(Ranju Valley)
পথিক মনে অজানা গাঁয়ের টানে….
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা। রংটং, তিনধরিয়ার পুরোনো পথে গড়িয়ে চলল আমাদের দার্জিলিংগামী ছোট্ট বাসটা। জানলার পাশেই সিট। আরামে এলিয়ে দিলাম শরীর। শহুরে ক্লান্ত মনটা ছুটে গেল জানলার বাইরের মায়াবী প্রকৃতির মাঝে। দু’পাশে সুবিস্তৃত সবুজ চা-বাগান। বৃষ্টি-স্নাত সবুজ ঢেউ খেলানো পাহাড়ের গা ছুঁয়ে তিস্তা ছুটে চলেছে দূরে, আরো দূরে। জলভরা মেঘ পানসি আকাশের বুক ছেড়ে নেমে আসতে চাইছে পৃথিবীতে মাটির টানে। ধীর ধীরে মেঘবালিকার আঁচল ঢেকে দিচ্ছে চারপাশ। ঠান্ডা হাওয়ায় একটু শীত শীত অনুভূতি হচ্ছে।
পাহাড় তার বাঁশির সুরে আমাদের বারবার ডাকে। সেই আহ্বানে সারা দিয়ে এবারে আমাদের গন্তব্য রঞ্জু ভ্যালি (৫০০০ ফিট)। দার্জিলিং থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত মংপু ডিভিশনের এক নির্জন গ্রাম।
জোড়বাংলো মোড়ে বাস থামতেই, স্যাক নিয়ে পুরোদস্তুর পথিক। তারপর তিনমাইলের দিকে এগিয়ে যাওয়া। গাড়িতেই যাওয়া যায়। কিন্তু পায়ে হেঁটে পথের সৌন্দর্যে আরো গভীরভাবে ডুব দেওয়া যায়। আজন্ম পথিক আমি ও ভাই (সুব্রত) ‘ঝুলল ঝোলা, চলল ভোলার’ মতো পায়ে পায়ে এগোলাম। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা দুপুর ২টোর ঘরে।

৫ কিলোমিটার দূরেই তিন মাইল চৌ-রাস্তা। সেখান থেকে সোজা পথ তাগদা তিনচুলে হয়ে লামাহাটা ছুঁয়েছে। বাঁদিকের রাস্তা রাঙ্গেরুন অভিমুখী। আমরা ডান দিকে পেশক-মংপুর দিকে পা বাড়ালাম। ৪ কিলোমিটার পরে দুটি পথের সংযোগস্থলে রঞ্জু ভ্যালি ফরেস্ট চেকপোস্ট। সেখান থেকে পিচপথ সোজা মিশেছে মংপুতে। আমাদের নামতে হবে চেকপোস্টের গা ঘেঁষে বাঁদিকে আরো দুই কিলোমিটার। বর্ষার জলভরা মেঘকে সাথী করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই পথের নেশায় বুঁদ হয়ে হাঁটলাম।
গ্রামে বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান মানুষের সংখ্যা বেশি। পারস্পরিক ধর্মের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। বুদ্ধপূর্ণিমায়, দশেরায় যেমন সারা গ্রাম আনন্দে মাতে, তেমন খ্রিস্টমাসের দিনগুলোতেও গ্রাম ভাসে খুশির জোয়ারে।
“য্যঁরা সাবধানী সে যাঁইয়ে গাঁ। জঙ্গলসে নিকালকে ব্ল্যাকপান্থার রোড পে আঁ যাতা হ্যায়। একসাথ চলনা…” হাঁটার শুরুতেই ভিনদেশীদের সতর্ক করেছিলেন রিদ্ধি রাই। জোড়বাংলোর বাসিন্দা। হাঁটাপথের নির্জনতায় তার কথার সঠিক মর্মার্থ বুঝেছিলাম। কিছুটা এগোতেই সঙ্গী হয়েছিল সেনচল অভয়ারণ্য। বাঁহাতে গভীর খাদ। ওপারে অনেক দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট গ্রাম। নিঝুম সেই পথে বন্য কথাকলি জেগেছিল চঞ্চল বুনো ইঁদুর, ছুটে চলা কাঠবেড়ালি, হনুমানের ছুটোছুটিতে অথবা শনশন হাওয়ায় ওঠা পাতার মর্মর ধ্বনিতে।

যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিল বকপাখির গড়নের নীলরঙা ফুল, ঝাড়বাতির আকৃতির হলদে ফুল, রানী-বেগুনি-সাদা রঙের আরও কত ফুল! ফুলের রেনু গায়ে মেখে বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতির মাঝে আমরা এসে দাঁড়িয়েছিলাম রঞ্জুভ্যালির দ্বারে। বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছিল সেই গোপনপুরের টুকরো টুকরো ছবি। নীলাকাশে তখন নানা অবয়বে সাদা সাদা মেঘবালিকার দল। প্রথম দর্শনেই মেঘমেদুর রঞ্জুভ্যালির প্রেমে পড়েছিলাম।

চুলের সিঁথির মতো পিচরাস্তা, ধূপির সারির মাঝখান দিয়ে এগিয়ে ডিসপেনসারির সামনের কাঁচাপথে মিশেছে। তারপর পাশেই সিঙ্কোনা চাষের অফিসের ডানদিক থেকে একটা বাঁক নিয়ে ফিরোজ তামাং-এর ‘আরতি হোমস্টে’র উঠোন ছুঁয়ে আরো উৎরাই-এ গড়িয়েছে। হোমস্টে’র বাঁ পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া সিঁড়ির ধাপ। গাড়ির রাস্তা হওয়ার আগে এই পাথুরে সিঁড়ি ভেঙেই গ্রামবাসীরা যাতায়াত করতো। এখনো মাঝেমধ্যে শর্টকার্ট করতে গ্রামের মানুষ এই পথই ব্যবহার করেন।
সূর্য তখন দিগন্ত সীমায় ডুব দিতে ব্যস্ত। আকাশের ক্যানভাসে লাল আবিরের ছড়াছড়ি। ধীর পায়ে সন্ধে নামছে নিঝুম গ্রামের শরীর জুড়ে। একটা নিশ্চিত রাতের ঠিকানার খুব প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম সেই মুহূর্তে। ‘আরতি হোমস্টে’ হয়ে উঠেছিল দু’দিনের শান্তির ঠিকানা।

গ্রামের ঠিক মাঝখানে ফিরোজ তামাং-এর দোতলা হোমস্টে। সামনে সুবিস্তৃত পাহাড়শ্রেণী। একটা সবুজ পাহাড় গড়িয়ে যেন আরেক পাহাড়কে ছুঁতে চাইছে, পরস্পরকে বাহুডোরে আলিঙ্গন করতে চাইছে। মনহারানো দৃশ্য!
রঞ্জুভ্যালি! একটা সাধারণ পাহাড়ি গ্রামের নাম ইংরেজি শব্দ দিয়ে কেন? প্রশ্নটা মনে হতে একাধিক জনকে জিজ্ঞাসা করি। শেষে এটাই বুঝেছি যে, আগে এই গ্রামের নাম ছিল ‘রঞ্জা ঝোরা’। এই ঝোরাটি গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তখন ঐ নামকরণ হয়েছিল। পরে নামটাকে একটু আদুরে ও আকর্ষণীয় করতে ‘রঞ্জা’ শব্দটাকে ‘রঞ্জু’ করা হয়েছে। আর গ্রামটির যেকোনো ভিউ পয়েন্ট বা উঁচু জায়গায় দাঁড়ালে চারপাশটাকে বিস্তৃত ভ্যালি বা উপত্যকার মতো দেখায়। তাই গ্রামবাসীরা ‘ভ্যালি’ শব্দটাকে নামের সাথে যুক্ত করেছেন। ‘ভ্যালি’ শব্দটার প্রকৃত ভৌগলিক অর্থটা মাথায় রাখেন নি। (Ranju Valley)

প্রায় ২০০ পরিবারের বাস। কোথাও এতটুকু গা ঘেষাঁঘেঁষি নেই। সবুজ উপত্যকার অপার বিস্তার। ধাপে ধাপে একটা দুটো বাড়ি। গ্রামের বুক চিরে পাথরে পাথরে লাফিয়ে বয়ে চলেছে গোটখোলা। সবুজ স্নেহের চাদর গায়ে যেন এক রূপকথার স্বপ্নপুরী।
গ্রামের সীমান্ত ঘেঁষে সিঙ্কোনা চাষের বিস্তৃত ক্ষেত। টেক্সাস নার্শারি, তিনট্যালি নার্শারি – সবই সিঙ্কোনার আবাদ। এখানকার এঁটেল মাটি সিঙ্কোনা চাষের উপযুক্ত। মংপু অফিসের অধীনেই এখানে সিঙ্কোনা চাষ হয়। সিঙ্কোনা বাংলো লাগোয়া ফুলে ভরা অর্কিড-হাউসও মন মাতায়। (Ranju Valley)

গ্রামবাসীদের আয়ের প্রধান উৎস এই আবাদি ভূমি। এছাড়া স্কোয়াশ, মটর, ভুট্টা, ফুলঝারু, আদার চাষ করে গ্রামবাসীরা। নিজেদের বাড়ির স্বল্প জায়গায় গরু প্রতিপালন, মুরগি পালন, ছোট্ট জলাশয়ে মৌমাছি প্রতিপালন (মধু চাষ) করে থাকে। একান্ত দরকারে দার্জিলিং বা মংপুতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে যায়। নতুবা গ্রামের ছোট পরিসরে গ্রামবাসীরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজেদের জগতের বাইরের পৃথিবী সেভাবে তাদের টানে না। (Ranju Valley)
গ্রামে বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান মানুষের সংখ্যা বেশি। পারস্পরিক ধর্মের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। বুদ্ধপূর্ণিমায়, দশেরায় যেমন সারা গ্রাম আনন্দে মাতে, তেমন খ্রিস্টমাসের দিনগুলোতেও গ্রাম ভাসে খুশির জোয়ারে। সেইসময় হোমস্টে বন্ধ থাকে। গ্রামে স্কুল বলতে একটা প্রাইমারি ও জুনিয়ার সরকারি স্কুল। উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলেমেয়েদের কালিম্পং বা দার্জিলিং-এ থেকেই পড়াশোনা করতে হয়। (Ranju Valley)

সেদিন আরতি হোমস্টের উঠোনে খোলা আকাশের নিচে ফিরোজের সাথে গল্প হচ্ছিল। তখনই তার কাছ থেকে গ্রাম সম্বন্ধে নানা তথ্য জেনে নেওয়া। কথায় কথায় রাত গভীর হয়। চারপাশে কুয়াশা-মুক্ত স্বচ্ছ পরিবেশ। দূর পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মতো বিন্দু বিন্দু আলোর হাতছানি। নজরে আসে কালিম্পং, মংপু, সিটং, রাম্বী গ্রাম- যেন এক একটা আলোর নেকলেশ। আধখানা চাঁদের আলোয় তিস্তা নদীর ঝকঝকে রুপোলি শরীর। (Ranju Valley)

রঞ্জু ভ্যালির একপ্রান্তে একা দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে চেয়েছিলাম সেই আলো-আঁধারি বাহারের দিকে। অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে জড়িয়ে আসছিল হৃদয়! অজান্তেই মন গুনগুন করছিল, রবি ঠাকুরের গানে, “দুরে কোথায় দূরে দূরে/ আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে…/ যে পথ বেয়ে কাঙাল পরান যেতে চায় কোন্ অচিনপুরে”। সম্বিত ফিরল ফিরোজ ভাই-এর ডাকে, “দিদি, শোনে যাইয়েঁ, কাল সুভা গাঁও ভি তো পুরা ঘুমনা হ্যাঁয়….”। সেই ভোরের আলোর অপেক্ষায় একসময়ে শান্তির ঘুম জড়িয়ে আসে নির্জন গাঁয়ের শান্তির ঠিকানায়। (Ranju Valley)
পরবর্তী পর্ব: ২৫ নভেম্বর, ২০২৫
ছবি:লেখক
পেশায় শিক্ষিকা। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পর্বত পদযাত্রী, পর্বতারোহী ও ভ্রামণিক এবং এই বিষয়ক লেখিকা।
