লেকের পাড়ে লজের বারান্দায় বসে সেই সন্ধ্যা খুব ভালো কাটল। আমরা বছরের যে সময়ে গেছি, সেই সময়ে, অর্থাৎ বর্ষাকালে জঙ্গলের কোর এরিয়া বন্ধ থাকে। আমরা শুধু বাফার জ়োনে ঘুরতে পারব। যেহেতু সেখানে বাঘের দেখা পাওয়া দুষ্কর, তাই এ সময় জঙ্গল ফাঁকা থাকে। আমরা বিকেলের সাফারি নিয়েছিলাম। সময়মতো খোলা জিপে উঠে রওনা হলাম, সঙ্গে একজন বনরক্ষী।
গেট পেরিয়ে জঙ্গল। জিপ ছাড়া যাওয়া যায় না। মাটিতে টাটকা থাবার দাগ, কিন্তু বাঘবাবু দেখা দিলেন না। পর্ণমোচী অরণ্যের নানারকম গাছপালা, তাদের বুনো গন্ধে চারপাশ ম-ম করছে। দিনের বেলায় ঝিঁঝিঁর ডাক। জঙ্গলের নেশায় আমি বুঁদ হয়ে ছিলাম, কিন্তু মাসিদের ভারী ইচ্ছে বাঘ দেখবে। নানা প্রজাতির হরিণ ও ময়ূর ছাড়া এদিকে কিছুই চোখে পড়ছে না। মাঝে একটা জাল দিয়ে ঘেরা বড় জায়গায় জিপ এসে থামল। কয়েকটি হরিণ শিশু অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এল। গার্ড বললেন এগুলো মা-হারা কৃষ্ণসার হরিণ। বড় হলে এদের রং পাল্টাবে।
ফেরার পথে, সূর্য তখন ডোবে ডোবে, একদল বাইসনের সঙ্গে আচমকা দেখা। তারা আমাদের সামনে দিয়ে রাস্তা পেরচ্ছে। ড্রাইভার আগেই বলেছিলেন টুঁ শব্দটি করবেন না, বাঘের থেকেও বাইসন বেশি ভয়ঙ্কর। ক্ষেপে গেলে গুঁতিয়ে গাড়ি উল্টে দেবে। অনেকক্ষণ চুপচাপ ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওদের একজন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। তারপর তারা যখন এগোতে লাগলো, আমরা গাড়ি পিছিয়ে পিঠটান দিলাম।

আকাশের আলো তখন নিবেছে, দুটো একটা করে তারা ফুটছে। জঙ্গলের মধ্যে একটু পরিষ্কার এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে আলো নিভিয়ে আমরা বসে রইলাম। পোড়া ডিজেলের গন্ধ যেই না সরে গেল, জঙ্গল তার বুনোফুলের গন্ধে বুক ভরিয়ে দিল। ক্রমাগত ঝিঁঝিঁর শব্দ আর মাঝে মাঝে বন্যপ্রাণির ডাক গভীর নৈঃশব্দ্যকেই যেন আরও প্রকট করে তুলছে। ঠান্ডা হাওয়া, অন্ধকারে জোনাকির আলো, চোখ তুললে তারাভরা আকাশ। এমন করে কখনও প্রকৃতির মাঝে দাঁড়াইনি। এমন সুন্দর জায়গায় আর কখনও যাব কিনা জানি না।
আমার মাসিরা দেখলুম তখন একটু ভয় পেয়েছেন এই ভেবে, যে আমাদের চালক নির্ঘাত পথ হারিয়েছে। ফেরবার পথে আর একটি জিপ উল্টোদিক থেকে আসতে দেখলুম। তারা জানাল একটি নতুন বাঘিনী নাকি হারিয়ে গেছে! এত বড় জঙ্গলে হারিয়ে গেল বাঘিনী! এবার কী হবে!! অন্য জায়গা থেকে বাঘিনীকে এখানে আনা হয়েছিল, কোনওভাবে ট্র্যাকারটা খুলে গেছে। তাকে খুঁজে পেতেই হবে। শুনেই তো মাসিরা বলতে লাগল বাড়ি যাব। ওঁরা তো ভেবেই ফেলেছিলেন যে আমরা সারারাত ধরে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ঘুরব! হোটেলে ফিরে শান্তি এবং জমিয়ে নৈশভোজ।
পরদিন সকালে খেয়ে দেয়ে লম্বা সফর। গন্তব্য সাঁচি। সাঁচিতে মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের ‘রং’ হোটেলে ছিলাম একরাত। কাছেই সেই বিখ্যাত বৌদ্ধ স্তূপ, সম্রাট অশোক যেটি তৈরি করিয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে, বৌদ্ধ ধর্ম সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য। বিরাট জায়গা জুড়ে স্তূপ এলাকা। প্রধান স্তূপটি পাথরের তৈরি, আকারে একটি ওল্টানো ভিক্ষাপাত্রের মতো। এটিকে বলা যায় সমাধিসৌধ। বলা হয় বুদ্ধদেবের চুল, দাঁত ও হাড় এটির ভিতরে রাখা আছে। ভেতরে ফাঁক নেই, তাই ঢোকার উপায় নেই। মাথার উপর ছত্র, সর্বোচ্চ সম্মান নির্দেশ করে। একটি অশোকস্তম্ভ দক্ষিণ দিকে ছিল, কিন্তু সেটি ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে, এবং সংগ্রহশালায় সযত্নে রক্ষিত আছে। স্তম্ভের টুকরো বাইরেও রাখা আছে।

প্রধান স্তূপটি ইটের তৈরি। পরবর্তীকালে শুঙ্গ বংশোদ্ভূত রাজা অগ্নিমিত্র পাথরের আস্তরণে তার কলেবর বৃদ্ধি করেন। সেই সময় স্তূপ ঘিরে একটি ‘balustrade’, স্তূপের গায়ে ঘেরা বারান্দা ও বারান্দায় ওঠার সিঁড়ি। এরপর খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে সাতবাহন রাজারা স্তূপের চারদিকে চারটি তোরণ নির্মাণ করেন। সাঁচির প্রধান স্তূপের ছবিটি ভারতীয় দু’শো টাকার নোটের একপাশে মুদ্রিত আছে। বৌদ্ধদের মধ্যে হীনযানীরা নিরাকার বুদ্ধের উপাসক। তাই তোরণের স্তম্ভে খোদাই করা অলংকরণ বুদ্ধের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বোঝায়, বুদ্ধের কোনও মূর্তি দেখা যায় না। একটি তোরণের মাথায় টাকমাথা হাত উপরে তোলা চার ভারবাহকের মূর্তি, কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে। সংসারের ভার বহন করতে হবে, সেটা সবাই সমানভাবে গ্রহণ করতে পারে না, এটাই দেখানো হয়েছে। হাসিমুখ ভারবাহকের প্রতিমূর্তি ‘লাফিং বুদ্ধা’ বলে বিক্রি হয়।

সাঁচি থেকে বিদিশা খুব কাছে। সেখানে মহা উৎসাহে গ্রিক স্থাপত্যের নিদর্শন হেলিওডোরাসের স্তম্ভ দেখতে গেলাম। কিন্তু লোকজন পথের হদিশ বলতেই পারে না। অনেক খুঁজে পাওয়া গেল ছোট্ট একটি রেলিং ঘেরা পার্ক, তার ভেতরে এই স্তম্ভ। পুরাতাত্ত্বিক জিনিসপত্র আর একটু যত্নে সংরক্ষিত হচ্ছে, দেখতে পেলে খুশি হতাম। পুরাতাত্ত্বিক স্থাপত্যের আরও এক নিদর্শন উদয়গিরি গুহা। এখানে অনেকগুলি মূর্তি আছে। দুটি প্যানেল আমার অসাধারণ লেগেছে। একটি বরাহ অবতার, অন্যটি অনন্তশয্যায় শয়ান বিষ্ণু। এখানে একজন গাইড থাকলে ভালো হত।
আমাদের শেষ দিন কাটল ভোপালে। সেখানে একটি খুব সুন্দর হ্রদ আছে, ‘আপার লেক’। তার একপাশে সরকারি হোটেল। বারান্দায় বসে অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। স্বাধীনতা দিবসের ছুটি, অসংখ্য লোকের ভিড় সর্বত্র। এতদিন লোকজন দেখতে পাইনি, শেষদিন দেখলুম মানুষের ঢল। প্রথমে গেলাম ভারতের বৃহত্তম মসজিদ ‘তাজ উল মসজিদ’-এ। আমাদের গাড়িচালক আদিল খুব উৎসাহভরে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল। জানাল, এখানে ওর বিয়ে হয়েছে, ওর বোনেরও বিয়ে হয়েছে। মিতবাক এই ভোপালী মানুষটি তার সুমিষ্ট ব্যবহারে আমাদের সবার মন জয় করে নিয়েছিল।

ভোপাল শহরের উন্নতির জন্য যাঁর অশেষ অবদান, তিনি হলেন ভোপালের রানি বেগম শাহজাহান। মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো, এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তাজ উল মসজিদ তাঁরই সৃষ্টি। মসজিদ দেখেই আদিল হঠাৎ বলল, ‘চলুন, এবার চিড়িয়াখানায় চলুন।’ সেকী কাণ্ড! বেড়াতে এসে চিড়িয়াখানা? তাও বর্ষাকালে? আর যা ভিড়। আদিল সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘না না, গাড়ি থেকে নামতেই হবে না।’ তাই নাকি? চল তো দেখি। আপার লেকের একধারে পাহাড় সমান করা চওড়া রাস্তা, একমুখী ট্র্যাফিক, আর পাহাড়ের কোলে জাল ঘেরা বড় বড় এনক্লোজার, সেখানে বন্যপ্রাণি। গাড়ি থামিয়ে নেমে নেমে দেখে এলাম। এমনিতে চিড়িয়াখানা গেলে বন্যপ্রাণীদের কষ্টে আমার চোখে জল এসে যায়। একে তো আটক হয়ে আছে বিনা দোষে, তার ওপর দর্শকদের চীৎকার আর ছুড়ে দেয়া খাবার, ঢিল-পাটকেলের যন্ত্রণা! এখানে এরা দর্শকদের অত্যাচার থেকে খানিকটা মুক্ত। এমন সুন্দর চিড়িয়াখানা সারা ভারতে আর কোথাও আছে কিনা জানিনা। লেকের পাড়ে বসে রইলাম খানিকক্ষণ। এক জায়গায় লম্বা লম্বা ঘাস। কাছে গিয়ে শুনি খচরমচর শব্দ। একটি শম্বর হরিণ ঘাস খাচ্ছিল, লোক দেখে গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে! তা অতবড়ো শরীর লুকিয়ে রাখা কি যায়? বাচ্চারা ওকে ছুঁতে চায়। গার্ড ভাগ্যিস সবাইকে সরিয়ে দিল! ওখানে একটা মুক্তমঞ্চ আছে, নানা অনুষ্ঠান হতে পারে।
রাতে মার্কেটিং করবো ঠিক করেছিলাম, কিন্তু ছুটিতে সব মার্কেট বন্ধ! মুখ বেজার করে ঠিক করলাম একটু মিষ্টি কিনে নি। আদিল নিয়ে গেল ‘নারবেদা’ নামে একটি দোকানে। অসাধারণ মিষ্টি! মনটা একটু ঠান্ডা হলো।
পরদিন ভোরে চলে যাব এই সুন্দর শহর ছেড়ে। হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট যা দিয়ে দিল তাতে আমাদের সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে। দিল্লি হয়েই ফেরা। এর মধ্যে আমার নঞ্চুমাসি (যিনি মধ্য-আশি) তাঁর ডায়রির পাতা ভরিয়ে ফেলেছেন বেড়ানোর গল্প লিখে। আর আমরা বাকি দু’জন বেড়ানোর গল্প করেই যাচ্ছি অক্লান্তভাবে। কত কিছুই যে না-দেখা রয়ে গেল। ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু তাপস ওখানে থাকে, স্কুল অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড আর্কিটেকচারে প্রফেসর, ওর সঙ্গে দেখা করা হল না, বিস্তর বকুনি খেলাম পরে। আর একবার যেতেই হবে এই মনকাড়া জায়গায়। সব ছবি দেওয়া গেল না, আসলে বেশিটাই তো মনক্যামেরায় বন্দি।
বিশাখা ঘোষ পেশাগত বাঁধনে বাঁধা অর্থনীতির সঙ্গে। কিন্তু মন চায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে, আর অজানা পৃথিবীকে চিনতে। তাতে নিজেকেও তো চেনা হয়। আপনাকে জানাতে তাঁর ভারী কৌতূহল। ছাত্রাবস্থা কেটেছে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁটাকল ক্যাম্পাস আর আইএসআই-তে। এখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্য়ালয়ে অধ্যাপনা করেন। ভালোবাসেন আড্ডা মারতে।
3 Responses
দারুন লাগলো। ভবিষ্যতে তোর আরো লেখা পড়তে পারবো আশা রাখি। এত ভালো সুন্দর লেখার হাত। থামিস না।
ভারি সুন্দর লিখেছিস রে
অসাধারণ! আপনার লেখায় রুচিশীল, শিক্ষিত মননের ছাপ থাকে সব সময়। 🙏🏾