banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

চা বাগিচার কড়চা: পর্ব ৩- সাহেব ও বাবু

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Tea Garden

চা-বাগানের শ্রেণিপার্থক্য দৃষ্টিগোচর হত বেশ সহজেই। প্রথম লক্ষণীয় বিষয় ছিল বাসস্থানের বিন্যাস। চা-বাগানের শ্রমিকদের বাসস্থানগুলি সাধারণত থাকত কারখানা ও অফিস অঞ্চল, অর্থাৎ উৎপাদনের মূল কেন্দ্র থেকে প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। শ্রমিকদের বলা হত কুলি, আর তাদের বাসস্থান অঞ্চলের নাম ছিল কুলি-লাইন। ১৮৩৩ সালে লেবার এনকোয়ারি কমিটি ‘কুলি’ শব্দের পরিবর্তে ‘লেবার’ কথাটি চালু করার কথা বলে। কিন্তু বিগত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকেও ‘কুলি’ কথাটি, কাগজকলমে না হোক, মুখে মুখে চালু ছিল। যাইহোক, কারখানা ও অফিসের কাছাকাছি ছিল সাহেবদের কুঠি। বাবুদের কোয়ার্টারগুলিও ছিল কেন্দ্রীয় অঞ্চলে, তবে সাহেবদের কুঠি থেকে বেশ দূরত্ব রেখে। এই তিন শ্রেণীর সামাজিক মেলামেশা ছিল নিজ নিজ পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ। 

আশপাশের বেশ কয়েকটি চা-বাগান নিয়ে সাহেবদের জন্য ছিল একটি ক্লাব। নাম ‘ইয়োরোপীয়ান ক্লাব।’ এটাই ছিল তাঁদের সপরিবার সামাজিক মেলামেশার জায়গা। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি সাহেবরা চলে গেলেও এ ক্লাবের নাম বদলায়নি, যেমন বদলায়নি দিশি ম্যানেজার এবং অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজারদের ‘সাহেব’ খেতাব। নিম্নবর্গের কর্মচারিরা তাঁদের ‘সাহেব’ সম্বোধন করতেন। তবে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সম্পর্কিত এই সম্বোধন বিষয়ে শুধু চা-বাগানকে দোষারোপ করা অন্যায় হবে, কেননা স্বাধীন ভারতের সরকারি দফতরেও সাহেবিয়ানা এখনও একইভাবে বজায় আছে। 

চা-বাগানের সাহেবরা সপ্তাহে একদিন, যতদূর মনে পড়ে সোমবার, ক্লাবে মিলিত হতেন। বলা বাহুল্য, বাবুদের সেখানে যোগ দেবার প্রশ্ন ছিল না। ক্লাবের ভেতরে বিনোদনের উল্লেখযোগ্য উপকরণ হিসেবে ছিল প্রজেক্টারে ইংরেজি সিনেমা দেখানো, বিলিয়ার্ড, তাস ইত্যাদি গৃহমধ্যস্থ খেলার আয়োজন। আর ক্লাবের বাইরে ছিল ব্যাডমিন্টন ও লন-টেনিস খেলার কোর্ট। সর্বোপরি ক্লাবের অভ্যন্তরে মদ্যপানের ব্যবস্থা। তবে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরিও ছিল। সে লাইব্রেরির প্রসাদ আমিও কিছু কিছু পেতাম বাবার সূত্রে।

আমার বাবা কর্মসূত্রে বাবু হলেও কালচিনিতে স্থানীয় ইয়োরোপীয়ান ক্লাবের লাইব্রেরিটি দেখাশুনোর দায়িত্ব ছিল তাঁর। সোমবার সন্ধ্যায় তাই তাঁকেও সেখানে যেতে হত। বাবার সঙ্গে অতি সংকোচে সেখানে শৈশবে গিয়েছি দু-এক বার। মনে আছে ক্লাবের পেছনের সারিতে বসে ‘বেনহুর’ ছবি দেখার কথা।

আমাদের আশপাশের চা-বাগানগুলির ইয়োরোপীয়ান ক্লাবটির অবস্থান ছিল আমাদের বাগান থেকে কিলোমিটার কয়েক দূরে, কালচিনি বাগানের কাছাকাছি বিশাল এক মাঠের পাশে, বেশ নির্জনে। খানিকটা ডানা গজাবার পর সেখানে ভোরবেলায়, ধূ ধূ দুপুরে কিংবা বিষণ্ণ বিকেলে পৌঁছে যাওয়া আমাদের কাছে এক ধরনের অ্যাডভেঞ্চার ছিল। আমার দুই প্রাণের বন্ধু বাবলু ও বিশুর সঙ্গে এক ভোরে সেখানে আমাদের প্রথম অ্যাডভেঞ্চারের স্মৃতি খুব মনে পড়ে।

সেদিন ছিল মহালয়া। আমাদের চা-বাগানের উত্তরসীমা বেয়ে কালচে পিচের রাস্তা আলিপুরদুয়ার থেকে হাসিমারার দিকে চলে গিয়েছে। রাস্তার গা ঘেঁষে পড়ে থাকে অলস রেল লাইন। মিটার গেজ। সারাদিনে অসম থেকে আসে আর যায় দু’ একটা মেল ট্রেন আর আসে-যায় দীর্ঘাতিদীর্ঘ মালগাড়ি। মালগাড়ির মেটে কামরাগুলি দুলতে দুলতে চলে যায়। আমরা  গুনতে থাকতাম… এক… দুই… তিন… চার…। রেললাইনের ওপারেও চা-গাছের সবুজ বিস্তার দিগন্ত ছুঁয়েছে। আকাশের নীল ও মাটির সবুজ একাকার সেখানে। কিন্তু ওপারটা বড্ড নির্জন। ওপারের শেড-ট্রিগুলিও যেন বড্ড বেশি দীর্ঘ আর ঝাঁকড়া… ডালপালাওলা, কালো। কেউ বারণ করেনি, তবু কোনওদিন সাহস করে রেললাইন আমরা পার হইনি এর আগে।

সেই মহালয়ার দিন রেললাইন পেরিয়ে তিনজন চলা শুরু করেছিলাম চা-বাগান ভেদ করে শুয়ে থাকা সরু পথটি ধরে। ঘাস আর মাটিতে মেশা এই রাস্তা, সূর্যোদয়ের সময় শিশিরস্নাত। সবে ভোর হচ্ছে, অতিকায় শিরীষ গাছগুলির ডালপালা, পাতার বাধা ডিঙিয়ে অগুন্তি আলোর ধারা মাটিতে এসে গেঁথে গেছে, যেখানে যেমন সুযোগ পেয়েছে। ধীরে ধীরে আলোর রং পাল্টে যাচ্ছে। পাখিরা এলোমেলো ডাকছে। পৃথিবীর ঘুম ভাঙছে।

Tea Factory
চা-কারখানার চিনের চাল পেরিয়ে দেখা যেত ধূসর সবুজ পাহাড় আর তারপর আকাশ

কোনও বইয়ের পাতায় কিংবা কোনও নির্দেশিকায় তো লেখা নেই, বড়রাও কেউ বলে দেয়নি কিছু, তবু আমরা জানতাম ‘ইয়োরোপীয়ান ক্লাব’ দূর থেকেই দেখতে হয়। যেমন নাকি  সাহেবদের কুঠিতেও হঠাৎ ঢুকে পড়তে নেই। বড়সাহেবের কুঠির কাঠের তৈরি বিরাট গেটটি সর্বদা বন্ধই থাকত। আমরা স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতে পেতাম সাহেবের বিরাটাকার ব্যাঘ্র-সদৃশ সারমেয়টি সবুজ ঘাসের লনে পায়চারি করছে কিংবা সাহেবের দুই কন্যা, যারা কিনা দার্জিলিং কনভেন্টে পড়াশুনো করে, ছুটিতে এসেছে, নেপালি আয়ার তত্ত্বাবধানে ছুটোছুটি করছে বাগানে। এসব দূর থেকে দেখবার দৃশ্য। 

নানা কথায় ও গল্পে আমরা পথ ভাঙছিলাম। বাবলু আর বিশুর গানের গলা ছিল চমৎকার,  বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গলা নকল করে ওরা মহালয়ার স্তোত্র আবৃত্তি করছিল, আর গান গাইছিল। মাইল দেড়েক হাঁটার পর চা-বাগান পাতলা হয়ে এসেছিল। দূরে উঁচু তারের বেড়ার ওপারে ইয়োরোপীয়ান ক্লাবটিও দৃষ্টির সীমায় এসে গেল একসময়। তারের বেড়ার ওপারেও অনেকটা ঘাসের জমি। চালতা গাছ আর কুলগাছের জঙ্গল, তারপর ফাঁকা জমিতে ফণীমনসা, পুটুস আর  ত্রিশিরার ঝোপ। তারপর টেনিসকোর্ট। তারপর দাঁড়িয়ে আছে সবুজ চাল আর সাদা দেওয়ালের ক্লাব-ঘরটি। আমাদের পায়ের শব্দে তিন চারটে পাটকিলে খরগোশ আচমকা লাফিয়ে উঠে পালিয়ে গেল। আমরা তিনজন তারের বেড়ার গায়ে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকি সেই বাড়ির দিকে। 

সে যাইহোক, একটা ক্লাব বাবুদের জন্যেও ছিল। সেটাই ছিল বাঙালিবাবুদের সংস্কৃতিচর্চার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। আমাদের এবং আমাদের পাশের গাঙ্গোটিয়া চা-বাগানের বাবুদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে এই ক্লাব। নাম ছিল ‘ডিমা-গাঙ্গোটিয়া স্টাফ ক্লাব।’ আমাদের বড় হয়ে ওঠার ইতিহাসে এ ক্লাবটি একটি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। চা-বাগানের পত্তনের সঙ্গে সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনীর কথা অজানা নয়, বিশেষত অসমে। মুল্করাজ আনন্দ ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ বইতে এই অত্যাচারের কথা লিখেছেন। তবে যে মাত্রায় অত্যাচার অসমে হয়েছিল, তুলনায় ডুয়ার্সে ততটা হয়নি। স্বাধীনতার পরে চিত্রটা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিল।

স্বাধীনতার পর কিছুটা সরকারি আইন প্রনয়ণের চাপে এবং বাকিটা ব্যবসার স্বার্থে কোম্পানিগুলি অন্তত বুঝতে শিখেছিল যে কাজের বাইরেও কর্মচারীদের বেঁচে থাকতে গেলে অতিরিক্ত কিছু প্রয়োজন। নিদেনপক্ষে বাবুদের জন্য যে এ বিষয়ে কিছুটা ভাবা হত তার একটা নিদর্শন এই স্টাফ ক্লাব। অনেকটা জমি নিয়ে এই ক্লাব। ক্লাব বাড়িটা ছিল দীর্ঘ ও প্রশস্ত। পর্যাপ্ত জানালা-দরজা। ভেতরে কাঠের তৈরি স্টেজ, বেতের অনেক চেয়ার পাতা। নাটক বা অন্য অনুষ্ঠান চলাকালীন গিন্নিরা বসতেন সামনে। ত্রিপলের ওপরে শতরঞ্চি পাতা থাকত। পেছনে বাবুরা চেয়ারে। ক্লাবের সামনে সুন্দর ফুলের বাগান ছিল। সিঁড়ির দু’ধারে চন্দ্রমল্লিকা ফুটত, জ্যোৎস্না রাতে তাদের রূপ খুলত। সে সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন কাজ। দীর্ঘদিন এ ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন বাবা। ক্লাবের পেছনদিকে অনেকটা জমিতে তরিতরকারি ফলাতেন তিনি। একজন মালি কোম্পানি থেকে দেওয়া হত। সবজি ফললে বাবা এক-একদিন এক একজন বাবুর বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন।

Dima Gangotia Tea Estate
চা বাগানকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠত সাহেব আর বাবুদের দুই পৃথক ক্লাব

ডিমা এবং গাঙ্গোটিয়া এই দু’টি বাগানেই সেসব দিনে ভাগ্যক্রমে বেশ কয়েকজন গুণী মানুষের সমাগম হয়েছিল। আমাদের বাগানে, অর্থাৎ ডিমায় সঙ্গীত নিয়ে গভীর চর্চা করতেন অমলকাকু ও করবীদি। কমলা জ্যেঠিমার ছিল অসম্ভব সুরেলা কণ্ঠ। এঁরা ছিলেন আমাদের শ্রদ্ধেয়। ওঁদের পরম্পরা বহন করে আমাদের প্রজন্মে প্রায় প্রতিভার বিস্ফোরণ হয়েছিল। আমার দুই বন্ধু, বাবলু ও বিশুর সঙ্গীতে জন্মগত প্রতিভা ছিল। বাবলু তো গানকে সাধনার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমার আর এক বন্ধু নিতাইয়ের ছিল তবলায় নিপুণ দক্ষতা আর ভোলার ছিল গমগমে আবৃত্তির গলা। আমাদের সহপাঠিনীদের মধ্যেও প্রতিভার অভাব ছিল না। শিখার রবীন্দ্রগানে আমরা মুগ্ধ হতাম। ওর দিদি দীপন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিত। বাবলুর দিদি, যাকে আমরা বুবুদি বলে ডাকতাম, তাঁর তত্ত্বাবধানে নৃত্যকলাতেও অনেকেই বেশ পারদর্শিতা দেখিয়েছিল। আমার বোন মহুয়া ছিল তারমধ্যে একজন। বলাই বাহুল্য এতজনের প্রতিভা প্রকাশের পীঠস্থানটি ছিল আমাদের ক্লাব।

 

আরও পড়ুন: অমিতাভ রায়ের কলমে: জোয়াই পর্ব ১৬

 

এইখানে এসে আলাদা করে একজন মানুষের নাম বলতে হবে, যিনি কৃষ্টি বিষয়ে বিবিধ গুণসম্পন্ন এবং হয়তো বাকিদের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা মানুষ। তাঁর নাম সনৎ চট্টোপাধ্যায়। আমরা তাঁকে ‘বুড়োদা’ বলে ডাকতাম। নানা গুণ এসে মিলেছিল তাঁর মধ্যে। গান শুধু গাইতেন না, রচনা করতেন মৌলিক গান এবং তাতে সুরারোপ করতেন। বাংলায় নয় শুধু, সাদরি ও নেপালি ভাষাতেও। রবীন্দ্রসঙ্গীত সেই কবে তিনি এই দু’টি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর কবিতার হাতও ছিল চমৎকার। ‘উন্মেষ’ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা তিনি দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছিলেন। স্কুলের বাঁধাধরা পড়াশুনোর বাইরে আমাদের মধ্যে যতটুকু সঙ্গীত ও সাহিত্যপ্রীতির উন্মেষ হয়েছিল তাঁর পিছনে এই মানুষটির অবদান ছিল অনেকখানি। তাঁর নির্দেশনায় আমরা রবীন্দ্রগানে, নাটকে, কবিতায়, নৃত্যনাট্যে ২৫শে বৈশাখ উদযাপন করতাম। গানে-কবিতায় বসন্ত বা বর্ষা ঋতুর বন্দনা করতাম। এইসব উৎসবে সাহেবদের শ্রোতা বা দর্শক হিসেবে যোগ দিতে আমরা দেখিনি যেমন, তেমনি শ্রমিকদের লাইন থেকেও কেউ আসত না। তবে ক্লাবের যে সব কাজকর্ম বাবুদের কাজ নয়, তা করার জন্য একজন ছিলেন শ্রমিক-লাইন থেকে। তাঁর পরিচয় ছিল ‘ক্লাব-বয়।’ 

কুলি-লাইনে সামজিক জীবন কী রকম ছিল, সত্যি কথা বলতে, ছোটবেলায় আমরা জানতে পারিনি তেমন করে। কেননা কুলি-লাইনে যাওয়া ছিল আমাদের কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আগে লিখেছি, ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলিতে নেপালি ও মদেশীয়া, এই দুই ধরনের শ্রমিক নিয়োজিত হয়েছিল। মদেশীয়াদের কথা পরে আলাদা করে বলতে হবে, কেননা চা-বাগানে শ্রমিক নিয়োগের গল্প বলবার মতোই ঘটনা। মদেশীয়া ও নেপালী শ্রমিকেরা একই কুলি-লাইনে থাকতেন না। তাঁদের বাসস্থান ছিল পৃথক।

একটা ঘটনা বলি, আমরা তখন বড় হয়েছি। বোধহয় নাইন-টেনে পড়ি। একদিন ফুটবল খেলতে কুলি-লাইনে গিয়েছিলাম এবং বাড়ি ফিরে খুব শাস্তি পেয়েছিলাম। কেন শাস্তি? আমাদের বাবু-বাসা সংলগ্ন একটি খেলার মাঠ ছিল। সেখানেই আমরা গ্রীষ্মে ও বর্ষায় ফুটবল খেলতাম, পুজোর পর বিকেলে খেলা হত ভলিবল, শীতে ক্রিকেট, শীতের রাতে ব্যাডমিন্টন। ক্লাবে ক্যারম, টেবিল-টেনিস ও একটা বিলিয়ার্ড-বোর্ড ছিল। এখন মনে হয় বাবুদের ক্লাবে বিলিয়ার্ড বোর্ড থাকাটা খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। হাজার হোক খেলাটা আরও একটু উচ্চকোটির। মনে হয় এটা কোনও ইংরেজ সাহেবের বদান্যতাতেই প্রাপ্ত। আমরা ছোটবেলায় যেমন লাট্টু ও গুলি খেলেছি, তেমনি এইসব খেলাও মোটামুটি ভালই খেলতে পারতাম। 

যাইহোক, আমরা সেদিন নিজেদের খেলার মাঠ ছেড়ে এবং ‘শ্রেণিমৈত্রী’ ভেঙে কেন যে কুলি লাইনের মাঠে ‘শ্রেণিঐক্য’ প্রদর্শনে প্রয়াসী হয়েছিলাম তার একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ থেকে থাকবে হয়তো। কালচিনি অঞ্চলের চা-বাগানে আমাদের স্মৃতিতে ষাটের দশকে দু’টি রাজনৈতিক দল ও তাদের শ্রমিক সংগঠনের উপস্থিতি আমরা টের পেতাম। কংগ্রেস তো ছিলই। আর ছিল রিভোলিউশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি বা আরএসপি। কংগ্রেস দলের উৎপত্তি ও বিবর্তনের ইতিহাস অনেকেরই জানা। এখানে বরং আরএসপি দল সম্পর্কে দু’এক কথা বলা যেতে পারে।

আরএসপি-র জন্ম ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ। কিন্ত তারও পূর্বের কিছু ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস হল বাংলার বিপ্লববাদের ইতিহাস। বাংলার প্রথম ও প্রধান বিপ্লবী দলটির নাম ছিল ‘অনুশীলন সমিতি।’ ঠিকানা ছিল ৮৯ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট। এ দেশের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের জনক অরবিন্দ ঘোষ বরোদায় থাকাকালীন তাঁর ভাই বারীন ঘোষকে বাংলায় পাঠান। বারীন ঘোষ বাংলার বিভিন্ন জেলায় অনুশীলন সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। সে আমলের বহু বিশিষ্ট বিপ্লবী ছিলেন এই অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত।

ত্রিশের দশকে জেলে থাকাকালীল অনুশীলন সমিতির বেশিরভাগ সদস্য মার্ক্সবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। তাঁদের মধ্যে কিয়দংশ সিপিআই দলে যোগ দিলেও একটা বড় অংশের রুশ-নিয়ন্ত্রিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের রাজনৈতিক নীতি ও রণকৌশলে আস্থা ছিল না। বিশেষত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ অধিবেশনের অতি বাম নীতি তাঁরা সমর্থন করেননি। তবে স্ট্যালিনের বিরোধিতা করলেও তাঁরা ট্রটস্কিকেও সমর্থন করেননি। অনুশীলন সমিতির এই গরিষ্ঠ অংশের মানুষ আরএসপি দলটি গঠন করেছিলেন।

Tea Plantation
চা-বাগানে কংগ্রেস ছাড়া যে দলের আধিপত্য দেখা যেত তার নাম আরএসপি

এই দলের শ্রমিক সংগঠনের নাম ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (ইউ.টি.ইউ.সি)। ইউটিইউসি নিয়ন্ত্রিত ‘ডুয়ার্স চা-বাগান ওয়াকার্স ইউনিয়নে’র বড় রকমের প্রভাব চা-বাগানের শ্রমিকদের উপরে ছিল। ১৯৪৮ এই শাখার জন্মকাল। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন ব্রজেন দাস আর সাধারণ সম্পাদক সুরেশ তালুকদার। আমাদের আশপাশের মাঝেরডাবরি, মথুরা, কোহিনূর চা-বাগানে এঁদের সংগঠনের নাম ডাক খুব শোনা যেত। ষাটের দশকে আমরা নাম শুনতাম এ.এইচ বেস্টারউইচের। ননী ভট্টাচার্যও ছিলেন একজন সম্মানীয় নেতা। আমাদের চা-বাগানটি অবশ্য বরাবরই কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত ছিল।

 

আরও পড়ুন: হিন্দোল ভট্টাচার্যের কলমে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিভাবনা

 

ডুয়ার্সের চা-বাগানে শ্রমিক সংগঠনগুলির উপস্থিতি টের পাওয়া যেত পুজোর আগে বোনাস আন্দোলনের সময়ে। আমার যতদূর মনে হয়, মজুরি সংক্রান্ত দর কষাকষির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের কার্যক্রম। শ্রমিকদের বৃহত্তর রাজনৈতিক-সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়াস তেমন ছিল না। আমাদের বাবু শ্রেণীর ছেলে-মেয়েদের রাজনীতি নিয়ে দু’চার কথা বলার আর শোনার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে গেলে সিপিআই দলটির কোনও অস্তিত্ব ডুয়ার্স অঞ্চলে, বিশেষত কালচিনি এলাকায় দেখিনি। শ্রমিকদের মধ্যে সিপিএম দলের কোনও সাংগঠনিক কাজকর্মও আমাদের এলাকার চা-বাগানে তখন ছিল না। তাদের সংগঠন ছিল মালবাজার অঞ্চলে। তবে আমাদের অঞ্চলে চারিদিকে চা-বাগানে ঘেরা যে গঞ্জটি ছিল, যার নাম হ্যামিল্টনগঞ্জ, সেখানে সিপিএম পার্টির সংগঠন ছিল। আমাদের স্কুলে এই রাজনৈতিক দলগুলির ছাত্রশাখাগুলির দেখা মিলত, স্কুলের দেওয়ালের পোস্টারে, মিছিলে আর স্কুলে ও হ্যামিল্টনের মেলায়।

আমাদের সবথেকে কাছের শহর ছিল আলিপুরদুয়ার। সেটা মূলত কংগ্রেস-প্রধান শহর হলেও বিবদমান আরএসপি ও সিপিএম-এর অস্তিত্বও সেখানে ছিল। তাদের বিবাদের আঁচ আমাদের কালচিনি স্কুলে এসে পড়ত। একবার আলিপুরদুয়ারে আরএসপি নেতা বাদল দত্ত খুন হয়ে গেলে আমাদের ক্লাস থেকে ডেকে রাস্তায় মিছিলে নিয়ে যাওয়া হল। সেই ছিল আমার প্রথম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ।

যাইহোক, আমরা বাবু-বাসার ছেলেমেয়েরা রাজনীতি নিয়ে প্রথম কিছুটা ভাবিত হয়েছিলাম নকশালবাড়ির ঘটনার পর। তার একটা কারণ ছিল এটা, যে এই নতুন রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিল আমাদের চা-বাগানগুলির সিনিয়র কিছু ছেলে। শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়ি  ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কিছু ছাত্র চা-বাগান এলাকায় এসে তাদের প্রভাবিত করেছিল। মোটা দাগে শ্রেণিসংগ্রাম, শ্রেণিহীন সমাজ ইত্যাদি কথাবার্তা তাদের কাছেই প্রথম শুনেছিলাম। আমাদেরও যে শ্রেণী-পরিচয় ছাড়তে হবে, এমন কথা এই দাদাদের কাছে প্রথম শুনলাম। সেই অনুপ্রেরণাতেই কিনা কে জানে, সেবারে লেবার-লাইনে আমাদের খেলতে যাবার উৎসাহ এবং বাড়ির বড়দের তিরস্কারের সম্মুখীন হওয়া।     

*চিত্রঋণ: লেখক
*তথ্যঋণ: 

১.সান্যাল মানিক/ চা-শিল্প ও শ্রমিক আন্দোলন /পশ্চিমবঙ্গ: জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ/পশ্চিমবঙ্গ সরকার/১৪০৮।
২.তিরকি মনোহর / জলপাইগুড়ির আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি/ পশ্চিমবঙ্গ: জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ/পশ্চিমবঙ্গ সরকার/১৪০৮।
৩.চক্রবর্তী সমীর / উত্তরবঙ্গের আদিবাসী চা-শ্রমিকের সমাজ ও সংস্কৃতি/মনীষা/অক্টোবর ১৯৯২।
৪..Bhowmik Sharit / Class formation in Plantation System/People’s Publishing House/1981.
৫. দাশগুপ্ত অপূর্ব / ডুয়ার্সের চা বাগান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি/সমাজ বিজ্ঞান ও প্রকৃতি পরিচয় / দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা,ফেব্রুয়ারি,২০১৫।  
৬.বিষ্ণু সুধীর কুমার/সাদরি: আদিবাসী চা শ্রমিকদের ভাষা/অর্পিতা প্রকাশনী,১ কে রাধানাথ মল্লিক লেন, কলকাতা-১২/১৫ই এপ্রিল,২০১১।

অপূর্ব দাশগুপ্ত 'পুরোগামী' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অবসরপাপ্ত বিশেষ রাজস্ব আধিকারিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com