শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্র (Post monsoon) এসে পড়েছে। একেকদিন সকালে দরজা খুলে দাঁড়ালে মনে হয় শরতের (Post monsoon) রোদ্দুর এসে পড়েছে ওই পদ্মের বনে। নরম সবুজ পাতায় আকাশের ছায়া মেঘের ছায়া আর সকালের ছায়া যেন মায়া দিয়ে বোনা। কিন্তু এই কি সব! এমন অনাবৃষ্টির (Post monsoon) দিনে ঘরে ঘরে ভাদ্রলক্ষ্মীর ডাক কি পৌঁছোবে না! তিল ধুবড়ির পাশটিতে আলপনার মতো পুষ্পপত্র, সে কি কেবল নিয়মরক্ষায় ব্যাকুল! মাঠে মাঠে সবে ধান রোয়া ফুরলো কেবল। ধানের গোছা পুরুষ্টু হচ্ছে। শামুকখোল আর মদনটাক সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায় কীসের আশায় কে জানে!

জল না থাকলে কি জীবনের অবশিষ্ট কিছু থাকে? এ পাড়ার মেয়েরা বুড়িরা ঘুনি পেতে মাছ ধরবে, মাঠে মাঠে চিতি কাঁকড়া ধরবে তবে না বর্ষা! চাষনালায় জল আসছে বটে কিন্তু সে জলে আকাশের ছায়া পড়ে না। তার স্রোত ভারী শিথিল। মালিনী নদীর মতো তাতে আকাশের ছায়া মেঘের ছায়া দেখবে বলে মানুষের সেই কতদিনের পিত্যেশ! সেসব হা পিত্যেশের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে জলে ডোবা গ্রাম। অসহায় ভাষাহীন চোখ। সে চোখের দিকে তাকালে ভাতের গ্রাস মুখে ওঠে না মানুষের।
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩]
নদীকে বাঁধতে বাঁধতে মানুষ কি নিজেকেই বেঁধেছে কেবল! কোন সে অখিল ক্ষুধায় নিজেকে হারিয়ে ফেলার যাপন এসব! এই সমস্তের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে মানুষ এখনও বাজারে হাটে আলু চাল পেঁয়াজের দরদাম করে। এমন কাদা-জলের দিনে খানিক রসুন না খেলে শরীরের জল কি মরে! অথচ রসুনের দর শুনলে কলিজায় ছ্যাঁকা লাগে। ঊনকুঁজো মানুষেরা তাই অনেক দরদস্তুর পেরিয়ে বেছে বেছে আলু কেনে, মরিচ কেনে। বাজার ফিরতি মানুষের মুখে এ কোন বিষাদ! সময়ের দরবারে ভাদ্রের আকাশ তাই গো হারা, হেরে বসে আছে জবুথবু।
তবু, মানুষ তো জানেই, ওর কোনো দোষ নেই। ও তো নদীকে বাঁধেনি, ও একখানা আকাশ কেবল। অনেক উপর থেকে মানুষকে দেখছে। মানুষের পৃথিবীকে দেখছে আসলে। সেই যে নদীর পাড়ে পাড়ে শরের গোছা, তিলা মুনিয়ার ভিড়! আরেকটু নেমে গেলেই জমা জলের জঙ্গল। সে জঙ্গলে হোগলার ফুল ফুটেছে। কী তার রঙ! কেউ কেউ সেসব তুলে নিয়ে গিয়ে দুধে জ্বাল দিয়ে খাবে, বাচ্চাদের বাটি ভরে খাওয়াবে।

আর ওই যে গরু চরানে ছেলে! ওর বাগালি ঘুচে যাওয়ার আগে ও বসে বসে দেখবে চাষনালার পাশে পাশে আদাড়ে বাদাড়ে কী অপূর্ব কচুর ফুল ফুটে আলো হয়ে আছে ভাদ্রের সকাল দুপুর। একেবারে হাতে তুলে নিলে, ওর মিঠে গন্ধে মৌতাত লাগে। এ যেন সেই কবেকার কোন উপকথার বাগানের গন্ধ। ভারী মৃদু অথচ কী অপার্থিব! এসব বসে বসে দেখলে কি আর বাগালের পোষায়! চাষের মাঠে এখন যেতে মানা, মাঠে মাঠে ধান। ছেলেটা তাই বনে বাদাড়ে আলোছায়ার পিছে পিছে ফেরে।
মানুষের রান্নাঘর এসব ভেবে দেখে না বোধহয়। ভেবে দেখার সময় কোথায় তার! অথচ ভাবলে সে টের পেতো, ঊষার গন্ধ লেগে আছে ওর বঁটিতে, আঙুলে। সে গন্ধ ভারী নাজুক। মানুষের ইন্দ্রিয় তাকে ছুঁতে পারে না সহজে। ডুমুর পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়ে রান্নাঘরের বারান্দায়। সে আলোয় বসে বসে কথামানবীরা ডুমুর কুটে নিচ্ছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য বীজ। ওরা মাটিতে মিশে যাবে আর কিছুক্ষণে। ভাদ্রের আকাশ এসব দেখবে। দেখছে, সেই কবে থেকেই।
ওর ঘর পড়ে থাকে গাঁয়ের ওপারে, সে ঘরে পায়রার হাঁড়ি ঝুলছে, ঝুলছে ফাওড়া, ঝুড়ি, মাছধরার ঘুনি। কী করবে বলুন ও! ভাদ্রের আকাশ দেখে দেখে দেখে ওর আশ মেটে না, তবু – বাগালি করে ও কি ভাদ্রলক্ষ্মীর আটনটি খুঁজে পায়! জীবন তো আর ব্রতকথার আলপনা নয়, জীবনের দায় বোঝা ভার। পদ্মের পাঁপড়ির মতো সে কেবল নিজেকে মেলে ধরতে চাইছে প্রতিদিন। সে হোক না বাগাল। হোক না হাঁস চড়ানি মেয়ে! বা ইস্কুল মাষ্টার! ছেঁড়া ছাতা আর রাজছত্রকে ভাদ্রের আকাশ কি ডাকেনি? ডাকে না?
এসব ভেবে ভেবে রোদ্দুরে ধান মেলে দিই একেকদিন। তোরঙ্গ থেকে কাঁথা, বালিশ, আলোয়ান। ভোর ভোর ধানক্ষেতের হাওয়ায় শিরশিরিয়ে ওঠে গা। শিশির ভিজিয়ে দেয় ঘাস। গোড়ালি ডুবিয়ে মাঠ পেরিয়ে ওই শালের জঙ্গলে যারা হারিয়ে যায়, তারা পোয়াল ছাতু পায় জানি। আর পায় ভোরকে। মানুষের পাওয়া কি কম? এই তো আর কদিনেই দুর্গাছাতু উঠবে। ঊষাকাল এখনও বিরল নয় তবু। মানুষেরা সেই ঊষাকে ছুঁয়ে থাকবে বলেই জঙ্গলে মাঠে ঘুরে ঘুরে ঝুড়ি বোঝাই করে পার্থিব বিলাসে।

মানুষের রান্নাঘর এসব ভেবে দেখে না বোধহয়। ভেবে দেখার সময় কোথায় তার! অথচ ভাবলে সে টের পেতো, ঊষার গন্ধ লেগে আছে ওর বঁটিতে, আঙুলে। সে গন্ধ ভারী নাজুক। মানুষের ইন্দ্রিয় তাকে ছুঁতে পারে না সহজে। ডুমুর পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়ে রান্নাঘরের বারান্দায়। সে আলোয় বসে বসে কথামানবীরা ডুমুর কুটে নিচ্ছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য বীজ। ওরা মাটিতে মিশে যাবে আর কিছুক্ষণে। ভাদ্রের আকাশ এসব দেখবে। দেখছে, সেই কবে থেকেই।
কচুফুল বাটা
উপকরণ – কচু ফুল ৫/৬টি, নুন, হলুদ, সর্ষের তেল, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচালঙ্কা, চিংড়ি (খুব সামান্য), কালোজিরে এবং লেবুর রস/তেঁতুল (নাও দিতে পারেন)।

পদ্ধতি – এখন চারদিকেই কচুর ফুল ফুটেছে। তুলেও আনতে পারেন, বাজারে পাওয়া গেলে তাও কিনে আনতে পারেন। ভালো করে ধুয়ে নিয়ে কচুফুলের হলুদ পাঁপড়ির গোড়া থেকে কেটে ভিতরের দণ্ডটি ফেলে দিন। এটিতেই বেশি গলা চুলকায়। এবারে, হলুদ পাঁপড়িটি কুচিয়ে নিন। কড়াইতে নুন হলুদ দিয়ে জল গরম করুন। ফুটন্ত জলে কচুর ফুল ভাপিয়ে নিন এবং জল ঝরিয়ে নিন। আবার কড়াই বসান, অল্প তেল দিন। তেল গরম হলে দু-চারটে কাঁচালঙ্কা কুচিয়ে দিন, চার পাঁচ কোয়া রসুন দিন। সুন্দর গন্ধ বেরোলে একটি ছোট পেঁয়াজ কুচিয়ে দিন।

অল্প ভাজা হলে দু চারটি চিংড়ি মাছ দিন। অল্প নুন, হলুদ দিয়ে একটু কষিয়ে এবারে ভাপিয়ে রাখা কচুর ফুল দিন। পুরোটা বেশ ভালো করে ভাজা ভাজা হয়ে গেলে সামান্য তেঁতুল বা লেবুর রস এবং দু-চার দানা চিনি দিন। এটি চাইলে নাও দিতে পারেন কিন্তু অনেক সময় কচুর ফুলে গলা ধরে, তাই দেন অনেকেই। এই পুরো মিশ্রণটি ঠাণ্ডা হয়ে গেলে শিলে বেটে নিন। আবার কড়াই বসান, অল্প তেলে কালোজিরে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে কচু ফুল বাটার মিশ্রণটি বেশ ভাজা ভাজা করে নিন। গরম ভাতের সঙ্গে এমন ভাদ্র দিনে ভারী উপাদেয় এই রান্না।
ডুমুরের ঘণ্ট
ডুমুরের ঘণ্ট
উপকরণ : ডুমুর এক মুঠো, একটা আলু, নারকেল কোরা, জিরে, তেজপাতা ১টা ছোটো, শুকনো লঙ্কা বা কাঁচালঙ্কা, ছোটো এলাচ ১টা, সর্ষের তেল, নুন, হলুদ, সামান্য চিনি আর খুব অল্প ঘি।

পদ্ধতি: ডুমুর গুলো ভালো করে কেটে, বীজ পরিষ্কার করে নুন হলুদের জলে ভিজিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। এরপরে অল্প নুন দিয়ে ডুমুর ভাপিয়ে নিন এবং জল ঝরিয়ে নিন। আলু চচ্চড়ির মতো কেটে অল্প ভেজে তুলে নিন। কড়াইয়ে অল্প তেল গরম করে জিরে, লঙ্কা, তেজপাতা ও এলাচ ফোড়ন দিন। ফোড়নের সুগন্ধ বের হলে ডুমুর এবং আলু দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিন। একে একে নুন হলুদ জিরেবাটা দিন। ভালো করে কষানো হয়ে গেলে গরম জল দিয়ে ঢাকা দিন।

সব কিছু বেশ ভালো মতো সেদ্ধ হয়ে গেলে ঢাকা খুলে আঁচ বাড়ান এবং নারকেল কোরা দিয়ে বেশ ভালো করে নাড়াচাড়া করে অতিরিক্ত জল শুকিয়ে নিন। অল্প ভেজা ভাব থাকবে। নামানোর আগে ঘি, সামান্য চিনি এবং কাঁচালঙ্কা দিন। আঁচ নিভিয়ে কিছুক্ষণ ঢাকা দিয়ে রাখুন। সব গন্ধ মিলেমিশে গেলে পাত্রে ঢেলে নিন। ভাতের পাতে পরিবেশন করুন এই ঘণ্ট। একই সঙ্গে উপাদেয় এবং উপকারী।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Bing.com
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।