Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors
Rathayatra
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

রথের দিন মন নেচে ওঠে না, এ আবার হয় নাকি? কচিবেলায় বাবা-মা এবং ঠাকুমা-দিদিমা মিলে আমাদের রথ সাজিয়ে দিতেন; একটু বড় হলে তখন আর নিজের রথ নয়, পাড়ার বাচ্চাদের রথ সাজিয়ে দিতাম; এরপর আমার মা-বেলায় নিজের মেয়ের রথ, আর এই সেদিনও বসে বসে দেখেছি নাতির জন্য তার ফরমায়েশ মতো আমার মেয়ের নিপুণ রথ সাজানো। ভাবলে সে এক মস্ত বিবর্তনই বটে। খুব মনে পড়ে পাড়ায় পাড়ায় বড় রথ আর ছোট রথের চাপা লড়াই। লিখতে গিয়ে দেখছি যে, সব পর্বগুলোই মনের মধ্যে বেশ নিবিড় আয়েস হয়ে আছে। 

একেবারে বালিকাবেলায় জানতাম না, যে এটা বেশ পুজোপাঠ সমেত এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং তা হয় তিথিনক্ষত্র মেনে। ঠাকুমা পাঁজি দেখে যে দিন বলতেন, আজ স্নানযাত্রা, সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যেত টুকরো ন্যাকড়ায় মুড়ে রাখা পুরনো কাঠের রথটাকে গুদাম ঘর থেকে বার করে, ধুয়ে শুকিয়ে আবার নতুন করে ফেলার উদ্যোগ। এই তো এল বলে- ‘আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া’– ঠাকুমার পাঁজিতে রথের দিন। আর ঠিক এই সময়ে, পাড়ায় পাড়ায় হাঁক পাড়ত দু’জন ফেরিওয়ালা। একজন ঝুড়ির মধ্যে খড় বিছিয়ে সাজিয়ে রাখত একচালের নানা মাপের ছাঁচের ঠাকুর– জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা; আর অন্যজনের কাছে থাকত– তালপাতার ভেঁপু আর তালপাতায় বোনা লাল-হলুদ চৌখুপি কাটা চৌকো চৌকো পাখা। একটা লম্বা বাঁশের আগা থেকে গোড়া অবধি গুঁজে গুজে সাজানো ভেঁপুগুলি। একটা ভেঁপু বাজাতে বাজাতে সে আসা মানেই, রথ এসে গেল। 

একেবারে শৈশবের কথা ভাবলে এখন আর তেমন কিছু মনে পড়ে না। তবে পাঁচ-ছ’বছর বয়সের মাতামাতির স্মৃতি বেশ সতেজ; আর তার সঙ্গে ঠাকুমার বলা মাখো মাখো সব গপ্পো। পাড়ার বন্ধুদের যখন সকলের একতলা রথ, আমাদের দু’বোনের তখন প্রায় আমাদের মাপের দোতলা রথ; টুকরো টাকরা কাঠ দিয়ে বাবা বানিয়ে দিয়েছিলেন, একটা পুরো দুপুর জুড়ে। ইশকুল থেকে ফিরেই মা সেটা সাজাতে বসে যেতেন, বাবার অ্যাসিসটেন্ট হয়ে; রঙিন ঘুড়ির কাগজের বদলে, পাতলা পাতলা মার্কিন কাপড়ের ওপর প্রথমে কিছু বড় বড় নকশা এঁকে, শুকিয়ে এবার সেগুলি আঠা দিয়ে টান টান করে রথের গায়ে লাগানো হল। তার ওপর তুলি দিয়ে লাল হলুদ, গাঢ় নীল আর কালো রঙের বাহারে আরও নানান কারিকুরি; এঁকে দিতেন ফুলের নকশায় মালার মতো আলপনা। সবশেষে চূড়ার নিচে সাদা আর হলুদ রঙের রিলিফে জগন্নাথের গোল গোল কালো চোখ দু’টি।

রথ একটা হলেও, তিন ঠাকুরের কথা মাথায় রেখে রথের চূড়ায় লাগিয়ে দিতেন, তিন রঙের তিনটি ‘ধ্বজা’ আর রথের চূড়ার প্রতীক সেই একহালি কচি তালপাতা।  পুরনো জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রাকেও এমন সুন্দর করে রং করে দিতেন যে, মনে হত একেবারে নতুন। আর নতুন করে আঁকা হত রথের ঘোড়াও। বাবার হাতে বানানো কেশর ওড়া সেই ঘোড়ার রং সাদা হলেও তার গায়ে আঁকা সাজসজ্জা ছিল দেখবার মতো। 

‘আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া’– ঠাকুমার পাঁজিতে রথের দিন। আর ঠিক এই সময়ে, পাড়ায় পাড়ায় হাঁক পাড়ত দু’জন ফেরিওয়ালা। একজন ঝুড়ির মধ্যে খড় বিছিয়ে সাজিয়ে রাখত একচালের নানা মাপের ছাঁচের ঠাকুর– জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা; আর অন্যজনের কাছে থাকত– তালপাতার ভেঁপু আর তালপাতায় বোনা লাল-হলুদ চৌখুপি কাটা চৌকো চৌকো পাখা। 

এরই মধ্যে পাশের পাড়ায়, মামারবাড়ির বাগান থেকে দিদিমা তুলে রাখতেন, কচি তালপাতা, ক্রোটন, আর কুঁড়িসমেত কামিনীর ডাল; সঙ্গে তাঁরই আদর যত্নে, বাগানেই ফোটা এক সাজি গন্ধরাজ, বেল, জুঁই আর নীল ঝুমকোলতা। আমারা সেগুলি নিয়ে এলে মা খুব সুন্দর করে মালা গেঁথে রথে সাজিয়ে দিতেন।  বেশিরভাগ রথে সাজানোর যে মালা দেওয়া হত, তা হল টগরকুঁড়ির; আর ঠাকুরের গলায় দুলত- ফোটা টগরের গোড়ে। ঠাকুমা বানিয়ে দিতেন রথের রশিটি। শাড়ির পাড়কে তিন গুছি করে বিনুনি বেঁধে। তার মাঝে মাঝে লাগানো থাকতো, কুচি কুচি কাঁসার ঘুঙুর। রথ টানলেই টুংটাং বাজত। সন্ধের আগেই রথ টানা শেষ হয়ে যেত বলে প্রদীপ জ্বালানো হত না।

তিন ভাইবোনের ছবি খোদাই করা ‘পুরীর স্মৃতি’ লেখা একটা ছোট্ট পেতলের থালায় প্রসাদ হিসেবে নকুলদানাও সাজিয়ে দিতেন ঠাকুমা। কোলে করে নামিয়ে আনা হত সেই সাজানো রথ– দোতলায় ঠাকুমার ‘কালো’ ঘর থেকে একতলার রকে। প্রদীপের আলোয় আরতি করে, জয় জগন্নাথ বলে শাঁখ বাজিয়ে, রথের রশিতে আলগা টান দিয়ে, যাত্রা করিয়ে দিতেন ঠাকুমা। দড়ি ধরে দু’তিন কদম এগোতে না এগোতেই শুরু হয়ে যেত, এর ওর রথ থেকে বন্ধুরা মিলে প্রসাদ মানে- বাতাসা, গুঁজিয়া, আর কুচোনো শসা ও কলা ভাগ করে খাওয়া।

রথ টানতে গিয়ে এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় হোঁচট খাওয়ার আগেই কেউ না কেউ এসে, রথটাকে উঁচু করে ধরে, টুক করে পার করে দিতেন। আমাদের সকলের কাছেই থাকত তালপাতার ভেঁপু। বাচ্চাদের আনন্দে আর ছোট্ট ছোট্ট রথগাড়ির কাঠের চাকার আওয়াজে কিছুক্ষণের জন্য ঝুমঝুমির মতো বেজে উঠত এ পাড়া ও পাড়ার সরু সরু সব রাস্তা। সেদিন আমরা গাদি- কিৎকিৎ এইসব দামাল খেলা ছেড়ে, সকলেই মশগুল হয়ে থাকতাম এক অন্যরকম ঘোরে। মোড়ের বাঁক ঘুরে হুট করে বেরিয়ে আসা সাইকেল বা রিকশাও আমাদের সময় দিত পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার।

পাড়ার গণ্ডির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, তাই আমাদের শিরোমণিপাড়ার বাড়ির সামনের রাস্তা– মানে এ মাথায় গাবতলা থেকে ও মাথার কামারপুকুর অবধি কয়েকবার আপ ডাউনেই শেষ হয়ে যেত রথের বিকেল। গোধূলির আলো মেখে ঠিক এই পড়ন্ত বিকেলে বাঁ হাতি কুলীনপাড়া থেকে শিরোমণিপাড়ায় একটা তিনতলা রথ ঢুকত কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে। আমাদের মতো একচালে নয়, তিন ঠাকুরের আলাদা আলাদা বিগ্রহ দিয়ে সাজানো। নীচের তলায় একজন পণ্ডিত বসে থাকতেন প্রণামীর থালা কোলে। আর রথের পিছনে দাঁড়ানো খালি গায়ে ধুতি পরা একজন সমানেই চামর দোলাতেন যাঁকে আমরা মস্ত বীর এবং সাহসি ভাবতাম। এই রথের রশি ধরতে বড়রা এগিয়ে আসতেন এবং অনেকেই প্রণামীও দিতেন। বড় রথ চলে যাওয়ার পরও অনেক দূর থেকে শোনা যেত সেই কাঁসরঘণ্টার আওয়াজ। 

Gods in the chariot
গপ্পে পুরীর রথের যে ছবি ঠাকুমা তুলে ধরতেন, তার কিছু কিছু দেখতাম বাবার আঁকা ছবিতেও। অলঙ্করণ: শ্রী অশোক মুখোপাধ্যায়

আমরা যখন দু’বোন রথসমেত বাড়ি ঢুকতাম, মা সেটা ওপরে তুলে নিয়ে গিয়ে রাখতেন তিনতলার ঠাকুরঘরের সামনে; ঠাকুমা আবার আরতি করে রথটি নামিয়ে নিয়ে যেতেন তাঁর ঘরে। ওই ঘর সাতদিনের জন্য হয়ে যেত জগন্নাথের মাসির বাড়ি। এই ঘরে যে দক্ষিণমুখো কাচের আলমারি ছিল, সেখানেই মাটির হাঁড়ির মধ্যে বেতের কুনকেতে থাকতেন ধান্যলক্ষ্মী। রথ থেকে নামিয়ে তিনজনকে আসন দিয়ে সাজিয়ে, পাখার বাতাসে জুড়িয়ে সকাল-সন্ধ্যে পুজো করতেন ঠাকুমা। আর রাতে তাঁর দু’পাশে দুই বোনে শুয়ে একই গপ্পো– তবু কতবার শুনতাম; সত্যিকারের পুরীর রথের গপ্পো। 

আমার ঠাকুরদার পুলিশে চাকরির সূত্রে উড়িষ্যার নানা জায়গায় তাঁরা সংসার করেছেন; আর পুরীতেই থেকেছেন সব চেয়ে বেশি। ঠাকুমা চোখ জ্বলজ্বল করে বলতেন, সর্বোচ্চ পদে থাকার ফলে, জগন্নাথের রথের সামনেই দাদু বসতেন। ইংরেজ আমলের পুলিশের উর্দি ছিল খাকি ব্রিচেস আর মাথায় এক পালতোলা টুপি, যার ঘাড়ের কাছ থেকে কোমর অবধি ঝুলত কালো সিল্কের কোঁচানো ঝালর; ইয়া বড় গোঁফজোড়ায়, তাঁর সেই ছ’ফুট আড়াই ইঞ্চি লম্বা বরকে দূর থেকেও তাই চেনা যেত। আর বলতেন, রথের রশি ধরতে গিয়ে তাঁর সেই এক মহাকাণ্ডের  গপ্পো। দাদুর কথা না শুনে, ভিআইপিদের জায়গা ছেড়ে, আমার পাঁচফুটি ঠাকুমা একছুটে রথের সামনে চলে এসেছেন দড়ি ধরতে; কিন্তু ভিড়ের চাপে গোল পাকিয়ে তাঁর তো প্রায় মরার উপক্রম। ঠাকুরদা রথের ওপর থেকে ভিড়ের মধ্যে বউকে দেখতে পাওয়ায় পুলিশ পাঠিয়ে কোলে করে তুলে আনিয়েছিলেন।

বিভোর হয়ে ঠাকুমা বলতেন, তিন রথের তিনটি রশি আসলে তিনটি সাপ; জগন্নাথের রথ টানছেন নাগিনী শঙ্খচূড়, বলভদ্রের বাসুকি আর সুভদ্রারটি টানছেন আর এক নাগিনী স্বর্ণচূড়া। জগন্নাথের ‘নন্দিঘোষ’, বলভদ্রের ‘তালধ্বজ’, আর সুভদ্রার ‘দর্পদলনী’ বা ‘পদ্মধ্বজ’- রথের নাম, রথের বারোটি ঘোড়ার নাম, কোন রথ কত টুকরো কাঠ দিয়ে তৈরি- এসব শুনতে শুনতেই ঘুম এসে যেত। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙেও মনে হত, যেন এক মস্ত শোভাযাত্রার ভিড়ে আমিও হারিয়ে গেছি। এরই মধ্যে ক্লাস ফোরে পড়বার সময় বছর তিনেক হস্টেলে থেকে পড়তে হলে, সবচেয়ে বেশি কষ্ট হত রথের সময় বাড়ি যেতে না পেরে। মানা, টুকি, দেবুদের রথ টানার কথা মনে পড়ে কেঁদে ভাসাতাম। রথের দিন নৌকো চড়ে খড়দার ওপারে, শ্রীরামপুরে মাহেশের রথ দেখে ফিরে অন্যদের বলা সেই ‘পেষাপেষি’ ভিড়ের  গপ্পোগুলোও মাঠে মারা যেত। আর ভাবতাম, এই বুঝি গোল গোল চশমা পরে, চরণ স্যাকরাদাদু এলেন, নিক্তিতে খানকয়েক লাল-কালো কুঁচফল বসিয়ে একরত্তি সোনা মাপতে। ওইদিন একুকুচি হলেও সোনা কেনার রেওয়াজ ছিল বাড়িতে।  

গোধূলির আলো মেখে ঠিক এই পড়ন্ত বিকেলে বাঁ হাতি কুলীনপাড়া থেকে শিরোমণিপাড়ায় একটা তিনতলা রথ ঢুকত কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে। আমাদের মতো একচালে নয়, তিন ঠাকুরের আলাদা আলাদা বিগ্রহ দিয়ে সাজানো। নীচের তলায় একজন পণ্ডিত বসে থাকতেন প্রণামীর থালা কোলে। আর রথের পিছনে দাঁড়ানো খালি গায়ে ধুতি পরা একজন সমানেই চামর দোলাতেন যাঁকে আমরা মস্ত বীর এবং সাহসি ভাবতাম। 

গপ্পে পুরীর রথের যে ছবি ঠাকুমা তুলে ধরতেন, তার কিছু কিছু দেখতাম বাবার আঁকা ছবিতেও। পরে  দূরদর্শনে যখন পুরী থেকে রথযাত্রার সরাসরি সম্প্রচার হত, তখন আমাদের সঙ্গে না ছিলেন বাবা, না বড় পিসিমা, না সেই ঠাকুমা– কেউই আর বেঁচে নেই। গপ্পো বলতে বলতে ঠাকুমার যেমন মনখারাপ হত দাদু বেঁচে নেই বলে, আমারও ঠিক তেমনই মনখারাপ হত, বাবা, ঠাকুমা আর আমাদের বড় পিসিমা– মামণির জন্য, যাঁরা পুরীতে থেকে বহুবছর এই রথযাত্রার সঙ্গে জুড়ে ছিলেন এবং অনর্গল ওড়িয়া বলতে ও লিখতে পারতেন।

বড় হয়ে কলকাতায় এসে দেখি, সাজানো রথ বিক্রি হচ্ছে। ফুলের বদলে খইয়ের মালা, রাংতা, চকচকে মার্বেল কাগজ আর টুনি দিয়ে সাজানো। বাচ্চারা রথ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরছে আর প্রণামী সংগ্রহ করছে। তখন আমি ক্লাস সেভেন; বাবা সদ্য চলে গেছেন। মা ঠাকুমা যেন কেমন হয়ে গেলেন। সংসারটাই বদলে গেছে। বাগবাজার, শোভাবাজার, রাজবল্লভপাড়ায় থাকা বন্ধুরা বলাবলি করছে- কোন কোন মন্দিরে কীরকম পুজো হয়; আমি আর বোন নতুন পাড়ায় ঘরবন্দি। হলুদ রঙের একটা স্কার্টের কাপড়ে ফেব্রিক পেইন্ট করার আয়োজন করছি; হঠাৎ কোথা থেকে কী একটা কাজে সেদিনই মায়ের কাছে এসে হাজির, আর্ট কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়া মানিকদা (চিত্রী অশোক ভৌমিক)। আমাকে আঁকতে দেখে খুব উৎসাহ নিয়ে বসে পড়ে বলল, কী সব হিজিবিজি আঁকছিস! আজকে তো রথ, আমাকে দে। জগন্নাথ এঁকে দিই। আমার কাছে একটাই রং ছিল- কালো। তাই দিয়েই কাঁচা হলুদ জমিতে জব্বর তুলির টানে জমে গেল রথযাত্রা। 

এর পর আর রথ টানিনি। তবে পাড়ায় পাড়ায় বেরনো রথ দেখতে ছুটে গেছি, আঁচল পেতে ধরেছি হরির লুঠের বাতাসাও। আর প্রতি বছর প্রাণভরে সাজিয়েছি আমার সেই ছোট্ট মেয়ের রথ, এমনকী কলেজে ছুটি নিয়েও। তবে সে সব তো শহরে থেকে শহরের মতো রথ সাজানো। কিন্তু মেলায় মেলায় ঘুরেছি অনেক। কলকাতার কত জায়গায় যে রথের মেলা বসে! গাছ, ঝুড়ি, কুলো, পাখা এবং অবশ্যই ভেঁপুও। গ্রামের মেলায় দেখেছি, মেয়েরা প্রায় সবাই একখানা করে জাম্বো সাইজের দু’ভাঁজ করা পাঁপড় ভাজা খেয়ে, একটা করে উজ্জ্বল লাল হলুদ রঙের তোতাপুলি আম আর তালপাতার পাখা কিনে ‘হাতে পো, কাঁখে ঝি’ নিয়ে ঘরে ফিরছে।

১৯৭৩ সাল থেকে কলকাতায় শুরু হল ইস্কনের রথ বেরনো। তখনও টিভি আসেনি; পরদিন খবরের কাগজে কাগজে ছবি। সাহেব-মেম একযোগে হরিনাম করতে করতে নাচছে। সে কী উত্তেজনা! মেয়ে  মোহন্ত তায় মেমসাহেব। আর এই হালে দেখলাম গল্ফগ্রিন থেকে এক নৃত্যশিল্পীর রথের শোভাযাত্রা।  তাঁর নাচের ইশকুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ওড়িশি নাচের পোশাক পরে নাচতে নাচতে আসছে। আমার তখনকার আস্তানা– আনোয়ার শাহ রোডের ‘প্রভাকর’ বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। সাতদিন ধরে দফায় দফায় ভোগ, হোমযজ্ঞ আর ঠাকুরের বেশ বদল। এই রথে জগন্নাথ একা। উল্টো রথে আবার এমনি করেই তাঁর ফেরাও।  

আমার মেয়ের জন্ম প্রায় রথের সময়। ১৯৮৩ সালে রথের দিনই তার জন্মদিন পড়ায়, ওর দুই পাড়াতুতো আদরের দাদু– ওকে সাজানো রথ উপহার দিয়েছিলেন। তিনখানা রথ পেয়ে ও তো দিশেহারা; ওর এক বন্ধুর মা তো বলেই ফেললেন, ‘এতগুলো রথ টানতে টানতেই ও বড় হয়ে যাবে।’ মানে খরচ করে আমাকে আর কোনওদিনই রথ কিনতে হবে না। এই এত বছর বাদে ২০২১, আবার আমার মেয়ের জন্মদিনের দিন রথ পড়ল। এখন আমার সেই ছাব্বিশ বছর উল্টে গিয়ে বাষট্টি।

ইতিমধ্যে অবশ্য এক বিরাট পর্ব গেছে নাতির রথ সাজানো। জগন্নাথ বলরামকে বাদ করে, নানারকম কার্টুন, গোরিলা, সিংহসমেত ‘চিড়িখানা’ করে রথ সাজাতে হবে। মেয়েও তার ছেলের ফরমায়েশে এবং কান্না জোড়ার ভয়ে ব্যাটম্যান রথ,  ‘গোলালা’ (গোরিলা) রথ, অ্যাভেঞ্জার রথ– বছরের পর বছর কত কী না সাজিয়ে দিয়েছে। গুটগুটে পায়ে সে সব টানতে টানতে সেই নাতিও এখন এক মান্য বীর। এবার গম্ভীর হয়ে জানিয়েছে যে, সে এখন কার্টুন এডিটিং নিয়ে খুবই ব্যস্ত; ফলে রথ টানায় ইন্টারেস্টেড নয়। মুম্বাইতে আস্তানা গেড়ে, রথের দিন মেয়ের সে কী মনখারাপ! কারণ, ওখানে কেউ রথ টানে না; মানে বাঙালি বাচ্চারাও নয়।

লকডাউনের ফলে মেয়ে নাতি এখন দু’জনেই কলকাতায় থাকলেও রথ টানাটানির কোনও গপ্পো নেই। কারণ, তারা দু’জনেই বড় হয়ে গেছে। আমি তাই এক নতুন তাল তুলেছি। রথের মেলা উপলক্ষে, অন্তরার সমস্ত আবাসিকদের জন্য এদিন জিলিপি আর জাম্বো সাইজের ভাঁজ করা পাঁপড়ের ব্যবস্থা করতে। অন্তরার কাছেই বেনের চাঁদ বলে এক জায়গায় জগন্নাথ মন্দিরের সামনে স্নানযাত্রার যে বড় মেলা বসে, সেই মেলাই আবার রথের দিনও বসে। ওখানে এখনও আমার চেনা সেই ‘গ্রামুরে’ ভাবটা বর্ষার জলপড়া দেওয়ালের গায়ে কাঁচা সবুজ শ্যাওলার মতো লেগে আছে। ফলে, আমার আবদারে সানন্দে সায় দিয়েছেন অন্তরা কর্তৃপক্ষও। রথের চাকা গড়ানোর আওয়াজ আর ভেঁপুর পোঁ প্যাঁ শব্দে– মনের আনন্দে তাল ঠুকছি আমি। 

এবছর এই রথযাত্রার  দিনটা আমাকে যেন তাই এক নতুন দিশায় যাত্রা করিয়ে দিল। 

জয় জগন্নাথ।

Author Mondar Mukherjee

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Picture of মন্দার মুখোপাধ্যায়

মন্দার মুখোপাধ্যায়

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে। লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।
Picture of মন্দার মুখোপাধ্যায়

মন্দার মুখোপাধ্যায়

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে। লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস