আগের পর্বের লিংক: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭]
ফরিদপুরের চৌকিদার ভিটেজমি ছেড়ে পালিয়ে ইন্ডিয়ায় এসে হয়ে গেল জমিদার৷ সাড়ে ছ-ফুটের ওপর লম্বা, চামড়া-মোড়া হাড়ের চওড়া কাঠামো, চোখ দুটো গর্তের বেশ ভেতরে, তার ওপর ট্যারা, কোঁকড়া চুল কাঁচাপাকা, কপাল উঠেছে মধ্যতালু পর্যন্ত, মোটা ঠোঁট, দাঁত পড়ে গাল তুবড়ে গেছে৷ অদ্ভুত তাঁর ধুতি পরা, হাঁটুর নীচে রগ-কিলবিলে পা বেরিয়ে থাকে৷ গরমকালে গায়ে ফতুয়া, শীতে রেলকোম্পানির নীল কোট৷ খুব ছোটো তখন, তাঁকে দেখেছি মাথায় সবজির ঝুড়ি নিয়ে এপাড়া ওপাড়া হাঁটতে৷ কুমড়া নাগেএএ… নাউ নাগেএএ… ভারালি নাগে… হিনচা নিবেন… কলমি নিবেন, মোচা আছেএএএ… উইস্তা (উচ্ছে) আছেএএএ… শীতের দুপুরে কুল আনতেন, গরমে তালশাঁস৷ একবার ডালা থেকে কুল সরাতে গিয়ে ধরা পড়ে বিমল৷ ট্যারা চোখের পাহারা বুঝতে পারেনি৷ এই জমিদার নাকি ডাকাত-ধরা বিরাট চৌকিদার ছিলেন৷ বলতেন, কুনওদিন ভাবি নাই সবজি কান্ধত্ নইয়া ফেরি করন লাগব৷ দশ-বিশটা ডাকাইত ধরছি নিজের হাতে৷ বড়ো বড়ো ডাকাইত সব৷ ভবা চৌকিদারের নামে কাঁপত৷ আমি যে থানায় থাকতাম, সেই অঞ্চলে ডাকাতি কইরা পার পায় নাই একটাও৷ নিজেও বিপদে পড়সি কয়েকবার৷ মঘা ডাকাত একবার শাবল তুইলা মুখে মারল৷ তিনটা দাঁত ভাঙল৷ সেই থেইক্যা একটা-একটা কইরা সবই গেল৷ মাংস চুইষা খাই৷ দাঁত গেল। চৌকিদারি গেল। দেশ গেল, ঘর গেল। অহন ভবারে লইয়া লোকে রঙ্গতামাসা করে৷
এই জমিদার ওরফে ভবা চৌকিদারের বসবাস ছিল আমাদের বস্তির উলটোদিকে শিবমন্দিরে৷ বেশ খানিকটা খালি জমি৷ বিঘে বা কাঠা-ছটাকে মাপ বলতে পারব না৷ এইভাবে বলা যায়, ছোটোদের পক্ষে জায়গাটা ছোটাছুটির মাঠ৷ এর পরেও শীতের দুপুরে বস্তিঘরের কাঁথা-বালিশ-চট-চাটাই গরম করবার ঢালাও মন্দিরতলা৷ সেইখানে শিবমন্দির৷ মন্দির বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু নয়৷ লম্বাটে ঘর, টিনের তৈরি, জানালাহীন, একটা দরজা, সেটাও টিনের, ঘরের একপ্রান্তে শিবের মূর্তি৷ বছরে মাত্র একদিন পুজো হত৷ শিবরাত্রিতে দরজার বাইরে একটা আলো ঝুলত৷ পাড়ার দশ-বিশজন মেয়ে মহিলা ফুলের সাজি আর ঘটি নিয়ে আসত৷ একটু বড় হয়ে দেখেছি মন্দিরের দরজা প্রায় সবসময় বন্ধ৷ তখন জমিদার আর সবজি বা কুল-তালশাঁস আনেন না৷ তিনি কোথায় যান, কী করেন, আমরা জানি না৷ নির্ভয়ে মাঠে খেলি৷ অতিসাইরা, খাচ্চর, শয়তানের বাচ্চা ইত্যাদি গাল পাড়তে পাড়তে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে না৷
জমিদারের বউ ছিল। দুটো ছেলে ছিল, কানাই ও বলাই, আমাদের চেয়ে বড়৷ তারা ভেতরের দিকে একটা বস্তিতে আলাদা থাকত৷ জমিদারের বউ তাঁর স্বামীর মতোই লম্বা এবং চওড়া হাড্ডির মানবী৷ লোকে বলত ‘মা মনসা’৷ কারণ তিনি যখনই আসতেন ঝগড়া হত৷ জমিদার হয়তো তখন শিবমন্দিরে স্টোভে রান্না করছেন৷ জমিদার-গিন্নি এলেন৷ শুরু করলেন, নরকের পুকটা (পোকা) কই? হারামিটা কই? রানতে(রাঁধতে) বইছে৷ রাইকখসটা নিজে রসাইয়া খায়৷ বউ-বাচ্চাগো কথা ভাবেও না৷ ঠাকুরে এইটারে নেয় না কেন! কুনদিন আমার ঘরে ঢুকলে টের পাবি৷ হাত-পা ভাইঙা গলিতে ফালাইয়া রাখুম— ইত্যাদি৷ ইস্ট ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্টে, মহিম মুদির দোকানে, নাথুমুদির দোকানে, পরিতোষদের কাঁচা আনাজের দোকানে উপস্থিত প্রাকৃতজন শিবমন্দিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে স্থির হয়৷ ভদ্রজন অন্যদিকে মুখ রাখে, কান রাখে গালাগালের দিকে৷ এবার জমবে খেলা৷ বেরিয়ে আসে জমিদার৷ দু তরফ থেকেই কুৎসিত কদর্য ভাষা ওড়ে৷ মাগনার আমোদে নিজেদের বেঁচে থাকাটা একটু রঙিন করে নেয় গণতান্ত্রিক নিরীহজন৷ হিরণদি দরজা বন্ধ করে৷ অরুণদি দরজা বন্ধ করে৷ হাসিকাকিমা বা রত্নাপিসিমা আমাকে ঘরে টেনে নিয়ে যায়৷ ছোটদের খেলা মাঝপথে ভাঙে৷ জমিদার আর জমিদার-গিন্নি মুখোমুখি৷ খিস্তাখিস্তির রণক্ষেত্র৷ আমি দেখেছি, নাচের ছন্দে দুজনে এক পা-এক পা করে দুজনের দিকে এগিয়ে আসে গাল পাড়তে পাড়তে৷ এক হাত ফাঁক রেখে দুজনে বুক চিতিয়ে শরীর টান করে, এ ওকে পরাস্ত করতে চায় গলার জোরে ও গালের জোরে৷ আবার এক পা এক পা করে পিছিয়ে যায়৷ আবার… কেউ কাউকে মারে না৷ জমিদার আর জমিদার-গিন্নির এই ঝগড়ার দৃশ্য মাঝেমাঝেই অনুষ্ঠিত হত৷ একদিন পিনাকীদা ঝগড়ার মধ্যে বাজিয়েছিল মাউথঅর্গান৷ সম্ভবত ‘বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহিঁ’-র সুরে৷ ওরা যত চেঁচায়, পিনাকীদা দুলে দুলে নাচে আর বাজায়৷ ঝগড়া থামিয়ে সেদিন ওরা পিনাকীদার কাণ্ডে হেসে ফেলেছিল৷

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
ছবি সৌজন্য: লেখক, Vectorstock,মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন্যাস। বই আখ্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।
