(Post Autumn)
সন্ধ্যে হয়ে এলে হিমের চাদর জড়িয়ে নেয় দিনান্তের আকাশ। কমলা কুসুমের ডিমের মতো নিটোল একখানা সূর্য, ওই আমাদের মাঠের প্রান্তে ডুবে যাবে আর কিছুক্ষণে। এই ডুবে যাওয়া অন্ধকারে ঢেকে যাবে মাঠ, ঘাট, চরাচর। তখন কেবল নৈঃশব্দ আর শিশিরের জল। ঘরে ঘরে মানুষেরা জানবে এখন কার্তিক, এখন হিম পড়বে রাতভোর। শিউলি এখনও ফুটছে। সারা সন্ধ্যে, রাত্তির ফুটে ওঠা গাছখানা যেন তারাভরা আকাশের মতো!
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭]
কী পাগল করা গন্ধ! সকলের তো আর এমন গন্ধ বিলোবার ব্যকুলতা নেই! ভোর ভোর ঝরে পড়বার আর্তিও নেই। খুব আশ্চর্য লাগে ভাবলে, এই পৃথিবীখানা মানুষেরই হাতে গড়া খানিক, কিন্তু মানুষের ঠিক নয় যেন। মানুষের ইচ্ছেয় এই পৃথিবীর খুব কিছু যায় আসে না। তার নিজের একখানা ক্যালেন্ডার আছে, মানুষই বরং অনেক বছরের অধ্যাবসায়ে তাকে খুঁজে পেতে আত্মস্থ করেছে। সেই হিসেবের পুঁজি নিয়েই চলছে মাস আর বছরের ফিরিস্তি। কিন্তু ওই যে বললাম, পৃথিবী এসবের তোয়াক্কা করে কম। (Post Autumn)

একেকদিন সকালে উঠে দেখি, এই মাঠ আর ঘাসজমি শিশিরে জবুথবু হয়ে বসে আছে। এদিক সেদিকে শোলার ফুলের মতো পরব ছাতু ফুটে উঠেছে। এই ফুটে ওঠা ছত্রাকের গায়ে কতই বা শক্তি! তবু কী আশ্চর্য দেখুন! রুক্ষ মাটির চাপড়া উপড়ে ফেলে সে মাথা তুলেছে, নিজেকে প্রকাশ করছে এই শিশির ভেজা ভোরে। এই কোমলতা কী নিবিড় রকম বলিষ্ঠ। অথবা ধরুন, এই ধানের গোছা! কোমল দুগ্ধনিভ রসে পরিপূর্ণ ওর বীজমালা। আর কদিনেই এই কোমলতা কাঠিন্যে পরিণত হবে। আমরা তাকেই বলবো ধান, তাকেই বলবো চাল। (Post Autumn)
নবান্ন থেকে দামোদর মাস হয়ে পম্পা সরোবরে, আমি কেবল নিরবিচ্ছিন্ন ভারতের বা বলা ভালো এই উপমহাদেশের ভিতরে তলিয়ে যাওয়া মনটিকে খুঁজি। আসলে খুঁজি এই কার্তিকের শিশিরে জবুথবু ভোরটিকেই হয়তো।
এই পার্থিব রূপ আর রূপান্তরের প্রতি মুগ্ধতা কি কেবল মানুষের? সেই কি কেবল কার্তিকের ভোরে শিশির কুড়োয়? নবান্নের জোগাড় করে? পার্বণের মধ্যে এক ধরণের স্নেহ সঞ্চিত আছে এই প্রকৃতির জন্য। সে বড় সুন্দর। আমার ঠাকুমা শিখিয়েছিলেন, কেমন করে শিশির ভেজা ঘাসের উপর নরম কাপড় পেতে শিশির কুড়োতে হয়। কেমন করে বাঁশের পাতায় জমে থাকা জল সংগ্রহ করতে হয়। ভাইফোঁটার দিনে সেই জল দিয়ে আমি দাদাদের কপাল মুছিয়ে দিতাম। (Post Autumn)

এ তো গেল ব্যক্তিগত কথা, সে কথা থাক। বরং নবান্নের ভোরে, নল সংক্রান্তির দিনে মানুষ আসলে কার কাছে ফিরে যায়? ফার্টিলিটি কাল্টের কোন আদি প্রতিমাকে সে খুঁজে ফেরে, এই দেশ গাঁয়ের লোকাচারে? সেই প্রত্নপ্রতিমায় কি জড়িয়ে থাকে আকাশপ্রদীপের আলো! অনেক বছর আগে দক্ষিণ ভারতের একদল মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এই কার্তিকের মাসে। তারা শৈব। তারা এক মাস নানা সংযম পালনের শেষে পম্পা সরোবরে যাবেন স্নান করতে। এই কদিন আগে, ঝড়খালির একদল মানুষের সঙ্গে দেখা হলো, তারাও এই একমাস সংযমের শেষে নামগান আর মহোৎসবে মাতবেন, – সেও এই দামোদর মাসেই। (Post Autumn)

নবান্ন থেকে দামোদর মাস হয়ে পম্পা সরোবরে, আমি কেবল নিরবিচ্ছিন্ন ভারতের বা বলা ভালো এই উপমহাদেশের ভিতরে তলিয়ে যাওয়া মনটিকে খুঁজি। আসলে খুঁজি এই কার্তিকের শিশিরে জবুথবু ভোরটিকেই হয়তো।
কৃষি আর আদিম পৃথিবীর গল্পে কেমন করে ও জড়িয়ে উঠেছে, সেসব ভেবে ভেবে উড়িষ্যার ঘরে ঘরে হবিষা ডালমা রাঁধবেন কেউ কেউ। গাড়ুর ডাল পেরিয়ে এসে, এই আরেক ধরণের ডালে আমার মন তখন থিতু হতে চায়। আমি টের পাই, এই রান্নাঘর দিয়ে দেশজ একখানা ক্যালেণ্ডার বুনে দিতে পারে এই জবুথবু পড়ে থাকা শিশিরের ভোর। এই রোদ্দুর মেঘ আর পৃথিবীর গল্পে মানুষেরও তো কিছু কিছু ভূমিকা আছে। (Post Autumn)

সেই কবে নাকি মানুষেরা ভেবেছিলেন, যে গোপদের জীবনে গিরি গোবর্ধনের এত ভূমিকা, তাকে একভাবে পুজো করা উচিত। ইন্দ্রপুজোর বদলে একখানা পাহাড়ের কাছে পূজার অর্ঘ্য সাজিয়ে রাখলেন গোপেরা। কূপিত ইন্দ্র ঝড় বাদলে বিধ্বস্ত করে দিতে চাইলেন তাঁদের জীবন। অথচ আহিরদের সেই দামাল ছেলে তাদের উদ্ধার করলেন ইন্দ্রের রোষানল থেকে। একে রূপকথা বলতে চাইলে বলুন তাই, উপকথা বলতে চাইলে বলুন তাই…সে আপনার ইচ্ছে। (Post Autumn)
আমি কেবল অন্নকূট উৎসবে গিরি গোবর্ধনের মতো করে সাজানো একখানা ভাতের পাহাড় দেখে দেখে ভাবি, কী আশ্চর্য করে মানুষ নৈবেদ্য সাজায়! আকাশ প্রদীপের আলো আর অন্নকূটের সজ্জা মিলেমিশে যাচ্ছে কার্তিকের দিনে। শিশির জলে কপাল ধুয়ে দিতে দিতে আমি কেবলই ভাবছি, আস্ত একখানা কার্তিকের পৃথিবী মানুষে মানচিত্রে এঁকে দিচ্ছে আপার্থিব একখানা মানচিত্র। এই রান্নাঘর, ধানক্ষেত আর শিশিরের জলে আঁকা। আসলে অপার্থিব নয়, কার্টোগ্রাফাররা সকলেই ভারী পার্থিব। (Post Autumn)

বুড়ো শসা দিয়ে চিংড়ির ঝোল
উপকরণ : বুড়ো হয়ে গেছে এমন শসা, চিংড়ি মাছ, নারকেল, সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা, নুন, মিষ্টি। আমি দুই একটি শ্যাম দেশীয় বেসিল পাতা দিয়েছি, কিন্তু তা না দিলেও ক্ষতি নেই।
পদ্ধতি : চিংড়ি মাছ কুটে বেছে নুন মাখিয়ে রাখুন। শসার খোসা ফেলে, ভিতরের বীজ ফেলে ছোট ছোট করে কেটে নিন। নারিকেল কুরিয়ে বেটে গরম জলে দিয়ে, অল্প পরিমাণে নারিকেলের দুধ বের করে রাখুন। আর খানিকটা নারকেল কোরা তুলে রাখুন শেষে ব্যবহারের জন্য।

কড়াই বসিয়ে তেল দিয়ে চিংড়িগুলো সাঁতলে নিন। ওই কড়াইয়েই আল্প তেল দিয়ে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে শসাগুলো ছেড়ে দিন। অল্প নেড়েচেড়ে নুন দিয়ে সামান্য জল দিয়ে, সেদ্ধ হতে দিন। সেদ্ধ হয়ে এলে নারকেলের দুধ এবং চিংড়ি মাছ দিন। সামান্য মিষ্টি দিতে পারেন স্বাদ বুঝে। অল্প চেরা কাঁচালঙ্কা দিন। অন্য একটি পাত্রে অল্প করে তুলে রাখা নারকেল কোরা ভেজে ওপর থেকে ছড়িয়ে দিন। বাগানের এক কোণায় পড়ে থাকা বুড়ো শসা দিয়েও একটি সুন্দর সাদাসিধা রান্না করা গেলে মন্দ লাগে না। (Post Autumn)
জলপাইয়ের হাতে মাখা আচার
উপকরণ : পাকা জলপাই, নুন, চিনি, কাঁচা এবং পাকা লঙ্কা আর সর্ষের তেল।

পদ্ধতি : জলপাইগুলি ভালো করে পাকিয়ে নিন। বেশ নরম ভাব এসে গেলে জলে দিয়ে সেদ্ধ করে নিন। সেদ্ধ জলপাই হাত দিয়ে খুব মসৃণ করে মেখে নিন। ওর মধ্যে নুন, বেশ ভালো মতো চিনি (জলপাইয়ের টক বুঝে) এবং কাঁচা-পাকা লঙ্কা দিয়ে ভালো করে মেখে নিন। এরপরে সর্ষের তেল দিয়ে মেশান। এই পুরো মাখাটি একটি কাঁচের পাত্রে ভরে মুখ বন্ধ করে সকাল থেকে দুপুর রোদে বসিয়ে রাখুন। এক রোদেই সুন্দর স্বাদ হয়। ভাতের শেষ পাতে বা কার্তিকের নরম রোদের দুপুরে জলপাই সেদ্ধ অপূর্ব। এই মাখা আচারটি সংরক্ষণের জন্য নয়। দিনের দিনই খেয়ে নিন। (Post Autumn)
ছবি সৌজন্য: লেখক, Tripura Star News, Wikimedia Commons, shutterstock
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
