(Rabindra Jayanti)
উত্তর কলকাতা, নাকি মধ্য কলকাতা? কলেজস্ট্রিট অঞ্চলটাকে উত্তর না মধ্য কলকাতার মধ্যে ফেলব, বুঝে উঠতে পারি না। কলেজস্ট্রিট সংলগ্ন কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিটের সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ মেচুবাজার অঞ্চলের ওপরেই আমার মামারবাড়ি। শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে মামারবাড়িতে। সুতরাং টান থাকা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়! (Rabindra Jayanti)
একটু উষ্ণতার জন্য: অরিজিৎ মৈত্র
ছোটবেলায় মামারবাড়ি যাওয়ার বিষয়টা ছিল আমার কাছে সবথেকে বড় বিলাসিতা। গরম এবং শীতের ছুটিতে কলকাতার বাইরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার থেকেও আমার কাছে বড় আকর্ষণ ছিল কেশব সেন স্ট্রিটে মামারবাড়িতে যাওয়া। আরও একটা বড় আকর্ষণ ছিল মার হাত ধরে ২বি বাসের দোতলায় চড়ে ২৫শে বৈশাখ মামারবাড়ি যাওয়া। (Rabindra Jayanti)

সেখানে প্রসস্ত ছাদের এক ধারে আমার প্ৰিয় কবির প্রতিকৃতির সামনে দিদার হাতে দেওয়া একটা বড় আলপনা। ঠিক যেমনটি শান্তিনিকেতনের মন্দিরে দেখা যায় আর রবীন্দ্রপ্রতিকৃতিতে রজনীগন্ধা, বেলি আর জুঁই ফুলের গোড়ে মালা। শুচিশুভ্রতার সঙ্গে পবিত্রতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটত, যা এখনও ঘটে। কবির প্রতিকৃতিটি আমাদের এক আত্মীয় এবং বিখ্যাত কমারশিয়াল আর্টিস্ট রঘুনাথ গোস্বামীর হাতে আঁকা। ১৯৪১ সালে কবির প্রয়াণের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪২ সাল থেকেই আমার মাতামহ অমিয় বাগচী রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালন করা শুরু করেন। (Rabindra Jayanti)

দাদু ছিলেন রবীন্দ্রঅনুরাগী, আত্মীয় ও চিত্রকর সুধীর খাস্তগীরের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দাদুর সাক্ষাৎ হয় বার দু’য়েক, একবার শান্তিনিকেতনে আর একবার কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। রবীন্দ্রনাটক রক্তকরবীর যান্ত্রিক নামকরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করে দাদু চিঠি লিখলে শান্তিনিকেতন থেকে কবি তার উত্তর দেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে মার হাত ধরে দাদু অনুরোধ করে যান যে কবির জন্মোৎসবের অনুষ্ঠান যেন কোনওদিন বন্ধ না হয়। তাঁর অনুরোধকে মান্যতা দিয়ে আজও আমাদের প্রয়াস অব্যাহত। (Rabindra Jayanti)

কোনও বছরই ছেদ পড়েনি এই আয়োজনে। দাদুর তৈরি করা রীতি মেনে আজও অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের আপ্পায়ন করা হয় তরমুজের শরবত আর মিষ্টির মাধ্যমে। সমগ্র অনুষ্ঠানের মধ্যেও রয়ে গেছে কিছু বিশেষত্ব। শঙ্খধনি আর ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ সমবেত গানের মাধ্যমে ২৫ বৈশাখের সন্ধ্যায় রবীন্দ্রপূজার সূচনা হয়। ‘জন্মদিন’ আর ‘২৫ বৈশাখ’ কবিতা দুটি পাঠ করা অবশ্যক। আজও মায়ের গলায় শোনা, ‘সেই চলতি আসনের ওপর বসে কোন কারিগর গাঁতছে নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা’ লাইনটি কানে বাজে। (Rabindra Jayanti)

এই বয়েসেও একটি দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকি সারা বছর। মাঝে মাঝে আমার কন্যাকে কৌতুক করে বলি, ‘জানিস এটাই আমাদের দূর্গাপুজো’। দাদু তো কবেই চলে গেছে, এরপর কালের অমোঘ নিয়মে দিদাও বিদায় নিয়েছে। তারপর মা আর মামা বয়ে নিয়ে গেছে সেই ধারা। মাঝে জীবনে এসেছিল নতুন অতিথি। সেও কবির জন্মদিন পালনে অংশ নিল তারপর আজ আমি ও আমার কন্যা, মামা, মামী, মামাতো বোন ধরে রেখেছি সেই ঐতিহ্যর রাস। (Rabindra Jayanti)

দাদু অমিয় বাগচী ছিলেন কবি-গীতিকার আর তাঁর মামাতো বোন নীলিমা সান্যাল ছিলেন আকাশবাণীর জনপ্রিয় সংবাদপাঠিকা। তাঁদের দু’জনের বন্ধুতালিকায় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, সুপ্রীতি ঘোষ, সবিতাব্রত দত্ত, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃণাল চক্রবর্তী, বিকাশ রায় প্রমুখ। তাঁদের মধ্যেও অনেকেই এসেছেন এই অনুষ্ঠানে। পরবর্তীকালে আমি দেখেছি ধীরেন বসু, মৃণাল চক্রবর্তী, শুভাপ্রশন্ন, পল্লব কীর্তনিয়া, অলোক রায়চৌধুরী, পঙ্কজ সাহা প্রমুখ শিল্পীদের এই অনুষ্ঠানে আসতে। (Rabindra Jayanti)

যাঁরা এসেছেন বা এখনও আসেন, তাঁরা আন্তরিকভাবেই আসেন কারণ আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও পারিশ্রমিক দেওয়ার রীতি নেই। পুরোনো কলকাতার বনেদি বাড়ির দূর্গাপুজোর কথা শুনেছি এবং দেখেওছি কিন্ত কোনও বনেদি বাড়িতে ৮৩ বছর ধরে নীরবচ্ছিন্নভাবে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের কথা আমার অন্তত জানা নেই! এই অবকাশে জানিয়ে রাখি যে কবি স্বয়ং আমার মামারবাড়ি ৪৭ নম্বর কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিটের বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছিলেন। তিনি প্রপীতামহ ড. কালিকৃষ্ণ বাগচীকে চোখ দেখাতে এসেছিলেন। প্রবোধকুমার সান্যালের লেখা, ‘বনস্পতির বৈঠক’ গ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। ওই বাড়িতে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও সর্বোপল্লি রাধাকৃষ্ণনও এসেছেন একাধিবার। সেইসব সোনালি দিন এখন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছে। বর্তমানে অশান্ত অস্থির পৃথিবীতে কবির বন্দনা কতদিন চালাতে পারব জানি না তবে প্রচেষ্টা চলবে নিরন্তর কারণ রবীন্দ্রনাথ চিরকালের, তাঁকে ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। তিঁনিই আমাদের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ এবং আত্মার শান্তি। (Rabindra Jayanti)
ছবি সৌজন্য- লেখক এবং মৌসুমী দত্ত রায়
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।