পর্ব – ৯
হাইঞ্জ পিওন্টেক ( ১৯২৫-২০০৩) একজন জার্মান লেখক এবং কবি। লেখা শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই। কিন্তু তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে আরও পরে, পাঁচ-এর দশকে। তাঁর লেখায় মিশে গেছে পরাবাস্তববাদ এবং অস্তিত্ববাদ। প্রেমের কবিতায় তিনি সিদ্ধহস্ত। আধুনিক জার্মান কবিতা এবং গদ্যে তিনি এক প্রসিদ্ধ নাম। ডয়েশ অকাদেমি থেকে তিনি ১৯৭৬ সালে পেয়েছিলেন জর্জ বাকনার পুরস্কার। (Heinz Piontek)

ভালোবাসার কবিতা
এত ভিড়ের মধ্যেও আমি তোমাকে চিনতে পারি
ঘন বৃষ্টির মধ্যে যেমন বুঝতে পারি কোথাও রোদ পড়ছে
কান্নার মধ্যেও যেমন আমার মনের ভিতর চুপ করে থাকে আদর
শুধু তোমাকে, তোমাকেই, আমি দেখেছি পেঁজা পেঁজা বরফের মধ্যে
হামাগুড়ি দিতে দিতে চলে যেতে
আমি তোমাকে একদিনও কোনও ফুল দিতে পারিনি
বলতে পারিনি– তোমাকে ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি
শুধু তোমার কাছে বিষণ্ণ গলায় বলেছি, – আমাকে একটু বসতে দাও
আমি ক্লান্ত, আমাকে একটু গরম জল দাও
ঠান্ডায় আমার আজীবন কেঁপে উঠছে
আর ওই দিকে যেও না, বরফ পড়ছে
তুমি এসব কিছুই শুনতে রাজি ছিলে না।
শুধু তোমার হাতখানি আমার ঠোঁটের উপর রেখে বলেছিলে– শান্ত হও।
আমাদের যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।
লাল গোলাপ
লাল গোলাপ আমার পছন্দ নয়
পছন্দ নয় বলেই তুমি যে আমায় তা দিতে পারবে না
এমন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না আর
আমি তোমাকে দখল করতে আসিনি
দখল বললেই আমার মনে পড়ে বুটের শব্দ
দখল বলতেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে মৃত্যু
গ্যাস চেম্বারের ভিতর একটুকরো অক্সিজেনের জন্য
শুকিয়ে যায় আমাদের সব প্রেমের কবিতা
লাল গোলাপ আমার পছন্দ নয়
তবু, তোমার কাছে আমি যে যেতে পারব না এমন নয়
বরফের ভিতর খুঁড়ে আমি কি
একটুকরো ঘাসফুল তোমাকে দিতে পারি?

মাংস
এত আগুন তুমি কীভাবে সামলাবে হরিণ?
তোমার পিছনে এগিয়ে আসছে এক ভয়ংকর নেকড়ে বাঘ
আর তোমার প্রেমিকা প্রার্থনা করছে
তুমি যাতে বাড়ি ফিরে আসো।
তোমার ছুটন্ত শরীরের মধ্যে খেলা করছে সোনার বিদ্যুৎ
তোমার চাউনির মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি শিকারের আত্মনিয়ন্ত্রণ
না, তুমি আক্রমণ করতে চাওনি কোনোদিন
কিন্তু নেকড়ে বাঘটি তোমাকে অনুসরণ করেছে এক শতাব্দীকাল
এত আগুন তুমি কীভাবে সামলাবে
কীভাবে প্রেমের কাছে ফিরবে এই পৃথিবী
আমি জানি না।
একটি শিকার অপর একটি শিকারের জন্য
এভাবেই অপেক্ষা করে থাকে
সীমান্ত
বাতাস কানে কানে কী বলছে তা কি তুমি শুনতে পাও?
বাতাস বলে– ওদিকে আগুন, স্যানেটোরিয়াম, কাঁটাতার
বাতাস বলে– ফিরে যাও ফিরে যাও ফিরে যাও
আকাশ কানে কানে কিছুই বলে না
একটি টানটান নীল চাদরের মতো সে শুধু ভালোবাসার কথা বলে
এমন শান্ত
তোমার শরীরে আমার শুয়ে পড়ার কথা ছিল

আপেক্ষিকতা
আমি তো ঈশ্বরের কথা বলতে পারব না
কিন্তু
আমি তোমাকে ভালোবাসি
যখন তুমি আমার কাছে এসে বসো
আমি এক সুগন্ধ পাই
আমি তো ঈশ্বরের কথা বলতে পারব না
শুধু জানি
আমি ভালোবাসি তোমায়
যখন তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাও
আমি এক সুগন্ধ পাই
প্রজন্ম
ভালোবাসার গান লিখব বলে একজন গায়ক
মুক্তি চেয়েছিল
ভালোবাসার গান লিখব বলে একজন গায়ক
বিপ্লবী হয়েছিল
ভালোবাসার গান লিখব বলে একজন গায়ক
সমাধি হয়েছিল
সংলাপ
তোমাক আমি চিনি না, এ কথা বিশ্বাস করি না
ওই ঠোঁট স্তন জঙ্ঘা যোনির ভিতর
তোমাকে আমি চিনি না, এ কথা বিশ্বাস করি না
বিশ্বাস করি না যখন তুমি মুক্ত পাখির মতো আমায়
উড়িয়ে নিয়ে যাও
আর আমি তোমার ডানার মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করতে করতে
বলি
শোনো
দুঃখিত হয়ো না
এ জীবন মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নয়
মৃত্যুও জীবন ছাড়া আর কিছুই ছিল না
তোমাকে আমি চিনি না, এ কথা বিশ্বাস করি না
শীত নামে গ্রীষ্ম নামে বসন্ত নামে
আকাশ ভরে যায় মানুষ পোড়া গন্ধে
আর দ্রুত ছুটে যায় ঘোড়া

প্রেম
যে কোনও প্রেমের কাছে এসে মনে হয় আমি গরিব
গরিব আমার হাত মুখ শরীরে লেগে থাকা মাটি
যে কোনও প্রেমের কাছে এসে মনে হয় আমি যোদ্ধা
আর তুমি
বর্ম হয়ে মিশে আছ আমার শরীরে
করিডোর
শহর কি ভালোবাসার গল্প জানে? জানে তুমি আমাকে প্রতারক বলেছিলে?
জানে, তোমার প্রেমিকের সামনে বসে আমি হাঁটুমুড়ে ভিক্ষা করেছিলাম
একবার, শুধু একবার আমাকে তোমাদের সন্তান করে তোলো।
শহর জানে না। কত ভালোবাসার গল্প বরফের তলায় চাপা পড়ে আছে।
কত বোমার টুকরো বুকে নিয়ে আদর করছি আমি
আর তুমি আমার উপর দিয়ে তৈরি করছ হাইরোড
খাঁচা
স্পর্শ করতে দিলে না, আমি তোমার পাশেই ছিলাম
তোমার গলার শব্দে
আমার বিষাদ মিশে থাকে
একেই কি ভালোবাসা বলে?
শীত, তুমি জানো।
*তথ্যসূত্র:
*ছবি সৌজন্য: Wikidata, Shutterstock, Needpix
পরের পর্ব প্রকাশ পাবে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।