজীর ফিউনারাল অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে। তাও তোমাদের যদি কোনও নিয়ম থাকে, উই হ্যাভ টু নো দ্যাট্।”

আজ লং আয়ল্যান্ড থেকে আসার পথে সোহেলের কাছে দেবী শুনেছিল বাবার দেহ হসপিট্যাল মর্গ থেকে ফিউনারাল হোমে পৌঁছে গেছে। কাল সকালে ওখানে কিছুক্ষণ রাখার পর সেমেটরিতে নিয়ে যাবে। সেমেটরি শুনে দেবী অবাক হয়েছিল। বাবা তো হিন্দু ছিল। নিজেই বলেছিল মেহরীন আন্টিকে বিয়ে করার সময় ইসলামে কনভার্ট করেনি। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছিল। 

তাহলে ওরা বাবার দেহ কবরখানায় নিয়ে যাবে কেন? নাকি বাবা ওকে সত্যি কথাটা জানাতে চায়নি? কিন্তু বাবাকে তো দেবী কখনও নামাজ পড়তে দেখেনি। মেহরীন আন্টি ভোরবেলায় ফজরের নমাজ পড়ে কাজে যায়। ওদের ধর্মে যেমন নিয়ম, তেমনভাবে চলে। বাবা তো কিছু মানত না। দেবী ভেবেছিল কথাটা সোহেলকেই জিজ্ঞেস করবে। বাবা নিজের ধর্মে ছিল, না বিয়ের জন্য মুসলমান হয়েছিল, সোহেল নিশ্চয়ই জানে। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে পারেনি। সারাটা পথ সোহেল নিজের মার জীবনের স্ট্রাগল, শোক, তাপ, দুঃখ-কষ্টর কথা বলছিল। কত কম বয়সে সোহেলের বাবা ক্যানসারে মারা গিয়েছিল। ছেলেকে আমেরিকায় মানুষ করার জন্য মেহরীন আন্টি বাংলাদেশে ফিরতে চায়নি। ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে, কি পরিশ্রম করে নিজের দোকানটা দাঁড় করিয়েছে। কিভাবে দেবী আর রাজাকে নিজের সংসারে অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে। বাবার শেষ সময়েও মেহরীন আন্টিই পাশে ছিল। সোহেল শুধু মার দুঃখের কাহিনী বলে যাচ্ছিল। এর মাঝখানে বাবার ধর্মের কথাটা তোলা হয়তো ঠিক হবে না। এই ভেবে দেবী তখন চুপ করেছিল। 

কিন্তু এখন সোহেল দেবীদের নিয়ম, রিচুয়ালস্-এর ব্যাপারটা জানতে চাইছে। তবে তো জিজ্ঞেস করাই যায়। রাজার ঘরেই কথাবার্তা শুরু হল। দেবী সরাসরি জানতে চাইল—“ফিউনারাল হোম থেকে আমরা সেমেটরিতে যাচ্ছি কেন? ওখানে তো শুধু বেরিয়াল হয়।”

সোহেল ওর মুখের দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে থেকে বলল—“দেবী, প্লিজ ট্রাই টু লিসন্। আমি এমন কিছু করব না, যা তোমাদের রিলিজিয়নকে কন্ট্র্যাডিক্ট করে। ফিউনারাল হোমে বাবুজীর জন্যে ভিউইং হবে। ওঁর অফিসের কো-লীগ, মার জানাশোনা লোকজন, আমার ক’জন বন্ধু, রাজার স্কুলের বন্ধুরা, দু-চারজন লেবার ওখানে যাবে। বাবুজী সম্পর্কে কিছু বলার ইচ্ছা হলে বলবে। তার আগে তুমি আর রাজা ওঁকে রেসপেক্ট জানিও। ভিউইং শেষ হলে ওখান থেকে উডলন সেমেটরি। ওখানে আলাদা হল আর ক্রিমেটোরিয়াম আছে। জ্যাকসন হাইটস্-এর সুরেশ আঙ্কল একজন হিন্দু প্রিস্টকে নিয়ে আসবেন।”

রাজা বলল—“দিদি, তোকে জিজ্ঞেস করার সময় পাইনি। বাবাকে পরানোর জন্যে একটা ব্ল্যাক স্যুট দিয়ে এসেছি। বাবা তো ইন্ডিয়ান জামাকাপড় পরতও না।”

সোহেল দেবীকে জিজ্ঞেস করল—“এবার তুমি বলো, অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর কাস্টম রাজাই ক্রিমেজনের আগে প্রিস্টের সঙ্গে পুজো করে ফায়ার জ্বালাবে তো?”

দেবী কখনও শ্মশানে যায়নি। ওদের কৃত্তিবাস লেনের বাড়ি থেকে শ্মশান দূরে ছিল না। তবু, দাদুর বেলাতেও ওরা যায়নি। শুধু একটা কথা মনে আছে। দাদু যখন মারা গেলেন, বাবা কোলকাতায় যেতে পারেনি। ছোটকাকা মুখাগ্নি করেছিল…

দেবীকে অন্যমনস্ক দেখে রাজা জিজ্ঞেস করল—“তুই কাল প্রিস্টের সঙ্গে কথা বলতে চাস? এত রাতে তো কল করা যাবে না।”

দেবীর হঠাৎ মনে হল যেন অন্য কোনও বাড়িতে এসেছে। এই শোক ওকে গভীরভাবে স্পর্শ করছে না। বাবা মারা গেছে। তার জন্যে শোক করছে অন্য এক মানুষ। মা কোথায় পড়ে আছে। ঠাকুমাও কি জানে তার ছেলে বেঁচে নেই? আজ এ বাড়িতে এত লোক আসছে যাচ্ছে, তাদের কাউকে দেবী চেনে না। মেহরীন আন্টি, সোহেল অন্য সমাজের মানুষ। এই প্রথম দেবী উপলব্ধি করল এদেশে ওদের কেউ নেই। শুধু বাবা ছিল নিজের লোক।

দেবী মাথা নাড়ল—“না, আমি ঠাকুমার কথা ভাবছি।  মা, পাপু কেউ তো জানে না। কলকাতায় ফোন করা দরকার।”

সোহেল সামান্য ইতস্তভাবে ওদের বোঝাতে চাইল হাতে আর বেশি সময় নেই। ভোরবেলার মধ্যে ওদের তৈরি হয়ে নিতে হবে। দেবী যদি ওর স্কুলের পুরনো বন্ধুদের খবরটা জানাতে চায়। এখন মেসেজ রাখতে পারে। সকাল ন’টা থেকে দশটার মধ্যে ভিউইং। প্রিস্ট রাজাকে পাঞ্জাবি পায়জামা পরতে বলেছে। দেবী যেন সময়মতো গুছিয়ে রাখে। ইচ্ছে হলে দেবীও ওর বাবার কাজ করতে পারে। 

সোহেল চলে যাওয়ার পর রাজা বলল—“সোহেলভাই কাল মিডনাইটে হসপিট্যালে চলে এসেছিল। তারপর থেকে সব অ্যারেঞ্জ করে যাচ্ছে। তোকে আনতে লং আয়ল্যান্ডে গেল। বাবার জন্যে আমরা কিছুই করলাম না।”

দেবী সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল—“সোহেল খুব কমপ্যাশনেট। স্টেপ-সন হিসেবে অনেক বেশিই করছে। রাজা, তোর কাজটা কিন্তু আরও কঠিন। কাল ক্রিমেটোরিয়ামে যাওয়ার আগে মাকে আমিই ফোন করবো রে…।”

বাকি রাতটুকু দেবীর জেগেই কেটে গেল। রাজা একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে দেবী ওকে ডেকে দিতে খানিক ঝিম মেরে বসে থাকল। দেবী তাড়া দিল—“দেরি করিস না। চান করে রেডি হতে হবে।”

রাজা বলল—“বাবা আরও জোরে ডাকত। হি ওয়াজ লাউডার দ্যান ইউ। নয়তো রোজ স্কুলবাস মিস্ করে যেতাম। নাউ হু ইজ গোইং টু ওয়েক মী আপ্?”

দেবী ভাবছিল সবাই মেহরীন আন্টিকে ঘিরে আছে। সান্ত্বনা দিচ্ছে। রাজা যে কি হারালো, সে শুধু ওই জানে। সেই অনিশ্চয়তার কথা দেবীর ভাবতেও ভয় হচ্ছে। 

মাস তিনেক পরে মেহরীন দেবীকে ডেকে পাঠালো। সেদিন রবিবার। মেহরীন সকালের দিকে রাজাকে জ্যাকসন হাইটস্-এর দোকানে পাঠিয়ে দিয়েছে। ফারুক পুরনো লোক। দু’জনে মিলে বিকেল পর্যন্ত চালিয়ে নেবে। দেবী কুইনস্-এর বাড়িতে আসার পর ওকে লাঞ্চ খেতে দিয়ে মেহরীন জিজ্ঞেস করল—“তোমার গ্র্যাজুয়েশনের কি দুই বছর বাকি আছে?”

দেবী প্রশ্নের কারণটা বোঝার চেষ্টা করছিল। আজকাল এরকম হচ্ছে। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে ভয়, সন্দেহ জাগছে। মেহরীন আন্টি কেন হঠাৎ পড়াশোনার খবর নিচ্ছে?

দেবী উত্তর দিল—“হ্যাঁ, এই সেপ্টেম্বরে জুনিয়র ইয়ার শুরু হবে। তারপর সিনিয়র ইয়ার। তখন তো রাজাও কলেজে চলে যাবে।”

—“আমি খুব চিন্তায় পড়ছি দেবী। এত খরচ দেওয়া তো সম্ভব নয়। সেই পরামর্শ করতেই তোমারে আসতে বললাম।” দেবী ভয়ে ভয়ে বলল—“আমি নিজের কলেজ লোন, পাশ করার পর চাকরি পেয়ে শোধ করে দিতে পারব। শুধু আমার ডর্মে থাকার খরচটা বাবা পে করতেন।”

—“সেইটা তেমন সমস্যা নয়। দুইটা বছর টানতে পারব। কিন্তু রাজার জন্য চার বছর কলেজ টিউশন ফি দেওয়া কি সহজ কথা? তোমার বাবা তার জন্য একটা ফান্ড করছিলেন। সেও অ্যামাউন্ট হিসাবে বেশি নয়।”

দেবী ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছিল না। মেহরীন আন্টি কি বলতে চাইছেন? রাজার পড়াশোনা বন্ধ করে দেবেন? হাইস্কুল ডিপ্লোমা নিয়ে কি করবে রাজা? ওঁর দোকানে গিয়ে বসবে? কেন? বাবা মারা যাওয়ার পর মেহরীন আন্টি ওঁর লাইফ ইন্সিওরেন্সের পেমেন্ট পাননি? বাবার অফিস থেকে কিছু পাননি? বাবার নিজের সেভিংস ছিল না? এই বাড়িটারও অর্ধেক অংশ তো বাবার। ওরা তো সেসব কিছু দাবি করছে না। মেহরীন আন্টি যেন ওকে দয়া দেখাচ্ছেন। শুধু দেবীর দুটো বছরের ডর্মের খরচ কোনওমতে চালিয়ে দেবেন। অথচ রাজার জন্যে বাবার রেখে যাওয়া টাকাকড়ি কিছুই দেবেন না? দেবীর মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছিল। আর কত অবিচার সহ্য করা যায়? কেন ওরা বারবার বঞ্চিত হবে? ছোটবেলা থেকে অভাব, অনটন দেখে আসছে। তার জন্যে দায়ী তো এই মহিলা! 

এত উত্তেজনার মধ্যেও দেবী বুঝতে পারছিল ওর মেজাজ হারালে চলবে না। রাজাকে এখনও এই বাড়িতে থেকে হাইস্কুল পাশ করতে হবে। দেবীর কলেজ শেষ হয়নি। এ অবস্থায় ওঁর কথার প্রতিবাদ করতে সাহস হয় না। ওদিকে বাবা মারা যাওয়ার পর কোলকাতার বাড়ির খরচ পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। তবে প্রোমোটারের কাছ থেকে ঠাকুমা দু’লক্ষ টাকা পেয়েছেন। ওদের আপাতত সেটাই ভরসা। নানা চিন্তায় দেবী দিশাহারা হয়ে পড়ছে। একবার সোহেলের সঙ্গে কথা বলে দেখবে? কিন্তু ও যদি নিজের মাকেই সাপোর্ট করে; তবে দেবী আর কার ওপর ভরসা করবে?

কলেজ ক্যাম্পাসে ফিরে দেবী ওর রুমমেট ক্রিস্টিনার সঙ্গে এ-নিয়ে আলোচনা করল। ক্রিস্টিনার বাবা ল-ইয়ার। ও হয়তো কোনও বুদ্ধি দিতে পারবে। ক্রিস্টিনা বলল—“তোমার বাবার উইল না থাকলে তোমার স্টেপ-মাদারই কিন্তু সব কিছু পাবেন। তুমি লিগ্যাল স্টেপ নিতে পারো। তবে তার জন্যে ল-ইয়ার দরকার। ইউ মে হায়ার সামওয়ান হু উইল গিভ ইউ প্রপার অ্যাডভাইস।”

sadness
ভালোবাসা, ঈর্ষা, যন্ত্রণার আগুনে দেবীর দেহ-মন পুড়ে যাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত সোহেলকেই দেবী নিজেদের সমস্যার কথা ফোনে জানাল। আর তখনই জানল বাবা উইল করে যায়নি। তবে রাজার কলেজের জন্যে আলাদা সেভিংস রেখে গেছে। বাড়িটাও জয়েন্ট প্রপার্টি। দেবী যেন ওর মাকে ভুল না বোঝে। ইন্সিওরেন্সের চেক্ থেকে দেবী আর রাজা যাতে কিছু অংশ পায়, সোহেল ওর মাকে সে কথা বোঝাবে। দেবী মন দিয়ে পড়াশোনা শেষ করুক। এখনই এত চিন্তার কিছু নেই। 

দেবী হঠাৎ ফোনে বলল—“সোহেল, আমাদের আজকাল দেখাই হয় না। কতদিন দেশে যেতে পারিনি। মাঝে মাঝে এত ডিপ্রেসড লাগে।”

—“ডোন্ট গেট সো আপসেট! এভরিথিং উড বি ফাইন। দেখা নিশ্চয়ই হবে। আমি কল করব।”

কলেজের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একদিন শনিবার দুপুরে দেবী জ্যাকসন হাইটস্-এ গেল। অনেকদিন ওদিকে যাওয়া হয়নি। মেহরীন আন্টির সঙ্গে দোকানে দেখা করে নেবে। ‘সাকিনাস্ রেস্টোরেন্ট’ নামে একটা প্লে দেখার ইচ্ছে আছে। সোহেল টিকিট পেলে দেবীকে জানাবে। 

‘কবুতর হালাল মীট, গ্রোসারী অ্যান্ড ভিডিও কর্নারে’ মেহরীনকে পাওয়া গেল না। রাজা আর ফারুক দোকান সামলাচ্ছে। মেহরীন আন্টি গেলেন কোথায়? দোকানে ফারুক ভিডিও স্ক্রিনে ‘হারানো সুর’ চালিয়ে দিয়েছে। ছবিটা পুরনো, দেবী আগে দেখেছে। দেবী রাজাকে জিজ্ঞেস করল—“কি রে? আমি কতক্ষণ ওয়েট করব? আমাকে তো নিজেই আজ আসতে বললেন।”

ফারুক মন্তব্য করল—“উনি জুয়েলারি স্টোরে গেলেন। তুমি গিয়া দ্যাখো না। বোধহয় রাজ জুয়েলস্-এ ঢুকসেন।”

দেবী এখন আন্দাজে কোন্ দোকানে ঢুকবে? রাজা এত ব্যস্ত যে কথা বলার সময় নেই। তারই মধ্যে বলল—“গুড নিউজ শুনেছিস? সোহেলভাই কল করেছিল?”

—“কিসের গুড নিউজ? জানি না তো।”

—“সোহেলভাই এনগেজড। ওর গার্লফ্রেন্ডকে মীট করেছিস? বাবার ফিউনারালে এসেছিল।”

দেবী কি ভুল শুনছে? সোহেল এনগেজড? ওর গার্লফ্রেন্ড আছে? রাজা জানে। অথচ দেবী জানে না! অসম্ভব। সোহেল আজকেও ওকে সন্ধ্যেবেলা ম্যানহ্যাটনে যেতে বলেছে। 

দেবীর কথায় অবিশ্বাস ঝরে পড়ল—“কে ওর গার্লফ্রেন্ড? তুই দেখেছিস?”

রাজা শুনতে পেল না। টিভিতে উত্তমকুমারের সংলাপ চলছে। সুচিত্রা সেনকে বলছেন—“কৌতূহল থাকা ভাল। কিন্তু সীমা ছাড়ানো উচিত নয়।”

তবু দেবী সীমা ছাড়িয়ে গেল—“ফারুকভাই, কথাটা সত্যি? সোহেল এনগেজড হয়েছে?”

—“গতকালই অ্যানগেজড হইসে। নাসিমাকে হীরার আংটি দিসে।”

ভালোবাসা, ঈর্ষা, যন্ত্রণার আগুনে দেবীর দেহ-মন পুড়ে যাচ্ছে। সোহেল! সোহেল! সাতটা বছর বড় কম সময় নয়। এত কাছাকাছি এলাম, তবু…”

—“নাসিমা! নাসিমা কে ফারুকভাই? আপনি তাকে দেখেছেন?”

—“দেখসি কয়বার। ব্রুকলীনের রহমান সাহেবের মেয়ে। সোহেলের দলে নাটক করে। ফার্মাসী পড়তেসে।”

“হারানো সুর”-এর গান পেছনে ফেলে দেবী জয়কিশনগঞ্জের পথে নেমে এল। বই-এর দোকানের পাশ দিয়ে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলেছে। দূরে কোথাও সুমনের গান বাজছে “তোমাকে চাই, তোমাকে চাই…”

মাথার ভেতর সূক্ষ্ম যন্ত্রণার অনুভূতি। রাজা আজ বলছিল স্কলারশীপ পেয়ে যাব। রাজা আজ বলল, সোহেল ভাই এনগেজড! একদিনে এত আনন্দ, এত কষ্ট দেবী কখনও পায়নি। ব্যাগ খুলে সেলফোনের সুইচ অফ করে রাখল। সোহেল ডাকলেও সাড়া পাবে না।

সমাপ্ত (কলামের পরবর্তী কিস্তি প্রকাশ পাবে ১২ এপ্রিল।

ছবি সৌজন্য: Pixabay

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Picture of আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
Picture of আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

আলোলিকা মুখোপাধ্যায়

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com