বছরের গোড়া থেকেই এক মারণ ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই চলছে। থমকে গেছে জীবনযাত্রা। গৃহবন্দীত্বের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি নিজেদের। কিন্তু এই ভাইরাসের হাত ধরেই যে বছরের সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসবে এমনটা ভাবিনি। গত ১০ই মে আমার প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক হরি বাসুদেবন কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মাত্র পাঁচ দিনের জ্বরে ভুগে চলে গেলেন। বিদায় জানানোর সময়টুকুও আমরা কেউ পেলাম না। তাঁর আকস্মিকভাবে চলে যাওয়া আমার মত অনেক ভক্ত ও অনুরাগীকে গভীরভাবে কষ্ট দিয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণ তীব্র ছিল। তাই স্যর সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরার সুযোগ পেলেন না। লোকচক্ষুর আড়ালে, একা একা চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন আমাদের প্রিয় HSV। তাঁর এই নিঃসঙ্গ শেষ সফরের কথা ভেবে খুব কষ্ট পাই। এরকম ভাবে যাওয়া তো স্যরের প্রাপ্য ছিল না।
বিগত তিন দশক ধরে উনি ছিলেন আমার শিক্ষক, আমার গবেষণার পরামর্শদাতা। ১৯৮৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর স্তরে এবং পরে এমফিল পড়ার সুবাদে স্যরের ক্লাস করার সুযোগ পাই। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ইতিহাস পড়াতেন। রুশ ইতিহাস ছিল ওঁর কোর্সের মূল বিষয়। স্যর যা পড়াতেন আর যেভাবে পড়াতেন তা এককথায় অনবদ্য। পড়ানোর মাধ্যমেই বুঝিয়ে দিতেন হিস্টোরিয়ান’স ক্রাফট মেথডলজির গুরুত্ব। ক্রোনোলজিকাল ন্যারেটিভের পাশাপাশি জোর দিতেন সমকালীন ডিবেটের ওপর এবং নানান বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন ছাত্র ছাত্রীদের। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ওঁর বোর্ড ওয়ার্ক—বক্তৃতার সারাংশ বোর্ডে চক দিয়ে লিখে দিতেন। রুশ ইতিহাসের বর্ণময় অধ্যায়–রোমানভ রাজবংশের বিদেশ নীতি ও কুটনীতি, বলশেভিক বিপ্লব ও জাতীয়তাবাদের প্রকাশ, লেনিন ও স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত অর্থনৈতিক সংস্কার, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউরোপীয় ও এশীয় দ্বৈত চরিত্র, রুশ সাহিত্যসম্ভার—এ সবই মিলেমিশে থাকত ওঁর বক্তৃতায়।
স্যর ম্যাপ দেখিয়ে পড়াতে ভালবাসতেন। টিচারস রুমে সোভিয়েত দেশের একটা বিশাল ম্যাপ টাঙানো থাকত আর ম্যাপের সামনে থাকত একটা ইজি চেয়ার। ওই চেয়ারে বসেই স্যর পরীক্ষার খাতা দেখতেন, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পড়ার বিষয়ে আলোচনা করতেন। এই ছবি কখনও পাল্টাতে দেখিনি। হাজরা রোডের পুরনো ক্যাম্পাস ও আলিপুরের নতুন ক্যাম্পাসের ইতিহাস বিভাগ হয়ে উঠেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র। আর HSV ছিলেন সেই বিভাগের এক উজ্জ্বল তারকা।
রুশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্যরের সুনাম ছিল। সোভিয়েত দেশের নতুন সংস্কারনীতি, গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত বিশ্লেষণ ছিল চিত্তাকর্ষক। কেবলমাত্র আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বুদ্ধিজীবিদের চিন্তার জগত কীভাবে পাল্টে যেতে শুরু করে রাশিয়ায়, সেইসব স্যর সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতেন। ডিসারটেশন লেখবার সময় রাশিয়ার পরিবর্তনশীল সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে এবং পোস্ট সোভিয়েত স্টাডিজ-এর স্বাদ পেতে শুরু করলাম। সেই সময় ট্রানজিশন পিরিয়ড-এর নানা মনীষীর আত্মজীবনী পড়বার জন্য স্যর আমাকে উৎসাহ দিতে লাগলেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সোভিয়েত ও পোস্ট সোভিয়েত আমলের সংস্কার ও গণআন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন লেখা পড়তেও উৎসাহ দিলেন সেই স্যরই। সেই সঙ্গে ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও বোঝাতেন।
এরপর ধীরে ধীরে সোভিয়েত-উত্তর যুগে কমিউনিটি স্টাডিজ নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলাম। পিএইচডির সময় বুখারার রাজনৈতিক ও সামাজিক চরিত্র দুই শতাব্দী ধরে কীভাবে পাল্টাতে থাকে তা নিয়ে গবেষণা চলল পাঁচ বছর। স্যর শিখিয়েছিলেন শুধুমাত্র ঘটনার বিন্যাস নয়, মানুষের ইতিহাসকেও ব্যক্ত করতে হবে। শুধু রাজা ও রাজত্বর কাহিনী নয়, তুলে ধরতে হবে পিপলস হিস্টরি। এত দায়িত্বভার সামলেও, স্যর ছাত্রছাত্রীদের, গবেষকদের কাজের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর নজর রাখতেন।
২০০৭-২০১১ – এই পাঁচ বছর তিনি মৌলানা আজাদ ইন্সিটিউট এ আধিকারিক পদের দায়িত্বভার সামলেছেন। তখন আমি সেখানে সিনিয়র রিসার্চার হিসেবে কাজ করছি। আমার গবেষণার বিযয় ছিল মধ্য এশিয়া। আমার সহকর্মীরা বিভিন্ন এশীয় রাষ্ট্র নিয়ে গবেষণারত। ইসলামীয় ও বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলির অভ্যন্তরীণ ডাইনামিজম, তাদের পরস্পরের কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে গবেষণার কাজকে উৎসাহ দিতেন স্যর। ওঁর পরিচালনায় আমাদের প্রতিষ্ঠান এরিয়া স্টাডিস এর একটি গ্লোবাল রিসার্চ ইন্সিটিউট হিসেবে পরিচয় লাভ করেছিল। হরি বাসুদেবনকে শুধুমাত্র একজন ঐতিহাসিক এবং রুশ বিশেষজ্ঞ বললে খুব কম বলা হবে। আর্কাইভ এবং একজিবিশন ছিল ওঁর প্যাশন। উনি বিশ্বাস করতেন এই দুইয়ের সাহায্যে ইতিহাসকে জীবন্ত করে তোলা যায়। কর্মসূত্রে স্যর এর সঙ্গে ডেলিগেশন ভিজিটে গেছি মস্কো ও উলান উডে তে। সেখানে ওঁর আলাপচারিতা দেখে চিনেছিলাম একজন ভবিষ্যৎদ্রষ্টাকে যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি। স্যর বরাবর চেয়েছেন ওঁর প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা হোক নতুন দিশার দিশারী এবং সেখানকার কর্মকাণ্ড পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আকর্ষণ করুক এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে গড়ে উঠুক আদান প্রদানের পরিবেশ।
HSV-এর মতো বহুমুখী প্রতিভার বিচার করার দুঃসাহস আমার নেই। ইতিহাসবিদ, গবেষক, শিক্ষক এই সমস্ত পরিচয়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল ওঁর মনুষ্যত্ব বোধ। অসহায় বা নিঃসঙ্গ ব্যক্তির পাশে নিঃসঙ্কোচে গিয়ে দাঁড়াতেন। নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বা গবেষণা কেন্দ্রের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে দেখতে চাইতেন। অথচ একজন দক্ষ পরিচালকের মতোই তিনি ছিলেন পক্ষপাতের উর্দ্ধে । সাদা ও কালো—এই দুই মেরুর জটিলতা ওঁকে কখনও বিচলিত করেনি। অকপট ও অকৃত্তিম স্বভাবের এই মানুষটি আমাদের সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। আমার পরম সৌভাগ্য ওঁকে আমার জীবনে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পেয়েছি।
আজ আমার মন ভারাক্রান্ত। প্রতিনিয়ত স্যরকে হারানোর কষ্ট অনুভব করি। ইউরেশিয়া এবং রাশিয়া নিয়ে গভীর ও তাত্ত্বিক আলোচনা এই কলকাতা শহরে কি আর হবে?
সুচন্দনা চট্টোপাধ্যায় পেশায় ইতিহাসবিদ ও গবেষক। 'রিকনসিডারিং ইনার এশিয়া', 'সোসাইটি এন্ড পলিটিকস ইন তাজিকিস্তান ইন দ্য আফটারমাথ অফ দ্য সিভিল ওয়ার', 'দ্য স্টেপ ইন হিসটরি' ওঁর লেখা কিছু উল্লেখযোগ্য বই।