আমার এমন এক বন্ধু আছে যার মৃত্যুদিন আছে। আমার এখন এক বন্ধু আছে যে আত্মহত্যা করেছিল, অকস্মাৎ। সুইসাইড নোট বিহীন অদ্ভুত অভিমানী একটা মৃত্যুদিন আছে আমার এক বন্ধুর। আমিও এক সময় এক নাগাড়ে দু তিন ঘন্টা মৃত্যুর কথা চিন্তা করে গেছি। আমায় আত্মহত্যাচিন্তা থেকে মুক্ত করেছে আমার এক বন্ধু। এক বন্ধু আমায় হত্যা করেছে। এক বন্ধু আমার মৃত্যুর পর বুকে পাম্প করে ফিরিয়ে এনেছে জীবন, ছিনিয়ে এনেছে জীবন,- আমার অরফিউস। আমি আমার সেইসকল বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং আমি তাদের আভূমি প্রণাম জানিয়ে এই লেখার সূচনা করছি। (Prose)
৫ই অক্টোবর হাঁ করে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। যেন তার জল বাতাসা চাই। আমি গা করিনি, ডাকিনি তাকে অন্তর হতে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে ৫ই অক্টোবর যখন চলে গেল, খেয়াল হল সুতপার কথা। সুতপাকে আমরা মরে যেতে দিয়েছি তিন বছর হল, এবছর আমরা তার মৃত্যুদিন ভুলে গেলাম।

শুনেছি, মরে যাওয়ার আগে সে নিজের মুখ দেখতে চেয়েছিল, তাকে আয়না দেওয়া হয়েছিল তাই। নিজেকে দেখার পর সে আয়না ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। আজ তার ডাকনাম আমাদের আর মনে নেই। সুতপার গল্পের সার্থকতা এখানেই।
কুয়াশা জমে থাকে তার বাড়ির গলিতে। গলির মুখ থেকে আমি চকিতে পালাই। আমি পালাই গলি থেকে দূরে। একদিন আমি গলিটা ভুলে যাবো, এই অভিপ্রায়ে দূরে আরও দূরে পালাই। কুয়াশারা ঘন হয় সুতপার গলিতে।
সুতপার মা দূর থেকে দেখে আমায় যেই ডাকতে যাবেন–
সুতপার মায়ের আর মনে নেই তার বন্ধুদের ডাকনাম, নামডাক।
আমরা অন্য মেয়েদের দেখি আর আমাদের সুতপার মুখ মনে পড়ে। অন্য অন্য মেয়েদের মুখে আয়না হতে সুতপা অনুপ্রবেশ করে আছে।
আংরেজ বিবির অসম্পূর্ণ উপাখ্যান : সাদিক হোসেন
দুহাজার দুই সালে শচীন তেন্ডুলকরের পোস্টারের দাম নিয়েছিল সে দশ টাকা। দুহাজার চব্বিশে সে গলায় এসিড ঢেলেছিল। না কি গলায় দড়ি, না কি গায়ে আগুন, না কি ঘুমের ওষুধ, না কি স্কুল তাকে বকাসুর বলে জানতো, স্কুল পিছু হঠে যায় একদিন, নামটা পিছু ছাড়ে না। বকাসুরের এক ছেলে এখন ঘোরে পাড়াময়। তাকে তার স্কুল কী নামে চেনে জানা নেই।

বকাসুরের মুখ ভরে ছিল কৃষ্ণ কালো জড়ুল। তাদের সে বিভিন্ন নামে ডাকতো। বকাসুরের বৃহৎ উদর ক্লাস সেভেনের হাইবেঞ্চ ছুঁয়ে শঙ্কিত কম্পমান, মায়া দি পড়া ধরছেন। মায়া দি বাড়ির কাজ না পেয়ে বকাসুরের খাতা এরপর ছুঁড়ে ফেলে দেবেন দরজা দিয়ে। ক্লাসরুম হাসতে হাসতে বকাসুরের বৃহৎ দেহকে সশ্রু দরজা দিয়ে বাইরে খাতার পিছনে অপসৃয়মান দেখবে ক্লাসের শেষে। একদিন বকাসুরের স্কুলের পোশাকে পিরিয়ডের রক্ত লেগে যাবে, তাকে কেউ এগিয়ে দেবে না স্যানিটারি ন্যাপকিন। ক্ষুদ্র স্কুলব্যাগ দিয়ে নিজের বৃহৎ পশ্চাদ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে বকাসুর স্কুল থেকে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাবে। রাস্তায় ক্লাসমেটরা— ওই দেখ বকাসুর যাচ্ছে, ওই দেখ জামায় রক্ত–
দুহাজার চব্বিশে বকাসুর কবজিতে ব্লেড, দু হাজার চব্বিশে বকাসুরের কোনো সুইসাইড নোট নেই। সে ভুলে গেছে বাড়ির কাজ করে আনতে, সে ভুলে গেছে সুইসাইড নোট লিখে যাওয়ার কথা। বকাসুরের ছেলে ফ্যা ফ্যা করে পাড়া ঘুরছে। তাকে ডেকে ডেথ সার্টিফিকেটে বকাসুরের আসল নাম লেখা ছিল কি না– একথা এখনই জিজ্ঞেস করতে মন চায়।
বকাসুরের মৃত্যুসংবাদ বন্ধুদের কাছে এসে উপস্থিত হলে তাকে চিনতে অস্বীকার করে প্রত্যেকে। জানা যায়, বকাসুর মুখের জড়ুল মুছেছিল অস্ত্রোপচার করে। জানা যায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সে নিজের বৃহৎ দেহকে বাগ মানিয়েছিল। জানা যায় তার একখানি ছেলের কথা। এসব নানাবিধ কারণে বন্ধুরা তাকে চিনতে চায় না।
বকাসুরের অপরিচিত মৃত্যুসংবাদ বসে থেকে থেকে ফিরে যায়, জামায় তার রক্ত লেগে আছে।

আমার অরফিউস আমায় হত্যা করেছিল বছর দশ আগে। তারপর সে আমার শবদেহ কাঁধে করে গেছে ইন্দ্রের দরবারে, গেছে প্রজাপতি ব্রহ্মার নিকট। আমার নেতিয়ে পড়া শরীর সে নিয়ে গেছে ন্যাশানাল মেডিকেলে। সেখানকার অর্ধমৃত রোগীরা আমায় সাদরে গ্রহণ করেছে। আমার অরফিউস আমায় নামিয়ে রেখে গেছে জল আনতে, ওষুধ আনতে। আমার মুখে দুফোঁটা জল দিয়ে সে আবার আমার বুকে ছুরি গেঁথেছে। অরফিউস মনস্থির করতে পারেনি আমায় নিয়ে কী করা উচিত, আমায় কী করা অনুচিত। অরফিউস নরক থেকে আমায় টেনে তুলে এনে আবার আমায় নরকে ঠেলে দিয়েছে। তার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কেবল আমার সমস্ত গল্পগুলি মৃতমানুষের মুখে বলা গল্প হয়ে উঠেছে, আমার সমস্ত কথা মৃত মানুষের মনের কথা।
ফেরা, উৎসে : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
মৃত মানুষের চোখ দিয়ে আমি এখন লাল মুনিয়া দেখি, লাল মুনিয়ার বাসা যে মেয়ে, তাকে দূর থেকে অরফিউসের মতো দেখায়। আমি সরে আসি বেদনায়, আমি সরে আসি ভীরুতায়। তাকে কাছ থেকে যে আমার মতোই দেখতে একথা জানা হয় না কখনো। সুতপাও আমাদেরই মতো দেখতে হয়েছে মরার পর, অস্ত্রোপচারের পর বকাসুরকেও আমাদের মতো দেখাচ্ছে। আমার সব বন্ধুর মুখ সমান। আমার সব বন্ধুর স্পর্শ এক। তড়িৎ। ঘুমের মতো। ঘুমের সময় আমরা সবাই স্মরণ করি সেভেন বি। খাতা উড়তে উড়তে বেরিয়ে যাচ্ছে মায়া দির ক্লাসের দরজা দিয়ে। খাতা উড়তে উড়তে মগডালে গিয়ে বসছে। খাতা খুঁটে খুঁটে পালক সাজাচ্ছে। খাতা লাল মুনিয়া। উড়ে উড়ে কাশফুল ছিঁড়ে বানাচ্ছে বাসা। কাশবনে সেই বাসার খোঁজে হারিয়ে যাচ্ছে আমার সব বন্ধুরা, ত্রিশের ঘরে তাদের প্রত্যেকের বয়স। তারা প্রত্যেকে সুতপার মুখ। তাদের সেসব মুখে ঘন কালো জড়ুল। তাদের সবার জামায় এখনো তেইশ বছর আগের রক্ত লেগে আছে।
অলংকরণ – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
অলোকপর্ণার জন্ম ১৯৯০ সালে, কলকাতায়। উত্তর ২৪ পরগণার নববারাকপুরে স্কুলজীবন ও বেড়ে ওঠা। কলকাতা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে কখনো ব্যাঙ্গালোর কখনো কলকাতায় বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। লেখালেখির সূত্রপাত কৈশোরে হলেও, ২০১০ থেকে তা শখ নয়,- আসক্তিতে পরিণত হয়েছে।
এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত বই- ঝিঁঝিরা (২০১৫), হাওয়াশহরের উপকথা (২০১৮), দাস্তানগো (২০১৯), রণ বিশ্বাস কারো নাম নয় (২০১৯), যাহা বলিব সত্য বলিব (২০২২), সবুজ অন্ধ করেছে (২০২৩)।