যখন ছোট ছিলাম, ক্যামেরায় ছবির দুনিয়া ছিল নেহাতই সাদা-কালো | আর অ্যালবাম বলতে জানতাম মোটা মোটা কালো কাগজে ফটো-কর্নার দিয়ে লাগানো সেইসব ছবির বাহার | সাবধানে ট্রেসিং কাগজের পরত উলটে ছবি দেখার নেশায় আচ্ছন্ন থাকতাম অনেক দুপুর | আমার সবচেয়ে মনের মতো ছিল আলিপুর চিড়িয়াখানায় তোলা একটা ছবি | তাতে যদিও আমাকে সামনে থেকে দেখা যাচ্ছে না, পাশ-ফেরা মুখ ; কিন্তু আমি জানি, সেই সাদা-কালো ছাপিয়ে সেদিন আমি পুরোহাতা লাল সোয়েটার পরেছিলাম, চাইনিজ-ছাঁট ববচুলে লাল ক্লিপ ছিল আর আমার একহাতে ছিল দার্জিলিঙের ফিনফিনে খোসার মিঠে কমলালেবু আর অন্যহাতে চিনেবাদাম ভরা খবরের কাগজের ঠোঙা | আমার পিঠে উপুড় হয়ে শুয়েছিল শীতের রোদ্দুর |
কলকাতায় শীতকাল মানেই চিড়িয়াখানা, সাদা বাঘের ছানা দেখার রোমাঞ্চ, হাতির শুঁড়ে জলের ফোয়ারা দেখার মজা | আর কী ? খাওয়াদাওয়া | শীত মানেই চড়ুইভাতি বা পিকনিক | আমরা যখন বেতের বাস্কেটে লুচি, ফুলকপি ভাজা, আলুর দম, ডিমসেদ্ধ, কমলালেবু, চালকুমড়োর মিঠাই আর কিসমিস দেওয়া বাপুজি কেক, নলেন গুড়ের নরম পাকের সন্দেশ আর ফ্লাস্কভর্তি চা বা কফি নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে শীতের রবিবারের সকালে বাস ঠেঙিয়ে বা বড়জোর সর্দারজির হলদে-কালো ট্যাক্সি চড়ে জানলা দিয়ে কলকাতার ধোঁয়াটে রাজপথ দেখতে দেখতে চিড়িয়াখানায় কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেতাম, সেটা ছিল পিকনিক| আর যখন দলবেঁধে লজঝড়ে বাসভাড়া করে হাঁড়িকুঁড়ি-ডেকচি-কড়াই-হাতা-খুন্তি-জলের জগ-থালা-গ্লাস আর ব্যাগবোঝাই কাঁচা বাজার নিয়ে বেসুরো গান গাইতে গাইতে, অকারণে হা হা হি হি করতে করতে শহর কলকাতা পেরিয়ে কাকভোরে চলে যেতাম একটু দূরে কোথাও, সেটা ছিল চড়ুইভাতি | সেখানে প্রচুর সবুজ, খোলা আকাশ, বাথরুমের অসুবিধে, রান্না হতে যেমন দেরি…খাওয়াদাওয়া হতেও ততটাই বেলা গড়িয়ে যাওয়া যেমন ছিল; ঠিক তেমনই ছিল প্রজাপতির মতো ডানা মেলার সুখ! কোথায়? রংবেরঙের গরম জামায়, ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড়ের চুমুকে আর কাগজের প্লেটে খাবলা খাবলা মাখন আর লাল স্ট্রবেরি জ্যাম মাখানো পাউরুটি, নিখুঁত করে খোসা না-ছাড়ানো ডিমসেদ্ধ, সবজেটে হলুদ সিঙ্গাপুরি কলা আর একটা করে ধবধবে সাদা রসগোল্লা ব্যালেন্স করায়|
যতক্ষণ ধরে দুপুরের রান্না হত, শতরঞ্চি পেতে কেউ কেউ তাস পিটত, কেউ বা ব্যাডমিন্টন র্যাকেটের ধাক্কায় শাটল কক উড়িয়ে দিত অনেক দূরে আর কেউ কেউ অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ত আশপাশে | দুপুরের মেন্যু বলতে থালায় পরিবেশন করা হত ধবধবে সাদা জুঁইফুলের মতো ভাত, ফুলকপি-কড়াইশুঁটি দেওয়া সোনামুগের ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা, বড় বড় আলুর খণ্ড দেওয়া কচি পাঁঠার ঝোল, কিসমিস দেওয়া ঘন টম্যাটোর চাটনি আর ক্ষীরের গুঁড়ো ছড়ানো ইয়াব্বড় বড় চমচম | হুশহাশ শব্দ করতে করতে খাওয়া, মাটিতে বসে খেতে খেতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে যাওয়া আর খেয়ে উঠে কুলকুচি করে জলটা যখন মাটিতে পড়ত, তখন তাতে রোদ্দুর লেগে ফিকে রামধনু-আলো | আর বিকেলে ? অত বেলা করে খেয়ে এমন গা ঢিসঢিস অবস্থা যে পরপর অন্তত দু-ভাঁড় চা চাই, সঙ্গে প্রজাপতি বিস্কুট আর কালোজিরে-জোয়ান দেওয়া একজোড়া খাস্তা নিমকি | তারপর তো সব গুছিয়েগাছিয়ে বাড়িমুখো হওয়া | ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আর ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখতে দেখতে … ‘আসছে বছর আবার হবে !’
আর একটু বড় হলাম যখন, নিজেরাই শীতকাল পড়লে ছাদে দল বেঁধে গুলতানির প্ল্যান করতাম | সেটা আবার অন্যরকম পিকনিক | ছাদে একটা ছোটো ঘরে কেরোসিনের স্টোভে আনাড়ি হাতের রান্নাবান্না | ঘ্যানঘ্যান করে বাড়ি থেকে ধার করে আনা বাসনে আর প্রায় ভিখিরিমার্কা বাজেটে ফিক্সড মেন্যু প্রতি বছর | ভাত, মাংসের ঝোল, চাটনি আর মাথাপিছু গুনে গুনে একটা করে রসগোল্লাও | মূলত আমরা সাতটি মেয়ে আর সঙ্গে কিছু নাছোড়বান্দা কুচোকাচা | আমরা এই ছানাপোনাদের খুব ভালোবেসে যে দলে নিতাম, তা মোটেই নয় | ওদের নেওয়ার স্বপক্ষে একটাই যুক্তি | খোরাকি কম, চাঁদা সমান সমান | তাতেও প্রতিবার টাকা কম পড়ে যেত, হিসেব মিলত না | এমনই হাভাতে অবস্থা ছিল আমাদের, যে মশলাপাতি, তেল, চাটনির টম্যাটো, চিনি, আলু …সব নিজেদের বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে আনা, এমনকি চাল পর্যন্ত ওইদিন মাধুকরীতে মেলা ! চালেরও তাই সাড়ে বত্রিশভাজা মার্কা চেহারা আর তেমনই হতচ্ছাড়া স্বভাব ! কোনোটা গলে পাঁক হয়ে গেছে, কোনোটা আবার ঘাড় উঁচু করে হাঁড়ির ভেতর থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে ! শুধু পাঁঠার মাংসটা আসত বাজার থেকে | যে যার বাড়ি থেকে থালা-গ্লাস পর্যন্ত নিয়ে আসত বগলদাবা করে | সে থালায় ভাত বাড়তে বাড়তে দুপুরের রোদ্দুর মরে আসত | মাংসের ঝোলে মিশে যেত চাটনি আর রসগোল্লার রস | আধসেদ্ধ মাংস চিবোতে চিবোতে আর নুন-ঝালের আন্দাজ না পাওয়া ঝোলে ভিজে ওঠা আঙুল চাটতে চাটতে আমরা নিজেদের রন্ধনপটুত্বে নিজেরাই চমৎকৃত হতাম ! স্কুলে পিকনিক টিকনিকের বালাই ছিল না | আমার সে মিশনারি স্কুলের শাসন ছিল প্রবাদপ্রতিম | কেন পিকনিক হয় না ; সে ভাবনা মনে বাসাও বাঁধেনি কখনও | পরবর্তীকালে স্নাতকস্তরে থাকাকালীন ডিপার্টমেন্টে একবার পিকনিক হয়েছিল বটে, আমি যাইনি | কলেজজীবনের পিকনিকের স্বাদ প্রথম পেলাম স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হয়ে | এখানে প্রতি বছর নিয়ম করে পিকনিক | প্রতি পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণ পুজোর মতোই নিষ্ঠাভরে পুজো, থুড়ি আনন্দোৎসব | কলকাতার বাইরে এদিক সেদিক যেতাম আমরা | ট্রেনে করে | সারা ডিপার্টমেন্ট অংশ নিত | ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলেই অপেক্ষা করে থাকতাম পিকনিকের জন্য |
লোকাল ট্রেনে হাওয়া খেতে খেতে আর তুমুল হুল্লোড় করতে করতে যাওয়া | চাঁদা যা নেওয়া হত, এমন কিছু বেশি নয় | জলখাবারে লুচি-তরকারি-মিষ্টি-চা, দুপুরে ভাত, ডাল, বেগুনী বা আলুভাজা, পাঁঠার মাংস, চাটনি, রসগোল্লা | তারপর সব গুটিয়ে বিকেলে চা খেয়ে শেষ বিকেলে ট্রেন ধরা | কলকাতা থেকে মোটামুটি এক ঘন্টা দেড় ঘন্টার রাস্তায় কোনো বাগান-জাতীয় জায়গা বেছে নেওয়া হত | অনেক ছেলেমেয়েই তো আসত কলকাতার বাইরে থেকে, তারাই সন্ধান দিত পিকনিক স্পটের | আমাদের শুধু চাহিদা ছিল খোলা মাঠের আর নীল আকাশের | তবে বেলা যত বাড়ত, তত মনে হত…খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে কাছাকাছি পরিষ্কার বাথরুম আছে কিনা | এমনও হয়েছে, ছেলেদের হুঁশই হয়নি যে বাগানের ধারেকাছে বাথরুম নেই, মেয়েগুলো কী করবে| এমনও হয়েছে যে শেষে প্রাণের দায়ে হেঁটে বা রিকশা নিয়ে কাছেপিঠে চেনাশোনা কারুর বাড়িতে যেতে হয়েছে বাথরুমের খোঁজে|
পিকনিক মানেই ছিল তাসের আড্ডা, অন্ত্যাক্ষরী, গানের আসর…কোরাস বা সোলো, মিমিক্রি এবং নির্ভেজাল হ্যা হ্যা হি হি | প্রেমিক প্রেমিকারা যদিও আড়াল খুঁজত একটু, কিন্তু বন্ধুদের নজর এড়িয়ে সে সাধ্য ছিলই না ! ব্যাডমিন্টন খেলার সরঞ্জাম, ফুটবলও যেত | সত্যি বলতে কী, আমরা সকলকে নেমন্তন্ন করলেও মনে মনে চাইতাম যেন এমন মাস্টারমশাইরা যান, যাঁদের সামনে তটস্থ হয়ে থাকতে হয় না | আরে, ছেলেগুলো তো বিড়ি-সিগারেটও খাবে ! আমাদের তিন বছরের ফারাক …সকলেই বন্ধু …সেখানে সিনিয়র জুনিয়র বলে তেমন চুলচেরা বিচারের জায়গাই থাকত না পিকনিকের দিনে | কালো বেড়ালের গান প্রায় পিকনিকের থিম সং ছিল |
“কালো বেড়াল কালো বেড়াল …কালো বেড়াল কালো বেড়াল, কে পুষেছে বাড়িতে
সে যে দই খেয়েছে, ভাঁড় ভেঙেছে, মুখ মুছেছে শাড়িতে …”
ষ, স, শ-এর উচ্চারণ কিন্তু পুরো ‘স্যামবাজারের সসীবাবু’-র মতো |
আর বিকেলে ফেরার সময়ে যখন নির্জন প্ল্যাটফর্মে একটা দুটো শুকনো পাতা উড়ত হঠাৎ করে, সামান্য হলদেটে গোলাপি আলোয় … আমাদের মনখারাপ চেপে বসত জগদ্দল পাথরের মতো | বুকের গভীরে | তখন কেউ হয়ত গেয়ে উঠত,
“সাঁঝে ফোটে ঝিঙাফুল, সকালে মলিন গো…”
ট্রেন চলতে শুরু করত, আমরা পা গুটিয়ে বসতাম কামরার ফাটা বেঞ্চে, কখনও বা ছারপোকার ভয়ে পুরোনো খবরের কাগজ বিছিয়ে | মেঝে জুড়ে ছড়ানো জুতো, হয়তো বা কিছু বাসনপত্তর | আমাদের মুখগুলি… সেই যত অগণন সকালের সূর্যমুখী…শেষ বিকেলের সূর্যাস্তের আলোয় বড় মলিন দেখাত | সেই সময়টুকুতে ঝিঙাফুল আর ঝকঝকে হলুদ সূর্যমুখীর কোনো ফারাক থাকত না | বিষাদের ম্লানিমা সবসময়েই বড় ধূসর এবং বিধুর | আর এখন ? এখন যেখানে থাকি, আলাদা করে শীতকাল আসে না সেখানে | ঋতুর তেমন কোনও রকমফের বুঝি না | এখন শীত মানে শুধুই পিছুটান | সে পিছুটানে বুলবুলভাজা হয়ে মিলেমিশে থাকে হারিয়ে যাওয়া একশ’ হাজার জিনিস | নাহুমের প্লাম কেক থেকে ঠাকুমার হাতের দুধ-পুলি, পিকনিক বা চড়ুইভাতির আমোদআহ্লাদ থেকে অদৃশ্য শীতের জাড় লেগে অবশ হয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা স্মৃতি ও বিস্মৃতি | সমস্ত হারিয়ে ফেলা গন্ধ এবং স্পর্শসুখ সারবরাদ্দে এসে আমার অস্তিত্বের দরজায় কড়া নেড়ে চলে যায়…
সন্তর্পণে, সঙ্কোচে, দ্বিধায় |
ইলেকট্রনিক্সের ছাত্রী ঈশানী রায়চৌধুরী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত। নিজস্ব লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে পছন্দ রম্য গদ্য আর ছোট গল্প | আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, ফ্রিডা কাহলো, খলিল জিব্রান, আর কে নারায়ণ প্রমুখ লেখকদের কাজ ভাষান্তর করেছেন। 'কৃষ্ণচূড়া আর পুটুস ফুল', 'আবছা অ্য়ালবাম', 'বাবু-টাবুর মা', ওঁর কয়েকটি প্রকাশিত বই।
2 Responses
ভারী সুন্দর ভাবে পিকনিক বা চড়ুই ভাতির স্মৃতি রোমন্থন করেছো.প্রচ্ছদ সুন্দর এঁকেছে …উপল.
দিদি অসাধারণ,?