পার্ক স্ট্রিট পদাবলী
লেখক: অগ্নি রায় ও রূপক চক্রবর্তী
অলঙ্করণ: যোগেন চৌধুরী
প্রকাশনা: দে’জ পাবলিশিং
“পার্ক স্ট্রিট পদাবলী“ একটি চমকে ওঠার মতোই বই। রোগা পাতলা চেহারা, যেমনটা কাব্যগ্রন্থ হয় আর কি, ঠিক তেমনই । তবে যোগেন চৌধুরীর প্রচ্ছদের ফলে একটু গেরামভারী হয়েছে। অভিনবত্ব আরও এক জায়গায়। এই ক্ষীণ গ্রন্থে দু’ দুজন দুরন্ত কবিকে আঁটানো তো সোজা ব্যাপার নয়! তবে কথায় আছে “সুজন হলে তেঁতুলপাতায় ন‘জনাও আঁটে” বাপু! এঁটেছে কিনা তা বলতে পারিনা, তবে একটু ঠাসাঠাসি হয়েছে বৈকি! দুই কবিকেই কবিতাখোর বাঙালিরা বিলক্ষণ চেনেন, রূপক চক্রবর্তী এবং অগ্নি রায় । এদের কবিতা মাঝেমাঝেই নামী অনামী পত্রপত্রিকায় বেরিয়ে মানুষকে চমকায়, ধমকায়, জ্বালিয়েও খায় বোধহয়।
কবিতে কবিতে মিল বা সমলক্ষণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, এখানেও নেই। তবে হ্যাঁ, দুজনেই আদ্যন্ত নাগরিক কবি, যাদের সপ্রতিভ স্মার্টনেস প্রশ্নের অতীত। কন্টেম্পোরারি বা সমকালকে এঁরা আকণ্ঠ পান করে বসে আছেন। এঁদের বরিশাল বা বহড়ু বা পদ্মানদী নেই, হিজল নেই, দোয়েল নেই, থমথমে গভীর প্রাকৃত নির্জনতা নেই, বরং এক আন্তরিক আর্তনাদ আছে। এইসব সংকলিত পদ্যবন্ধ জলের মতো ঘুরেঘুরে একা একা কথা কয়না বটে, কিন্তু নাগরিক স্বগতোক্তিগুলি আমাদের ঠিকই এক আরবান নির্বাসনে টেনে নিয়ে যায়।
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে সানাইবাদক বিসমিল্লা খানকে। চমকের শুরু এখান থেকেই। কেন এই উৎসর্গ তার জবাব খুঁজে লাভ নেই। তবে একটা জিনিস আমি ব্যক্তিগতভাবে বরাবর টের পেয়েছি, সানাইয়ের শব্দের ভিতরে ওতপ্রোত রয়েছে এক ক্রন্দনধ্বনি। সানাই হঠাৎ বেজে উঠলে বুকটা কেমন খাঁখাঁ করে ওঠে। বিসমিল্লা খান বোধহয় এক গুমরে ওঠা কান্নারই নাম।

রূপক চক্রবর্তী কবিতা লিখছেন অনেকদিন। নিজস্ব চারদিক নিয়েই তাঁর আবহ, তাতে ভাঙাচোরা, কৌনিক বা যাদুনলের নক্সার মতো প্রতিবিম্ব আসে, প্রতিবিম্ব আসে ইতিহাস বা খবরের কাগজ বা শ্রুত অভিজ্ঞতা থেকেও। তবে কলকাতাকে তিনি, গোলকিপার যেমন তার টিমকে ভালবাসে তেমনি ভালবাসেন। অন্তত কলকাতাকে আগলে রাখার যে উদ্বেগ তাঁর কবিতায় প্রস্ফুট হয় তা থেকে আমার এই অনুষঙ্গই মনে এল। আর বলতে হয়, তাঁর ভালবাসার তেমন কোনও বনলতা সেন নেই বটে, কিন্ত সেই জায়গার জবরদখল নিয়েছেন বাঙালির প্রিয় সব মানুষেরা, শিশির ভাদুড়ি থেকে অজিতেশ, কমলকুমার থেকে শক্তিসুনীল। পরিপাটি কবিতা লেখার ধাত তাঁর নয়, ভাঙচুর করেওছেন বিস্তর, তবে কালাপাহাড়ি ব্যাপারস্যাপার নেই।
দিদির ঘুম পালানো দুপুর
দিদি চিঠির ওপর উপুড়
বাইরে টাপুরটুপুর এবং চোখেও টাপুরটুপুর
গল্পের আসঙ্গে লেখা এরকম কবিতা অভিনব নয় বটে, কিন্ত রূপকের অতি স্পর্শকাতর সংবেদনশীল অনুভব এই কবিতাকে অনেক অন্তরঙ্গ করে তুলেছে। ছন্দজ্ঞান ত্রুটিহীন বলেই তিনি ছন্দ ভেঙেছেন দক্ষতায়। আজকাল অনেকে ছন্দ না জেনে গদ্যকবিতা লিখতে যায় এবং তা দুষ্পাচ্য হয়ে ওঠে। সংস্কৃত কাব্যে অন্তমিল থাকেইনা, কিন্তু পড়তে গিয়ে তা মনেও হবেনা। ছন্দ ও মাত্রা ঠিক রাখা গেলে কবিতার স্থাপত্যে ভুলচুক হয়না। রূপকের কিছু দেখনদারীও আছে। যেমন রুটিতোষ শব্দটি, যেমন প্রশ্নপত্র কবিতাটি, যেমন “কাচ হোক বা ভালোবাসা —- শেষ পর্যন্ত ভাঙবেই” এমত এক্সপ্রেশন। চমৎকার! বলে রাখি, যার হিম্মৎ থাকে তার দেখনদারীও খারাপ লাগেনা।
অগ্নি রায় সমর সেন বা অরুণ মিত্রের পথের যাত্রী কিনা সেই বিচার থাক। তিনি ছন্দ বা মিলকে পরাধীনতা মনে করেন কিনা তাও তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ কবিতা যে যার মতো লিখতেই পারে। আসল কথা হল, কমিউনিকেশন। সেটা যদি হয় তাহলে আর স্থাপত্যে কী হবে? অগ্নি যে অতি সচেতন নাগরিক কবি তাতে আমার তেমন সন্দেহ নেই। মগ্নকবিত্বের ধার অনেকেই ধারেননা। জীবনানন্দের পাশাপাশি বিষ্ণু দেও তো সমানে লিখে গেছেন। একজন জাগর স্বপ্নে আচ্ছন্ন, খানিকটা পাগল, খানিকটা ভিশনারি, খানিকটা বিস্ময়ে বিপন্ন। অন্যজন ক্ষুরধার বৌদ্ধিক জগতের জাগ্রত ও সচেতন কারিগর। কেউই ফ্যালনা নয়। তবে কি, আমাদের কবিতাচারণ শুরু হয়েছিল জল পড়ে, পাতা নড়ে দিয়ে। কিংবা আরও আগে, দে সতী দে সতী কাঁদিল পশুপতি পাগল শিব প্রমথেশ। কিংবা, রবিমামা দেয় হামা, গায়ে রাঙা জামা ওই।
অগ্নি কিছু অতি চমৎকার ছন্দোবদ্ধ কবিতাও লিখেছেন। ছন্দমিলেও যে তাঁর অনায়াস আধিপত্য তা বুঝতে অসুবিধে হয়না। এই আধিপত্যটা কবির থাকা বড় প্রয়োজন। অনেক পরিশ্রম না করলে, কুলিকামিনের মতো শব্দ, ছন্দ মাত্রার পিছনে না খাটলে কবিত্বের বাধক চৌকাঠটি পেরোনো মুশকিল। অগ্নি, মনে হয়, চৌকাঠটি পেরিয়ে গেছেন অনায়াসেই ।
কলে জল আসে, এসো পরিত্রাণ
জ্বলে পঞ্চভূত, সে তো কলহপ্রাণ
এসো ভগ্নদূত, খোঁড়ো পুরনো ঋণ
জাগো রাতমিছিল, সব অচ্ছে দিন ।
কবি অগ্নি আবার একজন সাংবাদিকও। ফলে তাঁর কবিত্বের পরিধি অনেকটা বিস্তার লাভ করতে পেরেছে। যে বকযন্ত্রে কবিতার জারণক্রিয়া হয় তাও আসলে এক আশ্চর্য ও অভিনব সত্যের কাছাকাছি উপনীত হওয়ার প্রাণপন প্রয়াস।।
অগ্নি রায় এবং রূপক চক্রবর্তী দুজনেই এই সময়কালে পাঠযোগ্যতায় অগ্রণী দুই কবি। তাঁদের এই অভিনব কবিতাগ্রন্থটি যোগেন চৌধুরী তাঁর নিয়মভাঙা নানা ছবি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন। সেও যেন কবিতাই। বইটি হাতে নিলেই মন ভাল হয়ে যায় ।
ছবি সৌজন্য: অগ্নি রায়
প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। ওঁর প্রথম উপন্যাস 'ঘুণপোকা' প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে দেশ পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে। পরবর্তীতে অসংখ্য গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। শিশুকিশোর সাহিত্য ও গোয়েন্দা ভিত্তিক সাহিত্যেও ওঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, বঙ্গবিভূষণ, আনন্দ পুরস্কার সহ অগুনতি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। প্রায় ছয় দশক ধরে তাঁর সৃষ্টি বাংলার পাঠকদের মন জয় করে চলেছে।
2 Responses
Sirshendu dar lekha eto sundar … bar bar porte ichhe kore.
Tar jathajatho porjyabekhan o bhavna asadharan. Bangla bhasa je kato sundar hotepare tar lekha theke ta bujte pari.
Ok.