(Raj Kapoor) পেশোয়ারের শিকড় ছিঁড়ে বোম্বাই শহর নয়, কলকাতাতেই নতুন করে ঘর খুঁজছিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুর। মাস মাইনেতে কাজ করেছেন ‘কলকাতার গ্র্যান্ড অ্যান্ডারসন থিয়েটার’ থেকে বিএন সরকারের ‘নিউ থিয়েটার্স’-এ। থিয়েটারে অভিনয় করা ছিল তাঁর প্রথম ভালবাসা। পৃথ্বীরাজ পরিবার নিয়ে চলে এলেন কলকাতার ভবানীপুরে। বাংলাও পারতেন গড়গড়িয়ে বলতে। ছেলে রাজকে কিছুদিনের জন্য ভর্তি করে দিলেন কলকাতার স্কুলে। কিশোর রাজ বাংলা বলতেও পারতেন। স্কুল ছুটি থাকলে বাবা আর ছেলে চলে যেতেন কলকাতার সিনেমা হলে। লরেল-হার্ডির ছবি বাবার খুবই পছন্দের। কিন্তু ছেলে রাজকে টানত একজনই। তিনি চার্লি চ্যাপলিন! (Raj Kapoor)
হল থেকে বাড়ি ফিরেই ভাই-বোনদের চ্যাপলিনকে নকল করে দেখাতেন রাজ। ছোটবেলা থেকেই রাজের জীবনে গুরু হলেন চ্যাপলিন । ভবিষ্যতের সুপ্ত বীজ যেন তখনই লুকিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই রাজই হলেন লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরা,অ্যাকশনের জাদুকর, ভারতের চার্লি চ্যাপলিন, রাজ কাপুর। ‘দ্য গ্রেটেস্ট শোম্যান অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’। (Raj Kapoor)
রাজ কাপুরের জন্ম ১৪ ডিসেম্বর ১৯২৪, পাকিস্তানের পেশোয়ারে। আসল নাম রণবীর রাজ কাপুর। রণবীর ফেলে মাঝের নাম রাজ দিয়েই তিনি ছায়াছবির জগতে জয়যাত্রা শুরু করেন। পেশোয়ার থেকে কলকাতা হয়ে বম্বে। পড়াশোনা দেরাদুনের কর্ণেল ব্রাউন কেমব্রিজ স্কুলে ও পরবর্তীতে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৩৫ সালে ১১ বছর বয়সে প্রথম অভিনয় ‘ইনকিলাব’ ছবিতে। সেখানেও কলকাতা কানেকশন। পরিচালক ছিলেন কলকাতার দেবকী কুমার বসু। এরপর স্বাধীনতার বছর ১৯৪৭। তরুণ তুর্কী রাজ কাপুর অভিনয় করলেন মধুবালার বিপরীতে ‘নীলকমল’ ছবিতে। ১৯৪৮ সালে চব্বিশ বছরের যুবক রাজকাপুর নিজস্ব স্টুডিও ‘আর কে ফিল্মস’ প্রতিষ্ঠা করেন। (Raj Kapoor)
সর্বকনিষ্ঠ পরিচালক হিসেবে রাজ কাপুর ইতিহাস তৈরী করলেন। আর.কে. ফিল্মসের ব্যানারে ১৯৫১ সালে আওয়ারা, ১৯৫৫ সালে শ্রী ৪২০, ১৯৫৬ সালে ‘চোরি চোরি’ ও ‘জাগতে রাহো’ এবং ১৯৬০ সালে ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বেহতি হ্যায়’এর মতো বেশকিছুসংখ্যক বানিজ্যসফল ছবি মুক্তিলাভ করে। ‘জাগতে রাহো’ ছবিটি ‘একদিন রাত্রে’ নামে বাংলা ভাষাতেও মুক্তি পেয়েছিল। রাজ কাপুর অভিনীত ‘একদিন রাত্রে’ ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকরের সেই অবিস্মরণীয় গান ‘জাগো মোহন প্রীতম’ যা সারা ভারতকে দুলিয়ে দিয়েছিল। ‘জাগতে রাহো’ চলচ্চিত্রটি কার্লোভি ভ্যারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ক্রিস্টাল গ্লোব পুরস্কার লাভ করে। (Raj Kapoor)
১৯৬৪ সালে রাজ কাপুর নির্মিত, পরিচালিত ও অভিনীত তাঁর প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ মুক্তি পায়। বৈজয়ন্তীমালা,রাজেন্দ্র কুমার ও রাজকাপুর অভিনীত ‘সঙ্গম’ মিউজিক্যাল হিটের নিরিখে আজও আইকনিক। ১৯৭০ সালে রাজ কাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ মুক্তি পায়। ছবিটি নির্মাণে ছয় বছরের অধিক সময় ব্যয় হয়েছিল। ঋষি কাপুরের চলচ্চিত্র অভিষেক এই ছবি দিয়েই। ঋষি কাপুর ও নবাগতা ডিম্পল কাপাডিয়াকে জুটি করে ১৯৭৩ সালে রাজ বানালেন ‘ববি’। যা বক্সঅফিসের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। চলচ্চিত্রে যৌনতা নিয়ে রাজ কাপুরের কোন ছুৎমার্গ ছিলনা। যৌনতাকে শিল্পের পর্যায়ে রাজ তাঁর ছবিতে উপস্থাপন করেছিলেন। জিনাত আমন ও শশী কাপুর অভিনীত ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ থেকে মন্দাকিনী অভিনীত ‘ রাম তেরি গঙ্গা মাইলি সাহসী ছবি হিসেবে আজও আইকনিক। (Raj Kapoor)
ভিডিও: বিষাদের মহানায়ক – জন্মদিনে দিলীপ কুমার
১৯৪৬ সালে কৃষ্ণা মালহোত্রা’র সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন রাজ কাপুর। রাজ ও কৃষ্ণা কাপুরের পাঁচটি সন্তান: তিন ছেলে, অভিনেতা , রণধীর কাপুর, ঋষি কাপুর এবং রাজিব কাপুর এবং দুই কন্যা ঋতু নন্দা এবং রিমা জৈন। রণধীরের স্ত্রী ববিতা ও ঋষির স্ত্রী নীতু,দুজনেই ছিলেন নায়িকা। যদিও বিয়ের পর তাঁরা ছবির জগতকে বিদায় জানান। (Raj Kapoor)
রাজ কাপুর তিনবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও দশ বার বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছিলেন। পাঁচ বার পেয়েছেন বাংলা থেকে বিএফজেএ পুরস্কার। রাজ কাপুরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ও তাঁর নামানুসারে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারের নাম রাখা হয়। (Raj Kapoor)
চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭১ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তাকে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৮৭ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ভারতের চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান তিনি। জীবনের শেষদিকে হাঁপানি রোগে ভুগছিলেন রাজ কাপুর। ১৯৮৮ তে দাদাসাহেব পুরস্কার নিতে অসুস্থ রাজ কাপুর হাজির হয়েছিলেন অস্কিজেন মাস্ক পরে। তাঁর নাম ঘোষণা হতেই তিনি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। বাড়তে থাকে হাঁপানি। (Raj Kapoor)
রাষ্ট্রপতি রামাস্বামী ভেঙ্কটরমণ মঞ্চ থেকে নেমে এসে রাজ কাপুরের হাতে ফালকে পুরস্কার তুলে দেন। দ্রুত চিকিৎসার্থে রাজকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। একমাসব্যাপী হাসপাতালে জীবন-মরণ লড়াই করে ২রা জুন ১৯৮৮ সালে জীবনাবসান ঘটে রাজ কাপুরের। বাংলাকে ভালবেসে বাংলা ভাষাকে ভালবেসে রাজের কখনও বাংলা ছবি করা হয়নি। উত্তমকুমার আর রাজ কাপুরকে নিয়েই প্রথম হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দ’ ছবির গল্প ভেবেছিলেন। তখন সেই বাংলা ছবির নাম ছিল ‘আনন্দ সংবাদ’। তাও বাস্তবায়িত হয়নি। অসমাপ্ত ‘আনন্দ সংবাদ’ পরে হিন্দিতে তৈরী হয় ‘আনন্দ’ নামে।
রণবীর আসল নামটা রাজ কাপুর ছেঁটে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাঁর নাতি সেই নাম তুলে নিয়ে হয়ে উঠলেন এ যুগের সুপারস্টার নায়ক রণবীর কাপুর। যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।