খুশকি সারানোর শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে খবরের কাগজ পত্রপত্রিকা টিভি ছয়লাপ। কিন্তু শ্যাম্পু করলেও খুশকি কেবল ফিরে আসে। চিরকালের মতো খুশকি সারানো কি সম্ভব? কী কী কারণে খুশকি হয়?
বাচ্চাদের খুশকির রকমসকম আলাদা, পরে বলব সে-কথা। বড়দের খুশকি নিয়ে কথা বলি। আমরা বড়দের খুশকিকে দুটো ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারি। প্রথম জাতের খুশকির পেছনে তেমন কোনো রোগ নেই, বা রোগীর শরীরে কোনও চর্মরোগ নেই যা থেকে খুশকি হতে পারে। আর দ্বিতীয় ভাগের খুশকি হলো অন্য কোনও একটা রোগের বহিঃপ্রকাশ।
অন্য রোগ ছাড়া খুশকি
বড়দের খুশকি সাধারণত আরম্ভ হয় বয়ঃসন্ধির সময়। বারো-তেরো বছর বয়স থেকে মাথায় একটা তেলতেলে ভাব আসতে পারে এবং খুশকি দেখা যায়। সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো খুশকি মাথা থেকে ঝরে পড়ে, মাথা চুলকায়, চুলও ওঠে। একধরনের তেলতেলে খুশকি আছে যাতে মাথা থেকে চাকলার মতো চামড়া ওঠে। এই খুশকির সঙ্গে আর কোন চর্মরোগ থাকে না, কিন্তু মাথার চামড়ায় একধরনের ছত্রাক পাওয়া যায়। ডাক্তারদের মতে এই খুশকি আসলে সেবোরিক ডার্মাটাইটিসের একটা মৃদু আক্রমণ। কম খুশকিতে সাধারন শ্যাম্পুতেই ভালো কাজ হয়, বিভিন্ন অ্যান্টিফাঙ্গাল দেওয়া শ্যাম্পু আরও বেশি কার্যকর হতে পারে।
অন্য ত্বকরোগ থেকে খুশকি
সবথেকে কমন হলো সেবোরিক ডার্মাটাইটিস। এখনি বলেছি যে সাধারণ খুশকিকে ডাক্তাররা মৃদু সেবোরিক ডার্মাটাইটিস জনিত খুশকি বলেন। এই ত্বকরোগ সাধারণত তেমন ক্ষতি করে না। মাথাতে ছাড়া অন্যত্র এই রোগ দেখা যেতে পারে, নাও পারে। তবে মুখে একটু-আধটু সেবোরিক ডার্মাটাইটিস অনেকেরই হয়—বয়সন্ধির পরে অনেকেরই মুখের ওপর জায়গায় জায়গায় হালকা সাদা ছোপ পড়ে, আর সেই ছোপের জায়গা থেকে একটু পাতলা আঁশ ওঠে। সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বাড়াবাড়ি হলে তখন ত্বক লাল হয় ও চুলকায়, আঁশ ওঠে। এরকম হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখান।
মাথার ত্বকে সোরিয়াসিস হলে বেশিরকম খুশকি হয়, আঁশ ওঠে আর চুলকায়। এক্ষেত্রে কিন্তু নিয়মিত ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ লাগাতে ও খেতে হবে। এছাড়া মাথার মধ্যে কিছু কিছু একজিমার কোনও কোনও পর্যায়ে খুশকির মতো হয়। এসব ক্ষেত্রে মাথা চুলকায়, লাল হয়ে যায়, এবং অল্পবিস্তর আঁশ ওঠে। মুখে বা শরীরের অন্যত্র এই রোগ দেখা যেতে পারে। আমাদের শরীরে দাদ হয় যে ছত্রাক সংক্রমণে, সেই ছত্রাক সংক্রমণ মাথায় হলে কখনো-সখনো তা খুশকির মতো দেখাতে পারে। বাচ্চাদের এটা বেশি হয়। সেখানে ফোলা, ব্যথা, লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হয়। দেহের অন্যত্র ছত্রাক সংক্রমণ পাওয়া যেতে পারে, বাড়ির অন্যদের দাদ দেখা যেতে পারে। একটু বয়স্ক লোকেরা অনেক সময় মাথায় খুশকি আর চুলকানি নিয়ে আসেন। কলপ মাখার ফলে এটা হতে পারে— কলপের এলার্জি থেকে একজিমা, দেখতে খুশকির মতো, তবে চুলকায় বেশি। কলপ ছাড়া অন্য কিছু থেকেও এরকম একজিমা হতে পারে— বিশেষ করে তেল এবং শ্যাম্পুতে গন্ধদ্রব্য থেকে।
লাইকেন প্লেনাস, ইকথিওসিস, সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমেটোসাস, ডিস্কয়েড লুপাস এরিথেম্যাটোসাস—এসবের লক্ষণ হিসেবে মাথায় খুশকির মতো হতে পারে। এছাড়াও কিছু ত্বকরোগের বিরল ধরনে, এমনকি কিছু ক্যানসার-জাতীয় রোগের (টি-সেল লিম্ফোমা) উপসর্গ হিসেবে খুশকি দেখা যেতে পারে। তাই বাড়াবাড়ি ধরনের খুশকি, খুশকির সঙ্গে ত্বকে অন্যত্র রোগ, বা শরীরে অন্য উপসর্গ থাকলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
নবজাতকের খুশকি
বাচ্চা জন্মানোর ঠিক পরে তার মাথায় অল্পবিস্তর খুশকি হয়। কোনও রোগ ছাড়াও এরকম খুশকি হতে পারে। আমাদের ত্বকের উপরের কোষগুলি চামড়ার কোষগুলি দ্রুত বিভাজিত হয়, এবং চামড়ার ওপর থেকে খসে পড়ে, এটা স্বাভাবিক। মাথার ত্বকের মৃত কোষগুলো চুলের জালে আটকে যায়। বাচ্চাদের কোষ দ্রুত বিভাজিত হয়, তার ওপর বাচ্চাদের মাথা পরিষ্কার করা অনেক সময় শক্ত। তাই ঝরা কোষগুলো চুলে আটকে থাকে আর সাদাটে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাথার উপর দেখা যায়—তখন আমরা বলি বাচ্চার মাথায় খুশকি হয়েছে।
কোনও কোনও বাচ্চার অনেক সময় বাড়াবাড়ি রকমের খুশকি হয়, এবং খুশকির আঁশগুলো মাথার সঙ্গে লেগে থাকে। এই ব্যাপারটা তুলনায় কম বাচ্চার হয়। এদের হয়তো সেবোরিক ডার্মাটাইটিস বা অ্যাটোপিক ডার্মাটাইটিস আছে। বেশি খুশকি হলে তাই বাচ্চাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। আবার উকুন থেকেও মাথায় খুশকির মতো গুঁড়ো হতে পারে।
চিকিৎসা
সাধারণ খুশকির প্রাথমিক চিকিৎসা হলো মাথায় তেল না দেওয়া এবং নিয়মিত শ্যাম্পু করা। এতে কাজ না হলে মাথাতে বিশেষ ধরনের শ্যাম্পু দেওয়া যেতে পারে। বিশেষ শ্যাম্পু বলতে স্যালিসাইলিক এসিড, জিংক পাইরিথিয়ন, সেলেনিয়াম সালফাইড, কিটোকোনাজল অথবা কোল টার মিশ্রিত শ্যাম্পু—এসব রাসায়নিকের একটি বা একাধিক শ্যাম্পুতে মেশানো থাকতে পারে। এছাড়া নির্দিষ্ট অসুখে নির্দিষ্ট ওষুধ দিতে হয়। সেটা কিন্তু নিজে নিজে দিলে বিপদ হতে পারে। শ্যাম্পুতে কাজ না হলে বা বেশি খুশকি হলে ডাক্তার দেখানো দরকার। খুশকির সঙ্গে অন্য কোনও চর্মরোগ থাকলে, বা দেহের অন্য কোনও উপসর্গ থাকলেও দেরী না করে ডাক্তার দেখান।
সাধারণ খুশকি চিরকালের মতো সারার কোনও ওষুধ নেই, শ্যাম্পু ইত্যাদি করে নিয়ন্ত্রণে রাখলে একসময় সেরে যায়। আর নানা রোগের সঙ্গী হিসেবে আসে যে খুশকি, রোগ সারালে সে খুশকি সেরে যায়। অবশ্য সব রোগ চট করে সারে না। আবার উকুন থেকে খুশকি হলে রোগ ধরতে পারলেই উকুন সারে, খুশকিও সারে।
তাই শেষ কথা হল, বেশি খুশকি হলে, বা শ্যাম্পু করে না কমলে, ডাক্তার দেখান।
ডক্টর জয়ন্ত দাশের জন্ম ১৯৬২ সালে। বর্তমানে হাওড়া জেলার বাসিন্দা। পেশায় চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ। স্বাস্থা সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। নিয়মিত লেখালিখি করেন একাধিক পত্রপত্রিকায়। 'স্বাস্থ্যের বৃত্তে' পত্রিকার এক্সিকিউটিভ এডিটর পদে রয়েছেন দীর্ঘদিন।
One Response
ভালো লাগলো।