Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ফেলাছড়ার রান্না আর চারুবালা দাসী

গোপা দত্ত ভৌমিক

এপ্রিল ১, ২০২১

Plight of the widows in Bengal
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

ছোটবেলায় বাড়িতে মাঝে মাঝে অতিথি হতেন রিষড়ার দিদিমা- যাঁর নাম শুনতাম চারুবালা দাসী দাসী কেন? বড়রা বলতেন, আমরা কায়স্থ বলে আমাদের ঘরেরা মেয়েরা দেবী হন না, দাসী হন চারুবালা ছিলেন আমার মায়ের জ্ঞাতিসূত্রে পিসিমা। মাথার চুল কদমছাঁট, গায়ে লংক্লথের শেমিজ আর সাদা থান 

চারুবালা এলেই আমাদের একতলার দালানের কোণে একটি উনুন এনে ঝাড়ামোছা করে রাখা হত সেই উনুনে একটু বেলা করে রিষড়ার দিদিমা পেতলের ছোট বোকনোতে ভাত বসাতেন। তাতে কয়েক টুকরো আলু কুমড়ো ফেলে দিতেন। কখনও একটা সাদা ন্যাকড়ার পুঁটুলিতে মুগ বা মটরের ডাল বেশ পড়ন্তবেলায় কালো পাথরের থালায় ওই সেদ্ধ ভাত, সামান্য ঘি বা সর্ষের তেল ছুঁইয়ে খেতেন সঙ্গে থাকতো করকচ লবণ- একটা নারকোলের অর্ধেক মালায় লবণ রাখা হত, ঘটিতে জল খেতে খেতে থালার পাশে উবু হয়ে বসা আমার গালে বেশ কয়েক গরাস তুলে দিতেন কী ভাল যে লাগত তখন!

এখন ভাবলে কিন্তু চোখে জল আসে। চারুবালার দালানের কোণের ওই দীন আয়োজনের মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তঘরের বিধবাদের তখনকার জীবন যেন ফুটে উঠতে দেখি দুপুরে প্রায় নিরূপকরণ ভাত, রাতে খই, দুধ আর একটা কলা- এর বেশি তাঁকে কোনওদিন খেতে দেখিনি সতেরো বছর বয়সের একটি সদ্যকিশোরী সন্তানকোলে বিধবা- বাপের বাড়িতে গ্রাসাচ্ছাদন জুটত। তার বেশি কিছু নয় তাঁর লক্ষীমন্ত মেয়েটিকে মামারা যেমন তেমন করে পাত্রস্থ করেছিলেন রিষড়ায় সেই মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গেই থাকতেন চারুবালা, তাই তিনি আমার রিষড়ার দিদিমা 

widows of Bengal
এমন কালীঘাটের দিদিমা, শ্রীরামপুরের ঠাকুমা, পানাগড়ের পিসিমা কত যে ছিলেন…

এমন কালীঘাটের দিদিমা, শ্রীরামপুরের ঠাকুমা, পানাগড়ের পিসিমা কত যে ছিলেন! এমনকী গোয়ালিয়রের মাসিও জুটে গিয়েছিলেন একজন তাঁর স্বামী খাস বাঙাল হলেও গোয়ালিয়রে চাকরি করতেন এইসব জ্ঞাতিসম্পর্ক আজকাল ছেলেমেয়েদের কাছে অজানা হয়ে গেছে

মাঝে মাঝে মা অভিযোগ করতেন, “কী রোজ সিদ্ধভাত খাও পিসিমা, একদিন তরকারি রাঁধ তো!” পিসিমা একগাল হেসে বলতেন, “নিজের জন্য আর ইচ্ছে করে না রে।” তবে পরদিন অবশ্য দালানে তরকারির ঝুড়ি নিয়ে মায়ের সঙ্গে বসার সময় আলুর খোসা একটু মোটা করে কাটতেন আলাদা বোতলে দিদিমার সর্ষের তেল থাকত। একটু কালোজিরে কাঁচালঙ্কা হলুদ আর আটার গুঁড়ো ছড়িয়ে কী চমৎকার মুচ্‌মুচে আলুর খোসা ভাজা করে ফেলতেন কোথায় লাগে আজকালকার প্যাকেটের পোট্যাটো চিপস্‌! 

widows of Bengal
বাঙালি বিধবাদের পাতে আলুসেদ্ধ ভাত একটু ঘি-তেল কাঁচালঙ্কার বেশি কিছু পড়ত না অধিকাংশ সময়েই

বেশিরভাগ সময়েই খোসার দিকে তাঁর মন থাকত! লাউয়ের খোসার স্বর্গীয় স্বাদের চচ্চড়ি বা কাঁচকলার খোসাবাটা তাঁর পাতেই খেয়েছি বড় হয়ে বুঝতে শিখেছি চারুবালাও ছিলেন পরিবারের খোসার মতো- নিতান্ত বাড়তি ওঁদের খাওয়াদাওয়ার দিকে কারও নজর থাকত না ওঁদের নিরিমিষ রান্নার জন্য আলাদা করে বাজার করাও হত না বাড়ির আমিষ পাকশালার জন্য যেসব শাকসবজি আসত, তার থেকেই বর্জ্য অংশ ওঁরা আলাদা করে রাখতেন এভাবেই ফেলে দেওয়ার বদলে খোসা হয়ে উঠেছিল বাঙালি বিধবাদের নিরিমিষ রান্নার একটি প্রধান উপকরণ

খুব কড়া নিয়মকানুন মানতে হত ওঁদের। যে বাটিতে একবার পিঁয়াজ বা রসুন তুলে রাখা হয়েছে তাতে কোনওভাবেই ওঁদের শাকসবজি রাখা যেত না আমি তখন ইস্কুলে প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়ি এবং পেঁয়াজ, রসুন, আদা এমনকী আলু পর্যন্ত গাছের শেকড়ে জন্মায়, এই জ্ঞানলাভ করেছি। প্রশ্নে প্রশ্নে তাঁকে জ্বালাতন করতাম, ‘ও দিদিমা, পেঁয়াজ-রসুন তো গাছে হয়, তবে আমিষ হবে কেন?’ তাঁর পেটেন্ট উত্তর ছিল, ‘বিধবাদের খেতে নেই সোনা।’

কতকিছু যে এই ‘নেই’-এর তালিকায় ছিল বিশেষ করে মুসুর ডালের কথা মনে পড়ে মা যখন পাঁচফোড়ন, কালোজিরে, রাঁধুনি বা শুধু পেঁয়াজ দিয়ে মুসুর ডাল ফোড়ন দিতেন, রান্নাঘর থেকে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত ঘরে, দালানে, বারান্দায় দিদিমার পাতের কাছে কিন্তু ওই ডাল আনা বারণ ডাল যে একপ্রকার দানাশস্য, তা তখন জেনেছি। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, কেন ওই চমৎকার ডাল দিদিমাকে দেওয়া যাবে না দিদিমা খেতেন মুগ, মটর আর একরকমের ডাল- তার নাম খেসারি বড় হয়ে একটা প্রবন্ধে পড়েছিলাম, রোজ রোজ খেসারির ডাল খেলে নাকি পক্ষাঘাত হয় সত্যি মিথ্যে অবশ্য যাচাই করে দেখিনি।

যে সব বাড়িতে প্রায়ই মাছের মুড়ো দিয়ে সোনামুগের ডাল কিংবা শীতকালে গাজর বিনস মটরশুঁটি দিয়ে মুসুরডাল হত, সেই সব বাড়িতেই বিধবারা আতপচালের ভাতের সঙ্গে দলা পাকানো খেসারির ডাল সেদ্ধ খেতেন তাঁদের পক্ষাঘাত হলে কার আর কী আসে যায়? বিশেষ করে যেসব বিধবাদের ছেলেমেয়ে নেই, অর্থাৎ ‘অবীরা বিধবা’, তাঁদের তো বানের জলে ভেসে যাওয়ার অবস্থা। দু’মুঠো খাওয়া, বছরে দু’জোড়া থান আর দু’তিনটি শেমিজ, দু’টো গামছা আর শীতকালে মোটা একখানা চাদর, নিজেদের কাপড়চোপড় কাচার জন্য গোল বলের মতো বাংলা সাবান, এই ছিল বরাদ্দ 

widows of Bengal
যেসব বিধবাদের ছেলেমেয়ে নেই, অর্থাৎ ‘অবীরা বিধবা’ তাদের তো বানের জলে ভেসে যাওয়ার অবস্থা

এই গোলাকৃতি সাবান আজকাল আর দেখি না। জানি না কী শুদ্ধ বস্তু দিয়ে ওটি প্রস্তুত হত এবং বিধবাদের জন্য কেন নির্দিষ্ট করা হয়েছিল কে-ই বা করেছিলেন তবে যিনিই করে থাকুন তিনি অবশ্যই পুরুষমানুষ এবং কখনও ওই সাবানে কাপড় কাচেননি কারণ বাংলা সাবান আমি নিজে ব্যবহার করে দেখেছি, ঘষাই সার, ফেনা আর হয় না লিখতে লিখতে হঠাৎ মনে পড়ল “অবশ্যই পুরুষমানুষ”- এই বাক্যাংশ নেহাৎ বোকার মতো লিখেছি, কারণ শাস্ত্রীয় নিয়মকানুন তো সর্বদেশে সর্বকালে পুরুষমানুষেরই সৃজন

দিদিমাকে মাঝে মাঝে দেখতাম সোডা দিয়ে বেশ করে তাঁর থান-ধুতি আর শেমিজ ফুটিয়ে নিচ্ছেন ওরই মধ্যে কিন্তু বেশ পরিপাটি থাকতেন চতুর্দিকে শাসন আর নিষেধের তর্জনী তোলা- সেই কাঁটাতারের মধ্যে নিজেদের টিঁকে থাকার পদ্ধতি তো বার করতে হয়েছিল এইসব নোয়া-খোয়ানো, শাঁখা-ভাঙা, সিঁদুর-মোছা অপয়া মেয়েদের! ‘অপয়া’ শব্দটা ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করলাম, কারণ পুজোআচ্চার কাজে হাত লাগানোর অধিকার থাকলেও, বিয়ের কোনও সামগ্রি ছোঁবার অধিকার কোনওকালে ওঁদের দেওয়া হয়নি

এমনকী তাঁদের ছেলেপুলে থাকলেও কোনও সাধের অনুষ্ঠানে কখনো কোনও বিধবাকে আসতে দেখিনি এইসব অনুষ্ঠানে এয়োস্ত্রীদেরই জয়জয়কার এমনকি নিঃসন্তান সধবাও এক্ষেত্রে বর্জনীয় ভাবতে অবাক লাগে এখনও এইসব প্রথা বেশ দাপটের সঙ্গে চলছে

ডালের থেকে ডালপালা ধরে কথা কতদূর চলে এসেছে দেখ! আবার ডালের কথায় ফিরি। বিধবারা কিন্তু তাঁদের প্রাপ্য ডালটুকু দিয়েই ম্যাজিক দেখাতেন মটরডাল বেটে ধনে জিরে লঙ্কা আদাবাটা হলুদ মিশিয়ে চাটুর ওপর কলাপাতায় তেল মাখিয়ে বড়সড় সেঁকা চাপড় তৈরি করে নিতেন তাঁদের হাতে জিরে জিরে করে কোটা চালকুমড়ো বা লাউয়ের সঙ্গে ওই ডালের চাপড় ভেঙে মিশিয়ে অপূর্ব স্বাদের ঘণ্ট তৈরি হত এতে অবশ্য একটু ঘি পড়ত 

curry for widows
মটর ডালের বড়া, বড়ি বা চাপড় দিয়ে লাউ বা লাউশাকের ঘণ্ট ছিল অমৃত

চৈত্র-বৈশাখ মাসে কচি এঁচোড়ের ডালনার মধ্যেও পড়ত মটর ডালের বড়া বাড়ির চালে বা বেড়ায়, মাচায়, লতানো ঝাঁপানো কুমড়ো ডগা কেটে নিলে কে আর দেখতে যাচ্ছে বাঙালির নিরিমিষ ঘরের লাউকুমড়োর কচি ডগার সঙ্গে সিম, বেগুন, আলু, কুমড়োর তরকারি যে খায়নি, সে ঠকেছে মটরডালের বড়ি কিংবা বড়া এতেও পড়ত আর ছিল কচু। এটিও শিকড়জাত, কিন্তু নিষিদ্ধ নয়

সর্ষে নারকোলকোরা দিয়ে কচুবাটাতে যে খানিকটা ঝাঁঝাল সর্ষের তেল পড়বে তা বলাই বাহুল্য ফুলকপি, বাঁধাকপি এইসব দামি তরকারি এঁদের আমি ক্বচিৎ খেতে দেখেছি টোমাটো তো বিলিতি বেগুন বলেই নিষিদ্ধ ছিল তবে আখিগুড় দিয়ে জলপাই, কাঁচা আমের টক বা তেঁতুলের হাত-অম্বল মাঝে মাঝে রেঁধে কালো পাথরের খোরায় ঢালতেন বোধহয় ভাতেভাত খেয়ে অরুচি ধরে গেলে ওইসব টক বা উচ্ছে, করলা খেয়ে মুখ ছাড়াতেন

কেন জানি না মনে হয় বাঙালি বিধবাদের এই আশ্চর্য নিরিমিষ রান্না- অতি সামান্য তেল মশলায়, হাতের জাদুতে তৈরি সব ব্যাঞ্জন একটি নিরুচ্চার বিদ্রোহ‘তোমরা আমা্দের জন্য সব বারণ করে দিয়েছ! কুছ পরোয়া নেই, দ্যাখো, সামান্য যা খুদকুঁড়ো পাচ্ছি তা দিয়েই আমরা অমৃত বানাব

সেসব পদের রান্নাশেষে নিজেদের জন্য সামান্য রেখে বাকিটা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ও ভাগ্যবতী এয়োস্ত্রীদের জন্য আঁশঘরের কাঁসার জামবাটিতে পাঠিয়ে দিতেও কক্ষণও ভুল হত না তাঁদের কী জানি, যেটুকু পাচ্ছেন তাও যদি বন্ধ হয়ে যায়! নাহ! ঠাট্টা করলাম আসলে হয়তো ওঁরা স্নেহভরেই পাঠাতেন 

 

*ছবি সৌজন্য: Scoopypost, Wikipedia, Youtube

চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

Picture of গোপা দত্ত ভৌমিক

গোপা দত্ত ভৌমিক

চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
Picture of গোপা দত্ত ভৌমিক

গোপা দত্ত ভৌমিক

চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস