Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কবিতার সঙ্গে বসবাস- বর্ণালী কোলের কবিতা

জয় গোস্বামী

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২

Abstration in poetry
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

কবিতার সঙ্গে বসবাস – কবিতাসত্য, কবিতাচিন্তা
কবিতার সঙ্গে বসবাস – জয়দীপ রাউতের কবিতা- ১
কবিতার সঙ্গে বসবাস – জয়দীপ রাউতের কবিতা – শেষ পর্ব
কবিতার সঙ্গে বসবাস – লিটল ম্যাগাজিন থেকে

আগের পর্বে যাঁর কবিতা নিয়ে কথা বলেছিলাম, তাঁর কবিতা আমি পেয়েছিলাম লিটল ম্যাগাজিন থেকে। কোনও কাব্যগ্রন্থ পাইনি তুষার বিশ্বাসের। এইজন্যই লিটল ম্যাগাজিন খুঁজে দেখি এবং লাভবানও হই। সে প্রমাণ আপনাদের কাছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আবারও করব। তবে এবার একটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কথা বলব। 

পাঠক, আমি প্রথমেই আশ্চর্য হয়ে গেছি কবিতাগ্রন্থটির নামকরণ দেখে। একটি কবিতার বই কোথা থেকে আরম্ভ হয়? যেহেতু প্রথমেই তার নাম চোখে পড়ে পাঠকের, তাই মলাট থেকেই শুরু হয়ে যায় কবিতার বইটির মধ্যে প্রবেশ করার পথ। যদিও শ্রেষ্ঠ কবিতা বা নির্বাচিত কবিতা ধরনের নামগুলির ক্ষেত্রে এমন উপায় থাকে না। ধরা যাক, নব্বই দশকের প্রতিষ্ঠিত কবি সুমন গুণ তাঁর একটি কবিতার বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘বান্ধবনগরে বাড়ি’। মলাটে নামটি দেখামাত্রই পাঠক বুঝতে পারেন এই কবি এমন অঞ্চলে বাস করতে চান যে-নগরে সবাই বন্ধু। সকল বান্ধব মিলে তৈরি করেছে এক পল্লী। সেখানেই এই কবির প্রার্থিত বাড়িটি অবস্থান করছে। কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম থেকেই এক্ষেত্রে আমাদের মন ভরে উঠল।

তেমনই এখন যে কাব্যগ্রন্থটির মধ্যে প্রবেশ করব সেই বইয়ের নাম: ‘আকাশ আজ রামকিঙ্কর’। কবির নাম–  বর্ণালী কোলে। এই নামকরণ প্রথমেই কবিতার সঙ্গে ভাস্কর্য ও চিত্রকলার সংযোগ তৈরি করে নেয় একদিকে। অন্যদিকে শিল্পী রামকিঙ্করের সৃষ্টির মতো মহৎ এক আকাশ আমাদের সামনে এনে দেয়। সেই সঙ্গে রামকিঙ্করের অনাড়ম্বর উদাসী জীবনের অনুষঙ্গে ধরা পড়ে আজকের আকাশটি। আজকের আকাশ, কবিকথক বলছেন, ‘আকাশ আজ রামকিঙ্কর’। এই ‘আজ’ কিন্তু যে কোনও দিনই হতে পারে। যিনি কবিতার বইটি হাতে নেবেন, তাঁর কাছে সেই দিনের আকাশটিই হয়ে উঠবে রামকিঙ্করের সমগ্র সৃষ্টি ও জীবনের মতো শিল্পমহত্বসম্পন্ন। কবিতার বইয়ের এমন আশ্চর্য সুন্দর নামকরণ দুর্লভ, তা মানতেই হবে। 

প্রথমেই আমি বলব এই বইয়ের ‘বিভাব’ কবিতাটির কথা, যে-কবিতা অপেক্ষাকৃত ছোট হরফে মুদ্রিত হয়েছে বইয়ের উৎসর্গ ও সূচিপত্রের ঠিক পরেই। এবং এই কবিতার কোনও শিরোনাম নেই। কবিতাটি এইরকম:

যার অন্তত চারটে দরজা
দরজা খুললেই বারান্দা
চার বারান্দায় নানা রঙের আকাশ
রেলিঙ-এ জড়ানো লতানো ফুল
চার রঙের হাওয়া
যদি পেতাম এমন কবিতা

এ-লেখায় কোনও যতিচিহ্ন নেই। প্রথম লাইনটি বলছে ‘যার অন্তত চারটে দরজা’। নিশ্চয়ই কোনও ঘর। কারণ দরজা খুললেই বারান্দা পাওয়া যাবে। এবং বারান্দাও চারটি। এক এক বারান্দায় যাও, তো এক এক রঙের আকাশ দেখবে। আশ্চর্যের বিষয়, ঠিক এইখানেই চিত্রকলার সঙ্গে সংযোগ রচিত হল। এবং কী মায়াবী এক জগৎ! চারটি বারান্দা, তার রেলিংয়ে জড়ানো পুষ্পলতা। কিন্তু এর ঠিক পরেই ক্ষুদ্র এই কবিতাটিতে এসে পড়ছে এমন এক লাইন যা সমস্ত বিশ্লেষণের অতীত– যা কেবল অনুভব করার, নিঃশব্দে মানসচক্ষে দেখার। কী সেই লাইন? ‘চার রঙের হাওয়া’। আবারো চিত্রকলার সঙ্গে সংযোগ এখানে। হাওয়ার কি রঙ হয়? এইখানেই লাইনটি যেমন বিশ্লেষণের বাইরে চলে গেল, তেমনই চিত্রকলার দিক দিয়ে দেখতে গেলে যেন বিমূর্ত ছবির উপস্থাপন ঘটল। কবিতাটির প্রথম লাইন বলেছিল ‘যার অন্তত চারটে দরজা’। দরজা কোথায় থাকে? ঘরে। ‘দরজা খুললেই বারান্দা’। ঘরের সংলগ্ন বারান্দাও তো পাওয়া যায়। ঘর কথাটি কিন্তু কোথাও লেখা হল না কবিতায়– অথচ ঘর থেকেই কবিতার শুরু। ঘর, বারান্দা, বারান্দার রেলিং– সব আছে, কিন্তু ঘরের উল্লেখ নেই কোথাও। কেন? 

Barnali Koley
বর্ণালীর দুটি কবিতার বই

সেই রহস্যই উন্মোচন করছে কবিতার শেষ লাইনটি: ‘যদি পেতাম এমন কবিতা’। শেষ লাইনের আগের লাইনে আছে ‘চার রঙের হাওয়া’। এমন একটি কবিতার দিকে যাত্রা করতে চান এই কবি, বর্ণালী কোলে, যার চারটে বারান্দায় চার রঙের আকাশ, যেখানে চার রঙের হাওয়া! অতুলনীয় কবিতা। ‘বিভাব’ কবিতাটি পড়ার পর আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম, পরবর্তী কবিতাগুলি পড়ার আগে আমাকে অনেকটা সময় নিঃশব্দে মনের ভিতর ধরে রাখতে হয়েছিল মাত্র ছয় লাইনের এই ক্ষুদ্র কবিতাটিকে।

এই প্রবেশক কবিতাটি যেমন বিমূর্ত সৌন্দর্য উপহার দিল, এই কবিতাগ্রন্থের কিছু কিছু কবিতায় কিন্তু স্পষ্ট প্রত্যক্ষ সমাজ-জীবনের কথাও এসেছে। এসেছে এমনকী গার্হস্থ্য হিংসার প্রসঙ্গ। তেমনই একটি কবিতা তুলে দিই:

মধ্যবিত্ত

সকালে বাসু তার বউকে মেরে হাত ভেঙে দিয়েছে
লাঠির আঘাতে
না, শিউরে উঠি না আমরা

ভালো আছি খাবার টেবিলে
ভ্রমণে ভ্রমণ

আমাদের সারাদিন শূন্যে তরবারি ঘোরানো
সারাদিন শূন্যে…

‘মধ্যবিত্ত’ নামের এই কবিতা আমাদের সমাজের অনেক গৃহবধূর জীবনের নিপীড়ন-কাহিনি বিবৃত করেছে। প্রতিবেশীর বাড়িতে নারীর প্রতি এমন অত্যাচার চলছে তা জেনেও পাশের বাড়ির বাসিন্দারা নিশ্চিন্তে খাবার টেবিলে বসে থাকে– ভ্রমণে যায় পুজোর ছুটিতে। এ পর্যন্ত আমার ধারণায় আসে, কেননা এ-কবিতা এখনো পর্যন্ত চলেছে বিবরণধর্মে নির্ভর করে। একটি স্পেসের পরেই আচমকা এসে পড়ে শেষ দুটি লাইন: ‘আমাদের সারাদিন শূন্যে তরবারি ঘোরানো/ সারাদিন শূন্যে…’। এইরকম একটি অপ্রত্যাশিত মোচড় নিয়ে এসে যে এই কবিতা সম্পূর্ণ করবে নিজেকে সেকথা ভাবিনি। সত্যিই তো, মধ্যবিত্ত মানুষ নিজের বসার ঘরে বসে অথবা চায়ের দোকানের আড্ডায় এইসব নিপীড়ন নিয়ে কত বিদ্রোহের কথা, ক্ষোভের কথা বলে যায় নিরন্তর। কিন্তু কেউ কি এগিয়ে আসে এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে? কবিতার শেষ লাইনদুটি তীব্র ব্যঙ্গের কষাঘাতে আমাদের লজ্জিত করে। কারণ আমাদের সকল প্রতিবাদ কেবল নিরাপদ বন্ধুবৃত্তে আর সান্ধ্য মজলিশে সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ‘সারাদিন শূন্যে’ কথাটি শেষ লাইনে অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় প্রযুক্ত হয়ে এই কবির শব্দ ব্যবহারের সংযমকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। 

Man and Tree
আপনি নিজেই প্রকৃতি

এর পরে যে-কবিতাটির কাছে যাব সেই কবিতার ভিতরেও একটি চরিত্র অবস্থান করছে – কিন্তু সেই অবস্থানকে কবি ব্যবহার করেছেন বড় নিপুণ কৌশলে। পাঠক আগে কবিতাটি পড়ুন:

এলিজি

এই তো কিছুদিন আগে অটো থেকে দেখলাম
রাস্তার ধারে সোনাঝু্রি গাছের তলায়
ঘাস কাটছেন
মানুষ না, আপনাকে দেখে ভেবেছিলাম
আপনি নিজেই প্রকৃতি

আপনাকে কি আর চুল্লি থেকে
ফেরত আনা যায়, বলাইকাকু?

এলিজি যে শোকগাথা তা সকলেরই জানা। তবে এই কবিতা একেবারে শেষ দুটি লাইনে গিয়ে উদ্ঘাটন করে তার শোক। কবিতায় সাসপেন্স তৈরি করতে হয় কীভাবে, এ-লেখা তার এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। লক্ষণীয়, এ-কবিতা বলছে কিন্তু একদম নিম্নবর্গের মানুষের কথা। ঘাস কাটা এক বয়স্ক দিনমজুরের কথা বলছে এ-লেখা। কোথাও কিন্তু কোনও ঘোষক স্বর নেই– বিদ্রোহী কোনও বাচন নেই। আছে অসামান্য সহৃদয়তা। যখন রাস্তার ধারে সোনাঝুরি গাছের তলায় বয়স্ক শ্রমিককে ঘাস কাটতে দেখে কবির মনে হচ্ছে: ‘আপনি নিজেই প্রকৃতি’। আজ পর্যন্ত কোনও শ্রমিকশ্রেণীর মানুষকে কোনও কবি বলেছেন: ‘আপনি নিজেই প্রকৃতি’? আমার মনে পড়ে না। পুরো কবিতায় কোনও যতিচিহ্ন ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু ‘আপনি নিজেই প্রকৃতি’ এমন অভাবনীয় অনুভব প্রকাশিত হওয়ার পরেই এসে পড়ছে বড় রকমের এক যতি। না, কোনও চিহ্ন নয়। বরং স্পেস প্রযুক্ত হচ্ছে। সেও তো যতি। বিরতি। এবং মনে রাখা দরকার ধানক্ষেতের মধ্যে কর্মরতা কৃষাণীকে দেখে কোনও কোনও কবির মনে হয়েছে স্বয়ং প্রকৃতি যেন– এমন উদাহরণ বাংলা কবিতায় পাওয়া যাবে খুঁজলে। কিন্তু একজন বয়স্ক পুরুষ শ্রমিককে ঘাস কাটার পরিশ্রমে ব্যস্ত দেখে, সোনাঝুরি গাছ আর তার তলার ঘাসের সঙ্গে মিলিয়ে– সেই পুরুষটিকে কীভাবে বলা গেল ‘আপনি নিজেই প্রকৃতি’। এই সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিক্ষেপণই তো আমরা কোনও সত্যিকারের কবির কাছে আশা করি। স্পেসের পর কবিতাটি আচমকা বাঁক নেয়। কবি শান্ত স্বরে কেবল হাওয়ায় মিশিয়ে দেন কবিতার শেষ লাইনদুটির গভীরতর শোক। আমরা বুঝি শোক যে কেবল আত্মীয়-বন্ধু-স্বজন সম্পর্কেই বোধ করে মানুষ তা নয়– কবির কাছে সম্পূর্ণ অনাত্মীয় একজন শ্রমজীবীও হতে পারেন তাঁর একান্ত আপনজন। শেষ শব্দ ‘বলাইকাকু’ নিজের আগে একটি কমা রেখেছে, নিজের পরে রেখেছে একটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন। কত অল্প শব্দের আয়োজনে, কত মর্মস্পর্শী এক কবিতায় রূপান্তরিত হল এই রচনা।

এই কবির দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করতে করতে চলে নিজের পরিপার্শ্বকে। নারীজীবনের ছবি একটু দূর থেকে দেখে মায়াময়তায় ফুটিয়ে তোলেন তিনি কবিতার মধ্যে। যেমন এই লেখাটি:

বউ

মাটির দেওয়াল খসে খসে পড়ছে… টালির চাল… বাড়িটার পাঁচিল নেই, দরজা নেই… বারান্দায়
লণ্ঠন ধরা বউ চুপ… মাটি আঁকড়ে

লণ্ঠন ধরা বউ, তোমার কি কোনও নাম আছে?

আবারো নিম্নবর্গের মানুষের জীবন এখানে ধরা দিচ্ছে। একটি গৃহবধূর হতদরিদ্র সংসার পরিস্ফুট হয়েছে, ছোট ছোট বাক্যাংশ দ্বারা নির্মিত কবিতাটিতে। লেখাটি গদ্যের মতো সাজানো। এই কবি তাঁর লেখায় ছন্দের ব্যবহার আনেন না– কিন্তু তার জন্য কোনও ক্ষতি হয় না তাঁর কবিতার। এই কবিতাটির প্রথম দু’ লাইনে যে-বাড়িটির ছবি দেখতে পাই, তা ক্রমশ ভেঙে পড়তে থাকা এক মাটির বাড়ি। সে-বাড়ির কোনও পাঁচিল নেই। এমনকী দরজা পর্যন্ত নেই। বারান্দায় লন্ঠন ধরে সেই বাড়ির বধূটি দাঁড়িয়ে আছে। বলা দরকার, বধূটি ‘দাঁড়িয়ে আছে’ কিন্তু কবিতায় বলা হয়নি কোথাও। বলা হয়েছে ‘বারান্দায় লন্ঠন ধরা বউ চুপ’, তারপর তিনটি ডট দেখতে পাচ্ছি আমরা। এ-কবিতার প্রথম বাক্যাংশ থেকেই তিনটি করে ডট চিহ্ন প্রয়োগ করা হয়েছে, কোনও বাক্য শেষ হচ্ছে না, তিনটি ডট অতিক্রম করে পরের বাক্যাংশ আসছে। এই কবিতার মধ্যেও শেষ লাইনের আগে একটি স্পেস স্থাপিত আছে। কবিতাটি সম্পূর্ণ পঠিত হওয়ার পর যে-স্পেস ব্যবহারকে এক গভীর সংযমী কাব্যবোধের পরিচয় বলে মনে হয়। স্পেসের ঠিক আগে দুটি শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে– ‘মাটি আঁকড়ে’। শব্দদুটি লন্ঠন ধরা বউ সম্পর্কে প্রযুক্ত। এ-কবিতাও, বোঝা যায়, পথ চলতি এক দৃশ্যের ভেসে ওঠা থেকে জন্মলাভ করেছে। ওই ভাঙা বাড়ির বারান্দায় লণ্ঠন ধরা বউ যেন আমাদের গরিব বাংলার চিরকালীন মুখচ্ছবি। এরপর আসে কবিতার সেই লাইনটি, স্পেসের পর যা আমাদের মন কষ্টে বেদনায় ভরিয়ে তোলে। ‘লণ্ঠন ধরা বউ, তোমার কি কোনও নাম আছে?’ সমস্ত গ্রামীণ বাংলার সকল ভেঙে পড়া মাটির বাড়ির মধ্যে এক আশাপ্রদীপ হয়ে জ্বলে থাকে ওই লন্ঠন ধরা বউ। তার কোনও নাম আছে কিনা কবি জানেন না। আমরাও জানি না। তবু কবি জানতে চান তার নাম আর তখনই এই কবিতার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়ে ওঠে এক অনির্বচনীয় আত্মীয়তা– এক নারীর সঙ্গে অপর নারীর। প্রত্যক্ষ ও ঘোষণাময় কোনও নারীবাদের উপস্থিতি ছাড়াই এ-কবিতা দাঁড়িয়ে থাকে নিজের পায়ে– কেবল এক করুণ ও দরদী সহমর্মিতায় নির্ভর করে।

Bengali bride
চৈত্রদুপুর ওদেরই পায়ের জলছাপ…

এমনই একটি একান্ত নারীমন-সঞ্জাত কবিতা এবার সামনে এনে দিই। যে-কবিতা হয়তো কোনও পুরুষ কবির পক্ষে লেখা কঠিন হত। আমি তো অন্তত এমন কোনও কবিতা লিখে উঠতে পারিনি– আমার ১৩ বছর বয়স থেকে এই ৬৮ বছর বয়স পর্যন্ত কবিতা লেখার চেষ্টা করেও পারিনি। 

পতিগৃহে

নূপুরধ্বনিরা আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে
ঠাকুরতলায় পুজোর জোগাড় করত ওরা
ওরাই ছিল শিউলিতলা

আঠেরো উনিশের বেবী, শম্পা, লতা
আলতা পরে রাঙা চেলি গায়ে এখন দূরদূরান্তে

চৈত্রদুপুর ওদেরই পায়ের জলছাপ

শুচিস্নিগ্ধ একটি বাতাস যেন বয়ে গেল মনের ভিতর দিয়ে। প্রথম লাইনটিতে যারা ছিল নূপুরধ্বনি, তৃতীয় লাইনে তারাই হল শিউলিতলা– গ্রামের ঠাকুরতলায় পুজোর জোগাড় করত এরাই। এরা কারা? ‘আঠেরো উনিশের বেবী, শম্পা, লতা’। এই নামগুলি কবিতায় উচ্চারিত হওয়ার পরক্ষণেই এসে পড়ে তাদের বিবাহসাজ। এসে পড়ে দূরদূরান্তে তাদের চলে যাওয়ার খবর। 

শেষ লাইনের আগে আবার একটা স্পেস। চৈত্রদুপুর, যা একই সঙ্গে তীক্ষ্ণ রৌদ্রের ঝলকে জ্বলমান আবার পাশাপাশি বসন্ত ঋতুকেও ধরে আছে। সেই রৌদ্রের মধ্যে জেগে রয়েছে যে দ্বিপ্রহর, সেখানে ওই সব মেয়ের পায়ের জলছাপ যেন নিজেই স্নিগ্ধা গ্রামমৃত্তিকা। বাংলার শাশ্বত গীতিকবিতাগুলির সঙ্গে একই আঙিনায় আসন পেতে বসতে পারে নবীনা কবির এই রচনাটি– এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। কেননা মনে রাখতে হবে কবিতার নাম ‘পতিগৃহে’ এবং এও মনে রাখতে হবে প্রথম লাইনটি কী বলেছে। বলেছে নূপুরধ্বনিরা আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। না, কোথাও যায়নি। কবিতার মধ্যে তাদের চিরস্থায়িত্ব দিয়েছেন এই কবি। 

এরপরে যে-কবিতাটি পাঠকের কাছে রাখব সে-কবিতাও নারী মনের কবিতাই। কবিতার নাম ‘সাধ’। আমি ভুলে যাচ্ছি না সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা চিরস্মরণীয় ‘সাধ’ কবিতাটির কথা, যা বাংলা কবিতার এক কীর্তিস্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে-কবিতার সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য নেই নবীনা এই কবির লেখাটির।

সাধ

হাওয়ায় ওড়াউড়ি করছে আমাদের হাত
বাড়িভরা লোকজন
সেজে উঠছে রোদ্দুর
ন’রকমের ব্যঞ্জনের ঘ্রাণ
ন’হাত শাড়ি
বেডকভার পালটানো
ফুলদানিতে ফুল

একমাস পরেই তুই আসছিস

এ-কবিতার কোথাও কোনও যতিচিহ্ন নেই। গর্ভিনী নারীর সাধভক্ষণের উৎসব চলছে বাড়িতে। প্রথম লাইনটি অপার্থিব সৌন্দর্য আনে: ‘হাওয়ায় ওড়াউড়ি করছে আমাদের হাত’। আনন্দে যেন এই পরিবারের সকলের হাত হাওয়ায় উড়ছে। রোদ্দুরও যেন উৎসবপ্রাণিত। কবিতাটিতে বলা হয়েছে ন’রকমের ব্যঞ্জনের ঘ্রাণ– বলা হয়েছে ন’হাত শাড়ি। কেন? কোনও কোনও পরিবারে সাত মাসে সাধভক্ষণের প্রথা আছে। কোনও কোনও পরিবারে এই প্রথা পালিত হয় গর্ভিনী ন’মাসে পৌঁছলে। এ-কবিতায় নিশ্চয় এই ন’মাস কথাটা বলা হয়নি কোথাও– কিন্তু ন’রকমের ব্যঞ্জনের ঘ্রাণ আর ন’হাত শাড়ি দিয়ে গর্ভধারণ ন’মাসে পড়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। কেননা শেষ লাইনটি বলে: ‘একমাস পরেই তুই আসছিস’ অর্থাৎ নবজাতককে আবাহন করা হচ্ছে। তার আগমনের আগেই তাকে ‘তুই’ বলে এই সম্বোধন নিশ্চিতভাবে এক নতুনত্ব নিয়ে আসে কবিতাটির মধ্যে, কেননা এই পরিবারে যে স্নেহবাৎসল্য আবির্ভূত হতে চলেছে তাকে আগেই যেন কোলে তুলে নেওয়া হল ‘তুই’ কথাটি প্রয়োগ করে। তার আগে পুরো কবিতাটির মধ্যে কোথাও ‘তুই’ কথাটি ছিল না। কিন্তু এক্ষেত্রেও আবার এসে পড়ে নামকরণের বুদ্ধিদীপ্ত ভূমিকা। কারণ নামকরণে ‘সাধ’ শব্দটি তো দেখতে পাচ্ছি আমরা!

এখন যে কবিতাটির কথা বলব সে-লেখার নাম ‘বইমেলা’। লেখক ও পাঠক সকলের কাছেই যা এক প্রিয় উৎসব।

বইমেলা

খুঁটি পোঁতার শব্দ
চারিদিকে খুঁটি পোঁতা
বইয়ের পেটি এল এই
ফুল আঁকা টেবিলক্লথ

স্টলের রঙ এখনো কিছুটা বাকি

নিজেই তুলে নিয়েছ বুরুশ

তোমার এক হাতে বালতি
বালতিতে রোদ্দুর

আকাশ রঙ করছ তুমি

স্টল সাজাচ্ছেন একজন। নিজের স্টল। বইমেলার অজস্র স্টলের একটি। সেই সাজানোর বর্ণনায় রত এই কবিতা শেষ দিকে এসে এক আশ্চর্যকে উপহার দেয়। যখন আমরা পড়ি ‘তোমার এক হাতে বালতি/ বালতিতে রোদ্দুর’। ‘তোমার এক হাতে বালতি’ পর্যন্ত ভাবতে পারা যায়– কিন্তু ‘বালতিতে রোদ্দুর’ ভরা আছে একথা নিশ্চয়ই আমরা ভাবতে পারি না। এই হল অভাবনীয়ের সৌন্দর্য। কবিতার শেষ লাইনটি অবশ্য সব অর্থের সীমা অতিক্রম করে। তবু আমরা কেউ কেউ ভাবি বইয়ের উৎসব তো আসলে আকাশকে রঙ করার উৎসবই! এই উদযাপন মহত্ব লাভ করে যখন শেষ লাইনটি বলে ‘আকাশ রঙ করছ তুমি’। বইমেলার এক স্টলকর্মীর মধ্যে দিয়ে এ-কবিতা একদিকে ঈশ্বরকে মনে করায়, অন্যদিকে মনে করায় প্রেমকে। প্রেম কার প্রতি? স্টল সাজানোয় একাগ্র ওই যুবকের প্রতিই যেন। এবার তাহলে একটি কবিতা পড়তে দিই পাঠকদের যাকে স্পষ্টতই প্রেমের কবিতা বলে চিহ্নিত করা যায়।

Flame
শ্বাস তো নেই, পলাশ সব।

পলাশ

পৃথিবীর ব্যস্ততম মানুষ আপনি। অফিস পথে হাঁটতে হাঁটতে ফোন করেন। কী যে হাঁপান, আপনি জানেন? অফিসে বুঝি আজকাল চাপ বেড়েছে? চারটে কথা বলে ফোন রাখেন।

আমি রাখি হাতের মুঠোয় হঠাৎ পাওয়া কয়েকটা
শ্বাস। রোদ্দুরে মুঠো খুলি। 

শ্বাস তো নেই, পলাশ সব।

এখন মোবাইল ফোনের যুগ। নইলে মানুষ হাঁটতে হাঁটতে ফোন করবে কী করে? ফোন যে করছে, হাঁটার সময় তার হাঁপ ধরা শ্বাসের শব্দ পাওয়া যায়। ‘কী যে হাঁপান, আপনি জানেন?’ যে ফোন করছে সে তো আর নিজের কথা অন্যপ্রান্তে কতটা হাঁপিয়ে ওঠা শ্বাসের সঙ্গে শোনা যাচ্ছে সেকথা জানে না! কিন্তু কবিকথকের উদ্বেগআকুতি ধরে রাখছে কবিতার এই ধরণের বাক্য: ‘কী যে হাঁপান, আপনি জানেন?’ এবং ‘অফিসে বুঝি আজকাল চাপ বেড়েছে?’ এই উদ্বেগস্বর জানিয়ে দেয় ফোনের অপরপ্রান্তে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা মানুষটির সঙ্গে এক হৃদয়সেতু আছে কবিকথকের। ‘চারটে কথা বলে ফোন রাখেন’– এই বাক্যের পর কবিতায় এসে পড়ে একটি স্পেস। স্পেসের পরের বাক্যটি বলে: ‘আমি রাখি হাতের মুঠোয় হঠাৎ পাওয়া কয়েকটা শ্বাস। রোদ্দুরে মুঠো খুলি।’ তারপর আবার স্পেস। মুঠোয় কেন কয়েকটি শ্বাস রাখা হল? মোবাইল ফোনকে তো মুঠোয় ধরেই কথা বলতে হয়। তাই মুঠোফোন নামেও অভিহিত করা হয় এই ফোনকে। ফোনের মধ্য দিয়ে যার কথা আসছিল, কথার মধ্যে আসছিল হাঁপিয়ে ওঠা শ্বাস, সেই শ্বাস পৌঁছচ্ছে অন্য প্রান্তে যে রয়েছে তার কাছে। এক্ষেত্রে, কবিকথকের হাতের মুঠোয় ধরা ফোনে সেই শ্বাসবায়ু চলে আসছে। তাই হাতের মুঠোয় কয়েকটি শ্বাস রাখা। প্রেমিকের শ্বাস। কবিতার শেষে এসে দেখা যায় মুঠো খুলে ফেলার পর সেখানে সব পলাশ। পলাশ শব্দটি প্রেমের অবস্থানকে নিশ্চিত করে এই কবিতায়। হাতের মুঠোয় কয়েকটি শ্বাস ধরে রাখার অভিনব চিন্তাও আমরা কিন্তু পেলাম এ লেখায়। ফোন তো আমরা সকলেই পাই। কিন্তু এইরকম নতুনভাবে চিন্তা করি কি? যেহেতু দেখা হচ্ছে না প্রেমিকের সঙ্গে তাই ফোনে বলা তার কথার নিশ্বাসটুকুই যেন কেউ আজ মুঠো খুলে দেখছে।

এখন তাহলে আমরা এসে দাঁড়াব এই কাব্যগ্রন্থের শেষ পৃষ্ঠার কবিতাটির সামনে। কী সেই কবিতা? বলছি:

জানালা

হিসাব করি সময়ের। নিজের জন্য সময়। ক্লান্তি, ফোন ইত্যাদির 

জন্য কেটেকুটে দিনশেষে কিছুই থাকে না… সপ্তাহে হয়তো

একদিন দুদিন এক ঘণ্টা

জানালা খুলি।

বেলফুলের গন্ধ
আকাশ আজ সাহিত্য পত্রিকার পাতা
আকাশ আজ রামকিঙ্কর

কবির জন্য সময় খুব কম আজকের সমাজে। প্রত্যেক কবিকেই জীবিকার জন্য অন্য কাজ করতে হয়। কেবল কবিতা লিখে জীবিকা নির্বাহ অসম্ভব। তাই কবিকে নিজের জন্য একাগ্র মনোনিবেশের সময়টুকু অতিকষ্টে খুঁজতে হয়। ‘ক্লান্তি, ফোন ইত্যাদির জন্য’ এই বাক্যাংশটি কবিতায় আছে। ক্লান্তি তো স্বাভাবিক – কারণ যে-কোনও জীবিকার শেষে বাড়ি ফিরে ক্লান্তি তো আসেই। কিন্তু ফোন? আজকের যুগে, এই একবিংশ শতাব্দীতে, ফোন খুবই প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় জিনিস কখন নেশায় বদলে যাচ্ছে সেকথা ফোন ব্যবহারকারী অনেক সময় বুঝতে পারেন না। ফোন হয়ে দাঁড়ায় এক আসক্তি। ফোনের সঙ্গে কখন মিশে যায় মেসেজ করার নেশা। কারণ হোয়াটসঅ্যাপ প্রক্রিয়াটিও ফোনেরই সঙ্গে জড়িত থাকে। এই যুগে ফোন-মেসেজ-হোয়াটসঅ্যাপ বাদ দিয়ে কোনও তরুণ-তরুণী কি জীবন যাপন করতে পারেন? না, পারেন না। যেমন, নেশা যারা করে তারা নেশাকে মনে করে তাদের জীবনের পক্ষে অবশ্য-প্রয়োজনীয় বস্তু। ফোনের নেশা, মেসেজের নেশা, হোয়াটসঅ্যাপের নেশাকেও সেরকমই ভাবেন আজকের নবীন-নবীনারা। কেননা ফোনের ব্যবহার তো এখন জীবনের একটি দরকারি প্রক্রিয়া। কখন যে সেই দরকার নেশার পর্যায়ে চলে গেছে, এবং ফোন-ব্যবহারকারী তরুণরা সেই নেশার কবলে পড়েছেন – সেকথা তারা নিজেরাই জানতে পারেন না। 

মনে রাখতে হবে ফোন এবং মেসেজ দু’ক্ষেত্রেই ব্যবহার করতে হয় শব্দ। কবিতা রচনার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে হয় শব্দকেই। মনের ভেতরকার যে কেন্দ্র থেকে কবিতার শব্দ জন্মলাভ করে, সেই কেন্দ্রকে সযত্নে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করতে হয় কবিতালেখককে। অন্যদিকে ফোন, মেসেজ ইত্যাদির দ্বারা অতিরিক্ত পরিমাণে শব্দব্যবহার চাপ সৃষ্টি করে কবির মনের শব্দসৃজন ক্রিয়ার উৎসের উপর, কবির অজান্তেই। মনে রাখতে হবে এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে বহিরঙ্গের শব্দ। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত শব্দ নয়। তাই কবিতার শব্দ হয়ে ওঠে প্রধাণত বিবরণধর্মী। বৈচিত্র হারায় শব্দ। সংকেতধর্ম হারায়। অত্যধিক ব্যবহারে শব্দপ্রয়োগ জীর্ণতার কবলে পড়তে পারে। অথচ ফোন-মেসেজ-হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার না করলে সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে কী করে? কবিসমাজের সঙ্গে কবির যোগাযোগ? তাই এই ফোন ব্যবহার এক নেশায় রূপান্তরিত হল আধুনিককালে। ঘন ঘন ফোন, ঘন ঘন মেসেজ– দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু ব্যবহৃত হচ্ছে শব্দ। কখনো মৌখিক ভাষায়, কখনো টাইপ করা ভাষায়। এখন কথা হচ্ছে, যে কোনও নেশাই সাময়িক ক্লান্তি আনে। যে মদ্যপান করে তার কি নেশার পর ক্লান্তি আসে না? আসে। তবু পরের দিন সেই ব্যক্তি আবারো মদ্যপানে আগ্রহী হয়। নেশা তো! কী করবে? 

Phone
ফোন হয়ে দাঁড়ায় এক আসক্তি

ফোনও তাই। জীবিকার ক্লান্তির সঙ্গে মিশে যায় ফোন-মেসেজ ব্যবহারের ক্লান্তি। নিজের জন্য সময় প্রায় থাকে না কবির। ‘একদিন দুদিন এক ঘণ্টা’ মাত্র। এই সব সমস্যা শুধু ‘ক্লান্তি’ আর ‘ফোন’ এই দুটি শব্দ দিয়ে কবিতাটির মধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। দুটিমাত্র শব্দ, কিন্তু সাম্প্রতিক যুগলক্ষণ যাঁরা জানেন তাঁরা এই দুটিমাত্র শব্দেই পুরো বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবেন। 

দু’বার স্পেস ব্যবহৃত হয় কবিতাটিতে। তার প্রথমটি আসার পর এক লাইনে আবারো দুটিমাত্র শব্দ আমরা দেখতে পাই – ‘জানালা খুলি’। এর পরেই আসে পূর্ণচ্ছেদ। পরক্ষণেই কবিতার দ্বিতীয় স্পেসটি এসে পড়ে। দ্বিতীয় স্পেস পেরিয়েই বাঁক নেয় কবিতাটি। জানালা খোলার পর কী পাওয়া যায়? ‘বেলফুলের গন্ধ’– নিশ্চয় জানালার বাইরে থেকেই সেই পুষ্পগন্ধ ভেসে আসে। তারপরেই ঘটে যায় কবিতার মধ্যে পর পর দুটি আশ্চর্যের জাগরণ! কী কী? ‘আকাশ আজ সাহিত্য পত্রিকার পাতা’ এবং ‘আকাশ আজ রামকিঙ্কর’। দুটি বাক্যের কোনওটির শেষেই কোনও যতিচিহ্ন নেই। কারণ আকাশের কি কোনও যতিচিহ্ন হয়? হয় না। অন্যদিকে লক্ষ্য করতে হবে যে বইয়ের শেষ লাইনের সঙ্গে মিলে যায় বইয়ের প্রথম লাইন। বইয়ের প্রথম লাইন কোথায় পাব? কেন, বইয়ের নামকরণেই তো পেয়ে যাব বইয়ের প্রথম লাইন, যা বইয়ের মলাটে মুদ্রিত আছে– ‘আকাশ আজ রামকিঙ্কর’। এইবার বইটি একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থরূপে নিজেকে ভূমিষ্ঠ করতে পারল পাঠকের ক্রোড়ে। ‘আকাশ আজ সাহিত্য পত্রিকার পাতা’– এই কল্পনাও খুব আশ্চর্য। কিন্তু ‘আকাশ আজ রামকিঙ্কর’ এই লাইনটি এক বিরাট উদ্ভাসনে আমাদের অধিকার করে। ‘আকাশ আজ সাহিত্য পত্রিকার পাতা’ এই লাইনটি খুবই সুন্দর, কিন্তু আমার মনে পড়ে যাচ্ছে এরই পাশাপাশি রাখা যায় এমন একটি কবিতার তিনটি লাইন। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছিলেন তাঁর ‘ঝরছে কথা আতসকাচে’ কাব্যগ্রন্থে এই লাইনগুলি:

দেখেছ দিগন্ত আজ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে?
এক একরকম মেঘ জেগে আছে এখানে-ওখানে
আমার কবিতা ওরা প্রকাশ করেনি এ সংখ্যায়

অলোকরঞ্জনের এই কবিতাটি আমি আমার ‘গোঁসাইবাগান’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে গ্রহণ করেছিলাম। অলোকরঞ্জন আকাশ বলেননি, বলেছিলেন ‘দিগন্ত’। অলোকরঞ্জন ‘সাহিত্য পত্রিকার পাতা’ কথাটিও বলেননি, ঠিকই। বলেছিলেন, ‘ক্রোড়পত্র’। চিন্তাসূত্রের দিক থেকে নিজের ছয় প্রজন্ম আগের কবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রইলেন এই কবি– যেভাবে পিতামহের সঙ্গে যুক্ত থাকে পৌত্র-পৌত্রী।

পরিশেষে এই কাব্যগ্রন্থের একটি অত্যাশ্চর্য কবিতার কথা বলে আমার এবারের ‘কবিতার সঙ্গে বসবাস’ সম্পূর্ণ করব। কবিতাটি এইরকম:

সিঁড়িকে

বাড়ির ভিতরেই তো আছ
সিঁড়ি, ও সিঁড়ি
উঠতে উঠতে এবার
পালিয়ে যাও
ধরাছোঁয়ার বাইরে 

কেন আমি কবিতাটির বিষয়ে অত্যাশ্চর্য কথাটি বলেছি তা নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে এখন। এই কবিতাটি ‘সিঁড়ি’ কথাটিকে এমনভাবে ব্যবহার করেছে যেন সিঁড়ি নিজেই একটি চরিত্র। সিঁড়ি যে বাড়ির ভেতরে বন্ধ হয়ে থাকে তা আমরা জানি। কিন্তু সিঁড়ি যে বন্দি হয়েও থাকে, তা কি ভেবেছি কখনো? এই কবিতাটি সেই চিন্তার নতুনত্ব নিয়ে এল আমাদের কাছে। সিঁড়ির মুক্তি কোথায়? খুব বেশি হলে একটি খোলা ছাদে গিয়ে উঠবে সিঁড়ি। এর চেয়ে অধিক দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার অধিকার সিঁড়ির নেই। কবিতাটি অত্যাশ্চর্য এই কারণে যে, সিঁড়িকে বলা হল ‘উঠতে উঠতে এবার পালিয়ে যাও ধরাছোঁয়ার বাইরে’। অর্থাৎ সিঁড়ি, এক্ষেত্রে, উঠতে উঠতে যেন অনন্তে মিশে গেল। এ এক অভাবনীয় কল্পনাশক্তির পরিচয়। অন্যদিকে এই কবিতা এক নারী কবির হাতে রচিত বলে, অন্য একটি দিকেও সংকেত পাঠায়। আমাদের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সমাজের নারীরা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক ধরনের প্রথাগত জীবনের মধ্যে বন্দি হয়ে আছেন। এই ‘আকাশ আজ রামকিঙ্কর’ কাব্যগ্রন্থে এমন বেশ কয়েকটি কবিতা দেখা যায় যেখানে নিম্নবর্গের নারী ও পুরুষের অসহায়তার কথা উচ্চারিত হয়েছে। ঘোষণাস্বরের মধ্য দিয়ে নয়, স্নেহমায়ার স্পর্শস্বর নিয়ে। 

কবিকে নিজের জন্য একাগ্র মনোনিবেশের সময়টুকু অতিকষ্টে খুঁজতে হয়। ‘ক্লান্তি, ফোন ইত্যাদির জন্য’ এই বাক্যাংশটি কবিতায় আছে। ক্লান্তি তো স্বাভাবিক – কারণ যে-কোনও জীবিকার শেষে বাড়ি ফিরে ক্লান্তি তো আসেই। কিন্তু ফোন? আজকের যুগে, এই একবিংশ শতাব্দীতে, ফোন খুবই প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় জিনিস কখন নেশায় বদলে যাচ্ছে সেকথা ফোন ব্যবহারকারী অনেক সময় বুঝতে পারেন না। 

স্পর্শস্বর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অর্থাৎ জোরালোভাবে কোনও পর্দা না ছুঁয়ে কেবল আলতোভাবে সেই স্বরটিকে স্পর্শ করে যাওয়া। যেমন বেহাগ রাগে সব স্বর শুদ্ধ। কারণ বেহাগ বিলাবল ঠাটের রাগ। কিন্তু, গুণী কণ্ঠশিল্পী কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবরোহণের সময় অথবা বেহাগের পকড় গাইবার সময়, আওচার করতে করতে, কড়ি-মধ্যমকে স্পর্শস্বর হিসেবে ব্যবহার করেছেন এমন অভিজ্ঞতা শ্রোতাদের আছে। ‘আকাশ আজ রামকিঙ্কর’ কাব্যগ্রন্থে সেইভাবে, স্পর্শস্বর প্রয়োগের মতো, নিম্নবর্গের মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে যাবার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। সিঁড়ি যে উঠতে উঠতে অনন্তে মিশে গেল, এটা যেমন এই ছোট্ট কবিতায় একটি অতুলনীয় নতুন চিন্তাপ্রয়োগের সাক্ষ্য দিচ্ছে– তেমনি ‘পালিয়ে যাও’ কথাটি জীবনযাপনের মধ্যে বন্দিত্ব অনুভব করা সব রমণীর স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়াও নির্দেশ করছে। অথচ কত অল্প কয়েকটি শব্দের দ্বারা এমন কবিতা রচনা সম্ভব করলেন এই কবি, বর্ণালী কোলে। কবিতাটির কোথাও কোনও যতিচিহ্ন নেই। কারণ এ কবিতা এক উন্মুক্ত স্বাধীনতার কথা বলছে, তাই কোথাও কোনও যতি দিয়ে তাকে বাঁধা হয়নি। এই কবি ভবিষ্যতে কী কবিতা লেখেন তা পাঠের জন্য আমাদের আগ্রহ জেগে রইল। আমার মতো বৃদ্ধদের কাছে আলো দেখান এমন সব নতুন কবিরাই। এঁদের অভিনন্দন।

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৫ অক্টোবর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Facebook, Pinterest, Fine art America
Joy Goswami

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

Picture of জয় গোস্বামী

জয় গোস্বামী

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।
Picture of জয় গোস্বামী

জয় গোস্বামী

জয় গোস্বামীর জন্ম ১৯৫৪ সালে, কলকাতায়। শৈশব কৈশোর কেটেছে রানাঘাটে। দেশ পত্রিকাতে চাকরি করেছেন বহু বছর। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন দু'বার - ১৯৯০ সালে 'ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা?' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯৯৮ সালে 'যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল' কাব্যোপন্যাসের জন্য। ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি পুরস্কার। দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন কবিতার সাহচর্যে। ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com