রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ আলিপুরের বেলভিডিয়ার নার্সিং হোমের আইসিইউ থেকে একতলার লবিতে নেমে কুর্চিকে দেখেই দেবদীপের সারা শরীর যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। পা সরছে না, মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না, চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। কুর্চি ছুটে আসতেই দেবদীপ জিজ্ঞেস করল, “এখানে বসে আছিস, আমাকে ফোন করিসনি কেন?”
— আগে বলো, কেমন আছে? এখান থেকে শুধু বলছে মাথায় চোট, আইসিইউ-তে আছে। বলছে, ডাক্তাররা দেখছেন, তাঁরা এখনও কিছু জানাননি। চোখেমুখে গভীর উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইল কুর্চি।
— ঠিকই শুনেছিস। জ্ঞান ফিরেছে, বেশ কিছু ইন্ট্রাভেনাস চালু হয়েছে। তার সঙ্গে এমআরআই, সিটি স্ক্যানের ব্যবস্থা হচ্ছে। ওসব রিপোর্ট দেখেই ডাক্তাররা বুঝবে, কী হয়েছে, কতটা সিরিয়াস। এখন এখানে থেকে আমাদের আর বিশেষ কিছু করার নেই। বলতে বলতে ভুরু কুঁচকে দু’চোখ বন্ধ করে চুপ করে গেল দেবদীপ। এতক্ষণের ঝড় তাকে কতটা বিধ্বস্ত করে গেছে, কুর্চিকে অরিত্রর কথা বলতে বলতেই যেন টের পেল সে।
দেবদীপকে চোখ বন্ধ করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুর্চির উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল। চুপ করে অপেক্ষা করল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর জিজ্ঞেস না করে পারল না, “বাঁচবে?”
— কী বলছিস!! প্রশ্ন শুনে এক ঝটকায় চোখ খুলে দেবদীপ অবাক হয়ে তাকাল কুর্চির দিকে।
— মাঠে ফিরতে পারবে আর?
এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না দেবদীপ। বাচ্চা ছেলের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। রুমাল দিয়ে দু’চোখ ঢেকে ভাঙা গলায় কোনোমতে বলল, “ফেরাতেই হবে।” একটু সময় নিয়ে চোখ থেকে রুমাল সরিয়ে কুর্চির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে জোর আন। অরিত্র লড়ছে, কিন্তু একা লড়ছে না। আমরাও লড়ছি অরির সঙ্গে। আমরা সবাই শক্ত থাকলে ও জিতবে, মাঠেও ফিরবে।” কুর্চি উত্তর না দিয়ে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল। ঠিক তখনই সুমিত্রা এসে সামনে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি দেবদীপ গুহ বিশ্বাস?”
দেবদীপ হ্যাঁ বলতেই ব্যাকুল গলায় সুমিত্রা বললেন, “আমি অরিত্রর মা। ক্লাব থেকে অরিত্রর এক বন্ধু আমাকে দুর্ঘটনার খবর দিয়ে জানাল, ওকে এখানে আনা হয়েছে, আপনিই সব দেখছেন। আমাকে বলুন কী হয়েছে? আমি কি ওর কাছে যেতে পারি?”
দেবদীপ বলল, “আসুন ওইখানটায় বসে সব বলছি আপনাকে। কুর্চি আয়।” ওয়েটিং লাউঞ্জের এক কোণে বসে দেবদীপ আবার পুরোটা বিশদে বলল। যোগ করল, “জ্ঞান ফিরেছে, তবে ইন্টেনসিভ কেয়ারে আছে। মাথায় চোট তো, তাই অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে এখন। আজ ওর কাছে কাউকেই যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে দুশ্চিন্তা করবেন না। অরিত্রর জন্যে মেডিকাল বোর্ড তৈরি হয়েছে। ভরসা রাখুন, ওর চিকিৎসায় কোনো গাফিলতি আমরা হতে দেব না। আর, ম্যাচের মধ্যেই তো চোট পেয়েছে, খরচ-টরচ সব আমাদের।”
— কবে ছাড়বে এখান থেকে? জানতে চাইলেন সুমিত্রা।
— সেটা এখন বলা মুশকিল। চিন্তিত মুখে বলল দেবদীপ। ডাক্তাররা বলছেন, কিছুদিন এখানেই থাকতে হতে পারে। আমি রোজই আসব। তাই আপনাকে রোজ হাসপাতালে আসতে হবে না। ডাক্তাররা যতদিন না ভিজিটর অ্যালাও করে, আমি রোজ আপনাকে সব খবরাখবর দিতে থাকব। তোকেও সব জানাতে থাকব, কুর্চি। চল, এখন বাড়ি চল। বলে উঠে পড়তে চাইল দেবদীপ।
উঠে পড়ার কোনো ইচ্ছেই দেখালেন না সুমিত্রা। কুর্চির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “তুমি কে?”
– আমি অরিত্রর বন্ধু।
কুর্চি শুধু এইটুকু বলেই চুপ করে গেল দেখে দেবদীপ তাড়াতাড়ি যোগ করল, “শান্তিনিকেতনে থাকে, আমার কাছ থেকে পাস নিয়ে খেলা দেখতে এসেছিল। অরিত্রকে চোট পেতে দেখে আর বসে থাকতে পারেনি। ছুটে এসেছে হাসপাতালে।”
— খেলতে খেলতে এত বড় চোট পেয়ে গেল ? কুর্চিকেই জিজ্ঞেস করলেন সুমিত্রা। মুখে কিছু না বলে মাথাটা দু’বার ওপর নিচ করল কুর্চি।
-এখানে আনার পর অরিত্রকে দেখেছ?
আবার মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়েই না বলল কুর্চি। অরিত্রর মার মুখোমুখি হয়ে ওর অস্বস্তি যেন বেড়ে গেছে। বুঝতে পারছে, তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মোটেই সহজ হবে না। আবার এখনই চলে যেতেও ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু দেবদীপ জোর করল। জিজ্ঞেস করল, “গাড়ি আছে? বসন্ত কোথায়?”
— গাড়ি আছে, বসন্তদাকে বলেছি ট্রেন ধরে ফিরে যেতে।
— তাহলে দিদি, আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আপনাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। আর আপনার ফোন নম্বরটা দিন, ফোনে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে আমার। আপনিও যখন ইচ্ছে আমাকে ফোন করবেন। সুমিত্রাকে বলল দেবদীপ। তারপর এগিয়ে গেল ওয়েটিং লাউঞ্জেরই অন্যপ্রান্তে তারই অপেক্ষায় বসে থাকা আরও জনা চার-পাঁচ লোকের দিকে।
সুমিত্রা ভাবলেন, সত্যিই তো তাঁর সঙ্গে কেউ নেই। নার্সিং হোমের নামটা শোনামাত্র একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটে চলে এসেছেন। বুঝতে পারছেন, অনেকক্ষণ এখানে কাটিয়ে দেবদীপ এখন চলে যেতে চাইছে। চিকিৎসার সব দায়-দায়িত্ব যখন সেই হাতে তুলে নিয়েছে, তখন দেবদীপের সঙ্গে গেলে আরও কিছুক্ষণ অরিত্রর খোঁজ-খবর নেওয়ার সুযোগটা তো পাওয়া যাবে। কুর্চি দাঁড়িয়েই ছিল। দেবদীপ ফিরে আসতেই মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে পড়তে বাধ্য হলেন সুমিত্রা। তিন জনে একসঙ্গে নার্সিং হোম থেকে বেরোতেই দেবদীপ সুমিত্রাকে বলল, “আপনি এক মিনিট অপেক্ষা করুন। আমি কুর্চিকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।” কয়েক পা এগোতেই কুর্চিকে জিজ্ঞেস করল, “কখন ফিরছিস শান্তিনিকেতন?”
— জানি না, গোলকিপারকে একবার না দেখে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।
— কবে দেখতে পাবি, সেটা ডাক্তাররাই বলতে পারবে। কিন্তু কাল সকাল ন’টায় একবার রোইং ক্লাবে আয়। কথা আছে। কাউকে বলবি না আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছিস। আর, গাড়ি নিয়ে আসবি না। ট্যাক্সি ধরে আয়।
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা কুর্চিকে আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে দ্রুত ফিরে গেল দেবদীপ, যেখানে সুমিত্রা তার জন্যে অপেক্ষা করছেন। গাড়িতে উঠেই সুমিত্রা জানতে চাইলেন, “সত্যি করে বলুন তো আমাকে, লাইফ রিস্ক আছে?”
— মাথায় আঘাত তো! ডাক্তাররা বলছেন, বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে বলা মুশকিল কোথায় কী চোট পেয়েছে, চিকিৎসায় কতটা সাড়া দিচ্ছে।
— তার মানে যমে মানুষে টানাটানি! এই অবস্থায় ওকে একা হাসপাতালে রেখে আমরা সবাই বেরিয়ে এলাম!
— অরিত্র আমার ভাই। রক্তের নয়, অন্তরের সম্পর্কে। নিশ্চিত না হলে আমিও কি ওকে ছেড়ে আসতে পারতাম? ওকে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ স্যানিটাইজড একটা জায়গায়। আমার আপনার কারুরই সেখানে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, অনেকগুলো যন্ত্র সেখানে ওর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাহারা দিচ্ছে। আর সেই সব যন্ত্রের ওপর নজর রাখছেন হাসপাতালের নার্স-ডাক্তাররা। তাঁরা সবাই জানেন, নজরদারিতে এতটুকু ফাঁক রাখা চলবে না। পেশেন্ট নিজে নামকরা খেলোয়াড়, তার ওপর প্রভাবশালী এক মন্ত্রী এই পেশেন্টের খবর নিতে ফোন করছেন।
— এসবই দরকারি জিনিস। তাতে হয়ত খুব ভালো চিকিৎসা হবে। কিন্তু নিয়তি কি আর বদলায়, ভাই? আপনি আসলে খুব পজিটিভ মানুষ। তাই আলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মায়ের মন তো? কিছুতেই আলো দেখতে পাচ্ছে না, মনে হচ্ছে অন্ধকার গিলে খেতে আসছে।
বলতে বলতে জলের অঝোর ধারা নামল সুমিত্রার দু-চোখ দিয়ে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নিঃশব্দে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলেন তিনি। দেবদীপও আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। মিনিট পাঁচেক এইভাবে কাটার পর মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে সুমিত্রা অস্ফুটে বলে উঠলেন, “রক্ষা করো, করুণা করো, মার্জনা করো।”
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।