রবুদার (Pt. Ravishankar) রসবোধের যে কী অসাধারণ সেন্স! বলি আর একটা ঘটনা। ব্রেকফাস্ট করছি আমরা চারজন। নানান টুকিটাকি রসিকতা, হাসিঠাট্টা চলছে। হঠাৎ রবুদা বললেন খুব নীচু স্বরে— “ইন্দ্রাণী আমি তো ওয়ার্ল্ড ট্যুর-এ যাচ্ছি। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?”
অবাক হয়ে বললাম— “আমি? কী করে?”
—“কেন, আমার সঙ্গে তানপুরা ছাড়বে।”
—“কিন্তু ও তো ছুটি পাবে না।”
নীচু স্বরে মুখ নামিয়ে রবুদা বললেন—“আমি কি বলেছি শংকর যাবে?”
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
রবুদা (Pt. Ravishankar) টাইগার হিল আর সূর্যোদয় দেখতে চেয়েছিলেন। পরের দিন ভোররাতে আমরা জিপে রওনা দিই টাইগার হিলের দিকে। উফফ্! কী ঠান্ডা! আমি বরাবরই ভীষণ শীতকাতুরে। সোয়েটার, কোট পরেও হিহি করে কাঁপছি। রবুদা আমার কাণ্ড দেখে মুচকি হেসে গান ধরলেন, “যাবই আমি যাবই, বাণিজ্যেতে যাবই…” গাইতে গাইতে হাত নেড়ে আমাকে ইশারা করলেন। আমি সব ভুলে গলা মেলালাম…“লক্ষ্মী রে হারাবো যদি অলক্ষ্মীরে পাবই…”

পৌঁছে গেলাম টাইগার হিলের ভিউ পয়েন্টে। ওরে বাব্বা! এত সকালে এখানে এত ভিড়! সাহেব, মেমরা সব গায়ে মোটা মোটা কম্বল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা একটা খাঁজে গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ বদলাতে শুরু করল। টকটকে লাল রং, তারপর আস্তে আস্তে রুপো গলানো ঝকমকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়ো। টকটকে লাল সূর্য বলে আমায় দেখো। চকচকে রুপো গলানো পাহাড়চুড়ো বলে আমায় দেখো। আমি আস্তে আস্তে চোখ সরিয়ে দেখলাম, গ্রিক দেবতার মতো পণ্ডিত রবিশংকর দু’হাত জড়ো করে নিমীলিত নেত্রে স্থির হয়ে আছেন। মনে পড়ল রবিঠাকুরের গান… “উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে, ঐ যে তিনি ঐ যে বাহির পথে…” পাহাড়চূড়োর দিকে তাকিয়ে গুণগুণ গেয়ে উঠলাম।
এরপর আমরা গেলাম লেবং রেসকোর্সের দিকে। নর্থপয়েন্ট স্কুল এবং তার কাছাকাছি রোপওয়ে। রোপওয়ের সামনে অনেক পর্যটক— বেশিরভাগই বাঙালি। আমরা যখন চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছি, তারাও দেখি আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখছেন। জিপে উঠেছি কী উঠিনি, হঠাৎ এক ভদ্রলোক, কোলে বাচ্চা, জিজ্ঞাসা করলেন, “স্যর আপনি কী করেন?” রবুদা কৌতুক করে বললেন, “এই একটু সেতার-টেতার বাজাই।”
—“ও-ও-ও- আপনি রবিশংকর?”
গাড়ি স্টার্ট দিল। যেতে যেতে দেখলাম এক হাতে বাচ্চা-কোলে ভদ্রলোক আর এক হাত ক্রমাগত কপালে আর বুকে ছুঁইয়ে যাচ্ছেন। রবুদা চলতি জিপ থেকে হাসতে হাসতে দু’হাত জড়ো করলেন ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে। দেখলাম পুরো ভিড়টা দৌড়চ্ছে আমাদের জিপের দিকে। (Pt. Ravishankar)

ফিরতি পথে তিব্বতী বৌদ্ধ মন্দির দেখলাম। রবুদার আবদারে শান্তনু আমাদের টয়ট্রেন দেখাতে নিয়ে গেল। রবুদা একদম বাচ্চা ছেলের মতো হাততালি দিয়ে উঠলেন।
ঘটনার তো শেষ নেই, কত যে স্মৃতি ভিড় করে আসছে।
রবুদাকে মালিশ করার জন্য হোটেলে একজন মালিশওয়ালা ঠিক করে দিয়েছিল শান্তনু। রবুদার খাটের পাশে তাঁর সেতার রাখা থাকত। কমলাদি একদিন গজগজ করতে করতে এসে বললেন, “জানো ইন্দ্রাণী, শংকরলাল, এই তোমাদের রবুদাকে নিয়ে পারা যায় না।” আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। শংকর হেসে বলল, “কেন? কী হল?” —“আরে ওই মালিশওয়ালা। সমানে রবুকে মালিশ করছে, চটাচট গায়ে চাপড় মারছে আর বলছে— আপ সিতার বাজাতে হ্যায়?”
—থোড়া বহুত।
—বাজাইয়ে, অচ্ছিতরা বাজাইয়ে। আপ রবিশংকরজী কে নাম শুনা হ্যায়?
—হ্যাঁ, শুনা হ্যায়।
—আরে বহুত ফেমাস হ্যায়। সিতার বাজাতে হ্যায়। উনকা নাম সারে দুনিয়ামে সব জানতে হ্যায়। বহুত কামাতে হ্যায়। আপ বড়িয়া সে প্র্যাকটিস কিজিয়ে। আপভি কামায়েঙ্গে…।
রবুদা চোখ বন্ধ করে হাসছেন। কিছুই বলছেন না।
কমলাদি বললেন, “আর আমি থাকতে পারলাম না। বললাম, আরে এহি সাব রবিশংকরজী হ্যায়। ক্যা বাকোয়াস কর রহে হো!”
তৎক্ষণাৎ মালিশওয়ালা রবুদার পা জড়িয়ে ধরেছে।

দেখতে দেখতে ফেরার দিন এসে গেল। সকালবেলা আমরা ফেরার তোড়জোড় করছি। কমলাদি এসে আমায় ডেকে নিয়ে গেলেন। আমরা লনে একজায়গায় বসলাম। কমলাদি চুপ করে মাথা নিচু করে আমার পাশে বসে নীরবে চোখের জল ফেলছেন। আমি তো কথা খুব কম বলি। আস্তে ওঁর হাতটা ধরলাম। অমনি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন সুন্দরী, লম্বা, ঝাড়া বাঁশপাতার মতো সুঠামদেহী কৃষ্ণাঙ্গী কমলাদি।
— “ইন্দ্রাণী, আঠেরো বছরের পর আর কাউকে বদলানো যায় না। তুমিও কখনও চেষ্টা কোরো না শংকরকে বদলাতে…” আমি হতভম্ব, বিভ্রান্ত। —“কখনও বাইরের লোকের সামনে তোমার কাছের মানুষের সমালোচনা কোরো না…।” ভাবলাম, আমি তো কিছু করিনি।
—“তুমি খুব ছোট, ভারী মিষ্টি।” আমি বললাম—“কী হয়েছে কমলাদি? মনখারাপ কেন? আমাদের তো আবার দেখা হবে।”
—হাউ হাউ করে মুখ ঢাকলেন চল্লিশ, বিয়াল্লিশোর্ধ্ব এই কিশোরী।
—“রবুর একটা মেয়ে হয়েছে। খবর এল এখুনি ন্যু ইয়র্ক থেকে…”
আমি কী করব, কার মেয়ে হল কিছুই বুঝতে পারছি না।
—“ও সন্তান চায় আমাকে বলতে পারত।”

আমি নির্বাক বিস্ময়ে দেখলাম আমার এতদিনের দেখা ঝলমলে চল্লিশোর্ধ্ব কিশোরী কীভাবে আস্তে আস্তে চোখের জলে ভেঙে ভেঙে, ভেঙে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
যা হোক, বাগডোগরা থেকে প্লেন ধরে আমরা রওয়ানা হলাম দমদমের দিকে। সারা রাস্তা রবুদা আর আমি ‘দেশ’ গেয়ে কাটিয়ে দিলাম। কলকাতা পৌঁছে রবুদা আড়ালে ডেকে বললেন, “শংকর তোমাকে একটা সুখবর দিই। কিন্তু কাউকে এখনই বলবে না, লিখবেও না। …স্যু জোনস-এর একটা মেয়ে হয়েছে। ন্যু ইয়র্ক থেকে আজ খবর এসেছে। মেয়ের নাম দিয়েছি ‘জীবন’।”
রবুদাকে ভীষণ খুশি খুশি লাগছিল। আর সদ্য কৈশোর পার হওয়া আমি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছিলাম না।
—“আবার দেখা হবে ইন্দ্রাণী”—একমাথা ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে নব্যপিতার গর্বিত পায়ে চলে গেলেন পণ্ডিত রবিশংকর—বিশ্বখ্যাত সেতারী।
জীবনের নাম নোরা জোনস্। বিখ্যাত গ্র্যামি-প্রাপক সংগীত ব্যক্তিত্ব।
(চলবে)
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
One Response
অসাধারণ! যেমন অসাধারণ আপনার লেখা, তেমনই কত অজানা কথাকে সুন্দর করে তুলে ধরা! সত্যিই অসাধারণ! আপনি লিখে যেতে থাকুন প্লিজ! লেখা থামাবেন না!!