(Premendra Mitra)
নিজের কোনও রচনাতেই সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতেন না, বরং মনে করতেন আরও দেওয়ার আছে। কল্লোল যুগের প্রতিভাবান গল্প লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজের সৃষ্টি নিয়ে এমনই নির্মোহ ছিলেন। সহজেই নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরেছেন। কবি, গল্পকার, চলচ্চিত্রের কাহিনিকার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর কলম মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছে। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে তাঁর মতো এমন প্রতিভাবান সাহিত্যিকরাই বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনকে পুষ্ট করেছিল। নিজেকে কল্লোল যুগের গল্প লেখক বললেও কল্লোলযুগের কবি বলতেন না।
১৯০৪ সালে ৪ঠা সেপ্টেম্বর বারাণসীতে জন্ম প্রেমেন্দ্র মিত্রর। পৈতৃক নিবাস দক্ষিণ ২৪ পরগনার বৈকুণ্ঠপুর। কোন্নগরের সম্ভ্রান্ত মিত্র পরিবারের সন্তান। বাবা জ্ঞানেন্দ্র নাথ মিত্র ছিলেন রেল কর্মচারী। মা সুহাসিনী দেবী। বাবার চাকরির সুবাদে নানা জায়গায় ঘুরতে হত তাঁদের। তবে ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে উত্তরপ্রদেশে ঠাকুমা-দাদুর কাছেই বড় হয়ে ওঠেন। যদিও পরে বাবার সঙ্গে কলকাতা ও ঢাকা শহরে জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছেন। সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। ১৯২০ সালে সাউথ সাব-আরবান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর স্কটিশ চার্চ কলেজে বিএ পড়ার জন্য ভর্তি হন।
ভিডিও: বাংলা কথাসাহিত্যের হীরে-‘মানিক’ – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। কিন্তু মন বসেনি। পড়াতে নয়, পড়তে বেশি ভালবাসতেন। পরবর্তীকালে একটি ঔষধ কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগেও কাজ করেছেন। সেখানেও মন টেকেনি। অবশেষে ঠাঁই হয় কলমে। ১৯২৩ সালে কলকাতার গোবিন্দ লেনের একটা মেসে থাকতে শুরু করেন। সেই সময় দু’টো গল্প লিখে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী পত্রিকায়। ১৯২৪ সালে প্রবাসী পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়, “শুধু কেরানী”। প্রবাসীর পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হয় অন্য গল্পটি, ‘গোপনচারিনী’। প্রথম জীবনে কৃত্তিবাস ভদ্র ছদ্মনামে লিখতেন। (Premendra Mitra)
ছোটগল্প রচনার মাধ্যমে সাহিত্যে হাতেখড়ি হলেও তিনি বিচরণ করেছেন সাহিত্যের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই। সম্পর্কের ভাঙা-গড়া, মানুষের মনের জটিলতা, মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের কষ্ট, জীবনের অনিবার্য ব্যর্থতা অনন্য ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন। পাঠক আস্বাদন করেছে সেইসব সাহিত্যের স্বাদ। তবে শুধু সামাজিক সাহিত্য নয়, প্রথম বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর কলম সৃষ্টি করেছিল বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, উপন্যাস। তাঁর প্রথম কল্প বিজ্ঞান রচনা ছিল পিঁপড়ে-পুরাণ। ‘কুহক এর দেশে’ গল্পে তাঁর কল্পবিজ্ঞান ও রহস্য কাহিনির নায়ক মামাবাবুর আত্মপ্রকাশ। তবে চরিত্রটি পাঠকমহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ১৯৪৮ সালে ‘ড্রাগনের নিঃশ্বাসে’ কাহিনির মাধ্যমে। (Premendra Mitra)
ভিডিও: মুক্তারামের রামকথা – জন্মদিনে শিবরাম
অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। নিজেকে বলতেন আমি ইতরের কবি। প্রথমা, ফেরারি ফৌজ, সাগর থেকে ফেরা তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। ছোটদের জন্যেও লিখেছেন। ময়ূরপঙ্খী, মকরমুখী, মিষ্টি মেঘ তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য শিশু সাহিত্য। যুদ্ধ কেন থামল, আকাশের আতঙ্ক, শুক্রে যারা গিয়েছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য কল্পবিজ্ঞান সৃষ্টি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের কলম সৃষ্টি করেছে বহু অমর চরিত্র। যেমন মামা বাবু, ঘনাদা, পরাশর বর্মা, মেজোকর্তা। তাঁর বহু রচনা চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। যেমন সমাধান, বিদেশিনী, সেতু। (Premendra Mitra)
নিজেকে কল্লোলের গল্প লেখক বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। গল্প কেন লেখেন তার আশ্চর্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন “প্রায় ছেলেবেলায় গোর্কির একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম, তাতে গল্প রচনার নানা কারণ-এর মধ্যে দু’টোর কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছিল, একটা হল নিজেকে জাহির করা, মোরগ যেমনভাবে ভোরবেলায় গলা লম্বা করে রংচঙে পাখন-পালক হাঁকিয়ে উঁচু কণ্ঠের ডাকে নিজেকে জাহির করে। এছাড়া আর এক জাতির লেখক আছেন, যাঁরা নিজের সঙ্গে কথা বলেন, নিজের সঙ্গে মানে নিজের মধ্যে সমস্ত মানুষের, সমস্ত জীবনের এক আশ্চর্য প্রতিনিধির সঙ্গে। সরল অকপটভাবে তাঁকে শোনান জীবনের বৃত্তান্ত। তাঁদের সেই স্বগতোক্তি থেকেই মহৎ সাহিত্যের সৃষ্টি হয়।” এই বিশ্বাস ফুটে উঠেছে তাঁর সাহিত্যেও। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রাখায় বিশ্বাস করতেন। জীবনবোধে পরিপূর্ণ ছিল তাঁর সাহিত্য। (Premendra Mitra)
সৃষ্টির জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৫৪ সালে পেয়েছিলেন শরৎস্মৃতি পুরস্কার। ১৯৫৭ সালের ‘সাগর থেকে ফেরা’ এই সৃষ্টির জন্য পেয়েছিলেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে। আনন্দ পুরস্কার পান ১৯৭৩ সালে। ১৯৮৮ সালে দেশিকোত্তম পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় তাঁকে। স্ত্রী বীণা মিত্র ছিলেন সিটি কলেজের বাংলার অধ্যাপিকা। স্বামীর সাহিত্যচর্চায় আমৃত্যু পাশে থেকেছেন। ১৯৮৮ সালের, ৩রা মে সাহিত্যের এই জাদুকলম থেমে যায়। আজ তাঁর জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। (Premendra Mitra)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।