পক্ষমেলা বিস্তৃত চক্ষু, পাতলা ঠোঁট যেন ধনুকের মতো বাঁকা। সবুজ শ্যামল রঙের পাশে রাগলেখাকে উজ্জ্বল বিদ্যুৎরেখার মতো দেখায়।
রাগলেখা গাঢ় স্বরে বলে, এসব শেষ হয়ে গেলে, চল আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। তোমার তো সন্তান নেই যে তার টান ছাড়তে পারবে না।
সুবাহুর এতক্ষণের ক্ষিপ্ততা যেন কোথায় সরে গেছে। সে অন্যমনস্কের মতো বলে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, কী হবে! সুদূর পশ্চিম থেকে এই গ্রামে কেনই বা অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই মহতী সভা, কে জানে? বলেই সুবাহু গর্বের ভঙ্গিতে দু’টি হাত মাথার তলায় রেখে শোওয়া অবস্থায় বলে, যাই বল, তুমি তো দেশের কোথায় না কোথায় গেছ! তবে এমন বর্ধিষ্ণু গ্রাম বোধহয় দেখনি তেমন? কীভাবে আমাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং মুর্শিদকুলি, দেখছ? দেওয়ান যদিও, তবে বাংলার সুবেদার তিনিই। আওরঙ্গজেবের নাতি আজিম-উস-সান বল, বা ফারুকশিয়র, নামেই ওরা সুবেদার। কুলি খানকে চটালে বাদশা নাতিদেরও রেয়াত করবে না, সারা বাংলা জানে! সেই মুর্শিদকুলি নিজের ধর্মের পণ্ডিতদের অবধি সাক্ষী হিসেবে পাঠিয়েছেন। বুঝলে রাগলেখা, এই সভার উপর আমার ভাগ্যের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। রাধামোহন ঠাকুরের বয়স হয়েছে। তাঁর জয় মানে আমারই প্রতিষ্ঠা। সুবাহু একটি হাত মাথার তলা থেকে নিয়ে উন্মুক্ত প্রশস্ত বুকের উপর রাখে, হাত বোলায়।
[the_ad id=”270085″]
রাগলেখা পুনর্বার বলে, সে তোমার পাণ্ডিত্যের কারণে তুমি যেখানে যাবে সেখানেই প্রতিষ্ঠা পাবে। সারা জীবন এই গ্রামেই কূপের মণ্ডুকের মতো পড়ে থাকবে?
সুবাহু তেমনি আত্মনিমগ্ন স্বরে বলে, আরে নিজের গৃহের কাছে প্রতিষ্ঠা পেলে তার চেয়ে উত্তম আর কী আছে? যদি শ্রীবৃন্দাবনে জন্ম নিতাম, সে স্থান পরিত্যাগ করতাম? মালিহাটিতে পঞ্চশাখার এত আধিপত্য, এ স্থান ছাড়ব কেন?
রাগলেখা চুপ করে যায়। দেখে সুবাহুর ঘোর লাগা মুখে আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। তার আঙুলগুলি সুবাহুর বুকের যে রোমরাজির উপর অন্যমনস্কের মতো খেলা করেছে এক মুহূর্ত আগেও, গভীর আশ্লেষে যেখানে মুখ ঘষেছে সে, মুহূর্তেই যেন অচেনা হয়ে গেছে ওই তৃণাচ্ছাদিত শ্যামলভূমি।

সুবাহু বলে, আগে এই বিতর্কসভার সমাপ্তি ঘটুক। এখন আর অন্য কিছু ভাবতে পারছি না আমি, বুঝলে? সারাক্ষণ মাথার ভেতর জয় আর পরাজয়। তুমি তো আমাকে চেন। কোনও একটা বিষয়ে ডুবে থাকলে অন্য বিষয়ে আমি মন দিতে পারি না। তবু তুমি বলেই এত অস্থির হয়ে সকাল থেকে সন্ধান করেছি।
রাগলেখা হাসে। শান্তভাবে বলে, জানি। সে আমার পরম সৌভাগ্য!
রাগলেখার গলার শ্লেষ বা নিরাসক্তি কিছুই ধরতে পারে না সুবাহু, কারণ সে ধরার চেষ্টাই করে না। রাগলেখা কিছু বলে না, তার প্রিয় পুরুষশরীরের শ্যামরঙে যে উন্মাদনা, তা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার ইচ্ছা হয়। কিন্তু কোন এক দুর্নিবার টানে পরম শত্রুর বুকেই পুনর্বার ঝাঁপিয়ে পড়ে। জেনেবুঝেই পুরুষের নিরাসক্তি আর স্বার্থপরতার মধ্যে অগ্নিপ্রবেশ করে নারী।
৮
ব্রজদেব স্নানের জন্য পুষ্করিণী তীরে গাত্রমার্জনা করছিলেন। বাংলার মুসলমান শাসক দ্বারা পরিচালিত এই তর্কসভায় অংশগ্রহণ করতে তাঁর প্রথম দিকে অনাগ্রহই ছিল। দীর্ঘকাল হল বাংলা ত্যাগ করেছেন তিনি। সে বাংলা অবশ্য আরও পুবে। এখানে আসার আগে শুনেছিলেন, রাজস্ব আদায়ে মুর্শিদকুলি অত্যন্ত নির্মম। দেওয়ানের জামাতা রাজি খাঁ একটা গর্ত খুঁড়ে মলমূত্রে পরিপূর্ণ করে রাখে। ঠাট্টা করে তার নাম দেওয়া হয়েছিল বৈকুণ্ঠ। যে হিন্দু জমিদার রাজস্ব আদায়ে দেরি করে তাকে বৈকুণ্ঠে ডুবিয়ে রাখা হয়! অথচ মুর্শিদকুলি তাঁর এক স্ত্রী নিয়ে অত্যন্ত বিশুদ্ধ জীবনযাপন করেন। রাজস্ব আদায়ে প্রাপ্যর চেয়ে একটি মুদ্রাও বেশি আদায় করেন না। নাটোর, দিঘাপতিয়া, নড়াইল, মুক্তাগাছা, তাহিরপুর এসব হিন্দুপ্রধান জমিদারি তাঁরই প্রসাদে গড়ে উঠেছে। দেওয়ানের আরও একটি আশ্চর্য গুণ আছে। তিনি ক্রীতদাস প্রথা পছন্দ করেন না। প্রাক্তন দাস থাকলেও তাদের উন্নতির পথে বাধা দেন না।
[the_ad id=”270084″]
ব্রজদেব পুকুরের তৃতীয় ধাপে নামেন। হরিদ্রা ও সর-মাটি সহযোগে উর্ধ্বাঙ্গ মার্জনা করেন। বঙ্গের প্রকৃতি বড় মনোরম। ক্রীতদাস না হয় বর্জনীয়, কিন্তু ক্রীতদাসী? ব্রজদেব অন্যমনস্ক হন। সামান্যা নারী কি অসামান্যা হয়ে উঠতে পারে?
শ্রীরাধিকা আরাধ্যা। কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার পরকীয়ার সম্বন্ধ এখানে ভক্তির কারক। পরকীয়া প্রেমে কাম জড়িয়ে থাকে। ভক্ত পরকীয়া সম্পর্ক উপাসনা করবে কী উপায়ে? কী যে অনাচার এই বঙ্গে! ভাবতে ভাবতে কাকচক্ষু জলে সবল দু’বাহু প্রসারিত করে দেন ব্রজদেব।
মালিহাটি আসার পথে শচীদেবীর আশ্রমে কাটিয়ে এসেছেন তাঁরা। কী অদ্ভুত কাণ্ড ঘটেছে সেখানে! কৃষ্ণের নামে যত ন্যক্কারজনক ঘটনা! আর এইসব কাণ্ডের প্রধান কাণ্ডারি এদের চৈতন্য মহাপ্রভু! শচীদেবীর চেলারা সখীভাবের কবলে পড়ে মেয়েদের পোশাক পরে থাকে। উচ্ছৃঙ্খল নায়িকার মতো হাবভাব! ব্রজদেবের সঙ্গীদের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা হয়েছিল আর কি!
ব্রজদেব জলে ডুব দেন। চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়। ভিন্নমুখী এলোমেলো বিষয় মাথায় ভিড় করে। ক্রীতদাসীর স্থান শয্যায়, পত্নীর স্থান লক্ষ্মীদেবীর মতো সম্মানের বৈকুণ্ঠ ধামে।
বৈকুণ্ঠ? মনে হওয়া মাত্রই রাজি খাঁ র তৈরি মলমূত্রের সেই বৈকুণ্ঠ নামের ভাগাড়ের কথা মনে পড়ে যায়। হরি! হরি! জলের মাঝে দাঁড়িয়েই কপালে হাত তুলে দোষ স্খালন করেন। চোখ খুলতেই যা দেখলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন ঠাহর পেলেন না। সিক্ত চুল থেকে জল নেমে চোখমুখ ভেসে যাচ্ছে বলে হয়তো ভুল দেখেছেন ভাবেন। বারংবার চোখ বন্ধ করেন। খোলেন। ইদানীং নিদ্রার সমস্যা হলেও চোখের সমস্যা তো এমনভাবে অনুভূত হয়নি! জলের শৈত্য তীক্ষ্ণ শলার মতো হাড়-মজ্জায় প্রবেশ করে। দু’ একবার চোখ কচলে দেখার পর দৃষ্টি স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করার জন্য মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন দিঘির মাঝবরাবর। এ কি সম্ভব! নাকি অসম্ভব দৃশ্য! স্থিরযৌবনা অচঞ্চল সেই মৃত্যু? সে হতে পারে না। তবে এ কে?
[the_ad id=”270086″]
কিয়ৎক্ষণ, কৃষ্ণ জানেন কতক্ষণ, সে মূর্তি স্থির থেকে তাঁরই দিকে জল কেটে এগিয়ে আসে। ব্রজদেব জলের নিরাপদ স্থানেও হঠাৎ যেন দমবন্ধ অবস্থা অনুভব করেন। মুহূর্তে মুছে যায় চতু্র্ধার। নিরাকার শূন্যের মাঝ থেকে যেন প্রশ্ন করেন, কে? কে তুমি? এখানে কে, কে তুমি? সন্ধ্যামণি, তুমি জীবিত ?
উল্টোদিকে জলের মাঝে ফুটন্ত শাপলার মতো সুন্দর মুখে স্থির কৌতূহল। সে কোনও উত্তর দেয় না। যথাসম্ভব স্থিরভাবে মুখোমুখি হয়। ব্রজদেব তাকে ধরার জন্য সমগ্র শরীর প্রসারিত করেন। পদ্মপলাশলোচনা সেই স্থির মূর্তি জলে ডুব দেয়। ব্রজদেবের পদস্খলন ঘটে!
পরবর্তী পর্ব ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১
*ছবি সৌজন্য Pinterest
সেবন্তী ঘোষের জন্ম শিলিগুড়িতে, উচ্চশিক্ষা বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে। নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা কবি ও লেখকদের মধ্যে সেবন্তী নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরষ্কার ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। সেবন্তীর পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং পোর্টালে। ওঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে 'আমাদের কথা', 'যে থাকে অন্ধকারে', 'ফুর্তি ও বিষাদ কাব্য', 'ফুল ও সুগন্ধ', 'দিল-দরিয়া' উল্লেখযোগ্য।