সুরেশ:- ভাল হল তো।
ভিকি:- ঘেঁটে ফেলেছি সুরেশভাই। লাইফ পুরে ঘেঁটে ফেলেছি। মাঝরাতে ঘুম থেকে বিছানায় উঠে বসে ভাবি এ কোন অচেনা বিক্রম খান্না আমার ভেতরে এসে থাকল, বাঁচল। একে তো আমি চিনিই না। কে এই লোকটা, বাইরে যার নাম ভিকি খান্না?
(রগ টেপে নিজের)
কি যেন বলে আমায় শালা ইন্ডাস্ট্রি? হ্যাঁ, ‘গাম্বাট ভিকি’ (হাসে) গাম্বাট-শালা। গাম্বাট। আগে তাও তো এক সেকেন্ডে মাথায় আগুন জ্বলে যেত, কোনওরকম হিপোক্রেসি বা মিথ্যাচার দেখলেই। হাত চালিয়ে দিতাম। লোকে বলতে শুরু করল, ‘ওই শালা গাম্বাট আসছে’। এত শুকনো নেশা করেছি একসময়। ছোটবেলা থেকেই। কলেজে ঢুকলাম। পড়া শেষ হল না। রাস্টিকেট করল। শিবকুমার খান্নার ছেলে বলে একটা প্রাইভেট কলেজে ঢুকে পড়লাম। সেখানেও টিঁকতে পারলাম না। চরস তখন আমায় পেয়ে বসেছে। চরস। পিন দিয়ে গোল কালো গুলিতে ফুটিয়ে সিগারেটের তামাকের সঙ্গে হাতে ডলে নিতে হবে। তারপর পাকিয়ে টানো। লাভলি। (থামে। শরাফের দিকে তাকায়) তোর কাছে আছে নাকি রে শরাফ, একপিস বানা না এখন!
শরাফ:- না, ভিকিভাই, এখন নেই আমার কাছে।
ভিকি:- অনেকদিন খাই না। রিহ্যাবে গিয়ে আমাকে ছাড়তে হয়েছিল। মাঝেমাঝে শখে একটা দুটো পাফ খাই এখন। আর আজকের দিনে তো আমার খাওয়াই উচিত, কি তাই না? (হাসে) বিরু ইয়ে লাইফ মে কেয়া হ্যায়? কুছ নেহি। এখন আর আগের মতো মাথাগরম হয় না। আমিও আমার সোসাইটির চাহিদা অনুযায়ী চুপ করে থাকতে শিখে গেছি, শান্ত হতে শিখে গেছি। যে হিপোক্রেসি দেখলে আগে আমার রাগে হাত নিশপিশ করত, এখন সেই হিপোক্রেসি নিজের হাড়েমজ্জায় সেঁটে নিতে শিখে গেছি।
(ভিকি বোতল থেকে অনেকটা মদ ঢেলে খায় একসঙ্গে। জয়দেবের দিকে তাকায়। তারপর সুরেশের দিকে)
ছোটবেলা থেকে শুনে এলাম আমার মা হচ্ছে সুপারস্টার অভয় চোপড়ার বিশেষ বান্ধবী। মা মারা যাওয়ার পর একটা কাগজে এও লেখা হল, মা-র সঙ্গে অভয় চোপড়ার রিলেশন ব্রেক করার পর, মা ডিপ্রেসড হয়ে খালি নেশা করত। আর তখন পিতাজির সঙ্গে মায়ের রিলেশন হয়। এ-ও লেখা হল অভয় চোপড়ার আর মায়ের নাকি একটা সন্তানও ছিল। সে নাকি আমেরিকায় কোথাও বড় হচ্ছে। এরা ভাবেও না লেখার সময় কী লিখছে, কোন সোসাইটিতে বসে লিখছে। যেখানে শুধু গসিপ আর কেচ্ছা বিক্রি হয়।
(মদ খায়)
হলিউডে লিজ টেলর বিয়ে করেছিল আটবার, সোফিয়া লোরেন যখন কার্লো পন্টিকে বিয়ে করেছিল, পন্টির বউয়ের সঙ্গে তখনও অফিসিয়ালি ডিভোর্স হয়নি। অজস্র সম্পর্ক করে, বিয়ে ভেঙে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল ভিভিয়ান লে। তিন তিনটে বিয়ে করার পরেও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি প্রকাশ্যে বলতে পারে সে বাইসেক্সুঁয়াল। বলতে পারে, ‘আমার স্বামী না থাকলে হয়তো আমি মডেল অভিনেত্রী কেনি সিজিজু-কে বিয়ে করতাম’। দু-দুটো বিয়ে করার পরেও জুলিয়া রবার্টস প্রকাশ্যে বলতে পারে লিয়াম নিসন থেকে সাদারল্যান্ড, জেসন প্যাট্রিক থেকে বেঞ্জামিন ব্র্যাট – অন্তত ছটা অ্যাফেয়ার ছিল তার জীবনে। এসবে ওখানে কারুর কিচ্ছু এসে যায় না। সবাই খুশি। টাকা, ফেম আর কাজ শেষ কথা বলে। আর আমাদের এই ঢাকা-চাপা দেওয়া ভন্ড গাঁইয়া সমাজ, আমাদের নিয়ে যা পারে তাই বলে। যা পারে তাই লেখে। সুপারস্টারের সন্তানের কষ্টের মানে বোঝে এরা?
(মদ খায়, হাসে। খানিকটা জান্তব লাগে ভিকিকে)
বুঝলে সুরেশভাই, একবার থাইল্যান্ড আউটডোরে ওই অভয় চোপড়ার মেজ নাতনিটাকে ঠুকে দিয়েছিলাম। সিনেমাটায় ও-ই আমার হিরোইন ছিল। রাতে শুটিং-এর পরে দুজনে মিলে হোটেলের পাবে বসে প্রচুর মদ খেয়েছিলাম। তারপর শালা ওর ঘরে ঢুকে … (হাসে) আমার মনে হচ্ছিল আমি আমার মৃত মাকে নিয়ে সমাজে চলতে থাকা চোরাগোপ্তা স্ক্যান্ডালগুলোর এতদিনে প্রতিশোধ নিলাম। আমি শালা যেন পুরো ওই চোপড়া ফ্যামিলির খানদান, ওদের ঠাটবাট, ওদের ওই কনজারভেটিভ বনেদি হাবভাব – সবকিছুকে ওই রাতে ঠুকে দিলাম। শালা – রয়্যাল ফ্যামিলি! আমি অ্যাকটিং করব, আমি হিরো হব। বাইরে রাঁড় পুষব। আর আমার বউ শালা বাড়িতে আমার এন্ডি-গেন্ডি সামলাবে, তাদের বড় করবে। হারামি শালা। আমি সিওর, থাইল্যান্ডে ওই রাতে ওই ঘরে শালা ওর মাতাল নাতনির গরম শরীর দেখতে দেখতে মৃত অভয় চোপড়ার প্রেতাত্মা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করছিল। (হাসে) কি লাইফ সুরেশভাই! এখন মাঝে মাঝে আমার ছোটবেলার ওই একা ফাঁকা ঘরটা মনে পড়ে। আমি চুপচাপ বসে বসে কাগজে এঁকে যাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি রাতে মা শুটিং থেকে ফিরলে মা-কে আমার আঁকাগুলো দেখাব।
(হাত বাড়িয়ে বোতল নিতে যায় ভিকি। শরাফ সরিয়ে নেয়)
শরাফ:- আর খেও না ভিকিভাই। অনেকটা খেয়েছো। শ্মশানে যেতে হবে তোমায়।
ভিকি:- অ্যাই জ্ঞান দিবি না। দে বোতলটা বলছি।
(শরাফ মাথা নাড়ে। ভিকি ওঠে)
তুই কি ভাবিস? ভিকি খান্নার ওই একটা বোতল? দাঁড়া আমি নিজে যাচ্ছি সেলারে।
(শরাফ অগত্যা বোতল দিয়ে দেয়। ভিকি তার গ্লাসে ঢালে। প্রমোদ আসে। ভিকি তাকায়)
ভিকি:- কি হল? ইস্যু সেটলড হয়েছে? যাব আমি?
প্রমোদ:- না, তবে প্রায় হয়ে এসেছে। আর অল্প ডিসকাশন বাকি আছে।
ভিকি:- বাবা, এ যেন শালা ট্রাম্প-ওবামা বৈঠক চলছে! শেষই হয় না। আপনার কী চাই?
প্রমোদ:- দুটো ওয়াইন বট্ল দিন। ম্যাডামরা খাবেন বলছেন।
(ভিকি জুলজুল করে প্রমোদের দিকে তাকায়। তারপর দুটো ওয়াইনের বোতল সেলার থেকে বার করে, সঙ্গে একটা হুইস্কির বোতল)
ভিকি:- এই নিন। (ওয়াইন বটল দেখায়) এটা ম্যাডামদের জন্য। আর (হুইস্কির বটলটা দেখায়) এটা আপনার আর জিজাজির জন্য। এখন যান। সবকিছু ফাইনাল হয়ে গেলে আমাকে ডাকবেন। আপনি চিন্তা করবেন না। আমার স্ত্রী দিব্যা খুব ভাল উকিল। হয়তো আপনার থেকেও ভাল। ও ঠিক বুঝে নেবে। আসুন।
(প্রমোদ বোতল নিয়ে চলে যায়। ভিকি সুরেশকে একটা চোখ মারে। তারপর নিজের আধখাওয়া বোতল থেকে সরাসরি মুখে ঢেলে খায়। চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সুরেশকে বলে)
ভিকি:- সুরেশভাই, আপনি আছেন বলে এত কথা বলছি। আপনাকে আমি খুব রেসপেক্ট করি। জয়দেব, শরাফ কিছু মনে কোরও না তোমরা।
সুরেশ:- আরে ঠিক আছে ভিকি। এখানে সবাই তোর লোক।
শরাফ:- একশোবার, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো ভিকি ভাই।
জয়দেব:- কি যে এতক্ষণ বলে গেলে ভিকিভাই, আমি তো ভাল করে বুঝলামই না – কী সব বকবক করে গেলে।
ভিকি:- (সুরেশের হাত চেপে ধরে) আরেকটা সত্যি কথা বলব আপনাকে? কিছু মনে করবেন না। শ্মশান নিয়ে আমাদের ফ্যামিলিতে আসলে কোনও ডিসপিউটই নেই। ওরলি। ওটা সকালেই ঠিক হয়ে গেছে। আসলে এতক্ষণ কথা চলছে পিতাজির প্রপার্টি নিয়ে। আমরা কে কী পাব, তাই নিয়ে কাজিয়া চলছে।
সুরেশ:- হুম।
পরবর্তী অংশ প্রকাশিত হবে ১৯ মার্চ ২০২১
জন্ম ১৯৬৯, ২৫ সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর। পূর্বতন প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। পরবর্তীতে সিটি কলেজে অধ্যাপনা। নাটককার, পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্রাভিনেতা, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গীতিকার সম্পাদক। 'কালিন্দী ব্রাত্যজন' নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার ও 'ব্রাত্যজন নাট্যপত্রের' প্রধান সম্পাদক। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের মন্ত্রী। পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি। উল্লেখ্য সত্যেন মিত্র পুরস্কার, শ্যামল সেন স্মৃতি পুরস্কার, দিশারী পুরস্কার, রমাপ্রসাদ বণিক স্মৃতি পুরস্কার, খালেদ চৌধুরী স্মারক সম্মান, অন্য থিয়েটারের শ্রেষ্ঠ নাট্য নির্মাণ সম্মান। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন গজেন্দ্র কুমার মিত্র-সুমথনাথ ঘোষ স্মৃতি সম্মান। তাঁর সম্পাদনায় 'গিরিশ কথা' ও 'শিশির কথা' দু'টি বই তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, প: ব: সরকার কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। পেয়েছেন এবিপি আনন্দ 'সেরা বাঙালি ২০১৯' সম্মান। পেয়েছেন বাংলার নাট্যশিল্প জগতের সর্বোচ্চ সম্মান 'দীনবন্ধু মিত্র পুরস্কার'।