রাশা ওমরানের জন্ম সিরিয়ার তারতুস প্রদেশের মাল্লাজাহ অঞ্চলে ১৯৬৪ সালে। আলাউই সম্প্রদায়ের আবাসস্থল তারতুস প্রদেশ ছিল অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু স্থান; প্রগতিশীল, উচ্চশিক্ষিত মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীদের বাস। রাশা ওমরানের বাবা মোহাম্মদ ওমরান ছিলেন একজন সুপরিচিত কবি, কর্মী এবং সাংবাদিক। শিশুকাল থেকেই রাশা দেখে এসেছেন যে তাঁদের বাড়ি ছিল লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিকদের সাংস্কৃতিক সমাবেশের জায়গা। রাশার যখন চার বছর বয়স, তখন তাঁর পরিবার দামাস্কাসে চলে আসে। সেখানেও তাঁদের বাড়ি আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের মতো ছিল না। রাশার মতে, তাঁদের বাড়ি ছিল একটা লাইব্রেরির মতো। সর্বক্ষণ চারপাশে অজস্র বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। কবিতার পরিমণ্ডলের মধ্যেই তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন।
রাশা প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করবার জন্য। কিন্তু প্রেম তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল অন্য পথে। প্রেম এবং বিবাহ, তারপর একমাত্র কন্যার জন্ম। জীবন অন্য খাতে বইতে শুরু করবার আগেই এল আঘাত। পঁচিশ বছর বয়সে পৌঁছে যাবার আগেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেল রাশার। তবে ১৯৯০ সালে রাশা আবার ভর্তি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার আরবি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন। সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ধীরে ধীরে বুদ্ধিজীবী সমাজ রুখে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। সেখানে ইস্রায়েল এবং ইহুদীবাদকে প্রতিহত করবার নামে ধীরে ধীরে শিকড় গেড়ে বসেছিল নিষ্ঠুর একনায়কতন্ত্র যা বিরোধী স্বর এবং গণতান্ত্রিক ভাবনার কণ্ঠরোধ করে। ধর্ম, রাজনীতি, যৌনতা এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি একেবারে নিষিদ্ধ করা হল।

২০১১ সালে সিরিয়াতে যুবসমাজের স্তরে স্তরে ছড়িয়ে পড়ছিল বিপ্লবের আঁচ। বিপ্লবের সমর্থনে প্রথম থেকেই দাঁড়িয়েছিলেন রাশা। তিনি বলেন ‘একনায়কতন্ত্র চলছে সিরিয়াতে, যে সরকার নিজের নাগরিকদের খুন করে, আমি তাকে সমর্থন করি না।’ রাশাকে কন্যা-সহ সিরিয়া ছেড়ে যাবার আদেশ দেওয়া হয়। কিছুটা বাধ্য হয়েই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সিরিয়া ছাড়েন রাশা। নাহলে তাঁকে গ্রেফতার হতে হত। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে আরব লিগের হেডকোয়ার্টারের সামনে সিরিয়াতে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনবার জন্য অনশন আন্দোলন গড়ে তোলেন। বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ আছে তাঁর। কবিতা ছাড়াও নিয়মিত আরবি ভাষার সংবাদপত্রে কলাম লেখেন রাশা। জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত এই কবি এখন মিশরের কায়রোতে বসবাস করেন।
রাশার বাবা স্বপ্ন দেখতেন যে মেয়ে একদিন বিরাট বড় লেখিকা হবে। উপন্যাস লিখবে। কারণ শিশুকাল থেকেই রাশা প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারিনী। রাশার কবিখ্যাতি তাঁর বাবা দেখে যেতে পারেননি। রাশা মনে করেন, উপন্যাস লিখতে গেলে নিজের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, যা সহজ নয়। রাশার কবিতায় তাঁর প্রেমের আশাভঙ্গের কথা, একাকী নির্বাসিত একটি মেয়ের কষ্ট, দূর থেকে দেখা জন্মভূমিকে ক্রমাগত রণভূমিতে বদলে যাওয়ার কষ্ট– এই সব অনুভূতি মিলেমিশে যায়।
শাল
আমি জানি
ভালোবাসা এমন সব জায়গায় লুকিয়ে থাকে
যে কেউ তাকে খুঁজে পায় না
কখনও ভিতু সাপের মতো একটুখানি উঁকি দেয়
হয়তো কোনওদিন তার সম্পূর্ণ শরীরটা বের করে
সে আমারই হাতের ’পর বিশ্রাম নেবে।
চিরপ্রেমিকা আমি
তাকে এক দীর্ঘ চুম্বন দেব
এবং অপেক্ষা করব
আমার চুম্বনে
রূপকথার গল্পের মতো
ঝলমলে রাজকুমারে রূপান্তরিত হবে না সে।
সে আমার শরীরকে পাকে পাকে জড়াবে,
তারপর চলে যাবে দীর্ঘ শীতঘুমে।
আমি ছাড়িয়ে নেব তার মহার্ঘ্য খোলস
তারপর সেই নির্মোক থেকে নির্মাণ করব
এক রুচিসম্মত শাল
এভাবেই বাকি জীবনটা কেটে যাবে।
এক নারী তার কাঁধে ভালোবাসার মহার্ঘ্য খোলস
দিয়ে তৈরি রুচিসম্মত শাল রেখে ঘুরে বেড়াবে
সে খুঁজবে সেই জাদুমন্ত্র
যেটা তিনবার জপ করলেই
তার শরীর ঘিরে ঘুমিয়ে থাকা সাপটা জেগে উঠবে
তারপর সেই সাপটা আবার শীতঘুমে যাবার আগে
দীর্ঘ চুম্বন দেবে
সেই নারীকে।
স্বাভাবিক জীবন
তাছাড়া আমিও জানি…
প্রেমের জন্য কেউ মারা যায় না।
আমি স্বাভাবিক একজন মহিলার মতোই দিনযাপন করি।
সকালে উঠি, কফি খাই,
একলা একটা মেয়ে যা যা করে
সেসব করি।
তারপর, ঘুমোতে যাওয়ার আগে
ঝাড়ু দিয়ে ফেলে দিই
মেঝেতে সারাদিন ধরে
যেসব মৃত্যু জমেছে… সেগুলো ।
প্রতিদিন এটা করি।
অথচ প্রতিদিন ভুলে যাই ওই গর্তটা বুজিয়ে দিতে
যেটা আমার আত্মার মাঝে তৈরি হয়েছে
তুমি চলে যাওয়ার পরে
ওই গর্তটা থেকে মৃত্যু একটু একটু করে চুঁইয়ে পড়ে
ধুলোর মতো…
বেরিয়ে আসে আমার শরীর থেকে
এভাবে বাঁচি আমি
এবং প্রমাণ করে দিই
যে প্রেমের জন্য কেউ মারা যায় না।
জাদুচিহ্ন
তোমার জন্য আমার যে প্রেম
আমি জানি যে সেটা একটু অদ্ভুত
একদিন এই প্রেমকাহিনি
নারীপ্রজন্মের মুখে মুখে ফিরবে
রূপকথার মতো
সমস্ত শূন্যতার মধ্যে
এখন এই যে অণুমাত্র হয়ে আছি আমি
তখন জ্বলে উঠব নক্ষত্রের মতো প্রতিবার
যখনই কোনও এক দিদিমা তার নাতনিকে শোনাবে
সেই কাহিনি।
শোনাবে
এক প্রেমিকার গল্প
যে নিজের ত্বকে
এঁকে রেখেছে একটা জাদুচিহ্ন
চিহ্নটা একটা ঘরের মতো দেখতে
যার জানালাগুলো খোলা
প্রবেশপথে একফালি ঘাসজমি শিশিরে ভেজা…
যদিও তার প্রিয় মানুষটি ঘরের মধ্যে ঢুকতে চেয়েছিল,
অথচ খেয়াল করেনি জাদুচিহ্নটা
ওই চিহ্নটার জন্যই
মানুষটার হাতদুটো হয়ে গিয়েছিল ফলন্ত খেজুর গাছ।
কারণ প্রত্যেকবার যখনই সে জানালার কাছে যেত,
সেটা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করত।

একাকিত্বের জাগলার
১
আর কী বা হওয়া সম্ভব
আর কীই বা হওয়া সম্ভব,
যখন একটা হাত গিয়ে কোনওমতে বুজিয়ে দেয় হৃদযন্ত্রের ছিদ্র,
আর একটা হাত শরীরের ঝরে পড়া পাতা কুড়িয়ে নিতে চায়।
কিংবা যখন দুটো ভুরুর মাঝখানে বুলেটের গর্তটাও
পুরোপুরি মেরে ফেলতে পারে না।
মাথার উপরে শুকনো ফলের সাথে ক্যাকটাসের ছবি ভেসে ওঠে।
আমি ধুলোমাখা পোশাকে ভিখিরির মতো এক কোণে বসে থাকি।
ছোট ছোট অজস্র নুড়ি পরশপাথর আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।
পথচারীরা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে আমাকে দেখে, চলে যায়।
আর কী হবে? কী হওয়া সম্ভব?
আমি স্নানঘরে গিয়ে কলের নীচে একটা বড় তোয়ালে রাখি।
ফোঁটা ফোঁটা পড়ে যাওয়া জলের শব্দ বুঝিয়ে দেয় আমি কতখানি একা।
হৃদযন্ত্রের ছিদ্রটা আর কিচ্ছু নয়,
কথাবার্তা যাওয়া-আসার পথ মাত্র।
যে কথাগুলো আমি প্রতিদিন বলে চলেছি, কিন্তু কে শুনছে?
২
চারপাশে কী ঘটছে না ঘটছে, ওসব নিয়ে বিশেষ ভাবি না আমি।
ফুটন্ত জলের মধ্যে হাত চুবিয়ে দিই, তারপর দেখি কেমন বুদবুদের মতো
ফোসকা পড়ে আমার আঙুলে। যন্ত্রণায় মরে যাই,
কিন্তু হাতটা অমনিই রেখে দিই।
কেউ খেয়াল করে না। আজ রাতে বাড়িতে অনেক অতিথি আসবে।
আমি ফুটন্ত জল নিয়ে অলৌকিক জাগলিংয়ের খেলা দেখাব তাদের।
আমি জল থেকে হাতটা বের করে রান্নাঘরের টাইলের উপরে রাখি,
তারপর যন্ত্রণার সঠিক উৎসটা খুঁজে বের করবার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাই।
আমার জ্বলে যাওয়া হাতটা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে টাইলের উপরে।
আমাকে চারপাশে অনেক অতিথিরা ঘিরে আছে। তারা তাদের সদিচ্ছা
যেগুলো টাইলের উপরে চুঁইয়ে পড়েছিল, সেগুলো সমেত টাইলটা ভালো করে মুছে দেয়।
ওরা বোঝেনি, ওই সদিচ্ছাগুলোর জোরেই আমি কিছুটা আরাম পেয়েছিলাম।
আমি সবার মাঝে বসে আছি পোশাকের প্রান্ত বিছিয়ে,
আমার জ্বলে যাওয়া হাত নিয়ে,
যে তাঁর সব কষ্ট ওই ফুটন্ত জলের থেকে তুলে নিয়ে
নিজের পোশাকের নীচে লুকিয়ে
সবার মাঝে চুপচাপ বসে থাকবে।
তারপর চলে যাবে নিজের শূন্য বিছানার দিকে
যন্ত্রণার সঠিক উৎস খুঁজে বের করবার জন্য।

৩
আমি জানতে চাই কে, কে সেই নারী?
যে আমার সব যন্ত্রণা, মানে… দাঁতব্যথা, বাঁ চোখে লেগে থাকা
অসীম ক্লান্তি সব, সবকিছু সমেত ধার করে নিতে চায়!
আমার মতোই কালো পোশাক পরতে পছন্দ করে সে।
আমার মতোই যাহোক করে কোনওমতে সেজে নেয় সে
কোনও খুঁটিনাটি কিচ্ছুটির তোয়াক্কা না করে।
কে সেই নারী, যার শরীরটা একদম আমার মতোই;
বাইরে নাচতে গিয়ে ঠিক প্রজাপতির মতো হাল্কা হয়ে যায়, আবার-
ঘরের ভেতরে ভারী ফসিলের মতো অনড় জড়বস্তুতে পরিণত হয়।
কে সেই নারী, যে বারে গিয়ে সেই বিশেষ যুবকের সাথেই কথা বলে,
যার সঙ্গে আমিও ফ্লার্ট করে থাকি প্রায়ই! কিংবা সেইসব পুরুষের সঙ্গে
যারা আমার কোমরের কাছে জমে থাকা সময়, আমার হাতের পাতার
কুঁচকে যাওয়া-রেখাগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না; বরং মোহিত হয়-
আমার চোখের মণিতে ওয়াইনের ঝলক, কিংবা নাকের পাটায়
রক্তিমাভা যেটা ফ্যাকাসে আলোতেও ধরা পড়ে, সেসব নিয়ে…
আমি জানতে চাই কে, কে সেই মহিলা, যে নিজের নাম বলতে গিয়ে
আমার নামটাই বলে; তাছাড়া আমার মতোই একই ভুল বারবার করেও
এতটুকু লজ্জিত হয় না। এমনকী আমার মতোই- হৃদয় ভেঙে গেলেও
চুপচাপ সেটা আবার আমার বুকের কুঠুরিতে তুলে রেখে দেয়।
প্রতিটি কবিতা কবির লিখিত অনুমতিসাপেক্ষে ভাষান্তরিত
*ছবি সৌজন্য: Arablit, The New York Review
জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।
3 Responses
খুব ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ!
খুব ভালো লাগলো।