[ছবিগুলো ফুল স্ক্রিনে (Full screen mode) দেখুন]
শোভাবাজার (Sovabazar) রাজবাড়ির দুর্গা পুজোই (Durga Puja) কলকাতায় আয়োজিত প্রথম শারদোৎসব। নবকৃষ্ণ দেবের সূচনা করা এই পুজোয় যোগ দিয়েছিলেন লর্ড ক্লাইভ থেকে লর্ড হেস্টিংসের মতো ব্রিটিশ শাসকরা। এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ থেকে বিদ্যাসাগর, গান্ধীজির মতো ব্যক্তিত্ব।
দুর্গা প্রতিমার কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথে। মায়ের ডানদিকের পায়ে যে বাঁশটি থাকে, সেটিই পুজো করা হয়। তারপর শুরু হয় প্রতিমা গড়ার কাজ। একই পরিবারের শিল্পীরা বংশপরম্পরায় এই রাজবাড়ির প্রতিমা তৈরি করে আসছেন।
দুর্গা নবমীর আগের পক্ষের কৃষ্ণা নবমীতে বোধন বসে। ঠাকুর দালানে বেদি করে দেবীর ঘট স্থাপন করা হয়। সেদিন থেকে পুজোর দিন পর্যন্ত বাড়ির ঠাকুর দালানে চলে চণ্ডীপাঠ, বেদ, রামায়ণ ও মধুসূদন পাঠ। পুজোর কয়েকটাদিন কলকাতা ও বাইরে থেকে বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত প্রণামী নিতে আসেন এই রাজবাড়িতে।
পুজো হয় বৈষ্ণব স্মার্ত মতে। মাকে আবাহন করা হয় কন্যা রূপে। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বিল্ববরণ, আমন্ত্রণ, অধিবাস, ঘট স্থাপন ও দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়৷ দেবী দুর্গাকে সোনার নথ ও সিঁদুর পরানো হয়৷ রাজা নবকৃষ্ণ দেবের পুত্র রাজা রাজকৃষ্ণ দেবের বাড়ির প্রতিমার সামনে সার দিয়ে ঝোলানো হয় ছোট ছোট অভ্র টুকরোর আবরণ। এর ফলে দেবীর মুখ পুরোপুরি ঢাকা পড়ে না, আড়াল থাকে। দুর্গা ঘরের মেয়ে, বাইরের মানুষের দৃষ্টির সামনে ঘরের মেয়ের আব্রু রাখতেই এই ব্যবস্থা। অতীতে আমোদিনীর সঙ্গে বাড়ির মেয়ে বৌরাও থাকতেন চিকের অন্তরালে। চিকের আড়াল থেকেই তাঁদের চোখে ধরা পড়ত বিনোদনের চাকচিক্য।
আগে রাজবাড়ির প্রতিমার জাঁকজমকের সাজ ডাকযোগে বিদেশ থেকে আসত। পুরাতনী ডাকের সাজ আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু দশক। প্রতিমাকে সাজানোর দায়িত্ব এখন কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের উপর। অন্যান্য সাবেক বাড়ির প্রতিমার সাজের তুলনায় শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমার সাজে পার্থক্য অনেক। বাঙালি ঘরানা নয়, বরং মা দুর্গা এবং তাঁর সন্তানসন্ততি এখানে সেজে ওঠেন পশ্চিমী শৈলির ডাকের সাজে। দূর থেকে তো বটেই, কাছে গেলেও চট করে ধরা পড়ে না সূক্ষ্ম পার্থক্য। দুর্গতিনাশিনী এবং তাঁর দুই কন্যার পরনে থাকে রাংতার পোশাক। দেখলে মনে হয় যেন বেনারসীর আবরণ। কার্তিক, গণেশের রণসাজ কাপড়ের তৈরি হলেও রাংতার প্রাধান্য লক্ষণীয়। আগে সিংহের আবরণ ছিল খাঁটি রুপো। বিদেশ থেকে আসা সেই রুপোর পাতে আবৃত হতেন মা দুর্গার বাহন। বিসর্জনের সময় রুপোর আবরণ-সহই গঙ্গায় ফেলা হত সিংহকে।
অতীতে বিশেষত্ব ছিল প্রতিমার অলঙ্কারেও। ধুনোর তৈরি আঠায় একটি একটি করে গাঁথা হত রুপোলি পুঁথি। একে বলা হত ‘বুলনের কাজ’। সেই কাজের গয়না পরানো হত দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে। আজ সেই শিল্পীরাও নেই, সাজ-ও নেই।
সপ্তমীর সকালে রুপোর ছাতা মাথায় নিয়ে কলাবউকে (নবপত্রিকা) বাগবাজারে রাজবাড়ির নিজস্ব ঘাটে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। আগে ফোর্ট থেকে ‘গোরার বাদ্যি’ আসত, থাকত দেশি ঢাকিদের দলও।
অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে একশো আটটি প্রদীপ জ্বেলে সন্ধিপুজো করা হয়৷ সন্ধিপুজোর সূচনা ও সমাপ্তিতে আগে কামান দিয়ে তোপধ্বনি হত। সেই কামান শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাখা রয়েছে৷ তোপের বদলে এখন বন্দুকের শব্দেই সন্ধিপুজোর শুরু ও শেষ হয়। সন্ধিপুজোয় অর্থাৎ অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে মা দুর্গা ত্রিশূল দিয়ে অসুর বধ করেন। অশুভ শক্তির বিনাস ঘটে, জাগ্রত হয় শুভ শক্তি। তোপ ধ্বনির দ্বারা প্রতিধ্বনিত হয় মর্ত্যবাসীর জয়োল্লাস।
শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয় অন্নভোগ হয় না৷ মায়ের ভোগ হিসেবে বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে তৈরি হয় নানা রকমের শুকনো ভোগ, যেমন দরবেশ, মতিচুর, খাজা, গজা, পান্তুয়া, জিলিপি, পেরাকি, নিমকি, ডালের কচুরি, সিঙাড়া, রাধাবল্লভী-র মতো ২০-২৫ রকমের শুকনো মিষ্টি ও নোনতা খাবার।
এই বাড়ির রীতি অনুযায়ী দশমীর দিন সকালেই মায়ের দর্পণ বিসর্জন হয়। প্রতিমার সামনে একটি বড় হাঁড়ি ভর্তি জলের ভিতর মায়ের পায়ের প্রতিবিম্ব দেখে বাড়ির সবাই প্রণাম করেন। সানাইয়ে বিষাদের সুর বেজে ওঠে৷ পিতৃ আলয় ছেড়ে মা দুর্গা শ্বশুরালয় যাত্রা করার আগে সোনার সিঁদুর কৌটো, আতপ চাল, ধান, দূর্বা ও গিনি দিয়ে কনকাঞ্জলি দেওয়া হয় রুপোর থালায়।
আগে বিসর্জনের সময় নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া হত। বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন লাগু হওয়ার পর থেকেই নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে রাজবাড়ির দুর্গাপুজোতে৷ এখন মাটির দু’টো নীলকণ্ঠ পাখি বানিয়ে দশমীর দিনে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে, বিসর্জনের সময় পাখি দু’টোকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস, এই নীলকণ্ঠ পাখিই কৈলাশে মহাদেবকে মায়ের রওনা হওয়ার খবর দেবে৷
বিকেলে খুঁটি ও বাঁশের মাচার উপরে দেবী প্রতিমাকে রেখে কাঁধে চাপিয়ে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয় বাগবাজারে রাজা নবকৃষ্ণের ঘাটে প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য। আগে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা ছিল দেখার মতো। সামনে থাকত ফোর্ট থেকে আসা স্কটিশ বিউগল ব্যান্ড, তার পিছনে পিছনে সারি দিয়ে বাংলা ঢাকিদের দল। পরিবারের সকল সদস্যরা প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হেঁটে যেতেন প্রতিমা বিসর্জনে।
শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনের দৃশ্যটি অভূতপূর্ব। দুটি নৌকার মাঝে প্রতিমা রাখা হয়। মাঝনদীতে পৌঁছে নৌকা দু’টি ধীরে ধীরে সরে গেলে মাতৃমূর্তি জলে বিসর্জিত হয়ে যায়৷ বিসর্জনের এ রীতি আজও অটুট শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোয়।
স্থিরচিত্র সহায়তায় – প্রসেনজিৎ কৃষ্ণ দেব, রায়না ঘোষ, সুদীপ্ত কৃষ্ণ দেব, কৃষ্ণ সুহানা দেব, শুভদীপ কৃষ্ণ দেব, তীর্থঙ্কর কৃষ্ণ দেব
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।