Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বাণীমাসিমার পৌষপার্বণ

গোপা দত্ত ভৌমিক

আগস্ট ২৩, ২০২১

Poush Parban in Bengali Household
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

বিয়ের পর অনেকগুলো বছর কেটেছিল উত্তর কলকাতায়সেখানে আমার কর্তার তখনকার কর্মক্ষেত্র বসু বিজ্ঞান মন্দিরের কাছাকাছি একটি ভাড়ার ফ্ল্যাট ছিল। বেশ কেটেছিল ওই ফ্ল্যাটে, বাড়িওয়ালা ব্যানার্জিবাবুর স্ত্রী বাণীমাসিমার সস্নেহ তদারকিতে। তিনি ভাড়াটে পরিবারগুলিকে নিজের পরিবারের শাখাপ্রশাখা মনে করতেন। আজকাল কন্ট্র্যাক্টে ভাড়ার যুগে সেসব আর ভাবা যাবে না। 

বাণীমাসিমারা সবাই বাঁকুড়ার লোক। আমার বিয়ের কয়েকমাস পরেই বাণীমাসিমার মেয়ে নূপুরের বিয়ে লাগল আর আমরা ভাড়াটে পরিবারগুলির সবাই তিনচারদিন ধরে ছাদে বাঁধা ম্যারাপে দেশ থেকে আসা ওঁদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করলাম। মনে হচ্ছিল, আমি যেন ওই বাড়িরই বৌ– তত্ত্ব সাজানোতেও আমাকে ডেকে নেওয়া হল। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপনা করি আমি, এটি বাণীমাসিমারও বিশেষ গর্বের ব্যাপার ছিল।

এহেন বাণীমাসিমা প্রতিবছর পৌষপার্বণের দিনটি সবাইকে ভূরিভোজ করিয়ে পালন করতেন। তিনি একে বলতেন পিঠে হাতকরা। বাড়ির গৃহিনী পিঠে হাতকরলে তবেই সংসারে লক্ষী অচলা হন, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। পৌষপার্বণের এত জমকালো চেহারা আমি বাপের বাড়িতে দেখিনি। সাধারণতঃ সেখানে পাটিসাপটা আর সরুচাকলি হত, সঙ্গে নতুন ওঠা নলেন গুড়ের পায়েস। বাণীমাসিমা কিন্তু প্রায় চারপাঁচ রকমের পিঠে বানিয়ে ফেলতেন। সেইসব লোভনীয় সম্ভারের মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দ ছিল ভাপা পিঠে। এই পিঠেও আবার দু’রকমের- ক্ষীরের পুর আর নারকোলের পুর। যাতে মিশে না যায়, তাই দু’রকমের আকৃতি করা হত। যেগুলোর পেটে ক্ষীর ভরা, তাদের আকার অনেকটা চারপাপড়ির ফুলের মতো। আর নারকোলের পুর দেওয়া পিঠেগুলো পটলের মতো। 

Bhapa Pitha
জলের ভাপে তৈরি ভাপা পিঠে। ভেতরে নারকেলের পুর

হাঁড়িতে টগবগ করে জল ফুটত। হাঁড়ির মুখে একটা ন্যাকড়া বেঁধে পিঠেগুলো রেখে ঢাকা ডেওয়া হতো। পদ্ধতিটা তিব্বতী খাবার মোমোর সঙ্গে মেলে। এছাড়া চোষির পায়েস, পুলির পায়েস ইত্যাদি বানাতেন তিনি। তাঁর সৎদৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে কলেজ থেকে ফিরে, মকরসংক্রান্তির সন্ধ্যেবেলা আমিও পাটিসাপটা বানাতে নেমে পড়তাম। কিন্তু পিঠে তো শুধু বানিয়ে নিজেরা খেয়ে ফ্রিজে জমিয়ে রাখার জন্য নয়সবাইকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে হবে! তবে তো পার্বণ। ঈশ্বরগুপ্তের পৌষপার্বণ নিয়ে লেখা মজার কবিতা বাণীমাসিমাকে শুনিয়েছিলাম। পিঠেপুলি পেটে যেন ছিটেগুলি ফোটে’ শুনে খুব হেসেছিলেন তিনিসেই সঙ্গে দুঃখ করতেন, আজকাল মেয়েবৌরা পিঠেহাতকরাতে গুরুত্ব দেয় না। ক্রিসমাসে কেক বানানোর ধুমই বেশি।

Bhapa Puli Pithe
ক্ষীরের পুর দেওয়া ভাপা পিঠের আকার হত পটলের মতো

পিঠে বানিয়েই বাণীমাসিমা সেদিন নিরস্ত হতেন না। অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার খেয়ে সকলের মুখ মেরে যাবে। তার জন্য বিশল্যকরণী হিসেবে বানানো হত মটরশুঁটির সবুজ আভাযুক্ত কচুরি আর গোলমরিচ দেওয়া ঝালঝাল নিরামিষ আলুরদম। স্বভাবতই কচুরিতে অল্প একটু হিংয়ের আমেজ থাকত। সন্ধ্যেবেলা চারঘর ভাড়াটের কাছে ঢাকা দেওয়া থালা পৌঁছত- পিঠে পায়েসের মাধুর্য্য আর কচুরি আলুরদমের লাবণ্যশোভিত হয়ে। লাবণ্য শব্দটি ভয়ে ভয়ে ব্যবহার করলাম, নোনতা স্বাদযুক্ত বোঝাতে। সেদিন রাতে ভাত, ডাল, মাছের ঝোলের পাট নেই।

অবধারিতভাবে মনে পড়ত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপূর্ব গল্প পুঁইমাচা। অকালমৃত বাড়ির বড় মেয়েটির স্মৃতি কীভাবে ঝাঁপিয়ে ফিরে আসছে পৌষপার্বণের দিন, মা আর ছোট বোনেদের মনে। বিভূতিভূষণের লেখা বাণীমাসিমাও খুব ভালোবাসতেন। কীভাবে যে তিনি মাসিমা থেকে আমার মাতৃপদের দাবিদার হয়ে উঠেছেন, তা বুঝলাম কয়েকবছর পর। এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের চিকিৎসাসূত্রে আমার কর্তা তখন মুম্বইতে কয়েকমাস ধরে রয়েছেন। ইতিমধ্যে আর এক বৃদ্ধ আত্মীয়ের শ্রাদ্ধ উপলক্ষে আমাকে কয়েকদিনের জন্য কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছিল। দীর্ঘ সফর ছাড়াও সেই বাড়িতে নানা অপ্রীতিকর ও অপমানসূচক দুর্ব্যবহারের ফলে শরীরে মনে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে সন্ধ্যেবেলা তালা খুলে বাড়ি ঢুকছি, দেখি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছেন বাণীমাসিমা।
কী চেহারা হয়েছে তোমার! সারাদিন খাওয়া হয়নি বোধহয়।

এরপর আর কথা চলে না। রাতে তাঁর কাছে খেতে বসলাম। নিজেরা রুটি খান, আমি বাঙাল মানুষ তাই ভাত রান্না করে রেখেছেন। মাছের অপূর্ব একটা সর্ষে ঝাল ছিল। ওঁরা বাঁকুড়ার লোক, আলুপোস্ত তো থাকবেই। আমার বাঙাল অভ্যেসে শেষপাতে ডাল খাওয়া নিয়ে ঠাট্টা করলেনকয়েকদিনের গ্লানি, দুঃখ যেন কর্পূর হয়ে উবে গেল তাঁর আদরমাখানো আপ্যায়নে।

Chushi Pithe
সূক্ষ্ম চোষি পিঠে। এগুলি দিয়ে তৈরি হয় চোষির পায়েস

কালের নিয়মে সে বাড়ি ছেড়ে কবেই চলে এসেছি। তবে যাতায়াত ছিল বহুবছর। পৌষপার্বণের দিন একটা ফোন আসবেই মাসিমার। আজ পিঠে হাত করলাম, তোমাদের কথা বড্ড মনে পড়ছে গো। কিন্তু লক্ষী তাঁকে রক্ষা করলেন কই? একমাত্র উপযুক্ত ছেলে নীল অকালে চলে গেল দুরারোগ্য অসুখে। বৌমা চলে গেলেন বাড়ি ছেড়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। স্বামীর মৃত্যুর পর খুব একা হয়ে গেলেন বাণীমাসিমা। তারপর তো চলেও গেলেন একদিন। তাঁদের সেই বাড়ি ভেঙে এখন বহুতল নির্মাণ চলছেশরিকরা নিজের নিজের অংশ বুঝে নিচ্ছে।

বিষয়ী, অভিজ্ঞ অনেকে ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবার জন্য আমাদের ধিক্কার দেন, নাকি আমরাও একটা ফ্ল্যাট পেয়ে যেতাম। তাঁদের বোঝাতে যাইনি যে ফ্ল্যাটের থেকে অনেক বেশি দামি জিনিস ওঁদের কাছে পেয়েছি। অর্থমূল্যে তার হিসেব হয় না। মকরসংক্রান্তি এলেই বাণীমাসিমার কথা মনে পড়েতাঁকে আর জানানোর উপায় নেই যে আমিও এখন ভাপাপিঠে করতে শিখেছি। কিন্তু সেই সুঘ্রাণ আসে না।   

 

*ছবি সৌজন্য: News18, Youtube, Euphorhea

চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

Picture of গোপা দত্ত ভৌমিক

গোপা দত্ত ভৌমিক

চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
Picture of গোপা দত্ত ভৌমিক

গোপা দত্ত ভৌমিক

চাকরিজীবনের শুরুতে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান হয়ে অবসরগ্রহণ করেন। গৌড় বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। গল্প ও প্রবন্ধ লিখছেন কয়েক দশক। নারী ও সমাজ বিষয়ে ওঁর প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস