‘জন্মদিন’ এবং ‘পঁচিশে বৈশাখ’ শব্দবন্ধদুটি বাঙালি মনন ও চিন্তনজগতে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। যাঁর কারণে এই সন্নিপাত, সেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যভুবনে বিষয়দুটি কীভাবে, কতটা স্থান করে নিতে পেরেছে, তা রবীন্দ্রকাব্যের নিবিড় পাঠের মাধ্যমে অনুধাবন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি কবি। তা-ই তাঁর কবিতায় কোনও বিষয়, কতটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেছে, তা থেকে ঔপনিষদিক ঋষিকল্প দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের মানসগঠন সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা করা সম্ভব। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করার জন্য এই অনুসন্ধান বিশেষ তাৎপর্যবাহীও বটে।
১৮৮৬ সালে প্রকাশিত ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থে প্রথমবার জন্মদিনের প্রসঙ্গ এল ‘জন্মতিথির উপহার’ শিরোনামাঙ্কিত কবিতায়, যেখানে বছর পঁচিশের রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্রী ‘শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু’কে জন্মতিথির উপহার হিসাবে ‘একটি কাঠের বাক্স’ দেওয়ার কথা বলছেন। “বাক্সখানি ভরে স্নেহ দিনু তোরে/ এইটে থাকে যেন মনে!” কবিতাটি প্রথম মুদ্রিত হয় ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকার চৈত্র ১২৯২ সংখ্যায়। মনে রাখতে হবে এর আগে প্রকাশিত কবির চারটি কাব্যগ্রন্থের কোথাও জন্মদিন বিষয়টি উল্লিখিত হয়নি।
এর পর, প্রায় চোদ্দো বছরের ব্যবধানে বৈশাখ ১৩০৭-এ রবীন্দ্রকাব্য ‘কল্পনা’য় রাগ-তাল-উল্লিখিত কবিতা ‘জন্মদিনের গান’ (বেহাগ। চৌতাল) প্রকাশিত হয়। যেখানে ধরা আছে কবির প্রার্থনা— “ভয় হতে তব অভয়-মাঝারে/ নূতন জনম দাও হে।… আমা হতে নাথ, তোমাতে মোরে/ নূতন জনম দাও হে।”

‘বিজয়ার করকমলে’ উৎসর্গীকৃত ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থটি শ্রাবণ ১৩৩২-এ বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় থেকে প্রথম গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে স্থান পায় ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় চৈত্র-বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যায় মুদ্রিত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটি। ২৫ বৈশাখ ১৩২৯-এ লিখিত এই কবিতাটির প্রথম স্তবকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— “রাত্রি হল ভোর।/ আজি মোর/ জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী,/ প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি/ হাতে করে আনি,/ দ্বারে আসি দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ।”
উপান্ত্য স্তবকে কবির অভিলাষ এবং বিশ্বাস— “হে নূতন,/ দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।/ আচ্ছন্ন করেছে তারে আজি/ শীর্ণ নিমেষের যত ধূলিকীর্ণ জীর্ণ পত্ররাজি।/ মনে রেখো, হে নবীন,/ তোমার প্রথম জন্মদিন/ ক্ষয়হীন—”
অন্তিম স্তবকে আহ্বান— “হে নূতন,/ তোমার প্রকাশ হোক কুজ্ঝটিকা করি উদ্ঘাটন/ সূর্যের মতন।/ বসন্তের জয়ধ্বজা ধরি,/ শূন্য শাখে কিশলয় মুহূর্তে অরণ্য দেয় ভরি—/ সেই মতো, হে নূতন,/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ ব্যক্ত হোক, তোমা মাঝে অনন্তের অক্লান্ত বিস্ময়।/ উদয়-দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে।/ মোর চিত্ত-মাঝে/ চির-নূতনেরে দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ।”
লক্ষ করার বিষয় ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটির এই শেষ দুই স্তবক, মূলত শেষ স্তবকটি রবীন্দ্রনাথ ২৩ বৈশাখ ১৩৪৮, অর্থাৎ ১৯ বছর বাদে, আবার লিখলেন এবং লিখনখানি কোনও গীতিসংকলনভুক্ত না-হয়ে, পাণ্ডুলিপি-ধৃত তাঁর শেষ গান হিসাবে রয়ে গেল। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, একমাত্র এই গানটিতেই সরাসরি ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কথাটি উল্লিখিত হয়েছে; যেখানে তাঁর লেখা প্রায় দুই সহস্রাধিক গানের আর কোথাও ‘জন্মদিন’ এবং ‘পঁচিশে বৈশাখ’ শব্দবন্ধের উল্লেখ পাওয়া যায় না।

কয়েকটি শব্দ এবং যতিচিহ্নের পরিবর্তন ছাড়া উল্লেখিত গানটি ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটির শেষাংশেরই প্রতিরূপ—
“হে নূতন/ দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।।/ তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন/ সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।/ উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে/ চিরনূতনেরে দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ।।”
বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সত্তর বৎসর পূর্ণ হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর কবিতায় মাত্র কয়েকবার জন্মদিনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন, সেই তিনিই পরবর্তী দশ বৎসরের জীবৎকালে অসংখ্যবার এই প্রসঙ্গে ফিরে ফিরে গেছেন। তাহলে কি সাধারণ মানুষের মতোই রবীন্দ্রনাথও যত জীবন-সমাপনের দিকে এগিয়েছেন, ‘শেষ পারানির কড়ি’ হিসাবে জন্মদিনকেই ‘স্মরণবীণ’ করে তুলতে চেয়েছেন?
১৩৩৯-এর ভাদ্র মাসে প্রকাশিত ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ‘আশীর্বাদ’স্বরূপ তুলে দেন ‘শ্রীমান অতুলপ্রসাদ সেন করকমলে’। সত্তরতম জন্মদিনের প্রাক্কালে ২৩ বৈশাখ, ১৩৩৮-এ শান্তিনিকেতনে বসে লেখা এই গ্রন্থের ‘জন্মদিন’ (‘রবিপ্রদক্ষিণপথে জন্মদিবসের আবর্তন/ হয়ে আসে সমাপন।’) কবিতাটি আকাশবাণীতে কবিকণ্ঠে প্রচারিত হয়। সেই সম্প্রচার সংকলিত হয়েছে বিশ্বভারতী ও আকাশবাণী প্রকাশিত Facets of a Genius ক্যাসেটে (১৯৯৯)।

‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৩৮-এর পৌষ সংখ্যায় ‘জন্মদিন’ নামে মুদ্রিত কবিতাটি ‘অপূর্ণ’ নামে ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। হেমন্তবালা দেবীকে লেখা কবির পত্রসংকলন চিঠিপত্র ৯-এর ১২০ এবং ১২১ পৃষ্ঠার মধ্যবর্তী অংশে কবির হস্তাক্ষরে মুদ্রিত সম্পূর্ণ কবিতাটির পাণ্ডুলিপির প্রথমেই রয়েছে— ”তোমার প্রথম জন্মদিন/ এনেছে মর্ত্যের ঘাটে যে-প্রাণ নবীন,/ চিরন্তন মানবের মহাসত্য-মাঝে/ এল কোন কাজে?”, যা ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত ‘জন্মদিন’ অথবা ‘পরিশেষ’-এর ‘অপূর্ণ’ কবিতায় স্থান পায়নি; বর্জিত হয়েছে পাণ্ডুলিপির শেষ ২২ ছত্রও। ১৩৩৮-এর অগ্রহায়ণে দার্জিলিংয়ে লেখা এই কবিতায় কবি জানতে উৎসুক হয়েছেন— “জন্মদিনে জন্মদিনে গাঁথনির কর্ম হবে শেষ,/ সুখ দুঃখ ভয় লজ্জা ক্লেশ,/ আরব্ধ ও অনারব্ধ, সমাপ্ত ও অসমাপ্ত কাজ,/ তৃপ্ত ইচ্ছা, ভগ্ন জীর্ণ সাজ—/ তুমি-রূপে পুঞ্জ হয়ে শেষে/ কয়দিন পূর্ণ করি কোথা গিয়ে মেশে।… জন্মদিন মৃত্যুদিন, মাঝে তারই ভরি প্রাণভূমি/ কে গো তুমি।”
‘কল্যাণীয়া অমলিনার প্রথম বার্ষিক জন্মদিনে’ ৮ কার্তিক ১৩৩৮, দার্জিলিংয়ে কবি লেখেন ‘আশীর্বাদী’ কবিতাটি, যেটি ‘প্রবাসী’-র মাঘ ১৩৩৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং ‘পরিশেষ’ গ্রন্থভুক্ত হয়।
তেহেরানে অবস্থানকালে ২৫ বৈশাখ ১৩৩৯, একাত্তরতম জন্মদিনে কবি রচনা করেন ‘পারস্যে জন্মদিনে’ (‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থ-ধৃত), যে কবিতায় আপ্লুত কবি লেখেন— “ইরান, তোমার যত বুলবুল/ তোমার কাননে যত আছে ফুল/ বিদেশি কবির জন্মদিনেরে মানি/ শুনালো তাহারে অভিনন্দনবাণী।/ ইরান, তোমার বীর সন্তান/ প্রণয়-অর্ঘ্য করিয়াছে দান/ আজি এ বিদেশি কবির জন্মদিনে,/ আপনার বলি নিয়েছে তাহারে চিনে।/ ইরান, তোমার সম্মানমালে/ নব গৌরব বহি নিজ ভালে/ সার্থক হল কবির জন্মদিন।/ চিরকাল তারই স্বীকার করিয়া ঋণ/ তোমার ললাটে পরানু এ মোর শ্লোক— / ইরানের জয় হোক।”
২৫ বৈশাখ ১৩৪২ বঙ্গাব্দে কবির দ্বিতীয় গদ্যকবিতার সংকলন ‘শেষ সপ্তক’ কাব্যগ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়। ২১ বৈশাখ অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে কবি জানান— “‘শেষ সপ্তক’ বলে নতুন কবিতার বই আমার জন্মদিনে বেরবে।” ওইদিনই কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে অন্য একটি চিঠিতে লেখেন— “শেষ সপ্তক বলে একটা কবিতার বই ছাপাখানায় চড়িয়েছি। ২৫ বৈশাখ বেরোবার কথা। উক্ত তারিখে আমার সম্বন্ধে তোমাদের মনকে প্রসন্ন কোরো।” কবি-সংকলিত ‘সঞ্চয়িতা’ বইটির তৃতীয় সংস্করণে ‘শেষ সপ্তক’ কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত চারটি কবিতার মধ্যে তেতাল্লিশ সংখ্যক কবিতাটি প্রথম চরণের নির্বাচিত শব্দবন্ধ দ্বারা ‘পঁচিশে বৈশাখ’ নামে চিহ্নিত হয়েছিল— “পঁচিশে বৈশাখ চলেছে/ জন্মদিনের ধারাকে বহন ক’রে/ মৃত্যুদিনের দিকে।/ সেই চলতি আসনের উপর বসে/ কোন কারিগর গাঁথছে/ ছোটো ছোটো জন্মমৃত্যুর সীমানায়/ নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।”

১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ প্রকাশিত ‘পত্রপুট’ কাব্যগ্রন্থের ১৫ সংখ্যক কবিতাটি কবি লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে ১৮ বৈশাখ ১৩৪৩। কবিতাটির মধ্যে লক্ষিত হয় কবির স্মৃতিমেদুরতা— “বালক ছিলেম যখন/ পৃথিবীর প্রথম জন্মদিনের আদি মন্ত্রটি/ পেয়েছি আপন পুলককম্পিত অন্তরে—/ আলোর মন্ত্র।”
‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থ(পৌষ ১৩৪৪)-এর সূচনা পৃষ্ঠায় কবির হস্তলিপিতে প্রকাশিত হয়েছিল কবিতাকণা— “অস্ত সিন্ধুকূলে এসে রবি/ পূরব দিগন্ত পানে/ পাঠাইল অন্তিম পূরবী।” এই কাব্যগ্রন্থের ১৩ সংখ্যক কবিতাটি (‘একদা পরম মূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়/ আগন্তুক!’) ‘জয়শ্রী’ (বৈশাখ ১৩৪১) ও ‘প্রবাসী’ (অগ্রহায়ণ ১৩৪৩) পত্রিকায় দুটি স্বতন্ত্র পাঠে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘জন্মদিন’ শিরোনামাঙ্কিত দুটি কবিতা (‘দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে’— ‘প্রবাসী’, আষাঢ় ১৩৪৪; ‘আজ মম জন্মদিন’— ‘প্রবাসী’, জৈষ্ঠ্য ১৩৪৫) ‘সেঁজুতি’ (২৪ ভাদ্র ১৩৪৫) কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়।
ছিয়াত্তরতম জন্মদিনের প্রাক্কালে ২২ বৈশাখ ১৩৪৪ আলমোড়ায় বসে ‘জন্মদিন’ (‘দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে’) শিরোনামাঙ্কিত কবিতায় নিজের ভ্রম এবং বিপন্নতা কবি প্রকাশ করে বলেছেন— “দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে হাজারখানা চোখ,/ ধ্বনির ঝড়ে বিপন্ন ওই লোক।/ জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলেই থাকে,/ দোহাই ওগো, তাদের দলে লও এ মানুষটাকে,”
২৫ বৈশাখ ১৩৪৫ রাত্রি পৌনে ন’টার সময়, সাতাত্তরতম জন্মদিনে কবি ‘জন্মদিন’ শীর্ষক ‘আজ মম জন্মদিন’ কবিতাটি গৌরীপুর ভবন, কালিম্পং থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আবৃত্তি করেন। পরদিন রেডিয়োতে সম্প্রচারিত কবিতাটির, পত্রিকায় মুদ্রিত অশুদ্ধ ও অসম্পূর্ণ পাঠ কবিকে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ করে। তিনি ‘প্রবাসী’-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে ২৬ বৈশাখ ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে এক চিঠিতে লেখেন— “সম্প্রতি আমার নববর্ষের বাচন ও জন্মদিনের কবিতা নিয়ে যে অন্যায় হয়ে গেছে সেটা আমার অজ্ঞাত ও অপ্রত্যাশিত।… কবিতাটি অল্প পরিমাণে সংশোধিত হয়ে প্রবাসীতে গেছে— সেইটিকেই আমার অনুমোদিত পাঠ বলে গণ্য করবেন।”
‘জন্মদিন’ শিরোনামাঙ্কিত আর একটি কবিতা (“তোমরা রচিলে যারে/নানা অলংকারে”) ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আষাঢ় ১৩৪৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি কবি রচনা করেছিলেন তাঁর আটাত্তরতম জন্মদিনে, পুরীতে, ২৫ বৈশাখ ১৩৪৬-এ। এই কবিতাটি বৈশাখ ১৩৪৭-এ প্রকাশিত ‘নবজাতক’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। লক্ষ করার বিষয়, সত্তরতম জন্মদিন থেকে কবি কীভাবে প্রায় প্রতিটি জন্মদিনকেই জন্মদিন সংক্রান্ত কবিতা রচনার মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে প্রকাশিত শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মদিনে’ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ)। শান্তিনিকেতনে সেই সময় পয়লা বৈশাখেই কবির জন্মদিন পালনের রীতি অনুসারে তাঁর অন্তিম জন্মতিথিতে সকালে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ‘জন্মদিনে’। এমনিতেই শেষদিকে ‘কবির একটি বিশেষ আগ্রহ থাকত নববর্ষের দিন বা পঁচিশে বৈশাখের বিশেষ দিনটি উপলক্ষ্যে একখানি নূতন বই বের করার।
‘মন্দিরা’, বৈশাখ ১৩৪৮-এ প্রকাশিত ‘সেদিন আমার জন্মদিন’ কবিতাটি কাব্যগ্রন্থে প্রথম কবিতা হিসাবে স্থান পায়। এই কবিতায় কবি যেন ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শুনতে পাচ্ছেন— “আজি এই জন্মদিনে/ দূরত্বের অনুভব অন্তরে নিবিড় হয়ে এল।… আজি এই জন্মদিনে/ দূরের পথিক সেই তাহারি শুনিনু পদক্ষেপ/ নির্জন সমুদ্রতীর হতে।” কাব্যগ্রন্থের ২ সংখ্যক কবিতাটি (“বহু জন্মদিনে গাঁথা আমার জীবনে/ দেখিলাম আপনারে বিচিত্র রূপের সমাবেশে।”) ‘অপরিসমাপ্ত’ নামে ‘বৈশাখী’, বার্ষিক ১৩৪৮-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে শান্তিনিকেতনের উদয়নে সকালবেলা লিখলেন “জন্মবাসরের ঘাটে/ নানা তীর্থে পুণ্যতীর্থবারি/ করিয়াছি আহরণ, এ কথা রহিল মোর মনে।/…” এটি গ্রন্থের ৩ সংখ্যক কবিতা।
আরও পড়ুন: মুস্তারী বাঈয়ের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
‘প্রবাসী’র জৈষ্ঠ্য ১৩৪৭ সংখ্যায় ‘জন্মদিন ১’ (‘জীবনের আশি বর্ষে’), ‘জন্মদিন ২’ (‘কাল প্রাতে মোর জন্মদিন’) এবং ‘জন্মদিন ৩’ (‘অপরাহ্ণে এসেছিল’) নামে তিনটি কবিতা প্রকাশিত হয়, যেগুলি কবি মংপুতে অবস্থানকালে ঊনআশিতম জন্মদিনের প্রাক্কালে ২২, ২৩ বৈশাখ ১৩৪৭ রচনা করেন। কবিতা তিনটি ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থে ৫,৬,৭ সংখ্যক কবিতা হিসাবে গ্রন্থিত হয়েছে। ‘বুদ্ধের নেপালি ভক্ত’-এর ‘বুদ্ধের বন্দনামন্ত্র’ শুনে কবির উপলব্ধি— “শুভক্ষণে পুণ্যমন্ত্রে/ তাঁহারে স্মরণ করি জানিলাম মনে—/ প্রবেশি মানবলোকে আশি বর্ষ আগে/ এই মহাপুরুষের পুণ্যভোগী হয়েছি আমিও।”— ৬ সংখ্যক কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে।
মংপুতে থাকাকালীন ২৩ বৈশাখ তারিখেই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর কবি লেখেন— “আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি/ প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ;/ আপন আগুনে শোক দগ্ধ করি দিল আপনারে,/ উঠিল প্রদীপ্ত হয়ে।” কবিতাটি ‘জন্মমৃত্যু’ নামে ‘প্রবাসী’র জৈষ্ঠ্য ১৩৪৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং ‘জন্মদিনে’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত হয় ৮ সংখ্যক কবিতা হিসাবে।
শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালীন ২১ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ রচিত এই কাব্যগ্রন্থের ২৭ এবং ২৮ সংখ্যক কবিতায় কবি লিখেছেন— “বিশ্বধরণীর এই বিপুল কুলায়/ সন্ধ্যা— তারই নীরব নির্দেশে/ নিখিল গতির বেগ ধায় তারই পানে।/… নব জন্মদিনে তারে বলি/ আঁধারের মন্ত্র পড়ি সন্ধ্যা যারে জাগায় আলোকে।” “আমি ব্রাত্য, আমি পথচারী,/ অবারিত আতিথ্যের অন্নে পূর্ণ হয়ে ওঠে/ বারে বারে নির্বিচারে মোর জন্মদিবসের থালি।”
‘জন্মদিনে: গ্রন্থ-পরিশিষ্ট’ অংশে স্থান করে নিয়েছে ‘ফসল গিয়েছে পেকে’ শিরোনামাঙ্কিত কবিতাটি। ১১/১৩ ফাল্গুন ১৩৪৭ শান্তিনিকেতনে লিখিত যে কবিতায় কবি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন— “… মাটির কোল হতে যে দান নিয়েছে এতকাল/ তার চেয়ে বেশি প্রাণ কোথাও কি হবে ফিরে দেওয়া/ কোনো নব জন্মদিনে নব সূর্যোদয়ে!”

২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ কবির মহাপ্রয়াণের অল্প কিছুদিন পরে ভাদ্র ১৩৪৭-এ কবির অন্তিম পর্বের কবিতাগুলি ‘শেষ লেখা’ নামে প্রকাশিত হয়। উদয়ন শান্তিনিকেতনে ১ বৈশাখ ১৩৪৮-এ লিখিত কাব্যগ্রন্থের ৬ সংখ্যক কবিতাটি (“ওই মহামানব আসে;/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।”) ‘প্রবাসী’র জৈষ্ঠ্য ১৩৪৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। শ্রাবণ ১৩৪৮-এ ‘প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয় ৬ মে ১৯৪১-এর সকালে উদয়নে লিখিত কবিতা—“আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা,…”, যেটি ‘শেষ লেখা’র ১০ সংখ্যক কবিতা। ১২ সংখ্যক কবিতা (“তব জন্মদিবসের দানের উৎসবে/ বিচিত্র সজ্জিত আজি এই/ প্রভাতের উদয়প্রাঙ্গণ।”) রচিত হয় উদয়নে ১৩ জুলাই ১৯৪১-এর সকালে।
এবার সন্ধান চালানো যেতে পারে কাব্যগ্রন্থ ব্যতীত অন্যগ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুচ্ছে জন্মদিনের প্রসঙ্গ কীভাবে উঠে এসেছে, সেদিকে। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘বিসর্জন’ নাটক কবি উৎসর্গ করেন ‘শ্রীমান সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাণাধিকেষু’কে। সেই উৎসর্গপত্রের প্রথমদিকে কবি লিখেছেন— “প্রবাসে প্রত্যহ তোরে/ হৃদয়ে স্মরণ করে/ লিখিয়াছি নির্জন প্রভাতে,/ মনে করি অবশেষে/ শেষ হলে ফিরে দেশে/ জন্মদিনে দিব তোর হাতে।”
‘স্ফুলিঙ্গ’ প্রকাশিত হয় ২৫ বৈশাখ ১৩৫২, এর কমপক্ষে ৬টি কবিতায় জন্মদিনের প্রসঙ্গ এসেছে। দৌহিত্রী নন্দিতার উদ্দেশে লেখা ৯৮ সংখ্যক কবিতায় কবির উপহার— “এক যে আছে বুড়ি/ জন্মদিনে দিলেম তারে/ রঙিন সুরের ঘুড়ি।” ১৮৪ সংখ্যক কবিতায় কবির সহজ উপলব্ধি— “জন্মদিন আসে বারে বারে/ মনে করাবারে—/ এ জীবন নিত্যই নূতন/ প্রতি প্রাতে আলোকিত/ পুলকিত/ দিনের মতন।” শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রচিত ১৮৫ সংখ্যক কবিতায় কবি লিখেছেন— “জন্মদিন এল তব আজি/ ভরি ল’য়ে সংগীতের সাজি।” ১৮৬ সংখ্যক ২ ছত্রের কবিতা “জন্মদিনে নাম রইল লেখা/ মৃত্যুপটে রবে কি তার রেখা?” আসলে ১৩৩৯-এ দিগিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের খাতায় লেখা কবির রচনা। নির্মলকুমারী মহলানবিশের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ২৪ অক্টোবর ১৯৩৮-এ লিখেছেন— “তব জন্মদিনখানি/ বিস্তীর্ণ করেছ তুমি কত দিকে কত দূর টানি।… তবে জন্মদিনটিরে/ ছন্দে মোর রাখিলাম ঘিরে।” ‘স্ফুলিঙ্গ’ গ্রন্থের ২১৩ সংখ্যক এই কবিতাটি প্রকাশিত হয় ‘জয়শ্রী’ পত্রিকার বৈশাখ ১৩৪৬ সংখ্যায়। ৩ ছত্রে লিখিত ‘স্ফুলিঙ্গ’-এর ৩০৩ সংখ্যক কবিতা— ”নূতন জন্মদিনে/ পুরাতনের অন্তরেতে/ নূতনে লও চিনে।”
কবির মৃত্যুর অনেক পরে, শ্রাবণ ১৩৬১ সালে প্রকাশিত ‘চিত্রবিচিত্র’ গ্রন্থের ‘চিত্রকূট’ কবিতায় দু’জায়গায় জন্মদিনের প্রসঙ্গ এসেছে। “জন্মদিনের ঘটা ছিল,/ ছয় বছরের ছেলে—” এবং “নয় বছরের জন্মদিনে/ তার তলে শেষ খেলা,”। ‘চিত্রকূট’ কবিতাটি (ও তার পাঠান্তর ‘বিশ্বামিত্র মুনি’) প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’র বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৫১ সংখ্যায়।
পত্রিকায় প্রকাশিত ও পাণ্ডুলিপিবদ্ধ বেশ কিছু অগ্রন্থিত কবিতায়ও জন্মদিনের প্রসঙ্গ এসেছে। ২১ ফাল্গুন ১৩৩৩-এ লেখা ‘বুদ্ধদেবের জন্মোৎসব’ কবিতাটি ‘প্রবাসী’র বৈশাখ ১৩৩৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ১৮ আশ্বিন ১৩৩৯-এ শুক্ল পঞ্চমীতে লেখা ‘চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনে’ ‘আশীর্বাদ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’র অগ্রহায়ণ ১৩৩৯ সংখ্যায়। ‘বিচিত্রা’র মাঘ ১৩৩৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ২ পৌষ ১৩৩৯-এ ‘শ্রীমান দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিবসে লেখা ‘আশীর্বাদ’।
১৫ জৈষ্ঠ্য ১৩৪০-এ দার্জিলিংয়ের গ্লেন ইডেন-এ লেখা কবির ‘উত্তিষ্ঠত নিবোধত’ কবিতাটি ‘প্রবাসী’র মাঘ ১৩৪৮ সংখ্যায় ‘আশীর্বাদ’ নামে প্রকাশিত হয়। কবিতায় কবি ‘কল্যাণীয়া শ্রীমতী রমা দেবী’র উদ্দেশে লেখেন— “আজি তব জন্মদিনে এই কথা করাব স্মরণ—/ জয় করে নিতে হবে আপনার জীবন মরণ/ আপন অক্লান্ত বলে দিনে দিনে;” ‘বিচিত্রা’র পৌষ ১৩৪২ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘জন্মদিনে’ কবিতায় কবি লিখেছেন— “তোমার জন্মদিনে আমার/ কাছের দিনের নেই তো সাঁকো।” কবিতাটি রচিত হয় শান্তিনিকেতনে ২৪ অক্টোবর ১৯৩৫। ১৩ অগ্রহায়ণ ১৩৪৩ শান্তিনিকেতনে কবি লেখেন ‘পুপুদিদির জন্মদিনে’, যে কবিতায় কবি লিখেছেন— “হঠাৎ তোমার জন্মদিনের/ আঘাত লাগল দ্বারে,/ ডাক দিল সে দূর সেকালের/ খ্যাপা বালকটারে।” কবিতাটি প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’তে মাঘ ১৩৪৩ সংখ্যায়।
রবীন্দ্রনাথের ছাপান্নটি কাব্যগ্রন্থ, গীতবিতান-গীতিগুচ্ছ এবং স্ফুলিঙ্গ-চিত্রবিচিত্র ও অন্যান্য অগ্রন্থিত কবিতার পাঠ-পরিক্রমা থেকে জন্মদিন নিয়ে কবির আবেগের সন্ধান পাওয়া যায়। এই হৃদয়ানুভূতি যে বয়োবৃদ্ধ-প্রাজ্ঞ কবিকে বেশি আলোড়িত করেছে, তাও সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। এবং এ কারণেই ‘জন্মদিনের মুখর তিথি’কে স্মরণীয় করে রাখা কবিকে বড় পরিচিত মনে হয়।
ছবি সৌজন্য: Public domain pictures, Britannica, Wikibio
পেশায় শিক্ষক দিলীপকুমার ঘোষের জন্ম হাওড়ার ডোমজুড় ব্লকের দফরপুর গ্রামে। নরসিংহ দত্ত কলেজের স্নাতক, রবীন্দ্রভারতী থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। নেশা ক্রিকেট, সিনেমা, ক্যুইজ, রাজনীতি। নিমগ্ন পাঠক, সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত সৈনিক। কয়েকটি ছোটবড় পত্রিকা এবং ওয়েবজিনে অণুগল্প, ছোটগল্প এবং রম্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে 'সুখপাঠ' এবং 'উদ্ভাস' পত্রিকায় রম্যরচনা এবং দ্বিভাষীয় আন্তর্জালিক 'থার্ড লেন'-এ ছোটগল্প প্রকাশ পেয়েছে।
2 Responses
ভাল লাগল। তথ্যবহুল লেখা। ❤️
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরে সমৃদ্ধ হলাম।