রবুদা পর্ব চলতেই থাকবে। উনি আমার অণুতে-পরমাণুতে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন। এত আদরের আর এত মহার্ঘ্য স্মৃতি (Memories) চট্ করে কি ভোলা যায়? আর ভুলতে কে বা চায়! আমি তো নয়ই। বরং পরম আদরে, সংগোপনে প্রতিটা মুহূর্ত প্রতিদিন আরও সজীব হয়ে আমার দুঃখে সিঞ্চন করে। আমি ঝলমল করে আবার কুড়ি বছরের তরুণী হয়ে যাই। এই তো আমার জীয়নকাঠি। এইরকম কত শত স্মৃতি নিয়ে আমার প্রতিদিনের গাথা। কবির ভাষায় গেয়ে উঠি… “প্রতিদিন তব গাথা গাব আমি সুমধুর”… এই স্মৃতিরাই আমার ঈশ্বর। আমি নিত্য তাদের পুজো করি; স্মরণ করি।

ওই দেখো আবার আমি রবুদার স্মৃতিতে চলে গেলাম।
এখন অবশ্য অন্যরকম আলোচনা। সেও স্মৃতিই, কারণ আমি যে তরণী বাইতে শুরু করেছি সে তো শুধু স্মৃতি দিয়েই গড়া। সামনে পুজো। সেই পুজোর স্মৃতির কথাই বলি এবার।
পুজোর স্মৃতি, বিশেষত ছোটবেলার— সবার কাছেই আনন্দের। আমার ছোটবেলা তো সেই ৪৫-৫০ বছর আগের কথা। তখন কেমন ছিল পুজো? আচ্ছা বলি।
আমরা ছিলাম চার ভাইবোন। আর মাসতুতো ভাইবোনেরা তিনজন। ওরা আর আমরা যে আলাদা পরিবার, আলাদা রক্ত, আলাদা গোত্র অনেক পরে বুঝেছিলাম। আমরা জানতাম আমরা সাত ভাইবোন। দুটো মা, দুটো বাবা। একটা মা বোঝার সুবিধার জন্য মাসিমা ডাকি। আর একটা বাবা যাতে গুলিয়ে না যায়, তাই মেসোমশাই বলি। দুটো বাড়ি/ দুটো হাঁড়ি/ যখন যেখানে খুশি সেখানেই ভোজন সারি।
বাঃ, বেশ ছন্দ মিলে গেল। হ্যাঁ এরকমই ছিলাম আমরা। খুব ভাব/ আবার আড়ি/ কিন্তু সেটা খুব বেশি হলেও মিনিট কুড়ি।
এই রে আজ তো আমায় ছড়ায় পেয়েছে। ছোটবেলার কথা বলতে গেলেই ছোট্ট হয়ে যাই। আমরা সেভেন মাসকেটিয়ার্স সব জায়গাতে একসঙ্গেই যেতাম।

দাদু, বাবা পুলিশে। মেসোমশাই ইনকাম ট্যাক্সে। সুতরাং সমাজের প্রায় সর্বত্র আমাদের অবাধ, নিঃসঙ্কোচ গতিবিধি ছিল। আমরা একসঙ্গে সিনেমা, যাত্রা, থিয়েটার দেখতাম, বিরতির সময় উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে পছন্দমতো চা, কফি এবং তৎসহ নানারকম স্ন্যাক্স ট্রে-বন্দি হয়ে চলে আসত। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করতাম, এসব শুধু আমরাই পাচ্ছি। বাকিরা নয়। কেন, সেটা অনেক পরে বুঝেছি। প্রশ্ন করলে মেসোমশাই নস্যি নিতে নিতে বলত, ‘খেয়ে নে। আর কিছু লাগলে বলিস।’

পুজোর কেনাকাটা ছিল বেশ মজার ব্যাপার। সবার জন্য একরকম প্রিন্ট কাপড় কিনে দর্জির দোকানে দেওয়া হত। মেয়েদের ফ্রক। ছেলেদের শার্ট। সব একরকম। ছেলেদের অবশ্য প্যান্টের কাপড় অন্যরকম। এবার পুজোর সময় সেভেন মাসকেটিয়ার্স দল বেঁধে যখন ঘুরতাম, ঠাকুর দেখার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজনের কাছে আমরাও বেশ দর্শনীয় হয়ে উঠতাম।
আমাদের বোনেদের সব সিঙ্গল কাট চুল, একরকম রিবন দিয়ে একই স্টাইলে বাঁধা। মেয়েরা একইরকম ব্যালেরিনা জুতো আর ছেলেরা সব ফিতে বাঁধা শু। মোজা সব ভাইবোনের একইরকম।
আমরা সব পিঠোপিঠি ভাইবোন। আমি আর আমার মাসতুতো বোন তিন মাসের ছোট-বড়। আমরাই সবার বড়। আমার ছোটবোন সাতজনের শেষজন। সে আমাদের থেকে প্রায় দশ বছর পরে পৃথিবীতে এসে একটা ফুলুস্টপ্ মেরে দিল।

দত্ত ব্রাদার্সে গিয়ে আমরা বোনেরা একইরকম কানের দুল, গলার হার, চুলের রিবন, হাতের আংটি, পায়ের তোড়া, নেলপলিশ— হাতের একরকম কালার, আর পায়ের আর একরকম শেড কিনতাম। ওই সময়টা আমাদের বিরাট স্বাধীনতা। স্কুল ছুটি, পড়াশোনা লাটে। সবরকম দায়িত্ব থেকে রেহাই। শুধু খেলা, গান শোনা, গান গাওয়া। প্রচুর মারামারি, ঝগড়া, আবার ভাব। রেডিওতে অনুরোধের আসর, নাটক, সংগীত শিক্ষার আসর, সব সবকিছু অ্যালাউড। উফফ্। পুজো আসছে। কী যে আনন্দ। ঠাকুর দেখতে যেতাম রাত বারোটার পর। দুটো অ্যাম্বাসাডর ভর্তি করে বেরোতাম আমরা। সারারাত পেরিয়ে ভোরবেলা ঝিমোতে ঝিমোতে বাড়ি এসে ঘুম। সময়টা তো শিউলি ফুলের। বাড়ি ফেরার সময় ফুটপাতে প্রচুর শিউলি ফুল পড়ে থাকতে দেখতাম। এখন তো গাছও দেখি না, ফুলও বেপাত্তা। কে জানে সেই গাছগুলো কোথায় গেল!

এমনিতেই ভোরবেলা ওঠা অভ্যাস আমার। বাবার সঙ্গে বিবেকানন্দ পার্ক হয়ে লেকে দৌড়তে যেতাম। ফেরার সময় শিউলি ফুল বেতের ঝুড়িভর্তি করে নিয়ে আসতাম। মালা গেঁথে দেওয়ালে টাঙানো ঠাকুরের ফ্রেমে পরিয়ে দিতাম। কী যে সুগন্ধ ছড়াত সারা বাড়িতে, এখনও স্মৃতিতে লেগে আছে সেই ঘ্রাণ।
পুজোর গন্ধের সঙ্গে শিউলির গন্ধ এক হয়ে আছে। এখন কি সেই ঘ্রাণ পাই? কই না তো? পুজো তো এসে গেল। কোথায় আমার শিউলি বৃক্ষরা? শুঁয়োপোকা হয় বলে সব কেটে দিয়েছে। তাই প্রজাপতিরাও অদৃশ্য। কেউ বলতে পারো, কোথায় পাব তারে? আমি যাব। শিউলি গাছের তলায় পড়ে থাকা শিউলি কুড়বো। আমার শাড়ির আঁচল ওই রঙে হলুদ হয়ে যাবে। কিন্তু ছোটবেলার পুজোর সেই মহার্ঘ্য ঘ্রাণ, সেটা তো ফিরে পাব! (Pujo Memories)
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
One Response
বাহ! খুব সুন্দর, স্বচ্ছন্দ এবং সাবলীল লেখা! খুব সুন্দর লাগলো। আপনার সঙ্গে সঙ্গে আমারও সেই ছোটবেলার সুগন্ধি পুজোর দিনগুলো মনে পড়ে গেলো। আমিও সেই নস্টালজিয়া তে একই সঙ্গে ভাসলাম!!