(Ranju Valley)
পায়ে পায়ে চুপকথার পাহাড়ি গাঁয়ে….
পরদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙে অজস্র পাখির ডাকে। কাকভোর থেকেই তাদের কলকাকলিতে মুখরিত গ্রাম। সাদা মেঘের ঘোমটা সরিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এখানে স্লিপিং- বুদ্ধকে পুরোটা দেখা যায় না। তবে মেঘের মাঝে উঁকি দেওয়া একফালি কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখে মুগ্ধতা জাগায়। সেই ভালোলাগার পারদ চড়তে থাকে শিশুরবির মনমাতানো বর্ণছটায়। আগের দিন রাতেই ফিরোজ গল্পে গল্পে জানিয়েছিল, “হামারা গাঁও মে সবসে বঢ়িয়া দিখনেওয়ালা নজাড়া দো হ্যাঁয়, সানরাইজ অউর ঝরনা। টাইগার হিলসে বঢ়া নজাড়া এঁহিপে মিলেগাঁ শুভে সানরাইজ কা টাইম…”। সাতসকালেই মিলে গেল তার প্রমাণ। এরপর তৈরি হয়ে নিলাম ঝরনা দেখতে যাওয়ার জন্য। (Ranju Valley)
আগের পর্ব পড়ুন: রঞ্জু ভ্যালি, এক মনভোলানো অচিনগাঁও – প্রথম পর্ব
সকাল ৯টা বাজে। হোমস্টের সামনে বিশাল বড় পাথরের চট্টানের (ঢুঙ্গা ভিউ পয়েন্ট) ওপরে বসে পাখির চোখে দেখছিলাম গ্রামটাকে। ধীর পায়ে কাছে এসে দাঁড়াল বিবেক তামাং। গ্রামের ছেলে। মুখে কোনো কথা নেই। শুধু মুখভরা অনাবিল হাসি। বুঝলাম, ফিরোজ পাঠিয়েছে। আমাদের ঝরনা দেখতে নিয়ে যাবে। পাথুরে সিঁড়িপথ। ফুলে ফুলে সাজানো বাড়ির উঠোন পেরিয়ে জঙ্গলের পথ ধরল বিবেক। পাশাপাশি কোনোমতে দুটো পা রাখা যাবে এমন সংকীর্ণ পথ। বর্ষার জলে পুষ্ট তরতাজা ঝোপঝাড় পথের দখল নিতে ব্যস্ত। দিনের বেলাতেও উচ্চস্বরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। (Ranju Valley)

কিছুটা এগোতেই হঠাৎ সেই শব্দকে ছাপিয়ে উপচে পড়ে ঝরনার কলতান। কিছুক্ষণ আগে ভিউ পয়েন্টের ডানদিকে যে গোট-খোলা পায়ের নূপুরে নিক্কন তুলে চপল ছন্দে পাথরে পাথরে নেচে চলছিল, গভীর জঙ্গলের মাঝে একটা খাড়া চট্টান পেতেই লম্বা লাফ দিয়ে জলপ্রপাতের রূপ নিল। নাম ‘সরণ ফলস’। ভরা বর্ষায় তার রুদ্র রূপ। অফুরন্ত জলধারা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিচে কালচে গভীর খাত সৃষ্টি করেছে। তার সামনে ওপারে যাওয়ার একটা কাঠের সেতু। সেতু পার করে সেই প্রপাতের কিছুটা কাছে এগোতেই চোখে-মুখে শীতল পরশ বোলাল সেই দুরন্ত ধারাপাত। অবাক বিস্ময়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি সেখানে। খুশির জোয়ার নামে মনের মাঝে। গুনগুনিয়ে ওঠে হৃদয়, “আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…”। (Ranju Valley)

“চলিয়েঁ দিদি। অরভি তো দেখনা হ্যাঁয়…”। বিবেকের ডাকে চেতনায় ফিরে ওর পিছু নিলাম। গ্রামের প্রান্তসীমা জুড়ে বিস্তৃত সিঙ্কোনা প্ল্যানটেশনের পাশ দিয়ে পাহাড়ি পথে হাজির হলাম ‘গঙ্গা পার্কে’। কোনো কৃত্রিম উদ্যান নয়। প্রকৃতির সৃষ্টি অপূর্ব সুন্দর এক ভিউপয়েন্ট। এখানে এসে দাঁড়ালে দু’চোখে নেশা ধরায় গভীর সেনচল অরণ্য। শুধু গাছের মাথা। কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। গাছের পাতাগুলো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সবুজ চাঁদোয়া তৈরি করেছে। যেন পণ করেছে সূর্যের আলো ঢুকতে দেবে না বনের মধ্যে। তার সামনে আকাশ জুড়ে সবুজ পাহাড়ের ঢেউ। পাহাড়ের পা ছুঁয়ে বয়ে চলেছে চপল রাম্বি খোলা। সবুজের মাঝে একটু বৈচিত্র্য আনতেই রাম্বির সাদা শরীর নিয়ে ছুটে চলা। (Ranju Valley)

সেই মুহূর্তে জঙ্গলের মাথা ছুঁয়ে হঠাৎ উড়ন্ত মেঘের পর্দা নামল। মুহূর্তের মধ্যে সবুজ পাহাড় গেল হারিয়ে। মেঘমদির বৃষ্টিধোয়া রঞ্জুভ্যালির চিকন সবুজ রূপে ডুবতে ভরা বর্ষায় একবার আসতেই হবে। তবে সেসময় একটু মেনে নিতে হবে জোঁকের আদর। একটু আধটু রক্তদান করতেও হয় বৈকি। যদিও অক্টোবর-নভেম্বর এখানে আসার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। মনকাড়া সানরাইজ, কাঞ্চনজঙ্ঘার বাহার আর ভরা ঠান্ডা- অসাধারণ। শেষ স্নোফল হয়েছে বছর পাঁচেক আগে এক জানুয়ারিতে। (Ranju Valley)
এই পথেই আরো দেড় কিমি মতো উৎরাইয়ে গভীর জঙ্গলের ভিতরে হেঁটে দেখা মেলে অপূর্ব রাজারাণী ফলসের। কিন্তু বর্ষার শুরুতেই জঙ্গল আরও ঘন। ব্ল্যাক প্যান্থার আর ভাল্লুকের ভয়। তাই রাজারানী ফলস এবার অদেখাই থেকে গেল। (Ranju Valley)

বিবেক সেই দুঃখ ভোলাতেই যেন পথের ডান পাশে এক নার্সারির পাশ দিয়ে আরো গভীর জঙ্গলে নিয়ে গেল। না গেলে তো দেখাই হতো না, লোকচক্ষুর আড়ালে সবুজ বনচ্ছায়ার স্নেহে এক চনমনে পাহাড়ি কিশোরীর মতো বয়ে চলা ‘ছ্যাড়ছ্যাড়ে খোলা’কে। সেই নির্জনপুরে, খোলার জলতরঙ্গের সঙ্গে মিলে সুরের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করছিল ঝিঁঝিঁ ও ঘন্টাপোকার ডাক। গাছগুলোর গায়ে কত পুরনো পুরু শ্যাওলার স্তর! কোন্ অতীত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে তারা বনস্পতিদের গভীর সোহাগে জড়িয়ে রেখেছে! (Ranju Valley)
উঠোনে স্কোয়াশের মাচা। এককোণে মধুচাষ। বস্তির গা-ঘেঁষা জঙ্গল থেকে রাতে মাঝে মাঝে ভাল্লুক ঢুকে পড়ে মধুর লোভে। সাতদিন আগেই ভাল্লুকের উৎপাত হয়েছিল, জানাল স্থানীয় বাসিন্দা বিজন তামাং।
সবুজে সবুজ বনপথে হেঁটে আমরা হোমস্টেতে ফিরে এলাম যখন, তখন দুপুর ২টো। ততক্ষণে ফিরোজ দুপুরের আহার নিয়ে প্রস্তুত। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের চারপাশে গ্রামের টাটকা সবজি। মন ও পেট দুই-ই পরম তৃপ্ত হয়েছিল সেই স্বাদে-গন্ধে। (Ranju Valley)

এরপর দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মনের মাঝে তখনও গ্রামটাকে আরেকটু ঘুরে দেখার আকুল ডাক। ক্লান্তি সরিয়ে তাই আবার পথিক হলাম। সেই বৈকালিক লগ্নেই বিক্রমের ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে গল্পে মজে ছিলাম। দেখলাম সিঙ্কোনা প্ল্যানটেশন বাংলোর সামনের সবুজ লনের শেষ প্রান্তে একটা গাছ থেকে একটা থালার আকারের পিতলের ঘন্টা ঝোলানো। এর প্রয়োজনীয়তা জানলাম কেয়ারটেকার বিক্রমের কাছেই। রঞ্জু ভ্যালি প্লে গ্রাউন্ডে সকাল ৬টার মধ্যে উপস্থিত হয় সিঙ্কোনা বাগানের শ্রমিকেরা। সেখান থেকে গ্যাংম্যান তাদের বাগানের বিভিন্ন এলাকায় কাজ ভাগ করে দেন। এই কর্মচারীদের সময় জানাতে ঘন্টা বাজানো হয় চারবার- সকাল ৬টা ও সাড়ে ছটা কাজে যোগদান, সকাল ১১টা টিফিনের সময়, আর বিকেল ৩.৩০-এ ছুটির সময়। (Ranju Valley)

গল্প শেষে রঞ্জুভ্যালির এক কিমি আগে লালুং বস্তিতে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম কিছুক্ষণ। বস্তির শুরুতেই একটা শিবমন্দির। পাশে অনামি চঞ্চল ঝরনা। প্রতিটা বাড়িতে ফুলে বাহার। উঠোনে স্কোয়াশের মাচা। এককোণে মধুচাষ। বস্তির গা-ঘেঁষা জঙ্গল থেকে রাতে মাঝে মাঝে ভাল্লুক ঢুকে পড়ে মধুর লোভে। সাতদিন আগেই ভাল্লুকের উৎপাত হয়েছিল, জানাল স্থানীয় বাসিন্দা বিজন তামাং। (Ranju Valley)

ঘোরাঘুরির মাঝে একসময় নির্জন বস্তির শরীর জুড়ে অন্ধকার নামে। পাশেই মাটিপাথরের শর্টকাট পিচ্ছিল পথ। সেই উৎরাই পথেই একসময় লালুং বস্তি থেকে রঞ্জুভ্যালিতে ফিরে আসি। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। নিরালা বারান্দায় মুখোমুখি আমি আর বর্ষায় ভিজতে থাকা পাহাড়। বুঁদ হয়ে শুনি বৃষ্টির গান। সময় গড়িয়ে চলে গভীর রাতের টানে। মনে হয়, নিজের সাথে একান্তে কথা বলার এক শান্তির ঠিকানা এই গ্রাম।

পরদিন ফেরার পালা। মোটে দু’দিনের গ্রাম সফর এবারের মতো ইতি। কিন্তু হাতে একটু সময় বেশি নিয়ে আসলে এর কাছেপিঠে লামহাটা(১৫ কিম), মংপু (১৪ কিমি), তিনচুলে (২২কিমি), তাকদা (২৬ কিমি), যোগিঘাট (১৯কিমি), রঙ্গারুন (১৭কিমি) দার্জিলিং (১৮কিমি) ঘুরে নেওয়া যায়। দার্জিলিং থেকে দূরত্ব কম হওয়ায় অনেকই কোলাহল মুখর শহর থেকে দূরে এমন শান্তির নীড়ই খুঁজে নিচ্ছেন।

একসময় পাহাড়ি পথের বাঁকের তালে আমাদের বাস গড়িয়ে চলে সমতল অভিমুখে। যদিও মন হারিয়ে যায় রঞ্জু ভ্যালিতে। ফিরতি পথে মনের আয়নায় ভেসে ওঠে দুদিনের মধুর যাপনের টুকরো জলছবি। মেঘমদির সবুজ অরণ্য, চপল ঝর্ণা, পাহাড়ি মানুষের হাসিমুখ, সুখ-দুঃখের রোজনামচা…কত্তো কিছু! কখন যেন ঠান্ডা হাওয়ায় চোখ জুড়িয়ে আসে। ঘুম ঘোরে মনের অতলে শুনতে পাই রূপকথার অচিনপুর থেকে বিবেক তামাং এর ভালোবাসার স্বর, “দিদি, ভুল না মত, আনা জরুর। আগলি বার ফির একসাথ রাজারানী ফলসকে দোয়ার…”। জাগরণে তাই কথা দিয়ে আসি,”আবার আসিব ফিরে”।
ছবি:লেখক
পেশায় শিক্ষিকা। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পর্বত পদযাত্রী, পর্বতারোহী ও ভ্রামণিক এবং এই বিষয়ক লেখিকা।
